০৭ মে ২০২৪, ২৪ বৈশাখ ১৪৩১, ২৭ শাওয়াল ১৪৪৫
`


দুর্নীতির বিরুদ্ধে জিরো টলারেন্স

দুর্নীতির বিরুদ্ধে জিরো টলারেন্স - সংগৃহীত

এবার আওয়ামী লীগের নির্বাচনী ইশতেহারে দলনেত্রী শেখ হাসিনা ‘দুর্নীতির বিরুদ্ধে জিরো টলারেন্স’ নীতি গ্রহণের ঘোষণা দিয়েছেন। তিনি বলেছেন, দুর্নীতি একটি বহুমাত্রিক ব্যাধি। পেশিশক্তির ব্যবহার ও অপরাধের শিকড় হচ্ছে দুর্নীতি। ফলে রাষ্ট্র ও সমাজ জীবনে অবক্ষয় বা পচন শুরু হয় এবং অর্থনীতি, রাজনীতি, শিক্ষা, স্বাস্থ্য ও প্রশাসনসহ কোনো ক্ষেত্রেই সঠিকভাবে লক্ষ্য অর্জন সম্ভব হয় না। দুর্নীতি দমনে রাজনৈতিক অঙ্গীকার আইনের প্রয়োগ মুখ্য হলেও মিডিয়া, এনজিও, সশীল সমাজ এবং জনগণেরও দায় রয়েছে। দুর্নীতি দমনে প্রয়োজন বা সমন্বিত পদক্ষেপ। প্রধানমন্ত্রী আরো বলেছেন, দুর্নীতি দমন কমিশনকে কর্মপরিবেশ ও দক্ষতার দিক থেকে আধুনিকায়ন করা হবে। দুর্নীতি দমনের ক্ষেত্রে আধুনিক তথ্য ও প্রযুক্তির সহজলভ্যতা এবং প্রায়োগিক ব্যবহারে সহযোগিতা করবে সরকার।

দুর্নীতিবাজরা দেশ ও জাতির শত্রু। রাষ্ট্রকে আগে চিহ্নিত করতে হবে কোথায়, কোন খাতে দুর্নীতি হচ্ছে বেশি। দেখা যায়, সরকারি সেবাধর্মী খাতে বেশি দুর্নীতি হয়ে থাকে। কিছু দিন আগে বিশ্ববিদ্যালয়ে শিক্ষক নিয়োগেও দুর্নীতির কথা জানা গেছে। সেবাধর্মী খাতগুলোতে লোকজনের সম্পৃক্ততা বেশি থাকে। তাই দুর্নীতিও হয় বেশি। সেখানে মাত্র এক বছরের দুর্নীতির অর্থ দিয়ে পদ্মা সেতু তৈরি করা সম্ভব। সেবা খাতে বছরে দুর্নীতি হচ্ছে প্রায় ৩০ হাজার কোটি টাকার। তার মধ্যে ঘুষ-দুর্নীতি ৯ হাজার কোটি টাকা। এটা বাজেটের ৩ দশমিক ৭ শতাংশ জিডিপির ০ দশমিক ৬ শতাংশ। উচ্চ আয়ের তুলনায় নিম্ন আয়ের মানুষের ক্ষেত্রে দুর্নীতি বেশি হয়ে থাকে। দীর্ঘমেয়াদি পরিকল্পনা গ্রহণ করলে দুর্নীতি অন্তত সহনশীল মাত্রায় আনা সম্ভব।

গোটা বিশ্বই এ সমস্যার মোকাবেলা করছে। হিসাব মতে, প্রতি বছর বিশ্বে দুই দশমিক ছয় ট্রিলিয়ন ডলার লুটপাট করা হয়। এর মধ্যে ঘুষ-দুর্নীতি এক ট্রিলিয়ন ডলার। বিশ্বময় দুর্নীতির বিরুদ্ধে প্রচার-প্রচারণার অন্ত নেই। তারপরও দুর্নীতিবাজেরা সাধারণত থাকে ধরাছোঁয়ার বাইরে। আমাদের দেশের বেশির ভাগ মানুষই দুর্নীতির বিরুদ্ধে। তবে বেশির ভাগ মানুষ দুর্নীতিবাজদের বিরুদ্ধে অভিযোগ করতে চায় না বা পারে না। এক জরিপে দেখা গেছে, মাত্র সাত দশমিক পাঁচ শতাংশ মানুষ দুদকে (দুর্নীতি দমন কমিশন) অভিযোগ দাখিল করে থাকেন। দুদক নিয়ে নানা অভিযোগ থাকলেও বলা চলে দুদকের প্রতি এখনো মানুষের অনেকটা আস্থা রয়েছে। সরকার দুদকের আইনি ক্ষমতা বৃদ্ধির লক্ষ্যে মামলা ছাড়াই দুর্নীতিবাজদের গ্রেফতার করতে পারবে- এ ক্ষমতা প্রতিষ্ঠানটিকে দিয়েছে। আগে, ঘুষ-দুর্নীতি থেকে দুদকের প্রত্যেক কর্মকর্তা-কর্মচারীকে মুক্ত হতে হবে। নতুবা এ আইনের অপব্যবহার হতে পারে। বাংলাদেশকে দুর্নীতিমুক্ত করতে দুর্নীতিমুক্ত দল চাই, দুর্নীতিমুক্ত নেতা চাই, দুর্নীতিমুক্ত সরকার এবং স্বাধীন দুর্নীতি দমন কমিশন চাই। সরকারি-আধা সরকারি অফিস থেকে দুর্নীতি দূর করতে পারলে জাতি দুর্নীতির অভিশাপ থেকে অনেকাংশেই মুক্তি পাবে। আইনের কড়াকড়ি অথবা গ্রেফতার করে সাময়িকভাবে দুর্নীতির বিরুদ্ধে সুফল পাওয়া যেতে পারে, স্থায়ী ভাবে নয়।

সুশাসন নিয়েও নানা প্রশ্ন রয়েছে। সুশীলসমাজ আর বিরোধী দলগুলোর পক্ষ থেকে সুশাসন নিয়ে নানা কথা বলা হয়। একটা কথা বলতে হয় যে, দীর্ঘস্থায়ী সুফল পেতে হলে কঠোর শাসনের পাশাপাশি দুর্নীতিবাজ কর্মকর্তা-কর্মচারীদের মধ্যে সামাজিক দায়বদ্ধতা ও বিবেক জাগ্রত করতে হবে। একটি বিষয় উল্লেখ করতে হয় যে, আমাদের জনসংখ্যার একটা অংশ, বিশেষ করে ধনিক শ্রেণী ব্যক্তি ও পরিবার গোষ্ঠী ও সম্প্রদায়ের স্বার্থে কাজ করে। সামগ্রিকভাবে দেশের মানুষের কথা ভাবে না। তাদের হাতে পুঞ্জীভূত সম্পদ দেশের মানুষ বা সম্প্রদায়ের স্বার্থে ব্যয় করা হয় না। ‘নিরাপত্তা’জনিত কারণে তারা দেশের সম্পদ বিদেশে পাচার করে থাকেন। তাদের প্রভাবে দেশের ব্যাংকিং সেক্টর আজ অস্থিতিশীল। অনেক সময় পুঁজি পাচার হয়ে যায়। আমাদের পুঁজিপতিরা যে অর্থ উপার্জন করেন, তা যদি গণমানুষের স্বার্থে ব্যয় করতেন তাহলে ব্যাংকিং সেক্টর এমন সঙ্কটের মুখে পড়ত না। বঙ্গবন্ধুর নেতৃত্বে মাত্র কিছুসংখ্যক মানুষের ভাগ্য পরিবর্তনের প্রয়োজনে বাংলাদেশ স্বাধীন হয়নি। কৃষক, শ্রমিক, দিনমজুর ও মেহনতি মানুষের মুক্তিই ছিল স্বাধীনতা সংগ্রামের মূল দর্শন।

দেশে আজ যে ধনিক শ্রেণী সৃষ্টি হয়েছে, তারা প্রধানত সাধারণ মানুষের স্বার্থের বিরুদ্ধে অবস্থান করছেন। এ দিকে উৎপাদিত ফসলের সুষম বণ্টন হচ্ছে না। সরকারের দৃষ্টি গরিব মানুষের দিকে বেশি থাকা চাই। কিন্তু শ্রেণিস্বার্থে সচেতন ধনিক শ্রেণী সম্পদ এককভাবে উপভোগ করতে চায়। গরিব-দুঃখী ও অসহায় মানুষের কল্যাণের কথা সবারই ভাবতে হবে। শোষকদের বিরুদ্ধে শক্ত অবস্থান নিতে না পারলে এবং তাদের স্বার্থে রাষ্ট্র পরিচালিত হলে গরিব-দুঃখী ও অসহায় মানুষের ভাগ্য পরিবর্তন সম্ভব নয়। জনগণের বিরাট অংশ মনে করে, শেখ হাসিনার সদিচ্ছার কোনো ঘাটতি নেই এবং নিষ্ঠার সাথে তিনি কঠোর পরিশ্রম করে যাচ্ছেন। কিন্তু শোষক শ্রেণীর বঞ্চনা থেকে জনগণকে মুক্ত করা সম্ভব হচ্ছে না। দুর্নীতি প্রকৃত উন্নয়নের প্রতিপক্ষ। দেশকে দুর্নীতিমুক্ত করতে না পারলে, উন্নয়ন তৎপরতার গতি থমকে যাবে। তাই, দুর্নীতির বিরুদ্ধে জিহাদ ঘোষণা করতে হবে। দুর্নীতি আজ সমাজের রন্ধ্রে রন্ধ্রে। আইনের প্রয়োগে কঠোরতা অবলম্বন ও সুশাসন নিশ্চিত করতে হবে। এমনকি সরকারি দলের দুর্নীতিবাজদের বিরুদ্ধেও কঠোর ব্যবস্থা নিতে হবে।
লেখক: বীর মুক্তিযোদ্ধা, সাবেক কর কমিশনার ও চেয়ারম্যান ন্যাশনাল এফএফ ফাউন্ডেশন।


আরো সংবাদ



premium cement