২৯ এপ্রিল ২০২৪, ১৬ বৈশাখ ১৪৩১, ১৯ শাওয়াল ১৪৪৫
`


সাদা ফুলের কালো সোনায় পাবনার চাষিদের ভাগ্যবদল

পাবনা জেলায় কালো সোনা খ্যাত পেঁয়াজ বীজের আশাতীত ফলনের সম্ভাবনা : নয়া দিগন্ত -

ফসলের মাঠে গেলে আপনার চোখ আটকে যাবে এক নয়নাভিরাম দৃশ্যের দিকে। সবুজ লম্বা ডগার আগায় থোকা থোকা সাদা ফুলের বৃত্তাকার মঞ্জরি। অসংখ্য মৌমাছির গুঞ্জরণের মিছিল। এমন দৃশ্য নজর কাড়ে সবার। পাবনার মাঠে মাঠে এখন পেঁয়াজবীজ গাছের ফুলের এমন দৃশ্য সবার অতি পরিচিত। পেঁয়াজবীজ আবাদ করে এ অঞ্চলের প্রায় আড়াই হাজার কৃষক পরিবার অভাব জয় করেছেন। ভারতীয় বীজের ওপর নির্ভরতা কমাতে অসামান্য অবদান রাখছেন তারা। পেঁয়াজ রোপণ মওসুমে প্রতি কেজি বীজ বিক্রি হয় আড়াই থেকে তিন হাজার টাকা। ‘কালো সোনা’ খ্যাত পেঁয়াজবীজ চাষ লাভজনক হওয়ায় দিনদিন এ বীজ চাষে ঝুঁকছেন কৃষকেরা।

জানা গেছে, পাবনা জেলায় পেঁয়াজের আবাদ বৃদ্ধির সাথে সাথে পেঁয়াজবীজ আবাদের পরিমাণ দিনদিন বৃদ্ধি পাচ্ছে। স্থানীয়ভাবে পেঁয়াজ সংরক্ষণের কোন ব্যবস্থা না থাকায় ও ন্যায্যমূল্য না পাওয়ায় কৃষক বীজ উৎপাদনের দিকে নজর দেন। পেঁয়াজের দাম কম হলেও বীজের বাজার সব সময় চড়া থাকে। পাঁচ-সাত বছর আগেও এ অঞ্চলে হাতেগোনা কয়েকজন কৃষক পরীক্ষামূলকভাবে পেঁয়াজ বীজের চাষ করেন। এখন অবস্থা ভিন্ন। বাজারে ব্যাপক চাহিদা ও লাভজনক হওয়ায় পেঁয়াজ বীজ চাষ বাড়ছে। এ অঞ্চলের প্রায় আড়াই হাজার কৃষক পেঁয়াজ বীজ উৎপাদন করে ভাগ্য পরিবর্তন করেছেন।
সাঁথিয়ার চাষি হায়দার আলী বলেন, বীজ উৎপাদন জমি চাষ, সার, বালাইনাশক, সেচ, শ্রমিক খরচ সব মিলিয়ে এক বিঘা জমিতে প্রায় ৫০ হাজার টাকা খরচ হয়। প্রাকৃতিক দুর্যোগ না ঘটলে বিঘা প্রতি প্রায় ১০০ কেজি পেঁয়াজ বীজ পাবেন। বাজারে প্রতি কেজি পেঁয়াজ বীজের দাম দুই হাজার টাকা। সে দেড় বিঘা জমির পেঁয়াজ বীজ থেকে খরচ বাদে প্রায় দুই লাখ টাকা আয় করবেন বলে আশা করছেন। তিনি বলেন, কোনো কোনো বছর প্রতি কেজি পেঁয়াজ বীজের দাম পাঁচ হাজার টাকা পর্যন্ত হয়ে যায়। তখন বেশি লাভ হয়।

জানা যায়, দেশে পেঁয়াজের বার্ষিক চাহিদা ১৯ লাখ টন। সেখানে উৎপাদন হয় মাত্র ১২ লাখ টন। ঘাটতি থাকে সাত লাখ টন। এই পেঁয়াজ বিদেশ থেকে আমদানি করা হয়। পেঁয়াজ আবাদের মাত্র ৩০ শতাংশ বীজ দেশে উৎপন্ন হয়। বীজের অভাব ও চড়া মূল্যের কারণে প্রতি বছর অনেক কৃষক ইচ্ছা থাকা সত্ত্বেও পেঁয়াজ আবাদ করতে পারেন না। পাবনা জেলার মাটি ও আবহাওয়া পেঁয়াজবীজ উৎপাদনের উপযোগী। ফলে দেশের মধ্যে পাবনার বীজ উৎকৃষ্টমানের। পাবনার চাষিদের উৎপাদিত পেঁয়াজবীজ দেশের চাহিদা পূরণে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রাখছে।

পাবনা কৃষি সম্প্রসারণ অধিদফতর সূত্রে জানা যায়, চলতি রবি মওসুমে জেলায় ৫২ হাজার হেক্টর জমিতে মুড়িকাটা, হালি ও বীজ পেঁয়াজ উৎপাদনের লক্ষ্যমাত্রা ধরা হয়েছে সাড়ে সাত লাখ টন। সারা দেশের মধ্যে পেঁয়াজ উৎপাদনে পাবনা জেলা প্রথম। এবার পেঁয়াজের দানা (বীজ) বিক্রি হয় বেশি দামে। গত বছর প্রতি কেজি বীজ বিক্রি হয়েছিল আড়াই হাজার টাকা দরে। এবার বিক্রি হয়েছে প্রতি কেজি চার হাজার থেকে চার হাজার ৫০০ টাকা দরে।

এখন পর্যন্ত বিরূপ আবহাওয়া বা প্রাকৃতিক দুর্যোগ না হওয়ায় মাঠে মাঠে পেঁয়াজ গাছে ফুলের অবস্থা খুবই ভাল। কৃষকেরা মাঠ থেকে পুরোপুরি পেঁয়াজবীজ সংগ্রহ শুরু করেছেন। প্রতি একরে গড় ফলন হবে আট থেকে ৯ মণ বীজ বলে আশা করছেন কৃষকেরা। বাজার দর স্বাভাবিক থাকলে প্রতি মণ বীজ বিক্রি হবে এক লাখ ৬০ হাজার টাকা। সেই হিসাবে প্রতি একরে আট মণ বীজের মূল্য প্রায় ১২ লাখ ৮০ হাজার টাকা।

এসব পেঁয়াজবীজ দেশের বিভিন্ন এলাকা থেকে মহাজন ও পাইকারি ব্যবসায়ীরা এসে কেজি দরে কিনে নিয়ে যান। এসব বীজ উচ্চমূল্যে ভারতে পাচার হয়। গত বছর বীজের কেজি ছিল তিন-চার হাজার টাকা। বর্তমানে বাজার দর দুই থেকে আড়াই হাজার টাকা। এলাকাভিত্তিক এ দাম আরো বেড়ে যায়। এ এলাকার উৎপাদিত বীজের চাহিদা দেশের সর্বত্র।
সাঁথিয়া উপজেলার মন্মথপুর গ্রামের পেঁয়াজবীজ চাষি আনোয়ার হোসেন জানান, গত বছর ৬০ শতাংশ জমিতে পেঁয়াজবীজ চাষ করে পাঁচ মণ বীজ পেয়েছিলেন। প্রতি কেজি বীজ আড়াই হাজার থেকে তিন হাজার টাকা দরে বিক্রি করেছিলেন। এ বছর তিনি এক একর জমিতে পেঁয়াজ বীজ আবাদ করেছেন।

সুজানগর উপজেলার বিলগাজনা গ্রামের পেঁয়াজবীজ চাষি সন্তোষ মণ্ডল ও রফিক মোল্লা জানান, পেঁয়াজের দানা উৎপাদন অতি লাভজনক হলেও ঝুঁকিও রয়েছে। প্রাকৃতিক দুর্যোগ না হলে একজন কৃষক এক মওসুমেই ধনী হতে পারেন। প্রতি একর জমিতে বীজ উৎপাদন করতে ৭৫ হাজার টাকার বেশি খরচ পড়ে। যা প্রান্তিক বা গরিব চাষিদের পক্ষে জোগান দেয়া সম্ভব নয়।

পাবনা কৃষি বিভাগ সূত্রে জানা যায়, পেঁয়াজের বীজ উৎপাদনে কৃষকদের নানাভাবে উদ্বুদ্ধ করছে কৃষি বিভাগ। লাভজনক হওয়ায় দিনদিন পেঁয়াজ বীজের চাষ ব্যাপক হারে ছড়িয়ে পড়ছে। চলতি মওসুমে ২০০ হেক্টর জমিতে প্রায় ২০ টন পেঁয়াজবীজ উৎপাদন হবে। যার বর্তমান বাজারমূল্য প্রায় আট কোটি টাকা। বিভিন্ন বাণিজ্যিক ব্যাংক যদি ঋণ সহায়তা দেয় তাহলে এ অঞ্চলের চাষিরা আরো বেশি বীজ উৎপাদন করতে পারবে বলে সূত্র জানিয়েছে।


আরো সংবাদ



premium cement