০৭ মে ২০২৪, ২৪ বৈশাখ ১৪৩১, ২৭ শাওয়াল ১৪৪৫
`


দ্রব্যমূল্যের ঊর্ধ্বগতির অভিশাপ

অল্প কয়েক দিনের ব্যবধানে পেঁয়াজের দাম বেড়েছে কয়েক গুণ। - ছবি : সংগৃহীত

দ্রব্যমূল্যের বাজারে হঠাৎ শুরু হয়েছে ঊর্ধ্বমুখী প্রবণতা। অল্প কয়েক দিনের ব্যবধানে পেঁয়াজের দাম বেড়েছে কয়েক গুণ। যে পেঁয়াজ বিক্রি হতো ২০ টাকা কেজিতে, তার দাম বেড়ে দাঁড়ায় ২৫০ টাকা। প্রধান খাদ্য চালের দাম ক্রমেই বাড়ছে এবং তা সর্বকালের রেকর্ড ভঙ্গ করতে চলেছে। সবজির দাম গড়ে তিন থেকে চার গুণ বেড়েছে। মাছের বাজারেও পড়েছে মূল্যবৃদ্ধির কালো ছায়া।

নিত্যপণ্যের লাগামছাড়া মূল্যবৃদ্ধি সাধারণ মানুষের দুঃখ-কষ্টের কারণ হয়ে দাঁড়াচ্ছে। তাদের আয়ের একটা বড় অংশ চলে যাচ্ছে চাল-ডাল-শাকসবজিসহ নিত্যপণ্য কিনতে। সরকার সবজিসহ নিত্যপণ্যের দাম সহনীয় মাত্রায় রাখতে কেউ যাতে অতি মুনাফার আশ্রয় না নেয়, সে বিষয়ে নজর দিতে পারে। পরিবহন চাঁদাবাজি বন্ধ করেও নিত্যপণ্যের দামের ক্ষেত্রে ইতিবাচক প্রভাব রাখা সম্ভব। দ্রব্যমূল্য নিয়ন্ত্রণে রাখা জনগণের কাছে সরকারের সুকীর্তি হিসেবে বিবেচিত হয়ে থাকে। সরকারের কাছ থেকে মানুষ যে দু’টি বিষয় প্রত্যাশা করে, তার একটি হলো আইনশৃঙ্খলার নিয়ন্ত্রণ, অন্যটি হচ্ছে দ্রব্যমূল্যের ঊর্ধ্বগতি রোধ। এ ব্যাপারে সরকার তাদের সাধ্যের মধ্যে সব কিছু করবে, জনগণ এটাই দেখতে চায়। কিন্তু দেশ পরিচালনায় সরকারের অযোগ্যতা, অদক্ষতা ও অবহেলার কারণে দেশে নজিরবিহীন পেঁয়াজ সঙ্কট দেখা দিয়েছে। শাসকদলীয় সিন্ডিকেটের কারণে শুধু পেঁয়াজ নয়, সব ধরনের নিত্যপ্রয়োজনীয় দ্রব্যমূল্যের ঊর্ধ্বগতি রোধ করা যাচ্ছে না।

দ্রব্যমূল্যের সাথে পাল্লা দিয়ে জীবন চালাতে গিয়ে সৎ ও সচ্ছল মানুষের জীবনে ত্রাহি অবস্থা। সাধারণ মানুষের ক্রয়ক্ষমতা যেমন সীমিত থাকে, তেমনি জিনিসপত্রের বাজারদর দ্বারাও তা নিয়ন্ত্রিত হয়। বিত্তবানদের জন্য দ্রব্যমূল্য প্রত্যক্ষভাবে কখনোই তেমন সমস্যা নয়। কারণ তাদের আয় প্রায় সীমাহীন। কিন্তু সাধারণ মানুষ যে আয় করে তা দিয়ে তাকে হিসাব করে চলতে হয়। মানুষের আয় যতটা বাড়ে সেই তুলনায় যদি জিনিসপত্রের দাম বেশি বৃদ্ধি পায় তাহলেই তার ক্রয়ক্ষমতা কমে যায়। এই ক্রয়ক্ষমতাই হলো তার ‘প্রকৃত আয়’। ‘প্রকৃত আয়’ বৃদ্ধি না পেয়ে যদি একই জায়গায় স্থির থাকে তাহলেই শুরু হয় আশাভঙ্গের নিদারুণ যন্ত্রণা। আর ‘প্রকৃত আয়’ কমে গেলে যে যন্ত্রণা- তার মাত্রার কোনো সীমা-পরিসীমা নেই। গণমানুষের আয়ের পরিমাণ ও বাজারদর- এ দুইয়ের মধ্যে যথাযথ সামঞ্জস্য বিধান করাটাই হলো, দ্রব্যমূল্য সমস্যা সমাধানের আসল উপায়। বাজার দর বৃদ্ধির তুলনায় আয় বাড়ল কি না, কিংবা উল্টো করে বললে, আয় বৃদ্ধির তুলনায় বাজার দর কম বাড়ল কি না- সেটিই দেখার বিষয়। চাল-ডাল-তেল-চিনির দাম যদি পাঁচ গুণ বাড়ে তাতে মানুষের কোনো যন্ত্রণাই তেমন থাকবে না যদি তাদের সবার আয় পাঁচ গুণের বেশি বৃদ্ধি পায়।

দ্রব্যমূল্যের ঊর্ধ্বগতির শিকার প্রধানত দেশের বিপুল সংখ্যাগরিষ্ঠ মানুষ- তথা শ্রমিক, ক্ষেতমজুর, কৃষক, পেশাজীবী, কারিগর, নির্দিষ্ট আয়ের কর্মচারী প্রমুখ। মেহনতি মানুষের মজুরি বাড়ে না, কৃষক ফসলের যুক্তিসঙ্গত দাম পায় না, কর্মচারীদের বেতন দ্রব্যমূল্যের সাথে সঙ্গতি রেখে বাড়ে না। কিন্তু জিনিসপত্রের দাম ক্রমাগতই বাড়তে থাকে এমনকি লাফিয়ে লাফিয়েও। ফলে সাধারণ মানুষের ক্রয়ক্ষমতা তথা ‘প্রকৃত আয়’ কমতে থাকে। শুরু হয় দ্রব্যমূল্য নিয়ে মানুষের যাতনা। ‘প্রকৃত আয়’ আগের অবস্থায় ফিরিয়ে আনতে চলে যায় অনেক মাস-বছর। ততদিনে নিত্যপ্রয়োজনীয় জিনিসপত্রের দাম বৃদ্ধি পেয়ে তার ‘প্রকৃত আয়’কে আবার পেছনে ফেলে দেয়। ফলে দ্রব্যমূল্যের যন্ত্রণা চলতে থাকে নিরন্তর। দ্রব্যমূল্যের ‘পাগলা ঘোড়া’র যন্ত্রণা থেকে নিস্তার পাওয়ার জন্য মানুষের ‘প্রকৃত আয়ের’ ধারাবাহিক বৃদ্ধি নিশ্চিত করতে হবে। এজন্য একসাথে নিতে হবে দুই দিক থেকে পদক্ষেপ। প্রথমত, ব্যাপক জনগণের ধারাবাহিক আয় বৃদ্ধি নিশ্চিত করার জন্য কার্যকর ব্যবস্থা গ্রহণ করতে হবে। দ্বিতীয়ত, পণ্য মূল্যবৃদ্ধির প্রবণতা কার্যকরভাবে নিয়ন্ত্রণ করতে হবে। মূল্য এমনভাবে নিয়ন্ত্রণ করতে হবে যেন তা স্থিতিশীল থাকে কিংবা বৃদ্ধি পেলেও তা যেন কখনোই আয় বৃদ্ধির সাধারণ হারের ঊর্ধ্বে না ওঠে।

আয় বাড়ানো ও দ্রব্যমূল্য নিয়ন্ত্রণ এই উভয় দিক থেকে গৃহীত এসব ব্যবস্থার মাধ্যমেই সাধারণ মানুষের ‘প্রকৃত আয়’ ও ক্রয়ক্ষমতা স্থিতিশীল রাখা এবং তা ধারাবাহিকভাবে বৃদ্ধি করা সম্ভব। কিন্তু এসব ব্যবস্থা নিতে হবে রাষ্ট্রকে এবং রাষ্ট্রের পক্ষ থেকে সরকারকে। সাথে সাথে, ব্যাপক জনগণ ও সমাজকে এসব ব্যবস্থা বাস্তবায়নের কাজে সম্পৃক্ত করতে হবে।

দ্রব্যমূল্যের ঊর্ধ্বগতি জনজীবনে অস্বস্তিকর অবস্থা সৃষ্টি করেছে। আমাদের সাধারণ মানুষের আয় দ্রব্যের মূল্যবৃদ্ধির সাথে সামঞ্জস্যপূর্ণ নয়। ফলে লাগামহীন মূল্যবৃদ্ধির কারণে দেশের বেশির ভাগ মানুষ বহু চাহিদা মেটাতে ব্যর্থ হন। ভারসাম্যপূর্ণ অবস্থা বজায় রাখতে অবিলম্বে দ্রব্যমূল্যের ঊর্ধ্বগতি প্রতিহত করতে হবে। দ্রব্যমূল্য স্থিতিশীল রাখতে সরকারকে অসাধু ব্যবসায়ী, মজুদদার ও কালোবাজারিদের বিরুদ্ধে দ্রুত কঠোর ব্যবস্থা নিতে হবে। তাহলেই মানুষ মূল্যবৃদ্ধির অভিশাপ ও দুর্ভোগ থেকে রক্ষা পাবে।

লেখক : মুক্তিযোদ্ধা ও রাজনীতিবিদ, প্রেসিডিয়াম সদস্য, এলডিপি


আরো সংবাদ



premium cement