দেশের জনপ্রিয় ও অগণিত পাঠকের প্রিয় নয়া দিগন্ত প্রতিষ্ঠাবার্ষিকী পালন করতে চলেছে এক অস্বস্তিকর পরিবেশে। পত্রিকার সাথে যুক্ত সবাই মিলে দেশের আতঙ্কজনক পরিবেশেই পালন করবেন পত্রিকার প্রতিষ্ঠাবার্ষিকী। অস্বস্তি ও আতঙ্কের কারণ অদৃশ্য অথচ ভয়ানক এক ভাইরাস। যার নাম ‘করোনা’। এই মহাশক্তির করোনা সমগ্র বিশ্বের মানুষকেই ভয়ঙ্কর পরিবেশে মহাআতঙ্কে বসবাস করতে বাধ্য করেছে। বিশ্বের বহু দেশ নানা ধরনের মারণাস্ত্র বানিয়ে শক্তিধর রাষ্ট্রে পরিণত হয়েছে। এই শক্তিধর রাষ্ট্রগুলো মারণাস্ত্রের ভয় দেখিয়ে শান্তিপ্রিয় দেশগুলোকে সব সময় আতঙ্কে রেখেছিল। শক্তির দাপটে শক্তিধর রাষ্ট্রগুলো মোড়লিপনা করে আসছিল। কিন্তু হঠাৎ করোনার আগমনে তাদের মোড়লিপনা ও শক্তির দম্ভ খর্ব হয়েছে। অদৃশ্যমান ক্ষুদ্র একটি ভাইরাসের কাছে তাদের মারণাস্ত্র তুচ্ছ প্রমাণিত হয়েছে। তাদের গর্বকে খর্ব করে দিয়েছে এই ভয়ঙ্কর ভাইরাস। সর্বত্র করোনায় আক্রান্ত আর মৃত্যুর বিভীষিকাময় চিত্র। সর্বত্র আতঙ্ক, আতঙ্ক, আর আতঙ্ক। এই আতঙ্কের মধ্যে মানুষ কিভাবে বাঁচবে তারও চেষ্টা করে চলেছে। নতুন এ ভাইরাসের কোনো নির্দিষ্ট ওষুধ না থাকায় মানুষ নানা ধরনের ওষুধ সেবন করছে। বিভিন্ন দেশ বিভিন্ন ধরনের ওষুধকে এ রোগ নিয়ন্ত্রণে ব্যবহার করছে। সবই করছে অনুমানের ওপর নির্ভর করে। ফলে অনেক ক্ষেত্রেই উপকারের চেয়ে অপকারের সম্ভাবনার কথাও বলা হচ্ছে। আমাদের পাশের দেশ ভারত। ভারতের অবস্থা গুরুতর। ফলে ভারত সরকারের পক্ষ থেকেও করোনার ওষুধ বা চিকিৎসার পদ্ধতি কী হবে সে কথা বলে দেয়া হয়েছে। বাংলাদেশ প্রতিদিন (১৩/২/২০২০) খোলা কলামে লিখেছেÑ ‘করোনা ভাইরাস ঠেকানোর উপায় বলে দিলো ভারত সরকার।’ কিন্তু এই বাতলে দেয়া বা বলে দেয়া ওষুধে কোনো কাজ হয়েছে বলে মনে হয়নি। কারণ বিগত ৯ মাসে ভাইরাসটির প্রতাপ কমেছে বলে শোনা যায়নি। বরং দিন দিন যে প্রতাপ বেড়েই চলেছে সে খবর প্রায়ই শোনা যাচ্ছে। ভারত সরকারের বলে দেয়া উপায় যে কোনো কাজ হবে না সে কথা বাংলাদেশের নির্বাসিত লেখিকা ও ডাক্তার তসলিমা নাসরিন ক্ষোভের সাথেই বলেছিলেন। উল্লিখিত ভারত সরকারের বক্তব্যের পরিপ্রেক্ষিতে ডা: তসলিমা বলেছেনÑ ‘ভারতে আয়ুষ মন্ত্রণালয় নামে একটি মন্ত্রণালয় আছে। এটি আয়ুর্বেদ, ইউনানি, হোমিওপ্যাথি, যোগ ব্যায়াম ইত্যাদির মন্ত্রণালয়। এ রকম মন্ত্রণালয় যে কোনো সভ্য দেশে থাকতে পারে তা আমার জানা ছিল না।’ ভারত সরকারের বলে দেয়া চিকিৎসা পদ্ধতিকে তসলিমা নাসরিন উড়িয়ে দিয়ে বলেছেনÑ এগুলো অবিজ্ঞান বা অপবিজ্ঞান। একজন চিকিৎসক হিসেবে বলছি, এটি গ্রহণযোগ্য নয় (বাংলাদেশ প্রতিদিন, ১৩/২/২০২০)। শুধু ভারত নয়, বিশ্বের মহাশক্তিধর রাষ্ট্র আমেরিকাতেও ঘটছে একই ঘটনা। সে দেশেও মৃত্যু হার অনেক বেশি!
চীন দেশের হুবেই প্রদেশের উহান শহর থেকে বিশ্বময় ছড়িয়ে পড়া এই করোনা ভাইরাস এখন পর্যন্ত মহা দাপটে মানুষের মধ্যে আতঙ্ক ছড়িয়ে যাচ্ছে। মানুষ আক্রান্ত হচ্ছে, সুস্থ হচ্ছে এবং মারাও যাচ্ছে। ফলে করোনার এই আগ্রাসন থেকে বাঁচতে বিভিন্ন দেশে বিভিন্ন ধরনের ব্যবস্থা গ্রহণ করা হচ্ছে। আর এর ফলে সব দেশের স্বাভাবিক কার্যক্রম প্রায় বন্ধই হয়ে গেছে। এমন এক দুর্যোগের মধ্যে বাঁচা ও বাঁচানোর জন্য মানুষ কিছু কিছু কাজ সতর্কতার সাথে পালন করতে শুরু করেছে। বাংলাদেশেও একই অবস্থা। প্রথম দিকে প্রায় সর্বই অচল হয়ে পড়েছিল। মানুষের এই দুর্যোগময় মুহূর্তে এক শ্রেণীর অসৎ মানুষ মানুষকে জিম্মি করে অর্থ কামানোর কাজে লিপ্ত হয়ে পড়েছিল। হাসপাতাল থেকে শুরু করে সর্বত্র লুণ্ঠনের রাজত্ব কায়েম করা হয়েছিল। পত্র-পত্রিকা ও অন্যান্য প্রচারমাধ্যমের কারণে এসব বিষয় স্পষ্ট হওয়ায় সরকার কিছু কিছু পদক্ষেপ নিতে শুরু করেছে। ফলে অপকর্মের সাথে যুক্ত অনেকের বিরুদ্ধেই ব্যবস্থা গ্রহণ করা হচ্ছে। একেতো করোনাভাইরাস ও করোনার চিকিৎসাজনিত অব্যবস্থাপনা, তার ওপর যুক্ত হয়েছে হত্যা, গুম, লুণ্ঠন, লুণ্ঠনকৃত অর্থসম্পদ বিদেশে পাচার ও ধর্ষণের মহামারী। ধর্ষণের মহামারী এমন এক পর্যায়ে পৌঁছেছে যে, প্রচারমাধ্যমে এবং আন্দোলনের কারণে সরকার ধর্ষণের শাস্তি মৃত্যুদণ্ডের বিধান প্রবর্তন করতে বাধ্য হয়েছে। কিন্তু তাতেও অনেকেই আশ্বস্ত হতে পারছে না। কারণ বিচারের দীর্ঘ সূত্রতা, পুলিশের রিপোর্ট তৈরিতে কারসাজি এবং রাষ্ট্রপতির ক্ষমা করে দেয়ার বিষয়গুলো নিয়ে আন্দোলনকারীরা ও অভিজ্ঞজনেরা আলোচনা করছে। যেমন বিএনপির স্থায়ী কমিটির সদস্য নজরুল ইসলাম খান বলেছেনÑ ‘ধর্ষণের মতো অপরাধের কঠিন সাজা হওয়া উচিত। কিন্তু ধর্ষক যখন ক্ষমতাসীন দলের সাথে যুক্ত থাকে তখন এই আইনের প্রয়োগ কতটুকু হবে তা চিন্তার বিষয়। এ ধরনের জঘন্য অপকর্মের সাথে যখন সরকারি দলের লোকজন সংযুক্ত থাকে তখন আইন যত কাড়াকড়ি হোক না কেন তার বাস্তবায়ন নিয়ে দুশ্চিন্তা জনগণের মধ্যে থেকেই যায়। টকশোগুলোতেও এ ধরনের আলোচনাই প্রাধান্য পেয়ে থাকে (নয়া দিগন্ত, ১৩/১০/২০২০)। দেশের সার্বিক পরিস্থিতির নারী ও শিশু নির্যাতন এবং ধর্ষণ ও গণধর্ষণের ঘটনাসহ অন্যান্য কারণে দেশে কতটা অবনতি ঘটেছে কয়েকটি দৃষ্টান্ত দিলে স্পষ্ট হবে।
১. নোয়াখালীতে নারী বিবস্ত্রকারীর অনুসারীদের হামলার শিকার সাংবাদিক, ক্যামেরা ছিনতাই, গাড়ি ভাঙচুর।
২. বিএফইউজে ডিইউজের বিবৃতি, সাংবাদিক ইলিয়াসের খুনিদের দ্রুত কঠোর শাস্ত দিতে হবে।
৩. বুয়েট শিক্ষার্থী আবরার হত্যা মামলায় সাক্ষ্য দিলেন ম্যাজিস্ট্রেট।
৪. নারায়ণগঞ্জে সাংবাদিক হত্যা, আরো দুই আসমি গ্রেফতার, আ’লীগ নেতার বাড়িঘর ভাঙচুর।
৫. সিলেটে নির্যাতনে যুবকের মৃত্যু, ফাঁড়ির ইনচার্জসহ চার পুলিশ সদস্য বরখাস্ত, প্রত্যাহার তিন।
৬. বেড়ার ইউএনওকে লাঞ্ছিত করলেন পৌরমেয়র।
৭. শাহবাগে ধর্ষণবিরোধী গণ-অবস্থান, গান ও কবিতায় প্রতিবাদ।
এসব শিরোনাম ১৩ অক্টোবর ২০২০ নয়া দিগন্ত পত্রিকার। প্রবন্ধ লিখতে লিখতেই ১৬/১০/২০ তারিখের নয়া দিগন্ত হাতে এলো। পত্রিকার সর্বত্রই আইনশৃঙ্খলা ও সার্বিক পরিস্থিতির অবনতির খবর রয়েছে। এসব খবরের মধ্যে কয়েকটি ধর্ষণবিষয়ক খবরের শিরোনাম তুলে ধরলাম। এর একটি আশার। বাকি সব হতাশার।
১. টাঙ্গাইলে ধর্ষণ মামলায় পাঁচজনের মৃত্যুদণ্ড।
২. না’গঞ্জে মাদরাসাছাত্রীকে ধর্ষণের পর হত্যা : বিধবাকে গণধর্ষণ।
৩. গাজীপুরে পার্লার ব্যবসায়ী, ব্রাহ্মণবাড়িয়ায় স্কুলছাত্রী, বরিশালে কলেজছাত্রী, যশোরে গৃহবধূ ধর্ষিত।
৪. চরফ্যাসনে মুদি ব্যবসায়ীর বিরুদ্ধে ধর্ষণের অভিযোগে মামলা।
৫. নারীদের প্রতিবাদী সাইকেল র্যালি, শাহবাগ থেকে নোয়াখালী লংমার্চ।
লংমার্চের উদ্দেশ্য ‘ধর্ষণ ও বিচারহীনতা’র বিরুদ্ধে প্রতিবাদ ও জনসচেতনতা সৃষ্টি।
করেনাভীতি, ধর্ষণভীতি এবং পুলিশের হত্যাকাণ্ড ও মাদকপ্রীতি দেশকে অন্ধকারের দুঃসহ জীবনে পৌঁছে দিয়েছে। দেশকে, দেশের মানুষকে স্বাভাবিক জীবন থেকে বিচ্ছিন্ন করে ফেলেছে। ফলে মানুষ যেমন স্বাভাবিক কর্মকাণ্ড থেকে সরে গিয়ে প্রায় বন্দী জীবনকে বেছে নিয়েছে তেমনি স্বাভাবিক চিন্তাভাবনা থেকেও দূরে সরে গেছে। কোনো কিছুতেই নেই কোনো আলোর প্রতিফলন। সর্বত্রই অন্ধকার। মানুষের চিন্তাচেতনা ও বক্তব্যেও এর প্রতিফলন লক্ষ করা যাচ্ছে। ১৬ অক্টোবর সকালে ফেসবুক খুলতেই দৃষ্টি কাড়ল শিল্পী অনুপম হুদার একটি অপূর্ব সুন্দর শিল্পকর্ম। বিন্দু বিন্দু ডট ও নকশার সাদাটে হালকা জমিনে লাল, নীল, হলুদের কৌশলী উপস্থাপনা চিত্রকে আকর্ষণীয় করেছে। এই চিত্রটি সম্পর্কে অনেকে নানা ধরনের মন্তব্য করেছেন। পর্শীয়া পারভীন লিখেছেনÑ এই ছবির মধ্য দিয়ে কী বোঝাতে চেয়েছেন শিল্পী। আমার খুব জানতে ইচ্ছে করছে। আমি ছবি বুঝতে পারি না। তবে দেখে মনে হয় কিছু একটা ব্যাপার আছে। শিল্পীর কাছে একটু জানতে চাইছি প্লিজ। লক্ষ করলাম শিল্পী অনুপম হুদা দর্শক পর্শীয়া পারভীনের প্রশ্নের কোনো উত্তর না দিলেও আর একজন দর্শক উত্তর দিয়েছেন। তার নাম আবু সাঈদ। তিনি লিখেছেনÑ এইভাবে ব্যাখ্যা করা যায়, হলুদ সাংবাদিকতা। চিত্রে হলুদের প্রভাব বাংলার (সম্ভাবত বাংলাদেশের বলতে চেয়েছেন) পতাকার লাল-সবুজ যাই যাই অবস্থা, যদিও বিশাল সংখ্যাই অসহায় সাদা মানুষ আছে (পূর্বে উল্লিখিত চিত্রের সাদাটে জমিনের সাথে সাদা মানুষকে তুলনা করেছেন হয়তো) তাদেরকেও ষড়যন্ত্রের নীল গ্রাস করে যাচ্ছে।
তবে আশা আলো কৃষ্ণগহ্বর, নীল ষড়যন্ত্র আর দালাল হলুদ (তিনি চিত্রের হলুদ রঙকে দালাল হিসেবে চিহ্নিত করেছেন) সাংবাদিকাতর সর্বশেষ গন্তব্য।
প্রকৃত অর্থে শিল্পকলা বিষয়ে ভাবনার কোনো শেষ নেই। যেকোনো দর্শক যেকোনোভাবে চিত্রের ব্যাখ্যা করতে পারে। দর্শক আবু সাঈদ ও সেভাবেই তার নিজের মতো করে ব্যাখ্যা করেছেন। তবে তার ব্যাখ্যা পড়ে তিনি যে একটি টিভির প্রতি ক্ষুব্ধ সেটাই প্রমাণিত হয়েছে।
বেশ কিছু দিন যাবৎই লক্ষ করা যাচ্ছে একটি টিভির দু’জন উপস্থাপিকার বিরুদ্ধে সমালোচনা। অভিযোগ ধর্মীয় অনুভূতিতে আঘাত দিয়েছেন তারা। কিন্তু অভিযুক্তদের পক্ষ থেকে এ বিষয়েও কোনো বক্তব্য লক্ষ করা যায়নি। অভিযোগ যদি সত্য হয়, তাহলে প্রশ্ন হচ্ছেÑ তারা কাকে খুশি করার জন্য এরূপ মন্তব্য করেছেন? বিগত কয়েক বছর যাবৎ অবশ্য খুশি করার প্রতিযোগিতা চলছে। সব শ্রেণীর মানুষ যার যার পেশার মাধ্যমে কাউকে খুশি করতে মহাব্যস্ত হয়ে পড়েছেন। করোনার ভীতি ও তাদের থামাতে পারছেন না। ফলে অনেককেই বলতে শোনা যায়Ñ এখন দেশের সবাই একদল। এখন পিয়ন, দারোয়ান, ড্রাইভাররা কোটি কোটি টাকার মালিক বনে গেছে! সুতরাং আঙুল ফুলে কলাগাছ হওয়ার এমন সুযোগ ছাড়ে কে। আঙুল ফুলে কলাগাছ হওয়া লুটেরাদের চিত্র যতই প্রকাশিত হচ্ছে মানুষ ততই বিস্মিত হচ্ছে তাদের অর্থসম্পত্তির হিসাব দেখে। টকশো বা অন্যত্র কাউকে এখন ক্ষমতাসীন আওয়ামী লীগের গুণগান গাইতে দেখলেই লোকে মনে করে এ আর এক সাহেদ। যাকে রিজেন্ট গ্রুপ ও রিজেন্ট হাসপাতাল লিমিটেডের চেয়ারম্যান হিসেবে জানেন। কোনো মহিলা চাটুকারকে দেখলেই ভাবেন এও আর এক পাপিয়া। দেশের এমনই এক পরিবেশে সব শ্রেণীর মানুষের প্রিয় নয়া দিগন্ত বর্ষপূর্তি পালন করতে যাচ্ছে। নয়া দিগন্ত পাঠকদের প্রত্যাশা, নয়া দিগন্ত নির্ভীকভাবে সত্য উচ্চারণের মাধ্যমে প্রকৃত দেশপ্রেমে সবাইকে উদ্বুদ্ধ করবে। আমি প্রিয় পত্রিকার সার্বিক সাফল্য ও দীর্ঘ জীবন কামনা করি। হ
লেখক : চিত্রশিল্পী, সাবেক পরিচালক,
চারুকলা ইনস্টিটিউট, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়
আরো সংবাদ
-
- ৫ঃ ৪০
- খেলা
-
- ৫ঃ ৪০
- খেলা
-
- ৫ঃ ৪০
- খেলা
-
- ৫ঃ ৪০
- খেলা
-
- ৫ঃ ৪০
- খেলা
-
- ৫ঃ ৪০
- খেলা