১৯ মে ২০২৪, ০৫ জৈষ্ঠ ১৪৩১, ১০ জিলকদ ১৪৪৫
`


আমদানির ৫ বিলিয়ন ডলার দায় শোধ করতে পারছে না বাংলাদেশ

-

- বাংলাদেশ ব্যাংকে ‘ডাল মে কুচ কালা হে’ : ড. দেবপ্রিয় ভট্টাচার্য
- তথ্যের অপঘাতে বাংলাদেশ ব্যাংকের সুনামের হানি হচ্ছে

সাম্প্রতিক সময়ে বিদেশ থেকে তেল আমদানি করে অর্থ পরিশোধ করা সম্ভব হচ্ছে না উল্লেখ করে বিশিষ্ট অর্থনীতিবিদ ড. দেবপ্রিয় ভট্টাচার্য বলেছেন, ‘বাংলাদেশ এতদিন গর্বের সঙ্গে দাবি করতো যে দেনা পরিশোধে কখনো খেলাপি হয়নি। সে দাবি এখন আর থাকছে না। ঋণ পরিশোধ করতে চাপ সৃষ্টি করা হচ্ছে। জ্বালানির বিল, বৈদেশিক কোম্পানির মুনাফা, বিদেশী এয়ারলাইন্সের পাওনাসহ বিভিন্ন ক্ষেত্রে ৫ বিলিয়ন ডলার যথাসময়ে পরিশোধ করা সম্ভব হয়নি।’
এসব তথ্য-উপাত্ত বাংলাদেশ ব্যাংক দেয় উল্লেখ করে তিনি আরো বলেন, সেখানে সাংবাদিকদের প্রবেশ নিষেধ। তার মানে সেখানে ‘ডাল মে কুচ কালা হে’। এখন এটা কি মসুর ডাল নাকি মুগ ডাল নাথকি সব জায়গাতেই ডাল- এটাই এখন বোঝার বিষয়।
বর্তমানে সাংবাদিক ও জনপ্রতিনিধিরা তথ্য পাচ্ছেন না, পাচ্ছেন ব্যবসায়িরা- এই মন্তব্য করে বেসরকারি গবেষণা প্রতিষ্ঠান সিপিডির বিশেষ ফেলো ড. দেবপ্রিয় আরো বলেন, এতদিন তথ্যের নৈরাজ্য চলছিল, এখন অপঘাত ঘটছে। বাংলাদেশ ব্যাংকে সাংবাদিক প্রবেশ করতে দিচ্ছে না। তা কী বার্তা দিচ্ছে। এখন ওখানে এমন কিছু ঘটছে তা যদি জনসমক্ষে প্রকাশ পায় তাহলে বড় ধরনের ‘নাশকতা’ হয়ে যাবে। এই নাশকতাকারীরা হচ্ছে বাংলাদেশের অর্থনৈতিক সাংবাদিকরা!
গতকাল মঙ্গলবার রাজধানীর পল্টনে ইকোনমিক রিপোর্টার্স ফোরামের (ইআরএফ) প্রতিষ্ঠাতা সভাপতি মোয়াজ্জেম হোসেনের স্মরণে ‘মোয়াজ্জেম হোসেন স্মারক বক্তৃতা’ অনুষ্ঠানে প্রধান বক্তা হিসেবে বক্তব্য রাখেন ড. দেবপ্রিয়। তিনি দেশের সমসাময়িক অর্থনৈতিক পরিস্থিতি, ব্যাংকিং খাতসহ সামগ্রিক আর্থিক খাতের বর্তমান পরিস্থিতি তুলে ধরেন।

ইআরএফ-এর সাধারণ সম্পাদক আবুল কাশেমের সঞ্চালনায় অনুষ্ঠানে বিশেষ অতিথি হিসেবে অংশ নেন সংগঠনটির প্রতিষ্ঠাকালীন আহ্বায়ক ও ইংরেজি দৈনিক দ্য ফাইন্যান্সিয়াল এক্সপ্রেসের সম্পাদক শামসুল হক জাহিদ এবং ইআরএফ সভাপতি রেফায়েত উল্লাহ মীরধা।
তথ্য লুকাতে বাংলাদেশ ব্যাংক সেখানে সাংবাদিক প্রবেশ করতে দিচ্ছে না উল্লেখ করে দেবপ্রিয় ভট্টাচার্য বলেন, আমাদের একটা গর্ব ছিল, বিদেশী ঋণ নিয়ে আমরা কখনো খেলাপি হইনি। কিন্তু সাম্প্রতিক সময়ে তেল আমদানি করে আমরা অর্থ পরিশোধ করতে পারছি না। দেশে ব্যবসা করা বিদেশীরা মুনাফা নিতে পারছে না। এয়ারলাইন্স ব্যবসায়ীরা অর্থ পাচ্ছে না। তার মানে গর্বের জায়গায় ফাটল ধরিয়ে দিয়েছে। এসব তথ্য-উপাত্ত বাংলাদেশ ব্যাংক দেয়। সেখানে প্রবেশ নিষেধ। দেশ এখন এলডিসি থেকে উন্নয়নশীল দেশের দিকে যাচ্ছে। সরকার ডিজিটাল ও স্মার্ট বাংলাদেশ বলছে। এই সময় ‘তথ্যের নৈরাজ্য’ সম্পূর্ণভাবে সাংঘর্ষিক বলে মন্তব্য করেন সিপিডির এ সম্মানীয় ফেলো।

একদিকে তথ্য লুকিয়ে রাখা হবে, আরেক দিকে ডিজিটাল বাংলাদেশ ও স্মার্ট বাংলাদেশ গড়ার চিন্তা করা হবে, এ দুটি সাংঘর্ষিক বলে মনে করেন দেবপ্রিয় ভট্টাচার্য।
দেবপ্রিয় ভট্টাচার্য অভিযোগ করে বলেন, জনপ্রতিনিধি ও সাংবাদিকরা তথ্য পাচ্ছেন না; কিন্তু ব্যবসায়ীরা পাচ্ছেন। ব্যবসায়ীদের তথ্য দেয়া হলে বাজারে প্রভাব পড়ে, জিনিসপত্রের দাম বেড়ে যায়।
তথ্যের অপঘাতে বাংলাদেশ ব্যাংকের সুনামের হানি হচ্ছে উল্লেখ করে দেবপ্রিয় বলেন, ‘তথ্য-উপাত্তের বড় উৎস বাংলাদেশ ব্যাংক। বাংলাদেশ পরিসংখ্যান ব্যুরোর (বিবিএস) তথ্যের আগে রফতানি-আমদানিসহ আর্থিক সূচকের জন্য কেন্দ্রীয় ব্যাংকের তথ্যের ওপর নির্ভরশীল ছিলাম আমরা। কিন্তু এখন দেখা যাচ্ছে, তথ্য কেউ পাচ্ছে, কেউ পাচ্ছে না; ব্যবসায়ীরা তথ্য পাচ্ছে অথচ সাংবাদিকরা পাচ্ছে না।’
দেশের নীতি নেতৃত্ব দুর্বল হয়ে গেছে মনে করে তিনি বলেন, নীতি ব্যাখ্যা করার জন্য কাউকে পাওয়া যায় না। দেশে নীতি সমন্বয়ের অভাব আছে, এ সমন্বয়হীনতা মোকাবেলা করার ক্ষেত্রে রাজনৈতিক শক্তির দুর্বলতা আছে। কেন্দ্রীয় ব্যাংক নির্দেশনা দেয়ার পরও একটি ব্যাংকের মালিকানা বদল হয়ে গেল কেন- প্রশ্ন রাখেন দেবপ্রিয়।

বর্তমান অর্থনীতি পরিস্থিতি নিয়ে তিনি বলেন ‘মুদ্রানীতি ও আর্থিকনীতি সমন্বয় করার ক্ষেত্রে ব্যবস্থাপনাগত দুর্বলতা রয়েছে। এটা দূর করতে হবে। একইভাবে মুদ্রার বিনিময় হার ও সুদহারেও নমনীয়তা আনতে হবে।’
ড. দেবপ্রিয় ভট্টাচার্য বলেন, ‘এখন শোনা যাচ্ছে রেমিট্যান্সের টাকা দিয়ে স্থানীয় শিল্প মালিকরা বিদেশে শিল্পের কাঁচামাল কিনছেন। এভাবে ২ বা ৩ শতাংশ প্রণোদনা দিয়ে রেমিট্যান্স বাড়ানো যাবে না। এ ক্ষেত্রে আরো নমনীয় হতে হবে। সুদহারেও নমনীয়তা আনতে হবে। মুদ্রানীতি ও আর্থিকনীতি সমন্বয় করার ক্ষেত্রে ব্যবস্থাপনাগত দুর্বলতা রয়েছে, সেটা দূর করতে হবে অর্থনীতির স্বার্থে।’
তিনি বলেন, ‘দেশের সামগ্রিক অর্থনীতিতে চারটি ঘাটতি রয়েছে। ফলে জিডিপির আনুপাতিক হারে রাজস্ব আয়, স্বাস্থ্য, শিক্ষাসহ সামাজিক খাতে বিনিয়োগ বাড়ানো যাচ্ছে না। মোট দেশজ উৎপাদনের (জিডিপি) প্রবৃদ্ধি হচ্ছে এক ইঞ্জিনবিশিষ্ট বোয়িংয়ের চলার মতো। সরকারের বিনিয়োগ থেকে প্রবৃদ্ধি হচ্ছে কিন্তু বেসরকারি বিনিয়োগ বাড়ছে না। আমাদের দ্বিতীয় ঘাটতি হলো রাজস্ব আয়ে। জিডিপি বাড়লেও আনুপাতিক হারে রাজস্ব আয় বাড়ানো যাচ্ছে না। আবার বিনিয়োগ বাড়ানো যাচ্ছে না স্বাস্থ্য, শিক্ষাসহ সামাজিক খাতে। অতিমূল্যায়িত প্রকল্প গলার কাঁটা হয়ে দাঁড়াচ্ছে।’
সাংবাদিক মোয়াজ্জেম হোসেন স্মরণে তিনি বলেন, ইংরেজি দৈনিক ফিন্যান্সিয়াল এক্সপ্রেসের সদ্যপ্রয়াত সম্পাদক এএইচএম মোয়াজ্জেম হোসেন পুরোপুরি পেশাদার ও পরিশুদ্ধ সাংবাদিক ছিলেন। সততা, নৈতিকতার সঙ্গে পুরোপুরি পক্ষপাতহীনভাবে সবসময় দায়িত্ব পালন করেছেন। অর্থনীতির সাংবাদিকতার পুরোধা ছিলেন তিনি।

 


আরো সংবাদ



premium cement