২৭ এপ্রিল ২০২৪, ১৪ বৈশাখ ১৪৩১, ১৭ শাওয়াল ১৪৪৫
`

চোখের ছানি অপারেশন

-

চোখের ছানি বিষয়ে আমরা অনেকেই অবগত। চোখে এক ধরনের স্বচ্ছ লেন্স আছে, যা প্রাকৃতিক উপাদানে তৈরি, যা চশমার গ্লাস বা লেন্সের মতোই আমাদের দেখতে সাহায্য করে। এটি এক ধরনের উভতল বা কনভেক্স লেন্স। চোখের অভ্যন্তরভাগে সামনের অংশে এই লেন্সটির অবস্থান। এই স্বচ্ছ লেন্সের কাজ হলো আলোকরশ্মি যখন চোখের ভেতরে আপতিত হয় তখন আপতিত আলোকরশ্মিকে নিয়ন্ত্রণ করে চোখের পেছনে অবস্থিত সংবেদনশীল পর্দা বা রেটিনার কোনো বিন্দুতে মিলিত হতে সাহায্য করা। ফলে রেটিনার স্নায়ু উজ্জীবিত হয় এবং মস্তিষ্কে এক ধরনের সঙ্কেত পাঠায়। ফলে আমরা দেখতে পারি। কোনো কারণে যদি প্রাকৃতিক এই লেন্সটি তার স্বচ্ছতা হারিয়ে ফেলে অর্থাৎ ঘোলা হয়ে যায় তবে আলোকরশ্মি চোখের ভেতরে প্রবেশে বাধাপ্রাপ্ত হয়। ফলে দেখার কাজটি বিঘিœত হয়। লেন্সের এই ঘোলা অবস্থাটিকে বলা হয় ক্যাটারেক্ট বা ছানি।
বিভিন্ন কারণে ছানি পড়তে পারে। তার মধ্যে অন্যতম হলোÑ বয়সজনিত ছানি। বয়স হলে স্বাভবিক নিয়মেই ছানি পড়ে। এ ছাড়াও আঘাতজনিত কারণে, জন্মগত ত্রুটি, চোখের প্রদাহ, বিভিন্ন ধরনের রেডিয়েশন বা মাইক্রো/মেক্রোওয়েভ রেডিয়েশন, ডায়াবেটিস ও অন্যান্য মেটাবলিক ডিসঅর্ডার ইত্যাদি কারণে ছানি পড়ে থাকে। এমনকি একটি শিশু ছানি নিয়েই জন্মাতে পারে। মাতৃগর্ভকালীন মায়ের কোনো প্রদাহ বিশেষ করে রোবেলা টক্সোপ্লাজমা ইত্যাদি ভাহরাসের সংক্রমণ অথবা গর্ভকালীন সময়ে ভ্রƒণের জিন বা ক্রোমোজমের কোনো ত্রুটিজনিত কারণে জন্মের সময় বা অব্যাবহিত পরে ছানি পরিলক্ষিত হয় যাকে কনজেনিটাল বা ডেভেলপমেন্টাল ক্যাটারেক্ট বলা হয়ে থাকে।
ছানির কারণ যাই হোক তার জন্য চিকিৎসার তেমন একটা হেরফের নেই। অর্থাৎ সব ধরনের ছানির একই চিকিৎসা আর তা হলো অপারেশন। অপারেশনের মাধ্যমে অস্বচ্ছ লেন্স বা ছানি অপসারণ করে সেখানে একটি কৃত্রিম লেন্স প্রতিস্থাপন করাই হলো অপারেশন। আর এই কৃত্রিম লেন্স প্রতিস্থাপনে চোখের সামনে কালো ও সাদা অংশের সংযোগস্থলে এক ধরনের টানেল বা ইনসিশনের মাধ্যমে অপারেশনটি করা হয়ে থাকে। ক্ষেত্রভেদে এই টানেল বা ইনসিশনের প্রস্থ দুই-তিন মিমি বা পাঁচ-সাত মিমি হয়ে থাকে। সাধারণত ফেকো পদ্ধতিতে টানেলের প্রস্থ ছোট দুই-তিন মিমি হয়ে থাকে। পাঁচ-সাত মিমি টানেলে অপারেশনটিকে বলা হয় এসআইসিএস বা স্মল ইনসিশন ক্যাটারেক্ট সার্জারি। ফেকো অপারেশনে প্রতিস্থাপিত লেন্সটি এসআইসিএস এ ব্যবহৃত লেন্সটি থেকে একটু ভিন্ন এবং দামেও অনেক পার্থক্য। তা ছাড়া ফেকো মেশিনটিও বেশ ব্যয়সাপেক্ষ। ফলে ফেকো পদ্ধতিতে অপারেশনটি একটু ব্যয়সাপেক্ষ, পক্ষান্তরে এসআইসিএস পদ্ধতিতে অপারেশনটি তুলনামূলক সাশ্রয়ী।
ছানির কারণ বা ধরন যাই হোক সমাধান হলোÑ অপারেশন এবং সঠিক সময়ে। ছানি অপারেশন করতে গিয়ে একেকজন একেক রকম সিদ্বান্তহীনতায় ভুগে থাকেন। প্রথমেই যে সিদ্ধান্তহীনতাটি মনে উঁকি দেয় তা হলোÑ অপারেশন আপাতত না করালে চলবে কি না; অথবা কতদিন অপেক্ষা করা যাবে? দেরিতে অপারেশন করলে কোনো ক্ষতি হবে কি না। ছানি চোখে দীর্ঘদিন থাকলে জটিলতা দেখা দিতে পারে। যেমনÑ হঠাৎ করে চোখের প্রেসার বেড়ে তীব্র ব্যথা ও চোখ লাল, সেই সাথে দৃষ্টি একদম কমে যেতে পারে। এটিকে বলা হয় ফেকোলাইটিক গ্লোকুমা। দ্রুত ব্যবস্থা নিতে না পারলে কয়েক ঘণ্টার ব্যবধানে দৃষ্টি স্থায়ীভাবে অন্ধ হয়ে যেতে পারে। সে ক্ষেত্রে অপারেশন করালেও স্বাভাবিক দৃষ্টি ফিরে আসা অসম্ভব। অতএব, ছানি পড়লে চক্ষু বিশেষজ্ঞের পরামর্শে যথাসম্ভব স্বল্পসময়ের মধ্যে অপারেশন করিয়ে নেয়া উত্তম।
শিশুদের ছানির বেলায় বিষয়টি আরো জটিল। জন্মের সময় শিশুদের দৃষ্টিশক্তি খুব অল্পই থাকে এবং ভূমিষ্ট হওয়ার পর থেকে শিশুর চোখের সম্পূর্ণ পরিপক্বতা পেতে বেশ সময় নেয়। দেখা যায় দৃষ্টিশক্তি সম্পূর্ণ বিকশিত হতে পাঁচ বছর সময় নিয়ে থাকে। রেটিনা তথা দৃষ্টিশক্তি বিকশিত হতে গেলে আলো অত্যাবশ্যক। আলোর কাজ হলো চোখের ভেতরে প্রবেশ করে স্নায়ুকে উজ্জীবিত করা। কোনো কারণে যেমন ছানির বেলায় চোখে আলো প্রবেশে বাধাগ্রস্ত হয় ফলে রেটিনা উজ্জীবিত হতে না পারার কারণে দৃষ্টিশক্তি বিকশিত হতে পারে না। দৃষ্টিশক্তি বিকশিত হতে না পারার এই অবস্থাকে বলা হয় এমব্লায়োপিয়া। জন্মের পরপরই এই বাধা অর্থাৎ ছানি অপারেশন করে চোখে আলো প্রবেশের পথ সুগম না করে দিলে স্থায়ী অন্ধত্বের সম্ভাবনা সৃষ্টি হয়। তাই যত দ্রুত সম্ভব শিশুদের ক্ষেত্রে ছানি অপারেশন করে নেয়া উত্তম। সবচেয়ে ভালো হয় শিশুর বয়স দুই বছর পূর্ণ হওয়ার আগেই অপারেশন করিয়ে নেয়া। শিশুদের ছোখের ছানি সময়মতো না করলে এমব্লায়োপিয়া বা স্থায়ী অন্ধত্ব ছাড়াও চোখ ট্যারা বা স্কুইন্ট এবং নিস্টেগমাস বা চোখের কাঁপুনির মতো সমস্যা হতে পারে।
এরপরই সবার মধ্যে যে ভাবনাটি উঁকি দেয় সেটি হলোÑ অপারেশন করলে আগের মতো ভালো দেখবে কি না, বিশেষ করে যাদের কোমরবিডিটি যেমনÑ ডায়াবেটিস, উচ্চ রক্তচাপ, হার্ট বা কিডনির সমস্যা, ক্যান্সার ইত্যাদি আছে। ছানি অপারেশন পরবর্তী সময়ে কেমন দেখবে এটি চট করে বলা সম্ভব নয়। ছানি অপারেশনে মূলত অস্বচ্ছ লেন্সটি প্রতিস্থাপনের মাধ্যমে চোখে আলো প্রবেশের প্রতিবন্ধকতাটুকু অপসারণ করা হয়। চোখের অন্য কোনো সমস্যা না থাকলে ধরে নিতে পারি অপারেশনের পর ভালো দেখবে। তবে যাদের ডায়াবেটিস, উচ্চ রক্তচাপ, কিডনি সমস্যা ইত্যাদি থাকে তাদের বেলায় বিষয়টি একটু ভিন্ন। এই সমস্ত রোগীদের বেলায় অনেকের দেহের অন্যান্য অঙ্গের জটিলতার পাশাপাশি চোখে পর্দা বা রেটিনাতেও সমস্যা থাকতে পারে। এমন বয়স্ক লোক যাদের রেটিনাতে সমস্যা আগে থেকেই বিদ্যমান তাদের ছানি অপারেশনের পরও দৃষ্টি সমস্যা কিছুটা থেকে যেতে পারে। সেই ক্ষেত্রে প্রয়োজন অপারেশনের আগেই ভালো করে সার্বিক বিষয় পরীক্ষা করে দেখে নেয়া। যদি এমন সম্ভাবনা আগে থেকেই আঁচ করা যায় তবে বিষয়টি রোগীকে আগেই জানিয়ে রাখতে হবে। তাহলে অপারেশন পরবর্তীতে ভুল বোঝাবুঝির সম্ভাবনা থাকে না। চোখের আরো কিছু সমস্যা আছে যেমনÑ গ্লোকুমা, মেকুলার ডিজেনারেশন, রক্তনালী ও রক্তক্ষরণজ্বনিত সমস্যা ইত্যাদি যেখানে অপারেশনের পরও অনেক সময় ভালো না দেখার সম্ভাবনা থেকে যায়। এ ক্ষেত্রে রোগীর জন্য করণীয় হলোÑ বিষয়টি নিয়ে চক্ষু বিশেষজ্ঞের সাথে বিস্তারিত আলোচনা করে সিদ্ধান্ত নেয়া।
কিছু কিছু ক্ষেত্রে অধিকতর সাবধানতা অবলম্বনের প্রয়োজন আছে। ডায়াবেটিসের ক্ষেত্রে সুগারের মাত্রা নিয়ন্ত্রণে এনে তবে অপারেশন করাই ভালো। তবে যাদের সুগার সম্পূর্ণ নিয়ন্ত্রণে আসে না বা নিয়ন্ত্রণে আনতে গেলে হাইপো হয়ে যায় তাদের বেলা কিছুটা ছাড় দিয়েই অপারেশন করতে হবে। সে ক্ষেত্রে একজন মেডিসিন বিশেষজ্ঞ বা এন্ড্রোকাইনোলজিস্টের পরামর্শ নেয়া যেতে পারে। আবার যাদের অতীতে উচ্চচাপ বা হৃদরোগজনিত জটিলতার ইতিহাস আছে বা অ্যাজমাজনিত শ্বাসকষ্টের সমস্যা আছে তাদের বেলায় অতিরিক্ত সাবধানতা প্রয়োজন। এ সমস্ত অসুস্থতার ক্ষেত্রে একটু অপেক্ষা করতে হবে এবং যে সময়টিতে উপসর্গবিহীন থাকে বা অধিকতর নিরাপদবোধ করে তখন অপারেশনের সিদ্ধান্ত নেয়া ভালো। এসপিরিন জাতীয় ওষুধ সেবন অপারেশনের আগে স্বল্পকালীন সময়ের জন্য বন্ধ রাখলে ভালো।
শেষ কথা হলোÑ ছানি শনাক্ত হলে সিদ্ধান্ত নিতে হবে। সময় নিতে হলেও চক্ষুবিশেষজ্ঞের সাথে পরামর্শ করে সিদ্ধান্ত নিতে হবে এবং তার তত্ত্ব¡াবধানে থাকতে হবে।
লেখক : এমবিবিএস, এফসিপিএস (চক্ষু), এমএস (চক্ষু), চক্ষু বিশেষজ্ঞ ও সার্জন
সহযোগী অধ্যাপক (অব:), আইডিয়াল আই কেয়ার সেন্টার,
৩৮/৩-৪, রিং রোড, শ্যামলি, ঢাকা। ফোন : ০১৯২০ ৯৬২৫১২


আরো সংবাদ



premium cement
পাকুন্দিয়ায় ইউপি চেয়ারম্যানসহ আসামি ৫২, গ্রেফতার ৪ জাল ভোট হলে তাৎক্ষণিক সেই কেন্দ্রের ভোট বন্ধ : ইসি আহসান হাবিব রাবিপ্রবিতে‘এ’ ইউনিটের গুচ্ছভর্তি পরীক্ষায় উপস্থিতি ৭৭.৩৯ শতাংশ রাজধানীর জুড়ে ইসতিসকার নামাজ আদায় নাগরপুরে তীব্র তাপদাহে হাসপাতালে রোগীর চাপ বাড়ছে উপজেলা নির্বাচন : নেতাদের বহিষ্কারাদেশ প্রত্যাহারের যে শর্তের কথা জানালেন রিজভী গুচ্ছের বিজ্ঞান বিভাগে সারাদেশে শিক্ষার্থীদের উপস্থিতি ৯০ শতাংশ গাজায় ছড়াতে পারে মহামারি নারায়ণগঞ্জে ৭ খুন : বিচার কোন পর্যায়ে? মৌলভীবাজারে কালবৈশাখীর তাণ্ডব, খোলা আকাশের নিচে অনেক পরিবার গুচ্ছ ভর্তি পরীক্ষা : জবিতে মোট উপস্থিতি ৮৩ শতাংশ

সকল