০৮ মে ২০২৪, ২৫ বৈশাখ ১৪৩১, ২৮ শাওয়াল ১৪৪৫
`


করোনায় মলিন গোলাপের হাসি

-

গোলাপ আর গোলাপ। সারি সারি গাছে ফুটে আছে হাজারো গোলাপ। যতদূর দৃষ্টি যায় চার দিকে শুধুই গোলাপ। দূর থেকে মনে হয় যেন এটা গোলাপের কোনো সাগর। তবে ক্রেতা নেই। করোনার কারণে বাগানেই নষ্ট হচ্ছে সব ফুল। এবার ঈদের আনন্দের কিঞ্চিত ছোঁয়াও লাগেনি সাভারের গোলাপের গ্রামে। প্রিয়জনদের হাতে কিংবা ড্রয়িংরুমে শোভাবর্ধনের পরিবর্তে এই গোলাপ এখন বাগানেই ঝরে পড়ছে।
গোলাপ গ্রাম হিসেবে খ্যাত ঢাকার অদূরে সাভার উপজেলার ১৪-১৫টি গ্রামেই বাণিজ্যিকভাবে চাষ হয় গোলাপের। কিন্তু করোনার কারণে গত দুই মাসেরও বেশি সময় ধরে গোলাপের কোনো ক্রেতাই এই গ্রামে আসছে না। গ্রামের বাইরে ঢাকায় কিংবা অন্য কোথাও নিয়ে গিয়েও বিক্রি করা যাচ্ছে না গোলাপ। করোনার কারণে সাভারে গোলাপ গ্রামের হাসিও আজ মলিন হয়ে গেছে।
একে তো সব ধরনের পরিবহন বন্ধ তারপরে আবার বন্ধ রয়েছে সব ধরনের সামাজিক, পারিবারিক কিংবা সাংস্কৃতিক অনুষ্ঠান। দীর্ঘ দিন বন্ধ বিনোদন কেন্দ্র, খুলছে না দোকানপাটও। করোনার কারণে বন্ধ বিয়েশাদীর মতো পারিবারিক অনুষ্ঠানও। ফলে বাগানের গোলাপ বাগানেই পচে নষ্ট হচ্ছে। আর্থিক সঙ্কটের কারণে অনেক বাগান মালিক তাদের বাগানের পরিচর্যাও বন্ধ করে দিয়েছেন। সরেজমিন বাগানে গিয়ে দেখা গেছে শুধু ফুল নয়, গোলাপ গ্রামের অনেক বাগানও নষ্ট হয়ে যাচ্ছে।
গোলাপ বাগান মালিকরা জানান, আমাদের এখানে প্রতিটি পরিবারের একাধিক গোলাপ বাগান আছে। আমাদের আয়ের একমাত্র উৎসই হলো এই গোলাপ বিক্রি। কিন্তু করোনার কারণে গত দুই মাস ধরেই আমরা কষ্টে আছি। অনেকের বাগান নষ্ট হয়ে গেছে। যাদের বাগান নষ্ট হয়ে গেছে তাদের তো পথে বসা ছাড়া আর কোনো উপায় নেই। কারণ পরিবারের সব পুঁজি তারা এই গোলাপ বাগানেই বিনিয়োগ করেছেন। এখন যদি সরকারিভাবে এই গোলাপচাষিদের জন্য আর্থিক প্রণোদনার ব্যবস্থা করেন তাহলেই বেঁচে যাবে গোলাপ গ্রামের অনেক পরিবার। সরকারের কাছে তারা এ বিষয়ে দৃষ্টি দেয়ারও দাবি জানিয়েছেন।
গোলাপচাষি মো: আব্দুল বারেক নয়া দিগন্তের এই প্রতিবেদককে জানান, আমাদের সব শেষ হয়ে গেছে। লাখ লাখ টাকা বিনিয়োগে গড়ে তোলা আমাদের চাষিদের অধিকাংশ গোলাপ বাগানই নষ্ট হয়ে গেছে। এখন আমাদের পথে বসা ছাড়া আর কোনো উপায় নেই। এই ক্ষতি আগামী পাঁচ বছরেও কাটিয়ে উঠতে পারব কি না সন্দেহ রয়েছে।
স্থানীয়রা জানান, রাজধানীর মিরপুরের বেড়িবাঁধের পশ্চিম দিকে তুরাগ নদীর কূলঘেঁষে এই এলাকার ১৪-১৫টি গ্রামের শতকরা ৮০ শতাংশ জমিতেই গোলাপের চাষ হয়। বাড়ির পাশের জমি এমনকি উঠানে অনেকে গোলাপের চাষ করে পরিবারের ব্যয় নির্বাহ করেন। তারা সবাই এখন বেকার। আশপাশের যেসব গ্রামে গোলাপের চাষ হয় সেগুলোর মধ্যে শ্যামপুর, মৈস্তাপাড়া, নয়াপাড়া, সাদুল্লাপুর, বনগ্রাম, কমলাপুর, মিকরাইল, বাগনীপাড়া, কালিয়াকৈর, আকরাইন, বাটুলিয়া গ্রামেই বেশি গোলাপের চাষ হয়। এসব গ্রামের হাজার হাজার মানুষ এখন বেকার হয়ে অসহায় জীবন যাপন করছেন।
সাদুল্লাপুরের রাস্তার পাশে টং দোকানে ফুল বিক্রি করতেন নজরুল ইসলাম। তিনি জানান, আমি নিজেও দুই মাস ধরে বেকার। আগে প্রতিদিন ফুল বিক্রি করেই ৫০০-৬০০ টাকা আয় করতাম। আগে ছুটির দিনে রাজধানীসহ দেশের বিভিন্ন এলাকা থেকে দলবেঁধে লোকজন পিকনিক কিংবা পারিবারিক বিনোদনের জন্য আসতো এই গোলাম গ্রামে। কিন্তু এখন পুরো গ্রামজুড়ে শুধুই হাহাকার। ক্রেতা নেই, দর্শনার্থীও নেই।
ঈদের ছুটিতে ব্যক্তিগত বাড়িতে গোলাপ গ্রামে পরিবার নিয়ে বেড়াতে এসেছেন আমার মা ফাউন্ডেশনের প্রতিষ্ঠাতা চেয়ারম্যান জি এম কামরুল হাসান। তিনি নয়া দিগন্তকে জানান, আগেও আমি এই গ্রামে বেড়াতে এসেছি। কিন্তু এবার ঈদেও দেখছি গোলাপ চাষিদের মুখে আগের সেই হাসি আনন্দ নেই। সবার মুখই কেমন যেন মলিন হয়ে গেছে। বাগানের আগের সেই জৌলুসও নেই। পরিচর্চার অভাবে অনেক ফুল বাগানেই ঝরে পড়ছে। সবাই কেমন যেন আতঙ্কের মধ্যে রয়েছেন। আগে এখানে ১০০ গোলাপ ফুল বিক্রি হতো দুইশ থেকে আড়াই শ’ টাকায়। আর এখন এক শ’ ফুল বিক্রি হচ্ছে মাত্র ৮০ থেকে এক শ’ টাকায়। তারপরেও ক্রেতা নেই। অনেক চাষি বাগান থেকে ফুল সংগ্রহ করার খরচও তুলতে পারছেন না।


আরো সংবাদ



premium cement