০৪ মে ২০২৪, ২১ বৈশাখ ১৪৩১, ২৪ শাওয়াল ১৪৪৫
`


বাঙালি জাতীয়তাবাদের শিকড় অন্বেষণ

হোসেন শহীদ সোহরাওয়ার্দী ও শরৎচন্দ্র বসু - ছবি : সংগৃহীত

(শেষ কিস্তি)
ইংরেজরা উপমহাদেশে প্রথম ক্ষমতা নিয়েছিল মুসলমানদের কাছ থেকে। পলাশীর রাজনৈতিক বিপর্যয়ের পর প্রথম সুযোগে ইংরেজরা মুসলমানদের আত্মপরিচয় মুছে দিতে চায়, তাদের মধ্যে হীনম্মন্যতা ঢুকিয়ে দিতে চায়; যাতে তারা কোনো প্রকার প্রতিরোধ গড়ে তুলতে না পারে। তাই বাঙালির জাতীয়তাবাদের শুরু ব্রিটিশ ঔপনিবেশিক শাসনামলে। ইংরেজদের অধীনে। ইংরেজ ভাষাতাত্ত্বিক ও নৃতাত্ত্বিকরা বাঙালির জাতিসত্তার পরিচয় নিয়ে প্রথম আলোচনা শুরু করেন। ব্রিটিশদের আশ্রয়ে-প্রশ্রয়ে হিন্দুদের নেতৃত্বে বাঙালি জাতীয়তাবাদ নামে হিন্দু জাতীয়তাবাদের উত্থান ঘটে। এই বাঙালি জাতীয়তাবাদের মাধ্যমে বাঙালি মুসলমান নয়; বরং তারা আর্য হিন্দুর নেতৃত্ব ও সংস্কৃতি প্রতিষ্ঠার চেষ্টা করে যা প্রকারান্তরে সর্বভারতীয় হিন্দু সংস্কৃতির অংশ। ব্রিটিশদের আনুকূল্যে বাঙালি হিন্দুরা বাঙালি শব্দটা আত্মসাৎ করে। তখন থেকে বাঙালি মানে হিন্দু এ সমীকরণ তৈরি করা হয়।

হিন্দুরা মনে করে বাঙালি মানে হিন্দু এবং মুসলমানরা বাঙালি নয়। কলকাতার মতো আসামেও মুসলমানদের বাঙালি পরিচয়ে না ডেকে ডাকা হয় ‘মিয়া’ নামে। মিয়া নামের মাধ্যমে মুসলমানদের বাঙালি পরিচয়ের বিকল্প পরিচয় চাপিয়ে দেয়া হয়। মুসলমান ও হিন্দু উভয় অহমীয় কিন্তু হিন্দুরা বাঙালি, মুসলমানরা মিয়া। ফলে বাঙালি হিন্দুদের কাছে এটি খুব জোরালো বয়ান যে, বাঙালি নামের সমার্থক শব্দ শুধু হিন্দু এবং মুসলমানরা বাঙালি নয়।

মুসলমানরাও যে বাংলাভাষী বাঙালি এটি তাদের হিন্দু জাতীয়তাবাদী চেতনায় স্থান পায়নি। হিন্দু লেখক, সাহিত্যিকদের লেখালেখিতে বাঙালি জাতীয়তাবাদ যে ধর্মনিরপেক্ষতার আড়ালে হিন্দু জাতীয়তাবাদ তা খোলাসা হয়ে পড়ে। বঙ্কিমচন্দ্র চট্টোপাধ্যায় বঙ্গদর্শন পত্রিকায় ‘বাঙালির উৎপত্তি’ নামে একটি প্রবন্ধ লেখেন, সেখানে তিনি বাংলাভাষী মুসলমানদের বাঙালি জাতি থেকে একপ্রকার খারিজ করে দেন। বঙ্কিমের মতে, ‘ইংরেজ এক জাতি, বাঙালি বহু জাতি। বাস্তবিক এক্ষণে যাহাদিগকে আমরা বাঙালি বলি তাহাদের মধ্যে চারি প্রকার বাঙালি পাই। এক, আর্য, দ্বিতীয় অনার্য হিন্দু, তৃতীয় অর্যানার্য হিন্দু, আর তিনের বার এক চতুর্থ জাতি বাঙালি মুসলমান। চারি ভাগ পরস্পর হইতে পৃথক থাকে। বাঙালি সমাজের নিম্নস্তরেই বাঙালি অনার্য বা মিশ্রিত আর্য ও বাঙালি মুসলমান; উপরের স্তরে কেবলই আর্য। এই জন্য দূর হইতে দেখিতে বাঙালি জাতি অমিশ্রিত আর্য জাতি বলিয়া বোধ হয় এবং বাঙালির ইতিহাস এক আর্য বংশীয় জাতির ইতিহাস বলিয়া লিখিত হয়।’

বাঙালি জাতীয়তাবাদের মূল ভিত্তি ছিল হিন্দু সাম্প্রদায়িকতা। এ সাম্প্রদায়িকতার কারণ হিন্দু-মুসলমানে বিরোধ। বিরোধ তৈরিতে মূল ভূমিকা ছিল ব্রিটিশ শাসকদের। নিজেদের শাসন-শোষণ পোক্ত করতে তারা হিন্দু জাতীয়তাবাদীদের সুযোগ-সুবিধা দিয়ে তাদের কাজে লাগিয়েছে। এর মাধ্যমে তারা হিন্দু-মুসলমানের মধ্যে বিভক্তি তৈরি করেছে। কারণ, সহজ বিভাজনটা করা সম্ভব ছিল ধর্মীয় পার্থক্য বড় করে তোলার মধ্য দিয়ে। ব্রিটিশ শাসন বড় ধরনের ধাক্কা খায় ১৮৫৭ সালের সিপাহিদের বিদ্রোহে। বিদ্রোহটি ছিল অসাম্প্রদায়িক, হিন্দু-মুসলিম উভয় সম্প্রদায়ের সিপাহিরা তাতে অংশ নিয়েছিল। শাসকরা ভয় পাচ্ছিল আরো বড় একটি অভ্যুত্থান না ঘটে যায়। তারপর থেকে চেষ্টা চলতে থাকে সাম্প্রদায়িকভাবে হিন্দু-মুসলমানে দূরত্ব বাড়ানোর। এ ব্যাপারে তারা কয়েকটি চতুর পদক্ষেপ নেয়। প্রথমত, ভারতের ইতিহাস রচনার সময় তারা মুসলমান যুগকে হিন্দুদের ওপর অত্যাচারী ও বহিরাগত হিসেবে চিত্রিত করে। দ্বিতীয়ত, আদমশুমারিতে হিন্দু ও মুসলমানকে আলাদাভাবে দেখায়। হিসাবে ধরা পড়ে যে, বাংলায় মুসলমানের সংখ্যা কিছুটা বেশি। তাতে হিন্দু সম্প্রদায়ের নেতাদের মনে শঙ্কার জন্ম নেয় মুসলিম আধিপত্যের। তৃতীয়ত, ব্রিটিশ শাসকরা নবগঠিত হিন্দু মধ্যবিত্তকে উৎসাহ দেয় ভারতীয় জাতীয় কংগ্রেস নামে রাজনৈতিক সংগঠন গড়ে তুলতে, যার নেতৃত্ব স্বভাবত চলে যায় তুলনামূলক অগ্রসর হিন্দু সম্প্রদায়ের মানুষদের হাতে। কংগ্রেস শুরু থেকে হিন্দুদের সুযোগ-সুবিধা ও দাবি-দাওয়া আদায়ে ভূমিকা রাখে। অনগ্রসর ও রাজনৈতিক সুবিধা থেকে বঞ্চিত মুসলমানরা উপেক্ষিত থেকে যায়। তাই ব্রিটিশ সরকার প্রশাসনিক সুবিধা ও পূর্ববঙ্গের অনগ্রসর মুসলমানদের স্বার্থে এবং কিছুটা রাজনৈতিক কৌশলের অংশ হিসেবে ১৯০৫ সালে পূর্ববঙ্গ ও আসাম নিয়ে একটি স্বতন্ত্র প্রদেশ স্থাপন করে। পশ্চিমবঙ্গের হিন্দু মধ্যবিত্ত শ্রেণী তখন প্রবল বিরোধিতা শুরু করে। বঙ্গভঙ্গের ফলে হিন্দু মধ্যবিত্ত প্রবলভাবে বাঙালি জাতীয়তাবাদী হয়ে ওঠে, সাম্প্রদায়িক মানসিকতার কারণে তারা বঙ্গভঙ্গকে মেনে নিতে পারেনি। পূর্ববঙ্গের চাষাভূষা মুসলমানরা শিক্ষা, অর্থনীতি, রাজনীতিতে উন্নতি করবে আর কলকাতাকেন্দ্রিক হিন্দু মধ্যবিত্ত শ্রেণীর অর্থনীতি, সাংস্কৃতিক ও রাজনীতিতে আধিপত্য খর্ব হবে ভেবে হিন্দু সাম্প্রদায়িক মধ্যবিত্ত শ্রেণী বঙ্গবঙ্গকে মেনে নিতে পারেনি। কারণ, এতে তাদের বৈষয়িক ও সাংস্কৃতিক স্বার্থে সরাসরি আঘাত লেগেছিল। তারা জাতীয়তাবাদী আন্দোলন শুরু করে। বঙ্গভঙ্গের বিরোধিতা করে হিন্দু সাহিত্যিকরা প্রচুর লেখালেখি করেছেন, রাজনীতিকরা বক্তৃতা দিয়েছেন, শিল্পীরা রচনা করেছেন অনেক স্বদেশী গান, যাদের একটি রবীন্দ্রনাথের লেখা বাংলাদেশের জাতীয় সঙ্গীত হিসেবে গৃহীত হয়েছে। নীহার রঞ্জন রায় তার ‘বাঙালির আদি ইতিহাস’ বইয়ের ভূমিকায় বঙ্গ বিভাগের জন্য দুঃখ প্রকাশ করেছেন এবং একে বাঙালির দুই হাজার বছরের ইতিহাসের সবচেয়ে মর্মান্তিক ঘটনা হিসেবে উল্লেখ করেছেন। হিন্দু সমাজের অধিপতিরা ব্রাহ্মণ্যবাদী; তাই মুসলমানদের হেয় জ্ঞান করাটা হয়ে দাঁড়িয়েছিল তাদের জন্য প্রায় স্বভাবগত। মুসলমানদের দৃষ্টিতে অবজ্ঞাটা প্রতিভাত হচ্ছিল সাম্প্রদায়িক বিদ্বেষ হিসেবে। তারা বাঙালি মুসলমানদের ন্যাড়া, ম্লেচ্ছ, যবন ইত্যাদি শব্দে সম্ভোধন করত।

বাঙালি হিন্দুরা বঙ্গভঙ্গের বিরোধিতা করে স্বদেশী আন্দোলনের মতো বিভিন্ন ধরনের প্রচারণায় অংশগ্রহণ করে এবং ব্যাপকভাবে ইউরোপীয় পণ্য বয়কটের ঘোষণা দেয়। একটি অখণ্ড বাংলার প্রতিষ্ঠার আশায়, হিন্দু বাঙালিরা একটি বিপ্লবী আন্দোলনের ডাক দেয়, তাদের তরফ থেকে ধ্বনি উঠে ‘বন্দে মাতরমের’, যেটি মুসলমানদের কাছে আতঙ্কের ছিল কারণ, বন্দে মাতরম কেবল একটি উদ্দীপক আওয়াজ ছিল তা নয়, এটি ছিল রণধ্বনিও। আওয়াজটি শুনে বাঙালি মুসলমান শঙ্কিত হলো। এসব কারণে মুসলমানদের মনে বাঙালি জাতীয়তাবাদের ওপর আস্থা তৈরি না করে; বরং সন্দেহের জন্ম দেয়। অন্যদিকে বঙ্গভঙ্গকে বাঙালি মুসলমানরা সমর্থন করে কারণ পূর্ববঙ্গ ও আসাম নিয়ে গঠিত নতুন প্রদেশে মুসলমানদের ছিল সংখ্যাধিক্য; প্রদেশেটির রাজধানী স্থাপিত হয়েছিল ঢাকায়। ফলে মুসলমান সম্প্রদায় কিছুটা বাড়তি সুযোগ-সুবিধা পাবে আশা করছিল। বঙ্গভঙ্গ রদ হওয়াতে তারা হতাশই হয়।

১৯০৫ সালে যে বাঙালি হিন্দু মধ্যবিত্ত ‘বন্দে মাতরম’ রণধ্বনি তুলে মাতৃভূমির অখণ্ডতা রক্ষা করতে প্রয়োজনে প্রাণ পর্যন্ত দেবে বলে জানিয়েছিল, ১৯৪৬-৪৭-এ এসেই তারাই দেশভাগের জন্য রীতিমতো অস্থির হয়ে পড়েছিল। দেশভাগে মুসলিম লীগ যতটুকু সম্মত ছিল, কংগ্রেসের বর্ণহিন্দু মহাসভাপন্থীদের উৎসাহ ছিল তার থেকে বেশি। এক সময় যে বঙ্গমাতার অখণ্ডতা রক্ষা তাদের কাছে অত্যাবশ্যকীয় ছিল, ১৯৪৭ সালে এসে সেই বঙ্গমাতার বিচ্ছেদের জন্য তারা উঠেপড়ে লেগেছে শুধু বাঙালি মুসলমানদের আধিপত্যের শঙ্কা থেকে। হোসেন শহীদ সোহরাওয়ার্দী ও শরৎচন্দ্র বসু অখণ্ড বাংলা নিয়ে স্বাধীন ও পৃথক বাংলাদেশ গঠনের প্রস্তাব দেন। মুসলিম লীগ এ প্রস্তাবে সমর্থন দিলেও কংগ্রেস ও বাঙালি হিন্দুর বিরোধিতায় তা সফলতার মুখ দেখেনি। কারণ, অখণ্ড বাংলায় হিন্দুদের সংখ্যালঘু হয়ে যাওয়ার ভয় এবং মুসলিম আধিপত্যের ভীতি। বর্ণহিন্দুদের আশঙ্কা হলো যে সংখ্যাধিক্যে অখণ্ড বঙ্গে মুসলমানরা হর্তাকর্তা হয়ে থাকবে। এভাবে হিন্দু অভিজাতরা নিজেদের রাজনৈতিক স্বার্থে বাঙালি জাতীয়তাবাদকে ব্যবহার করেছে। এ ক্ষেত্রে তারা কখনো আশ্রয় নিয়েছে বঙ্গমাতার অঙ্গচ্ছেদ ঠেকানোর আন্দোলনের নামে, কখনো মুসলমানদের আধিপত্য রুখে দেয়ার নামে নানা ছলচাতুরি। বাঙালি হিন্দুরা যদি অখণ্ড বাংলা চাইত, তাহলে আজকের বাংলাদেশের মানচিত্র ও ভৌগোলিক সীমানা হতো বড় ও স্বতন্ত্র। পশ্চিম বাংলায় ১৯৪৭ সালের পর যেসব মুসলিম রয়ে গেছেন তারা সে দেশে বাঙালি হিসেবে যথেষ্ট আদৃত হননি। সরকারি চাকরিসহ বিভিন্ন সুযোগ-সুবিধায় বাঙালি মুসলমানরা এখনো পিছিয়ে রয়েছে।

জাতীয় বিভাজনে জাতীয়তাবাদ
‘জাতীয়তাবাদ’ শব্দটির অর্থ অনেক বেশি ব্যপ্ত ও গভীর। কিছুটা বিতর্কিতও। এর কোনো নির্দিষ্ট সংজ্ঞা নেই। মানুষের আত্মপরিচয় জাতি-পরিচয় ঘিরে গড়ে উঠতে পারে; আবার শ্রেণী, বংশ, ধর্ম কিংবা ভাষা-পরিচয়কে কেন্দ্র করেও গড়ে উঠতে পারে। আদর্শ হিসেবে জাতীয়তাবাদী চেতনা অতিমাত্রায় খেয়ালি এক আদর্শ। কখনো কখনো একই ভাষাভাষী জনগোষ্ঠীর মধ্যেও নাগরিকের পরিচয়ের ভিত্তিতে কিংবা ধর্মের ভিত্তিতে ভিন্ন জাতীয়তাবাদ পরিলক্ষিত হয়। তাই জাতীয়তাবাদ সব সময় বিতর্কিত ও বিপজ্জনক এক ধারণা। প্রবল জাতীয়তাবাদ উগ্রবাদে মোড় নেয়। গত শতকের শুরুর দিকে জার্মানি ও ইতালিতে জাতিবাদী জাতীয়তাবাদের ভয়াবহতা পরিলক্ষিত হয়। এর আগে উনিশ শতকের মাঝামাঝি থেকে জাতিবাদী জাতীয়তাবাদের আবেদন ফিকে হতে শুরু করে। তারও আগে ফরাসি বিপ্লব ও প্রতিবিপ্লবের পরপর জাতিবাদী জাতীয়তাবাদ নিয়ে মানুষের মনে সন্দেহ শুরু হতে থাকে। জাতিবাদী জাতীয়তাবাদের বিকল্প হিসেবে নাগরিকের পরিচয় ভিত্তিতে নাগরিক জাতীয়তাবাদের বিকাশ ঘটেছিল উনিশ শতকের মাঝামাঝি থেকে। কিন্তু উপনিবেশ পরবর্তী যুগে নাগরিক জাতীয়তাবাদও রাষ্ট্রের অভ্যন্তরে নাগরিক ও অ-নাগরিক বিভাজন বজায় রেখেছিল। মূলত গত শতকের ষাটের দশক থেকে জাতিবাদী ও নাগরিক জাতীয়তাবাদী ধারণার বাইরে রাষ্ট্রীয় জাতীয়তাবাদ হিসেবে ভিন্ন এক জাতীয়তাবাদী ভাবনার উন্মেষ ঘটতে থাকে। ফলে দেখা যায়, জাতিবাদী জাতীয়তাবাদ মানুষ বা প্রতিপক্ষকে হত্যা করে রাষ্ট্রের নামে হত্যাকে অনুমোদন দেয় জাতীয় স্বার্থ বা নিরাপত্তার কথা। রাষ্ট্রের অভ্যন্তরে নাগরিকদের মধ্যে ‘আমরা ও তারা’ বিভাজন সৃষ্টি করে।

পাকিস্তান প্রতিষ্ঠার পর থেকে পূর্বপাকিস্তানে পাকিস্তানি জাতীয়তাবাদের বদলে ‘পূর্ববাংলার বাঙালি জাতীয়তাবাদ’ বিকশিত হয়। সে চেতনা অবলম্বন করে জাতীয়তাবাদী আন্দোলনও গড়ে ওঠে। সেই ধারায় ১৯৭১ সালে রক্তক্ষয়ী যুদ্ধের মধ্য দিয়ে স্বাধীন জাতিরাষ্ট্ররূপে প্রতিষ্ঠিত হয়েছে বাংলাদেশ। স্বাধীনতার পর দেশের নাগরিকদের রাষ্ট্রীয় বা জাতীয় পরিচয় নির্ধারণ করার ক্ষেত্রে বাঙালি জাতীয়তাবাদ বিভাজন তৈরি করেছিল। সংবিধানে ঘোষিত হয়েছিল, ‘বাংলাদেশের নাগরিকগণ বাঙালি বলিয়া পরিচিত হইবেন।’ এটি ছিল বাংলাদেশে বসবাসকারী বিভিন্ন ক্ষুদ্র জাতিসত্তার জনগোষ্ঠীর পৃথক অস্তিত্বকে অস্বীকার করার সমান। এমনকি ক্ষুদ্র জাতিসত্তার জনগোষ্ঠীসমূহকে তদানীন্তন গণপরিষদে বাঙালি হওয়ার পরামর্শ দেয়া হয়েছিল বলে কথিত আছে। জাতীয়তাবাদ যে কখনো কখনো সাম্প্রদায়িকতায়ও রূপ নিতে পারে, সংখ্যাগরিষ্ঠতার জোরে ভিন্ন জাতিসত্তার সংখ্যালঘু পাহাড়ি জনগোষ্ঠীদের বাঙালি বানানোর প্রচেষ্টা সেটি প্রমাণ করে। স্বাধীনতার পরবর্তী সময়ে বাংলাদেশে বাঙালি জাতীয়তাবাদের সাথে বাংলাদেশী জাতীয়তাবাদেরও বিকাশ ঘটে। পঁচাত্তরের পর জাতীয়তাবাদের প্রশ্নে দেশ দ্বিধাবিভক্ত। কেউ বাঙালি, আবার কেউ বাংলাদেশী জাতীয়তাবাদের দাবিদার। জাতীয়তাবাদ নিয়ে জাতি ঐতিহাসিকভাবে দ্বিধাবিভক্ত।

বাংলাদেশের বড় দু’টি দল ও এদের বলয়ের অবস্থান সম্পূর্ণ ভিন্ন। একটি বড় দল নিজেদের রাজনৈতিক বলয় বাঙালি জাতীয়তাবাদে বিশ্বাস করে। অপরদিকে অন্য বড় দল ও এদের বলয় বাংলাদেশী জাতীয়তাবাদে বিশ্বাস করে। উভয়ের এই দ্বিমত ও অবস্থানে সৃষ্ট অস্থিরতা সংবিধানে গিয়েও ঠেকেছে। জাতীয়তাবাদী এ বিভাজনে দেশে রাজনৈতিক অস্থিরতা তৈরি হয়েছে, মানুষে মানুষে ভেদাভেদ সৃষ্টি হয়েছে। এর ফলে দেশে বৈষম্য বাড়ছে, অন্যায়-অবিচার বাড়ছে, সহিংসতা বাড়ছে, পাশবিক প্রবণতা বাড়ছে, মানবিক গুণাবলি কমছে।

ইংরেজরা আসার পর বাংলা ধর্মনিরপেক্ষ জাতীয়তাবাদের ধারণা পেয়েছে। তবে হিন্দু বা মুসলমানদের মধ্যে ধর্মীয় জাতীয়তাবাদ পিছু হটেনি। বাংলাদেশ এ জাতীয়তাবাদী দ্বন্দ্বের প্রতিক্রিয়া-পরিণাম, বাংলাদেশ দু-দুটি বিভাজনের ফসল। তার পরও তার জাতিসত্তাবিষয়ক সঙ্কটের সমাধান হয়নি। এ জন্য একজন মার্কিন রাষ্ট্রবিজ্ঞানী বলেছেন, বাংলাদেশ স্ববিরোধিতার চ্যালেঞ্জে ভরা একটি দেশ। বাঙালিকে যারা হুজুগে, আত্মবিস্মৃত, আত্মকলহপরায়ণ, আত্মভ্রষ্ট ও আত্মঘাতী বলে অভিহিত করেছেন, তারা এ জাতির মহান সব সম্ভাবনার ধ্বংস হয়ে যাওয়ার ঘটনাবলিতে ব্যথিত হয়ে তা করেছেন।


আরো সংবাদ



premium cement