০৭ মে ২০২৪, ২৪ বৈশাখ ১৪৩১, ২৭ শাওয়াল ১৪৪৫
`


ভারত-চীন সীমান্ত বিতর্ক

শুধু বেইজিং নয়, অন্য প্রতিবেশীদের সাথেও দিল্লির সম্পর্কের অবনতি হচ্ছে

-

ভারতের গণমাধ্যমের একাংশ আর সামাজিক মাধ্যমে দুটো ঘটনার তুলনা টানছেন অনেকেই। ২০১৯-এর ২৬ ফেব্রুয়ারি আর ২০২০-র ৫ মে। প্রথম ঘটনাটি ছিল পাকিস্তানের বালাকোটে ভারতীয় বিমানবাহিনীর ‘সার্জিকাল স্ট্রাইক’ আর দ্বিতীয়টি যেদিন চীনা ফৌজ লাদাখের গালওয়ান উপত্যকা আর পাংগং হ্রদের ধারে ভারতীয় এলাকায় প্রবেশ করেছিল। দু’টি দিনের তুলনা টেনে বেশ কিছু সংবাদমাধ্যম লিখছে, যে প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদি এবং তার গোটা সরকার বালাকোট হামলার দিন উচ্চকিত হয়ে উঠেছিলেন; কিন্তু তারা চীনা বাহিনীর অগ্রসর হওয়া নিয়ে দীর্ঘ দিন চুপ করে থেকেছেন।
এখন প্রশ্ন উঠতে শুরু করেছে, ভারতের বিদেশ নীতি নিয়েই। কারণ যে সময়ে চীনের সাথে সংঘর্ষে অন্তত ২০ জন ভারতীয় সৈন্য নিহত হলেন সেই সময়েই বুধবার নেপালের পার্লামেন্টের উচ্চকক্ষ সে দেশের নতুন ম্যাপ সর্বসম্মতিক্রমে পাস হলোÑ যাতে ভারতের কিছুটা অংশও রয়েছে বলে নতুন দিল্লির অভিযোগ।
পাকিস্তানের সাথে ভারতের সম্পর্ক দীর্ঘ দিন ধরেই খারাপ, তা আর বলার অপেক্ষা রাখে না। চীনের সাথেও মতবিরোধ ছিলই। কিন্তু নেপালের মতো ভারতের বন্ধু রাষ্ট্রও এখন কঠোর অবস্থান নিচ্ছে।
এর আগে বাংলাদেশের তিনজন মন্ত্রী ভারত সফর বাতিল করেছিলেন এমন একটা সময়ে, যখন বাংলাদেশসহ প্রতিবেশী কয়েকটি দেশের সংখ্যালঘুদের নিজেদের নাগরিকত্ব দেয়ার জন্য নতুন আইন করেছিল ভারত। যদিও ওই আইন প্রসঙ্গে বাংলাদেশ বারেবারেই বলেছে যে আইনটি ভারতের অভ্যন্তরীণ বিষয়। এই ঘটনাগুলো থেকেই প্রশ্ন উঠছে যে কেন কয়েক বছর ধরে নিকটতম প্রতিবেশীদের সাথে ভারতের সম্পর্কের অবনতি হচ্ছে?
দিল্লির জওহরলাল নেহরু বিশ্ববিদ্যালয়ের অবসরপ্রাপ্ত অধ্যাপক অশ্বিনী রায় বলছিলেন, এই অঞ্চলের প্রতিটা দেশই বোঝে যে চীন-ভারত সম্পর্কের ওপরেই নির্ভর করছে, তারা নিজেরা কতটা স্বাতন্ত্র্য বজায় রাখতে পারবে। ‘নেপাল এই সুযোগটা আগে থেকেই নিয়েছে। এখন আরো বেশি করে সুযোগের সদ্বব্যবহার করছে,’ তিনি বলেন। তিনি বলছিলেন, গোটা দক্ষিণ এশিয়ায় চীনের বৈদেশিক সম্পর্ক ভারতের থেকে অনেক উন্নত। ‘তারা বেশ আগ্রাসী মনোভাব নিয়েই এই অঞ্চলে কাজ করে, তারই ফলে এখন দেখা যাচ্ছে নানা দেশের সাথে ভারতের সম্পর্কের ক্ষেত্রে। আমরা প্রকৃত অর্থেই নিজেদের জমি হারাচ্ছি,’ মি. রায় বলেন।
নেপালের সাথে বিবাদ : যখন এ রকম একটা চীন বিরোধী মনোভাব ভারতের সাধারণ মানুষের একাংশের মধ্যে দেখা যাচ্ছে, সেই সময়েই আরেক প্রতিবেশী নেপাল তাদের দেশের নতুন মানচিত্র পার্লামেন্টে পাস করিয়ে নিয়েছে, যাতে ভারতের কিছুটা অংশও রয়েছে বলে নতুন দিল্লির অভিযোগ। নেপালের মতে, নতুন মানচিত্রর ভিত্তি হচ্ছে ১৮১৬ সালের সুগাউলি চুক্তি। কিন্তু ভারত সেই দাবি নাকচ করে দিয়ে আসছে।
মে মাসের মাঝামাঝিতে বিতর্কিত ভূখণ্ড কালাপানি আর লিপুলেখকে নিজেদের মানচিত্রে অন্তর্ভুক্ত করার সিদ্ধান্ত গ্রহণ করে নেপালের সরকার। অথচ ভারতের সব থেকে বন্ধু রাষ্ট্র বলে মনে করা হয় যাদের, তাদের মধ্যে নেপাল অন্যতম। কিন্তু তারাও ভারতের সাথে একটা বিবাদে জড়িয়ে পড়েছে। ‘ভারত উচ্চাকাক্সক্ষী, তবে চীন অনেক বেশি আগ্রাসী,’ বলছেন যাদবপুর বিশ্ববিদ্যালয়ের আন্তর্জাতিক সম্পর্ক বিভাগের অধ্যাপক কাকলি সেনগুপ্ত। ‘যদি নেপালের নতুন মানচিত্র প্রকাশের ঘটনাটা দেখি, সেখানেও চীনের প্রভাব কাজ করে থাকতে পারে,’ তিনি বলেন।
বিশ্লেষকরা যেমন এক দিকে চীনের উচ্চাকাক্সক্ষা এবং দক্ষিণ এশিয়া অঞ্চলে তাদের প্রভাব বিস্তারে সচেষ্ট হওয়ার কথা বলছেন, তেমনই ভারতের অভ্যন্তরীণ রাজনীতিকেও দোষ দিচ্ছেন নিকটতম প্রতিবেশীদের সাথে ভারতের সম্পর্কের অবনতির জন্য। জওহরলাল নেহরু বিশ্ববিদ্যালয়ের অবসরপ্রাপ্ত অধ্যাপক ও দক্ষিণ এশিয়া বিশেষজ্ঞ পার্থসারথি ঘোষ বলছিলেন, প্রধানমন্ত্রী হওয়ার আগে বিদেশ নীতি নিয়ে নরেন্দ্র মোদির খুব একটা বক্তব্য বা দূরদৃষ্টি লক্ষ্য করা যায়নি। তিনি ২০১৪-র আগে বহুবার বিদেশ ভ্রমণ করেছেন; কিন্তু সেসবই ছিল তার সংগঠনের প্রচারের জন্য, হিন্দুত্ববাদের প্রচারের জন্য, তিনি বলেন। তিনি আরো বলছেন যে নির্বাচনে জয়ী হওয়ার পরেও মি. মোদি বিদেশ নীতি সংক্রান্ত যা করেছেন, তারও বেশির ভাগটাই প্রচারসর্বস্ব।
‘তার শপথ গ্রহণ অনুষ্ঠানে সব সার্ক দেশগুলোর প্রধানদের আহ্বান জানালেন, নওয়াজ শরিফও এলেন। কিন্তু কাজের কথা কিছু এগুলো না।’ তারপর থেকে তিনি যতবারই বিদেশ সফরে গেছেন, সেগুলো যত না সেই সব দেশের সাথে সম্পর্ক ভালো করার জন্য, তার থেকে বেশি নিজের দেশের মানুষের কাছে প্রচারের উদ্দেশে করা হয়েছিল বলেই আমার মনে হয়,’ বলছিলেন মি. ঘোষ।
এই সরকারের আমলেই বিশ্বের নানা রাষ্ট্রনেতার সাথে বহু বৈঠক হয়েছে। প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদি চীন, পাকিস্তান, বাংলাদেশ, নেপালসহ পৃথিবীর নানা দেশে গেছেনÑ আলোচনা হয়েছে, চুক্তি হয়েছে। মি. মোদি প্রধানমন্ত্রী হিসেবে চীন সফর করেছেন পাঁচবার এবং ২০১৪ সালে ক্ষমতা গ্রহণের পর চীনা নেতার সাথে বিভিন্ন বিষয়ে তার বৈঠক হয়েছে অন্তত ১৮ বার। কিন্তু নিকটতম প্রতিবেশীদের কাছে কি ভারতের সম্পর্কে একটা নেতিবাচক বার্তা যাচ্ছে, দেশের ভেতরে উগ্র জাতীয়বাদী মনোভাব উত্তরোত্তর বৃদ্ধি পাওয়ার ফলে?
যাদবপুর বিশ্ববিদ্যালয়ের আন্তর্জাতিক সম্পর্ক বিভাগের অধ্যাপক ইমন কল্যাণ লাহিড়ীর কথায়, ‘যেসব আইন নানা সময়ে ভারতে পাস করা হচ্ছে, সেগুলো প্রতিবেশী রাষ্ট্রগুলো ভালোভাবে নিচ্ছে না। আজকে বিশ্বায়নের যুগে উগ্র জাতীয়তাবাদ কিন্তু কখনই কাম্য নয়। ‘আর ভারতের কাছে প্রতিবেশীরা এটা আশাও করে না। ভারত একটা সময়ে জোটনিরপেক্ষ আন্দোলনে ছিল, বর্ণবৈষম্যের বিরুদ্ধে লড়াই করেছেÑ সে রকম একটা দেশের কাছে প্রতিবেশীরা এ ধরনের উগ্র জাতীয়তাবাদী আইন আশা করে না,’ বলেন ইমন কল্যাণ লাহিড়ী।
অনেক বিশ্লেষক বলছেন প্রতিটা দেশের সাথে পৃথকভাবে আলোচনা চালাতে হবে ভারতকে। আর ভারতের সাধারণ মানুষ আর রাজনৈতিক নেতাদের একাংশ যে ‘যুদ্ধংদেহি’ মনোভাব নিয়ে চলতে শুরু করেছেন, ভারতকে সেই সামরিক সমাধানের পথে না হেঁটে কাজে লাগাতে হবে কূটনীতিকে।


আরো সংবাদ



premium cement