২৮ এপ্রিল ২০২৪, ১৫ বৈশাখ ১৪৩১, ১৮ শাওয়াল ১৪৪৫
`

উইটনেসের পদযাত্রা ও আমাদের হান্নান চাচা

উইটনেসের পদযাত্রা ও আমাদের হান্নান চাচা - ফাইল ছবি

আজ কলম চলছে না। বড়ই কষ্টসাধ্য কাজ। হৃদয়ের তীব্র অনুভূতি, বেদনা, বস্তুত কলম বা তুলি কোনোটি দিয়ে পূর্ণরূপে প্রকাশ করা সম্ভব নয়।

মনে পড়ে ১৯৮৬ সালের কথা। অক্টোবর মাসে দুর্যোগ নেমে আসে আমাদের পরিবারে। মাত্র ৪২ বছর বয়সে ইন্তেকাল করেন আমাদের সেজো দুলাভাই প্রফেসর মাহফুজুর রহমান খান (বুয়েটের কম্পিউটার সাইন্স বিভাগের অন্যতম প্রতিষ্ঠাতা ও পরবর্তীতে বিভাগীয় প্রধান), তৃতীয় বোন ফাহিমা খানমের স্বামী। মৃত্যুর এ ধাক্কা পুরো পরিবারকে শোকার্ত করল। এ ঘটনার পর জীবন নিয়ে ভাবতে শুরু করলাম। বিভিন্ন ধর্মীয় বই বেশি বেশি পড়া শুরু করলাম। এরপর থেকে আমার শ্বশুরবাড়ি ৩৮ মিন্টু রোডে (তখন আমার শ্বশুর মরহুম বিচারপতি মোহাম্মাদ আবদুল কুদ্দুস চৌধুরী আইন সচিব ছিলেন) নিয়মিত মাহফিল আয়োজন করা শুরু করলাম। শ্বশুর-শাশুড়ি দু’জনই ধর্মপ্রাণ ছিলেন। তাই বাসার এ আয়োজনে কোনো সমস্যা হলো না। প্রতি সপ্তাহে একদিন করে বিকেলে হতো। বক্তা বা আলেমদের দাওয়াত দিয়ে আনতাম। পুরুষ বক্তা হলে পর্দার আড়ালে বসতেন। মাহফিলে উপস্থিত থাকতেন অন্যান্য বিচারপতির স্ত্রী, কন্যা ও কিছু আত্মীয়স্বজন। এ ব্যাপারে খুব উৎসাহ ছিল স্নেহাস্পদ নাযিফা কামালের (কনিষ্ঠা কন্যা, সাবেক প্রধান বিচারপতি মোস্তফা কামাল, সে সময় আমাদের প্রতিবেশী) সাথে তার বান্ধবী তানজিয়াও ছিল। মাহফিল চলছিল।

১৯৮৮ এর মাঝামাঝি কোনো একদিন পড়ন্ত বিকেলে আমার শ্বশুরের সাথে দেখা করতে ৩৮ মিন্টু রোডের বাসায় আসলেন শাহ্ আব্দুল হান্নান। আমার স্বামী ড. চৌধুরী মাহমুদ হাসান তার সাথে আমার পরিচয় করিয়ে দিলেন। হাসিমুখে কুশল বিনিময় হলো। ১০-১৫ মিনিট কথা বললেন। আমার মাহফিল নিয়েও কথা হলো। তখন ইসলাম সম্পর্কে আমার জ্ঞান ছিল খুব কম। মাথায় অসংখ্য প্রশ্ন থাকত, যেখানেই জ্ঞানী ব্যক্তিকে পেতাম প্রশ্ন করতাম। তবে বেশির ভাগ ক্ষেত্রে সন্তুষ্টি আসত না। এক পর্যায়ে তাকে আর্ট গেস মিউজিক নিয়ে প্রশ্ন করি। তিনি হাসিমুখে উত্তর দিলেন। ড. ইউসুফ আর কারজাভির ‘ইসলামে হালাল ও হারামের বিধান’ বইটি পড়তে বললেন। এটাও বললেন ড. কারজাভি এ যুগের অন্যতম শ্রেষ্ঠ আলেম। বইটি আমি আগে আমার বাবার বাসায় দেখেছি, অল্পবিস্তর পড়েছি। তখন জানতাম না, ড. কারজাভি এত বড় মাপের আলেম। মনে হলো ১০-১৫ মিনিটে অনেক কিছু শিখলাম। আমাদের মাহফিলে বক্তা হিসেবে আসার ইচ্ছা ব্যক্ত করলেন তিনি। কিছু দিনের মধ্যে আমি ব্যবস্থা করলাম। তিনি পর্দার আড়াল থেকে বক্তব্য দিলেন।

মাহফিলের শেষে বললেন, তিনি যোগ্যতাসম্পন্ন নারীদের ইসলামের আলোকে দীক্ষিত করতে চান। ওই সময়ে কিছু প্রভাবশালী নারীবাদী লেখকের ইসলাম বিদ্বেষী বক্তব্য তরুণ প্রজন্মকে প্রভাবিত করছিল। উপরন্তু ইসলামে নারীর সার্বিক মর্যাদা ও অধিকার সম্পর্কে সঠিক তথ্য তেমনভাবে প্রচার হতো না। এসব কারণে অন্য একটি মাহফিল করতে অনুরোধ করলেন তিনি। যেখানে শুধু কলেজ ও বিশ্ববিদ্যালয় পড়ুয়া মেয়েরাই থাকবেন। দ্রæত আরেকটি মাহফিলের আয়োজন করা হলো। উপস্থিত বেশ কয়েকজনই নাযিফার বান্ধবী। উপস্থিতি খুব বেশি ছিল না ১০-১২ জন হবে হয়তো। তিনি আমাদের সাথে নিচে কার্পেটে (একটু দূরত্ব রেখে) বসে অত্যন্ত আন্তরিকতার সাথে কথা বললেন। বর্তমান উম্মাহর অগ্রগতির জন্য নারীদের অংশগ্রহণের বিষয়ে বুঝালেন। রাসূল সা: এর একটি হাদিস উল্লেখ করলেন।

জাবির ইবনু আবদুল্লাহ রা: হতে এও বর্ণিত আছে, নবী সা: দাঁড়িয়ে প্রথমে সালাত আদায় করলেন। পরে লোকদের উদ্দেশে খুতবাহ দিলেন। যখন নবী সা: খুতবাহ শেষ করলেন, তিনি (মিম্বর হতে) নেমে মহিলাদের (কাতারের) কাছে আসলেন এবং তাদের নসিহত করলেন। তখন তিনি বিলাল রা:-এর হাতে ভর করেছিলেন। বিলাল রা: তাঁর কাপড় ছড়িয়ে ধরলে, নারীরা এতে সাদাকাহর বস্তু ফেলতে লাগলেন। আমি আতা রহ:কে জিজ্ঞেস করলাম, আপনি কি এখনো জরুরি মনে করেন যে, ইমাম খুতবাহ শেষ করে নারীদের কাছে এসে তাদের নসিহত করবেন? তিনি বললেন, নিশ্চয় তা তাদের জন্য অবশ্যই জরুরি। তাদের কি হয়েছে যে, তারা তা করবে না? (৯৬১: সহিহ আল বুখারি)। (৯৫৮: মুসলিম ৮/১ হা: ৮৮৫) (আ.প্র.নাই, ই.ফা. ৯১০)। এ হাদিস থেকে তিনি বোঝালেন নারীদের জন্য নবীজি সা: আলাদাভাবে নসিহত করতেন।

এই হলেন আমাদের হান্নান চাচা। মেয়েদের ওই ছোট্ট দলটি তখন তার হাতে কুঁড়িসদৃশ ছিল। তার সযত্ন পরিচর্যায় পূর্ণরূপে দলটি বিকশিত হলে উইটনেস (আল কুরআন ২:১৪৩ আয়াত এর সাক্ষী শব্দের আলোকে) নামে যা পরবর্তীতে দেশের বাইরেও বিস্তৃতি লাভ করে। তার হাতে গড়া সে দিনের সেই তরুণীরা উচ্চশিক্ষিত হয়ে আজ দেশে-বিদেশে বিভিন্ন গুরুত্বপূর্ণ পদে সাফল্যের সাথে দায়িত্ব পালন করে যাচ্ছেন। তার নির্দেশনা ও স্লোগান অনুযায়ী এখনো উইটনেসের কাজ চলছে।


আরো সংবাদ



premium cement