০৪ মে ২০২৪, ২১ বৈশাখ ১৪৩১, ২৪ শাওয়াল ১৪৪৫
`


ব্যাংক একীভূত করার উদ্যোগ কতটা সুফল বয়ে আনবে?

ব্যাংক একীভূত করার উদ্যোগ কতটা সুফল বয়ে আনবে? - ফাইল ছবি

সঙ্কটেপড়া ব্যাংক খাতে শৃঙ্খলা ফেরাতে কিছু উদ্যোগ নিয়েছে বাংলাদেশ ব্যাংক। তারই অংশ, ব্যাংক একীভূতকরণ। যদিও কর্তৃপক্ষ ‘একীভূতকরণ’ শব্দটি ব্যবহার করছে, তবে শেষ পর্যন্ত এটি হবে অধিগ্রহণ। আর্থিক প্রতিষ্ঠান একীভূতকরণ কোনো নতুন ধারণা নয়, বরং দেশে ও বিদেশে সফল একীভূতকরণের অনেক উদাহরণ আছে। তবে এবারের উদ্যোগে কে জিতবে আর কে হারবে কিংবা কার লাভ হবে, কার ক্ষতি হবে, তা নিয়ে প্রশ্ন উঠেছে। বৃহৎ ব্যাংকের সাথে প্রতিযোগিতায় টিকতে না পারলে অপেক্ষাকৃত ছোট ব্যাংক বড় ব্যাংকের সাথে একীভূত হয়ে থাকে। পরিসংখ্যান দেখা যাচ্ছে, যুক্তরাষ্ট্রেও ব্যাংকের সংখ্যা ক্রমহ্রাসমান। বর্তমানে যুক্তরাষ্ট্রে ব্যাংকের যে সংখ্যা, এক শ’ বছর আগে তা তিন গুণ বেশি ছিল। ১৯২৮-১৯৩৩-এর মহামন্দা, ২০০৮ সালের বৈশ্বিক অর্থনৈতিক দুর্যোগ, ১৯৯৯ সালের ‘দ্য গ্রাম-লিচ-ব্লিলি অ্যাক্ট ইত্যাদি কারণে যুক্তরাষ্ট্রে ব্যাংকের সংখ্যা কমে যায়। কিন্তু ১৯৯৯ সালের আইনের কারণে ব্যাংকগুলোর একীভূতকরণ ও অধিগ্রহণের পথ সুগম হয়। সে ক্ষেত্রে বাণিজ্যিক ব্যাংকের সাথে বিনিয়োগ ব্যাংকের একীভূত অথবা অধিগ্রহণ হয় আবার উল্টোটাও ঘটে।
পার্শ্ববর্তী দেশ ভারতে ২০১৭ সালের পূর্বে রাষ্ট্রীয় ব্যাংক ছিল ১৭টি। এগুলো পরে ১০টি ব্যাংকে একীভূত হয়। একীভূত অথবা অধিগ্রহণের নির্দেশনায় ও এর বাস্তবায়নে দুটি পক্ষ সবচেয়ে ‘আতঙ্কিত’ হতে পারেন। প্রথমত, আমানতকারী এবং দ্বিতীয়ত, একীভূতকৃত ব্যাংকের কর্মকর্তা-কর্মচারী। আমানতকারীদের ভয় থাকবে, জমাকৃত আমানতের সুরক্ষা।

তবে সে দায় একীভূত নীতিমালায় সুস্পষ্ট উল্লেখ থাকতে পারে এবং উভয় শ্রেণীকেই আস্থায় আনা যেতে পারে। এখন পর্যন্ত যে ১০টি ব্যাংকের একীভূত হওয়ার সিদ্ধান্ত হয়েছে, তার মধ্যে ৫টি সরকারি ব্যাংক ও ৫টি বেসরকারি ব্যাংক। সরকারি যে ৫টি ব্যাংক একীভূত করার সিদ্ধান্ত হয়েছে তার মধ্যে রয়েছে সোনালী ব্যাংক, বাংলাদেশ ডেভেলপমেন্ট ব্যাংক বা বিডিবিএল, কৃষি ব্যাংক, রাজশাহী কৃষি উন্নয়ন ব্যাংক ও বেসিক ব্যাংক। এর মধ্যে সোনালীর সাথে বিডিবিএল, কৃষি ব্যাংকের সাথে রাজশাহী কৃষি উন্নয়ন ব্যাংক বা রাকাবের একীভূত করার সিদ্ধান্ত নেয়া হয়েছে। আর বেসরকারি যে ৫টি ব্যাংকের একীভূত করার সিদ্ধান্ত হয়েছে, তার মধ্যে রয়েছে এক্সিম ব্যাংক, সিটি ব্যাংক, ইউসিবি, ন্যাশনাল ও পদ্মা ব্যাংক। এর মধ্যে এক্সিমের সাথে পদ্মা, ইউসিবির সাথে ন্যাশনাল ও সিটির সাথে সরকারি মালিকানাধীন বেসিক ব্যাংককে একীভূত করার সিদ্ধান্ত হয়েছে বলে সংশ্লিষ্ট সূত্রে জানা যায়। সরকারের পক্ষে বাংলাদেশ ব্যাংক দুর্বল ব্যাংকগুলো সবল বা ভালো ব্যাংকের সাথে একীভূত করার উদ্যোগ নিয়েছে। ইতোমধ্যে মার্চ মাসে এক্সিম ব্যাংকের সাথে একীভূত হতে চুক্তি করেছে পদ্মা ব্যাংক। এর মধ্য দিয়ে ব্যাংক একীভূত করার ধারা শুরু হয়।

বাংলাদেশ ব্যাংকের কর্মকর্তারা আশা করছেন, এর মাধ্যমে দুর্বল ব্যাংকগুলোর ভঙ্গুর অবস্থা কাটিয়ে ওঠা সম্ভব হবে। কিন্তু যেসব ভালো ব্যাংকের সাথে দুর্বল ব্যাংকগুলোকে একীভূত করা হচ্ছে, তা চাপিয়ে দেয়া হচ্ছে কি না, তা নিয়ে সংশয় প্রকাশ করেছেন অর্থনীতিবিদগণ। এর মধ্যে ব্যাংক- কোম্পানি একত্রীকরণের একটি নীতিমালাও প্রকাশ করেছে বাংলাদেশ ব্যাংক। সবল ব্যাংকগুলোকে সরকার ও বাংলাদেশ ব্যাংকের পক্ষ থেকে নীতিসহায়তা দেয়ার কথা বলা হয়েছে নতুন নীতিমালায়। এতে বলা হয়েছে, ‘ভালো ব্যাংকটি দুর্বল ব্যাংকের কার্যক্রম তথা আমানত, গ্রাহক, শাখার নেটওয়ার্ক, অপারেশন, কৌশল, গবেষণা ও আধুনিক প্রযুক্তি ও একই কারিগরি সিস্টেম এবং ব্যবস্থাপনার আরো ভালোভাবে ব্যবহার করে সাশ্রয়ী ব্যয়ে আরো বড়, দক্ষ ও শক্তিশালী হওয়ার কারণে দুই ব্যাংকেরই লাভবান হওয়ার সুযোগ তৈরি হয়। কেন্দ্রীয় ব্যাংকের মুখপাত্র বলছেন, এই নীতি সহায়তাকে কাজে লাগিয়ে দক্ষ ব্যবস্থাপনার মাধ্যমে একত্রীকরণ থেকে লাভবান হতে পারবে দুর্বলদের দায়িত্ব নেয়া ব্যাংকগুলো। অন্যদিকে বাংলাদেশ ব্যাংকের পক্ষ থেকে ছয় ধরনের নীতি সহায়তার কথা উল্লেখ করা হয়েছে। এর অন্যতম ‘ন্যূনতম মূলধন সংরক্ষণ, সিআরআর বা ক্যাশ রিজার্ভ রেশিও, এসএলআর বা স্ট্যাচুটরি লিকুইডিটি রেশিও, এলসিআর বা লিকুইডিটি রেশিও সংরক্ষণে নির্দিষ্ট সময়ের জন্য একটি সুনির্দিষ্ট অংশ অব্যাহতি প্রদান।’

বাংলাদেশ ব্যাংকের মুখপাত্র মেজবাউল হক বলেন, ‘এতে ঋণ দেয়া বা লগ্নি করার জন্য বাড়তি অর্থের জোগান পাবে ব্যাংক। এর মুনাফা দিয়ে ক্ষতি পুষিয়ে নিতে নীতিমালায় আরো বলা হয়, অগ্রাধিকার ভিত্তিতে তারল্য সুবিধা পাবে ব্যাংকগুলো। ব্যাংক কোম্পানি আইন ও বাংলাদেশ ব্যাংক অর্ডার অনুযায়ী অন্যান্য সহায়তা দেয়ার কথাও বলা হয়েছে এতে। কিন্তু এসব সুবিধার বিপরীতে খারাপ ব্যাংকের দায় নিয়ে ক্ষতি পোষানো ভালো ব্যাংকের জন্য চ্যালেঞ্জের হবে বলে মনে করেন- পলিসি রিসার্চ ইনস্টিটিউটের নির্বাহী পরিচালক আহসান এইচ মনসুর। আর একটা বিষয় হলো ঋণখেলাপিদের বিরুদ্ধে কঠোর পদক্ষেপ না নিলে একীভূতকরণ বা অধিগ্রহণ কোনোটিই কাক্সিক্ষত ফল বয়ে আনবে না। এজন্য দুর্বল ব্যাংকগুলোকে ঋণখেলাপিদের নাম প্রকাশ করতে বাধ্য করতে হবে। তাদের সামাজিকভাবে লজ্জায় ফেলতে হবে। তা না করে একীভূতকরণ বা অধিগ্রহণ করা হলে ঋণখেলাপিদের শাস্তি হবে না, কোনো পরিচালক বা ব্যাংক কর্মকর্তাকে আইনের মুখোমুখি হতে হবে না, এমনকি জনগণের কষ্টার্জিত অর্থ চুরি বা চুরিতে সহায়তা করার জন্য কারাদণ্ড দেয়া হবে না। একীভূতকরণের মাধ্যমে দুর্বল ব্যাংকগুলোর উচ্চ খেলাপী ঋণ, কম দক্ষতা ও সুশাসনের অভাব রাতারাতি ঠিক হয়ে যাবে না। তাই অধিগ্রহণকারী ব্যাংককে ব্যবসায়িক নীতিতে পরিবর্তন আনতে হবে এবং সমস্যাযুক্ত শাখাগুলোতে সুশাসন ফেরাতে বাড়তি উদ্যোগ নিতে হবে। এতে অধিগ্রহণকারী ব্যাংকের মুনাফা ক্ষতিগ্রস্ত হতে পারে। এতে ব্যাংকগুলো ভালো লভ্যাংশ দিতে পারবে না, ফলে ক্ষতির শিকার হবেন বিনিয়োগকারীরা। ফলে তাদের শেয়ারের দরপতন হতে পারে।

সরকার দুর্বল ব্যাংকের খেলাপী ঋণের দায়িত্ব নিলেও অধিগ্রহণকারী ব্যাংককে দুর্বল ব্যাংকের নিয়মিত ঋণগ্রহীতাদের সাথে কাজ করতে হবে। বাংলাদেশ ব্যাংকের একীভূতকরণ নীতিমালায় আরো বলা হয়েছে, একীভূত হওয়া ব্যাংকের কর্মীদের তিন বছর পর্যন্ত ছাঁটাই করা যাবে না। এমনকি একীভূত হওয়ার আগে কর্মকর্তা-কর্মচারীরা যে বেতন ও শর্তে কর্মরত ছিলেন, সেই একই বেতন ও শর্তে তাদের বহাল রাখতে হবে। ব্যাংকাররা বলছেন, এ বিধানের ফলে ব্যাংকের কর্মীদের মধ্যে একধরনের বৈষম্য তৈরি হতে পারে। এ বৈষম্যের কারণ ব্যাখ্যা করে তারা বলেন, সাধারণত ব্যাংকে প্রতি বছর কর্মীর কার্যমূল্যায়ন করা হয়। তার ভিত্তিতে তাদের পদোন্নতি ও অন্যান্য বিষয় নির্ধারিত হয়ে থাকে। নীতিমালায় খারাপ ব্যাংকের কর্মীদের তিন বছরের জন্য চাকরি ও আর্থিক সুবিধার গ্যারান্টি দেয়া হয়েছে। অথচ ভালো ব্যাংকের কর্মীরা প্রতি বছর তাদের কাজের ভিত্তিতে মূল্যায়িত হবেন। দেশের ব্যাংক খাতের বর্তমান পরিস্থিতির পিছনে কয়েকটি কারণ রয়েছে- তার মধ্যে সুশাসন, রাজনৈতিক হস্তক্ষেপ, মাত্রাতিরিক্ত খেলাপী ঋণ ও তারল্য সঙ্কটই প্রধান। এসব কারণে ব্যাংকগুলো ক্রমেই দুর্বল হয়ে পড়ছে।

এতে অর্থনৈতিক কর্মকাণ্ডের গতিও বাধাগ্রস্ত হচ্ছে। ব্যাংক ও আর্থিক প্রতিষ্ঠান থেকে জালিয়াতির মাধ্যমে ঋণ নিয়ে তার একটি বড় অংশই বিদেশে পাচার করে দেয়া, যার ফলে অর্থনীতিতে বাস্তবে অর্থ না থাকা, জিডিপিতে দেখানো হলেও বাস্তবে এই অর্থ দেশে নেই। যার ফলে অর্থ ফেরতও আসছে না, খেলাপী হচ্ছে। খেলাপীর কারণে প্রভিশন রাখাও ব্যাংকের জন্য বোঝা হয়ে দাঁড়াচ্ছে। এতে ব্যাংকের প্রায় দ্বিগুণ অর্থ আটকে যাচ্ছে। এজন্য খেলাপীদের কোনোভাবেই ছাড় দেয়া ঠিক হবে না। কারণ ব্যাংক হচ্ছে অর্থনীতির প্রাণ। ব্যাংক দুর্বল হলে অর্থনীতিও দুর্বল হয়ে পড়ে। বাংলাদেশ ব্যাংক দুর্বল ব্যাংকগুলোকে সবল ব্যাংকের সাথে একীভূতকরণের যে কর্মকৌশল গ্রহণ করেছে তাতে কতটুকু সুফল আসবে তা পুরোপুরি বলা যাচ্ছে না, তবে তার চেয়ে বড় বিষয় হলো-খেলাপীদের যদি সুস্পষ্টভাবে না ধরে বার বার তাদের সুযোগ দেয়া হয়, তা অর্থনীতির জন্য বড় ক্ষতি ডেকে আনতে পারে।

রাজনৈতিক অঙ্গীকার ছাড়া খেলাপী গ্রাহকদের বিরুদ্ধে পদক্ষেপ নেয়া ও ঋণ আদায় করা অনেকটাই অসম্ভব। তাই ব্যাংক খাতে শৃঙ্খলা ও সফলতা আনয়ন ও গতিশীল অর্থনীতির ব্যবস্থার জন্য শুধু ব্যাংক একীভূূতকরণ নয়, বরং সুশাসন ও খেলাপীদের কঠোর সাজার ব্যবস্থা করতে হবে। উচ্চ মূল্যস্ফীতি থেকে বের হয়ে কিংবা সামষ্টিক অর্থনীতিতে স্থিতিশীলতা এনে আমরা এখনো উন্নয়নে আগের ধারায় ফিরে আসতে পারিনি। আমাদের প্রবৃদ্ধি হওয়ার কথা ৭, ৮, ৯ শতাংশ, সেখানে বিশ্ব ব্যাংকের পূর্বাভাস- এ বছরের প্রবৃদ্ধি হবে ৫.৬ শতাংশ। কোভিডের পর থেকে এ পর্যন্ত আমরা প্রবৃদ্ধির সঠিক পথ রেখায় আসতে পারিনি। এসব আমলে নিয়ে ব্যাংক খাতকে স্বাভাবিক অবস্থায় ফিরিয়ে আনতে উদ্যোগী হতে হবে সরকারকে। এটা সবার প্রত্যাশা।

লেখক : অর্থনীতি বিশ্লেষক
ই-মেইল : main706@gmail.com


আরো সংবাদ



premium cement