২৬ এপ্রিল ২০২৪, ১৩ বৈশাখ ১৪৩১, ১৬ শাওয়াল ১৪৪৫
`

উচ্চ প্রবৃদ্ধি অর্জনের চেয়ে জীবনের গুরুত্ব বেশি

উচ্চ প্রবৃদ্ধি অর্জনের চেয়ে জীবনের গুরুত্ব বেশি - ছবি : সংগৃহীত

বৈশি^ক মহামারী করোনাভাইরাস পরিস্থিতির মধ্যে ১১ জুন সংসদে ২০২০-২১ অর্থবছরের জন্য ৫ লাখ ৬৮ হাজার কোটি টাকার বাজেট উপস্থাপন করেছেন অর্থমন্ত্রী। ‘অর্থনৈতিক উত্তরণ ও ভবিষ্যৎ পথ পরিক্রমা’ শিরোনামে বাংলাদেশের এটি ৪৯তম, এই মন্ত্রীর দ্বিতীয় ও আওয়ামী লীগ সরকারের ২১তম বাজেট। অর্থমন্ত্রী হিসেবে আ হ ম মুস্তফা কামাল ২০১৯-২০ অর্থবছরের বাজেট প্রথম পেশ করেছেন। সে বছর ৫ লাখ ২৩ হাজার ১৯০ কোটি টাকার বাজেট ঘোষণা করা হয়। বর্তমান পরিস্থিতিতে দেশের মানুষ ও অর্থনীতির জন্য ৫ লাখ ৬৮ হাজার কোটি টাকার মধ্যে পরিচালনা ব্যয় ধরা হয়েছে ৩ লাখ ৪৮ হাজার ১০০ কোটি টাকা। এর মধ্যে উন্নয়ন ব্যয় ধরা হয়েছে ২ লাখ ১৫ হাজার ৪৩ কোটি টাকা। আর বার্ষিক উন্নয়ন কর্মসূচির প্রস্তাব করা হয়েছে ২ লাখ ৫ হাজার ১৪৫ কোটি টাকা। 

চলতি অর্থবছরে প্রাক্কলিত জিডিপির আকার ২৮ লাখ ৮৫ হাজার ৮৭২ কোটি টাকা থেকে ২ লাখ ৮৫ হাজার ৬২৮ কোটি টাকা বাড়িয়ে আসন্ন অর্থবছরে মোট জিডিপির আকার ধরা হয়েছে ৩১ লাখ ৭১ হাজার ৫০০ কোটি টাকা। প্রবৃদ্ধির হার ধরা হয়েছে ৮ দশমিক ২ শতাংশ।

বিশ^ ব্যংকের পূর্বাভাস বলছে, চলতি বছরে বৈশি^ক অর্থনীতি সঙ্কুুচিত হবে ৫ দশমিক ২ শতাংশ। করোনার কালো ছায়ার বাইরে নয় বাংলাদেশের অর্থনীতি। এ দেশের সম্ভাব্য প্রবৃদ্ধি ২ শতাংশের ওপর যাবে না বলে আন্তর্জাতিক সংস্থাগুলোর ধারণা। চলতি অর্থবছরে (২০১৯-২০) বাজেটে ঘোষিত রাজস্ব আহরণে লক্ষমাত্রা অর্জিত হয়নি। সংশোধিত লক্ষ্যমাত্রাও অর্জন অসম্ভব। এ পরিপ্রেক্ষিতে প্রস্তাবিত বাজেটের যে প্রবৃদ্ধি (৮.২ শতাংশ) তা বাস্তবতাবিবর্জিত। সিপিডি বলেছে, প্রবৃদ্ধির হার ২.৫০ শতাংশের বেশি হবে না। কোভিড-১৯ কত দিন থাকবে, অর্থনৈতিক সঙ্কট কত দিন বিরাজ করবে তার ওপর নির্ভর করবে বাজেট বাস্তবায়ন ও অর্থনৈতিক পুনরুদ্ধার। কোভিড মহামারীতে প্রবৃদ্ধিভিত্তিক উন্নয়ন তাসের ঘরের মতো ভেসে গিয়ে মানুষের উপার্জনের রাস্তা বন্ধ হয়ে যাওয়ায় দরিদ্র আরো বেশি দরিদ্র ও কর্মহীন হয়ে পড়েছে। বেকারত্বের হার বেড়েই চলেছে। এ পরিপ্রেক্ষিতে অর্থনৈতিক পুনরুদ্ধার মানুষের জীবন রক্ষার প্রাক্কালে বাজেট প্রণয়ন, বাজেটে অর্থায়ন সরকারের জন্য একটি বড় চ্যালেঞ্জ। এ সময় প্রবৃদ্ধি অর্জনের চেয়ে মানুষের জীবন রক্ষার গুরুত্ব দেয়া উচিত বেশি।

বাজেটে স্বাস্থ্য, কৃষি, শিক্ষা ও কর্মসংস্থানে এর প্রতিফলন কেমন হবে তার ওপর সবার নজর রয়েছে। বিশেষ করে বর্তমানে মহামারীতে দেশের স্বাস্থ্য খাতের যে বেহাল দশা তা সবার কাছে প্রমাণিত। তাই বাজেটে স্বাস্থ্য খাত নিয়ে সরকারের কী পরিকল্পনা সে দিকে সবার নজর। সর্বাগ্রে এ খাতে অবকাঠামোগত উন্নতি দরকার। এ খাতে অনেক অপচয় হয়; তা রোধ করতে হবে। এ খাতের উন্নতির জন্য সরকার তাৎক্ষণিকভাবে যেসব জনবল নিয়োগ দিয়েছেন এবং দিচ্ছেন, এসব নতুন নিয়োগপ্রাপ্ত ডাক্তার, নার্স ও টেকনোলজিস্টদের প্রশিক্ষণ দিতে হবে। তাদের দক্ষ করে গড়ে তুলতে হবে। প্রস্তাবিত বাজেট নিয়ে মোটা দাগে কয়েকটি কথাÑ এ বাজেটে আয়-ব্যয়ের সমন্বয় করা খুব কঠিন হবে। বর্তমান খারাপ পরিস্থিতিতেও এনবিআরকে ৩ লাখ ৩০ হাজার কোটি টাকা সংগ্রহের দায়িত্ব দেয়া হচ্ছে যা সম্পূর্ণ অসামঞ্জস্যপূর্ণ।

ব্যয়ের খাতগুলো প্রধানত হলোÑ ভর্তুকি, প্রণোদনা, অবসরভাতা, সরকারি কর্মকর্তা-কর্মচারী-কর্মচারীদের বেতন, দেশী-বিদেশী সুদ ব্যয়। তবে আয়ের টাকা দিয়ে ব্যয় কুলাবে না। ফলে বড় আকারের ঋণ করতে হবে। বাজেটে ঘাটতি ধরা হয়েছে এক লাখ ৯০ হাজার কোটি টাকা যা জিডিপির ৬ শতাংশ। ঘাটতি পূরণে ব্যাংক থেকে ৮৪৯৮০ কোটি টাকা, সঞ্চয়পত্র থেকে ২৫ হাজার কোটি এবং বিদেশী ঋণ ৭৬ হাজার কোটি টাকা নিতে হবে। এতে বিনিয়োগ কমে যাবে, কর্মসংস্থানের ওপর নেতিবাচক প্রভাব পড়বে। সরকারের ব্যাংক খাত থেকে এত বেশি ঋণ না নিয়ে বরং খেলাপি ঋণ কিভাবে আদায় করা যায় , কিভাবে ব্যাংক খাতে শৃঙ্খলা আনা যায় সে দিকে নজর দেয়া উচিত। বর্তমান পরিস্থিতিতে প্রস্তাবিত বাজেটে রাজনৈতিক সদিচ্ছার কোনো ঘাটতি নেই। কিন্তু বাস্তবতার নিরিখে এ বাজেটটি একটি সাধারণ বাজেট। করোনার অভিজ্ঞতার এ বাজেটে প্রতিফলন ঘটেনি। এ সময়ে আর্থিক খাতের সংস্কার করার বিরাট সুযোগ থাকলেও বাজেটে তার দেখা মেলেনি। 

বাজেটে কালো টাকা সাদা করার সংস্কৃতি থেকে আমাদের বেরিয়ে আসা উচিত। বলা হয়েছে, অপ্রদর্শিত সম্পদে নির্ধারিত হারে এবং অপ্রদর্শিত অর্থে ১০ শতাংশ কর প্রদান করলেই এ নিয়ে আর কোনো প্রশ্ন করা হবে না। এর ফলে হয়তো কিছু ফ্ল্যাট, বাড়ি ক্রয় করা হবে; কিন্তু অর্থনীতি ও দুর্নীতি রোধে কোনো ভূমিকা থাকবে বলে কেউ মনে করে না। বাজেটে মুদ্রাস্ফীতি ধরা হয়েছে ৫.৪ শতাংশ। কৃষিতে প্রতিবারের মতোই ভর্তুকি বাড়ানো হয়েছে ঠিকই। কিন্তু কৃষিকে আরো আধুনিকায়ন ও টেকসই করার ব্যাপারে কার্যকর পদক্ষেপ নেয়া উচিত। কারণ বর্তমান করোনা পরিস্থিতিতে খাদ্যসঙ্কট ও খাদ্য নিরাপত্তার ওপর জোর না দিলে মানুষের জীবনের প্রতি হুমকি বাড়বে। 

যেসব শ্রমিক বিদেশ থেকে ফেরত আসছে তাদের কর্মে নিয়োজিত করার জন্য বাজেটে বিশেষ বরাদ্দ থাকা উচিত। বেকার যুবক ও শ্রমিক যারা কাজ হারাচ্ছে বা হারাবে তাদের কাজে ফিরিয়ে আনা অর্থনীতির জন্য একটি বড় চ্যালেঞ্জ। বাজেটে পোশাক শিল্পের আগের সুযোগ বহাল থাকার কথা বলা হয়েছে। পাশাপাশি পণ্য রফতানিতে উৎসে কর ০.৫ শতাংশের বিষয়টি প্রশংসার দাবি রাখে। তবে এ বিশাল খাতে কোনো শ্রমিক যেন চাকরি না হারায় সে বিষয়ে সুনির্দিষ্ট নীতিমালা ও ফান্ড থাকা উচিত। কোভিড-১৯ মোকাবেলায় স্বাস্থ্য খাতে ১০ হাজার কোটি টাকা থোক বরাদ্দ রাখা হয়েছে। তবে ভবিষ্যতে কোভিড-১৯-এর পথ কতদূর যায়, সেটার ওপর এ বরাদ্দের বাস্তবতা নির্ভর করবে। 

অর্থনৈতিক চ্যালেঞ্জ মোকাবেলায় প্রবৃদ্ধি অর্জনের চেয়ে কৃষি উৎপাদন ও বহুমুখী বাজারজাতকরণ, দারিদ্র্য বিমোচন, সামাজিক সুরক্ষা সম্প্রসারিত করে বেকার ও কর্মহীন মানুষের কর্মসংস্থান সৃষ্টি করে দক্ষ মানবসম্পদ উন্নয়নের দিকে নজর দেয়া উচিত।

প্রস্তাবিত বাজেটে সামাজিক নিরাপত্তায় ৯৫ হাজার ১৫৫ কোটি টাকা বরাদ্দ রাখা হয়েছে যা মোট বাজেটের ১৬.৮৩ শতাংশ। তা ছাড়া এ বছর নতুন করে যুক্ত হচ্ছে ১১ লাখ ৫ হাজার সুবিধাভোগী। আগামী অর্থবছরে ৫০ লাখ দরিদ্র কর্মজীবী মানুষকে নগদ অর্থ সহায়তা দেয়া হবে। অর্থমন্ত্রী বলেছেন মুদ্রা সরবরাহের ওপর জোর দেয়া হবে। মুদ্রা সরবরাহ বৃদ্ধি করা হবে। আন্ডার এবং ওভার ইনভয়েসিং, ভুয়া বিনিয়োগের মাধ্যমে অর্থপাচার ও কর ফাঁকির অভিযোগ দীর্ঘদিনের। এবারের বাজেটে এসব হিসাব ভুয়া হিসাব প্রমাণিত হলে তার ওপর ৫০ শতাংশ হারে কর আরোপের ঘোষণা দেয়া হয়েছে। তা ছাড়া তৈরী পোশাক শিল্পের কর ছাড়ের মেয়াদ বাড়ানো হয়েছে। বাজেটে এসব ভালো দিক থাকলেও রাজস্ব আদায়ের এনবিআরের জন্য ৩ লাখ ৩০ হাজার কোটি টাকা আদায় করার যে লক্ষ্য ধরা হয়েছে তা বর্তমান পরিস্থিতিতে একেবারেই অগ্রহণযোগ্য। বর্তমানে পুঁজিবাজার মৃতপ্রায়। ব্যাংকিং খাতের দুরবস্থায় পুঁজিবাজারের অবস্থা আরো নাজুক হওয়ার উপক্রম। বাজেটে বিনিয়োগ বৃদ্ধি ও কর্মসংস্থান সৃষ্টির উল্লেখযোগ্য পদক্ষেপ দেখা যায়নি। তবে বাজেটে করমুক্ত আয়সীমা ৩ লাখ টাকা করায় সাধারণ মানুষের ভোগান্তি কিছুটা কমবে। করমুক্ত সর্বনি¤œ হার এবং করপোরেট ব্যয় হার কমানোর উদ্যোগ ভালো। 

প্রতি বছর বাজেটের আকার বাড়ানো একটি স্বাভাবিক নিয়ম হয়ে গেছে। তা ছাড়া প্রবৃদ্ধি অর্জনের লক্ষ্যমাত্রা, রাজস্ব আয়, এনবিআরের লক্ষ্যমাত্রা নিয়ে বিশাল আকারে বাজেট দেখে মনে হয় এটি করোনাকালীন মহামারীর কোনো বাজেট নয়, স্বাভাবিক সময়ের একটি সাধারণ বাজেট। বাজেটে দেশের মানুষের জীবন-জীবিকার এবং স্বাস্থ্য, ব্যবসাবাণিজ্য, ক্ষুদ্র ও মাঝারি শিল্প উদ্যোক্তাদের সমস্যার চিত্র যথাযথভাবে ফুটে ওঠেনি। বৈশি^ক মহামারীতে সমাজের উচ্চ, মধ্য ও নি¤œ এবং খেটেখাওয়া মানুষের দুর্ভোগের বাস্তব চিত্র বাজেটে ফুটে উঠলে আন্তর্জাতিক দাতা সংস্থাগুলো থেকে এই সঙ্কটকালে বিভিন্ন অনুদান ও সাহায্য পেতে সহজ হতো। বাজেটে ঘাটতি অর্থায়নে ব্যাংক ব্যবস্থা ও বৈদেশিক উৎস থেকে এবং বেশি ঋণ পাওয়ার আশা করা হয়েছে।, এটা পাওয়া চ্যালেঞ্জিং হবে। করণ ব্যাংকিং সেক্টর চরম এতিম অবস্থায় আছে। এ খাতের সংস্কার ও ব্যাংক কমিশন গঠনের কথা থাকলেও তা আজো করা হয়নি। দেশের ব্যাংকিং খাত শক্তিশালী থাকলে বর্তমান নাজুক পরিস্থিতিতে বাজেট প্রণয়নে অনেক সহায়ক হতো। অথচ দুর্বল ও প্রায় ভঙ্গুর এ সেক্টরের ওপর ঋণ ও প্রণোদনার বোঝা চাপিয়ে দেয়ায় বেসরকারি ঋণপ্রবাহ মারাত্মকভাবে হ্রাস পাবে। সুনির্দিষ্ট কর্মপরিকল্পনা থাকলে বাজেটটি আরো বাস্তবমুখী হতো এবং এর বাস্তবায়ন সহজ হতো। বাজেটে বিভিন্ন নিত্যপ্রয়োজনীয় পণ্যে কর কমানো হয়েছে। ফলে এসব পণ্যের দাম কমতে পারে। নি¤œ ও প্রান্তিকদের জন্য আগামী অর্থবছরে সামাজিক নিরাপত্তা খাতের আওতা বাড়ানো হয়েছে। তবে তা প্রকৃত ভুক্তভোগীরা যাতে পায় সে বিষয়ে কঠোর নজরদারি দরকার। 

লেখক : অর্থনীতি বিশ্লেষক
main706@gmail.com


আরো সংবাদ



premium cement
রাজশাহীতে মৌসুমের সর্বোচ্চ তাপমাত্রা ৪২ ডিগ্রি ছাড়াল যুক্তরাজ্যে বাংলাদেশী শ্রমিকদের ভিসা সহজ করার আহ্বান প্রবাসী প্রতিমন্ত্রীর চীন ও যুক্তরাষ্ট্রের প্রতিদ্বন্দ্বী না হয়ে অংশীদার হওয়া উচিত : শি জিনপিং ওকাব সভাপতি নজরুল ইসলাম, সম্পাদক জুলহাস আলম পাবনায় ১০ কোটি টাকার অনিয়মে ৩ ব্যাংক কর্মকর্তা কারাগারে চুয়েট ১১ মে পর্যন্ত বন্ধ, শিক্ষার্থীদের আন্দোলন স্থগিত নরসিংদীতে হিট স্ট্রোকে শিশুর মৃত্যু হিলিতে ভটভটি-মোটরসাইকেলের সংঘর্ষে নিহত ২ ‘গাজার ধ্বংসাবশেষ পরিষ্কার করতে ১৪ বছর লাগতে পারে’ সখীপুরে ছাগল চুরির মামলায় মা-ছেলে কারাগারে ‘অন্যায়ের সাথে নয়া দিগন্তের সাংবাদিকরা কখনোই আপোষ করেন না’

সকল