২৯ এপ্রিল ২০২৪, ১৬ বৈশাখ ১৪৩১, ১৯ শাওয়াল ১৪৪৫
`


জাতিসঙ্ঘে যুদ্ধবিরতি প্রস্তাব পাস সত্ত্বেও গাজায় ইসরাইলি হামলা অব্যাহত

ইসরাইল আন্তর্জাতিক সমর্থন হারাচ্ছে : ট্রাম্প
-

জাতিসঙ্ঘ নিরাপত্তা পরিষদে যুদ্ধবিরতির প্রস্তাব পাস হওয়া সত্ত্বেও ইসরাইলি হামলা থেমে নেই। আলজাজিরার লাইভ রিপোর্টে এমনটিই জানানো হয়েছে সংবাদমাধ্যমটি। আলজাজিরার একজন সাংবাদিক গাজার দেইর এল-বালাহতে অবস্থান করছেন। সেখানে আল-আকসা হাসপাতালের জরুরি বিভাগে বহু হতাহতকে দেখতে পেয়েছেন বলে তিনি জানিয়েছেন।
ওই সাংবাদিক আরো জানান, ইসরাইলি বাহিনী মধ্য গাজার আজ-জাওয়াইদায় একটি বাড়ি লক্ষ্য করে হামলা চালিয়েছে। এর পরই হাসপাতালটি আহত মানুষে ভরে গেছে। জাতিসঙ্ঘ নিরাপত্তা পরিষদে প্রস্তাব পাসের পর এটিই প্রথম হামলা। তিনি আরো উল্লেখ করেন, আহতদের মধ্যে বহু নারী ও পুরুষ রয়েছেন।
প্রত্যক্ষদর্শীর জানিয়েছেন, হামলায় শিশুও নিহত হয়েছে। জাতিসঙ্ঘের প্রস্তাব পাস হওয়ার পর ফিলিস্তিনিরা ভেবেছিল গাজা উপত্যকায় বোমাবর্ষণ কমে যাবে। কিন্তু সে আশায় গুড়ে বালি। এ দিকে ইসরাইলি সেনাবাহিনী জানিয়েছে, ইসরাইলি যুদ্ধবিমান গাজাজুড়ে ৬০টিরও বেশি লক্ষ্যবস্তুতে আঘাত করেছে। এক্স (সাবেক টুইটার)-এ এক বিবৃতিতে তারা জানিয়েছে, হামলায় টানেল এবং কিছু ভবন লক্ষ্যবস্তু করা হয়েছে, যেখানে হামাস যোদ্ধারা উপস্থিত ছিল। তারা আরো বলেছে, ‘গাজা শহরের শিফা হাসপাতালে সেনাবাহিনীর অভিযান অব্যাহত রেখেছে। গত কয়েক দিনে সেনারা বেশ কয়েকজন হামাস যোদ্ধাকে হত্যা করেছে এবং অস্ত্র জব্দ করেছে।’ বিবৃতিতে আরো যোগ করা হয়েছে, ‘সেনারা দক্ষিণ গাজার খান ইউনিসে তাদের অভিযান অব্যাহত রেখেছে। অস্ত্র ও সামরিক সরঞ্জাম জব্দ করেছে। হামাস যোদ্ধাদের হত্যা করেছে এবং তাদের অবকাঠামো ধ্বংস করেছে। ইসরাইলি সেনাবাহিনী আল শিফা হাসপাতাল এবং খান ইউনিসের চার পাশে বড় আকারের অভিযান পরিচালনা করছে।’
এ ছাড়া রাফাহ শহরের একটি বাড়িতে ইসরাইলি বোমা হামলায় ১৮ জন নিহত হয়েছে বলে আলজাজিরার খবরে উল্লেখ করা হয়েছে। নিহতদের মধ্যে ৯ জন শিশু রয়েছে। রাফাহ শহরের উত্তর-পূর্বে নাসর এলাকায় ইসরাইলের গোলাবর্ষণেও হতাহতের ঘটনা ঘটেছে। গাজার দক্ষিণ জেলায়ও হামলা চলছে। যেখানে ১.৪ মিলিয়নেরও বেশি বাস্তুচ্যুত ফিলিস্তিনি অবস্থান করছে।
বিবিসি ও সিএনএন জানায়, গাজায় অবিলম্বে যুদ্ধবিরতির দাবিতে জাতিসঙ্ঘের নিরাপত্তা পরিষদের প্রস্তাব পাস হওয়া সত্ত্বেও হামলা চলছে। প্রায় ছয় মাসের যুদ্ধে এ ধরনের প্রথম প্রস্তাব পাস করা হয়েছে। যুক্তরাষ্ট্র তার আগের অবস্থান পরিবর্তন করে ভেটো দেয়া থেকে বিরত থাকার পর প্রস্তাবটি পাস হলো। এতে সব বন্দীর অবিলম্বে ও নিঃশর্ত মুক্তি দাবি করা হয়েছে।
অক্টোবরে যুদ্ধ শুরু হওয়ার পর থেকে নিরাপত্তা পরিষদ অচলাবস্থায় ছিল। তারা যুদ্ধবিরতির আহ্বানে সম্মত হতে ব্যর্থ হয়েছিল। অন্য দিকে গাজায় ইসরাইলের আক্রমণ নিয়ে যুক্তরাষ্ট্রের এ পদক্ষেপ মিত্র ইসরাইলের সাথে তাদের ক্রমবর্ধমান মতবিরোধের ইঙ্গিত দিচ্ছে। দীর্ঘ টানাপড়েনের পর অবশেষে গাজা উপত্যকায় জরুরিভিত্তিতে যুদ্ধবিরতির প্রস্তাব পাস হলো জাতিসঙ্ঘের নিরাপত্তা পরিষদে। পাস হওয়া এই প্রস্তাবটিতে গাজায় যুদ্ধবিরতির পাশাপাশি উপত্যকার নিয়ন্ত্রণকারী গোষ্ঠী হামাসের কব্জায় থাকা জিম্মিদের দ্রুত ও নিঃশর্ত মুক্তির ব্যাপারটিরও উল্লেখ রয়েছে।
সোমবার জাতিসঙ্ঘের সর্বোচ্চ ক্ষমতাধর সংস্থার বৈঠকে প্রস্তাবটি ভোটের জন্য তোলার পর পরিষদের সব সদস্য প্রস্তাবের পক্ষে ভোট দিলেও যুক্তরাষ্ট্র ভোটদানে বিরত ছিল। তবে প্রস্তাবটির বিপক্ষে কোনো যুক্তি উপস্থাপন বা ভেটো প্রদান করেনি দেশটি। এর আগে গাজায় যুদ্ধবিরতিসংক্রান্ত যত প্রস্তাব উত্থাপিত হয়েছে- প্রায় প্রতিটিতেই আপত্তি বা ভেটো দিয়েছে ইসরাইলের সবচেয়ে পুরনো ও পরীক্ষিত মিত্র যুক্তরাষ্ট্র। মূলত যুক্তরাষ্ট্রের ভেটোর কারণেই আর আলোর মুখ দেখেনি সেসব রেজ্যুলেশন।
কিন্তু গাজায় ইসরাইলি বাহিনীর চলমান অভিযান নিয়ে ইসরাইল ও যুক্তরাষ্ট্রের মধ্যে দিন দিন অসন্তোষ বাড়ছে। সোমবারের প্রস্তাবে যুক্তরাষ্ট্রের ভেটো না দেয়াকে সেই টানাপড়েনেরই প্রতিফলন বলছেন আন্তর্জাতিক রাজনীতি বিশ্লেষকরা। নিরাপত্তা পরিষদে প্রস্তাবটি পাসের পরপরই সামাজিক যোগাযোগমাধ্যম এক্সে বার্তা দিয়েছেন জাতিসঙ্ঘের মহাসচিব অ্যান্তোনিও গুতেরেস। সেই বার্তায় পাস হওয়া প্রস্তাবটি বাস্তবায়নের ওপর জোর দিয়েছেন তিনি। জাতিসঙ্ঘ মহাসচিব বলেন, ‘দীর্ঘ অপেক্ষার পর অবশেষে গাজায় জরুরিভিত্তিতে যুদ্ধবিরতি এবং সব বন্দীর নিঃশর্ত মুক্তির প্রস্তাব পাস হলো। প্রস্তাবটি যত শিগগির সম্ভব বাস্তবায়ন করতে হবে। এ ক্ষেত্রে কোনো প্রকার ব্যত্যয় হলে তা হবে ক্ষমার অযোগ্য।’
যুক্তরাষ্ট্রে ইসরাইলি কূটনীতিকদের সফর বাতিল : এ দিকে গাজায় যুদ্ধকে কেন্দ্র করে মার্কিন প্রেসিডেন্ট জো বাইডেন ও ইসরাইলের প্রধানমন্ত্রী নেতানিয়াহুর সম্পর্ক তলানিতে গিয়ে ঠেকেছে। সোমবার জাতিসঙ্ঘের নিরাপত্তা পরিষদে গাজায় যুদ্ধবিরতির প্রস্তাবে যুক্তরাষ্ট্র ভেটো না দেয়ায় তীব্র প্রতিক্রিয়া দেখিয়েছেন নেতানিয়াহু। চলতি সপ্তাহে ইসরাইলের শীর্ষ কূটনীতিকদের ওয়াশিংটন সফর বাতিল করেছেন তিনি। গতকাল মঙ্গলবার এ তথ্য জানিয়েছে রয়টার্স।
গাজার দক্ষিণের শহর রাফাতে সামরিক অভিযান চালানোর বিষয়ে আলোচনা করতে যুক্তরাষ্ট্রে যাওয়ার কথা ছিল ইসরাইলের শীর্ষ কূটনীতিকদের। ইসরাইল ও হামাসের মধ্যে অবিলম্বে যুদ্ধবিরতি এবং হামাসের হাতে আটক সব বন্দীর মুক্তির দাবিতে জাতিসঙ্ঘের নিরাপত্তা পরিষদের ভোটাভুটিতে যুক্তরাষ্ট্র যুদ্ধবিরতির পক্ষে অবস্থান নেয়ায় এ সফর বাতিল করেছেন নেতানিয়াহু।
এ বৈঠক স্থগিত হওয়ায় রাফাতে স্থল আগ্রাসন রোধে যুক্তরাষ্ট্রের প্রচেষ্টার পথে নতুন এক বাধা সৃষ্টি হয়েছে। ফিলিস্তিনি বেসামরিক নাগরিকদের জন্য সর্বশেষ তুলনামূলক নিরাপদ আশ্রয়স্থল হলো রাফাহ। অঞ্চলটিতে এ ধরনের আক্রমণের হুমকি দীর্ঘদিনের মিত্র যুক্তরাষ্ট্র ও ইসরাইলের মধ্যে উত্তেজনা বাড়িয়ে তুলেছে। বাইডেনের অবাধ্য হয়ে নেতানিয়াহু যদি অভিযান এগিয়ে নিয়ে যান তবে যুক্তরাষ্ট্র সামরিক সহায়তা বন্ধ করে দেবে কি না, তা নিয়ে এখন প্রশ্ন উঠছে।
রিপাবলিকান ও ডেমোক্র্যাটিক প্রশাসনের সাবেক মধ্যপ্রাচ্যবিষয়ক প্রতিনিধি অ্যারন ডেভিড মিলার বলেন, ‘এ থেকে বোঝা যাচ্ছে, বাইডেন প্রশাসন ও নেতানিয়াহুর মধ্যে সম্পর্কে ফাটল ধরছে। সতর্কতার সাথে এ সঙ্কট মোকাবেলা করা না গেলে পরিস্থিতি আরো খারাপ হতে থাকবে।’
কয়েক মাস ধরে ইসরাইলকে রক্ষা করার দীর্ঘকালীন মার্কিন নীতি থেকে সরে বাইডেনের জাতিসঙ্ঘ পরিষদে ভোট দেয়া থেকে বিরত থাকার সিদ্ধান্ত ইসরাইলি নেতার প্রতি ক্রমবর্ধমান মার্কিন হতাশারই ইঙ্গিত বলে মনে করছেন বিশেষজ্ঞরা। আগামী নভেম্বরে প্রেসিডেন্ট পদের জন্য পুনর্নির্বাচন করতে যাচ্ছেন বাইডেন। এ সময় আমেরিকার মিত্র ও ডেমোক্র্যাটদের কাছ থেকে ইসরাইলি সামরিক বাহিনীর লাগাম টেনে ধরতে চাপের মুখে পড়েছেন তিনি। গত ৭ অক্টোবর ইসরাইলে হামাস বাহিনীর আকস্মিক হামলার শোধ নিতে গাজায় বর্বরতা চালিয়ে যাচ্ছে ইসরাইল। মার্কিন সফর বাতিল ঘোষণার পাশাপাশি নেতানিয়াহু বলেন, প্রস্তাবে ভেটো দিতে যুক্তরাষ্ট্রের ব্যর্থতা দেশটির আগের অবস্থান থেকে ‘স্পষ্ট পশ্চাদপসরণ’ এবং ইসরাইলের যুদ্ধ প্রচেষ্টাকে ক্ষতিগ্রস্ত করবে। এ দিকে মার্কিন কর্মকর্তারা বলেছেন, বাইডেন প্রশাসন ইসরাইলের সিদ্ধান্তে বিস্মিত হয়েছে এবং এটিকে একটি অতিপ্রতিক্রিয়া হিসেবে বিবেচনা করেছে। তাদের দাবি, মার্কিন নীতিতে কোনো পরিবর্তন হয়নি।
উল্লেখ্য, গাজা উপত্যকায় প্রায় ছয় মাস ধরে চলা যুদ্ধে ওয়াশিংটন এত দিন ধরে যুদ্ধবিরতি শব্দটি এড়িয়ে গেছে। এমনকি হামাসের বিরুদ্ধে প্রতিশোধ নেয়ার সময় ইসরাইলকে রক্ষা করতে জাতিসঙ্ঘে ভেটো ক্ষমতা ব্যবহার করেছে দেশটি।
স্থায়ী যুদ্ধবিরতির দাবিতে অনড় হামাস : টাইমস অব ইসরাইল জানায়, ফিলিস্তিনি প্রতিরোধ আন্দোলন হামাস সোমবার রাতে বলেছে, তারা মধ্যস্থতাকারীদের জানিয়েছে যে স্থায়ী যুদ্ধবিরতি, গাজা থেকে ইসরাইলি সৈন্য প্রত্যাহার, বাস্তুচ্যুত ফিলিস্তিনিদের প্রত্যাবর্তন এবং বন্দীদের বিনিময় ইত্যকার দাবিতে তাদের অবস্থান এখনো অপরিবর্তনীয় রয়েছে। ইসরাইল ক্রমাগত সৈন্য প্রত্যাহার ও স্থায়ী যুদ্ধবিরতির দাবি প্রত্যাখ্যান করে আসছে। এ ছাড়া যুদ্ধ শেষ করার জন্য বন্দী মুক্তির শর্তকেও তারা অস্বীকার করছে। ইসরাইল এই দাবিকে অবাস্তব বলে প্রত্যাখ্যান করেছে। তারা জোর দিয়েছে যে হামাসের সামরিক ও শাসন ক্ষমতা ধ্বংস করার জন্য তার সামরিক অভিযান আবার শুরু হবে। উল্লেখ্য, হামাসের হাতে এখনো প্রায় ১৩০ জন বন্দী গাজায় রয়ে গেছে বলে মনে করা হয়।
ইসরাইল আন্তর্জাতিক সমর্থন হারাচ্ছে : ট্রাম্প
চলমান গাজা যুদ্ধে ইসরাইল আন্তর্জাতিক সমর্থন হারাচ্ছে উল্লেখ করে যুক্তরাষ্ট্রের সাবেক প্রেসিডেন্ট ও আগামী নভেম্বরে অনুষ্ঠেয় নির্বাচনের রিপাবলিকান প্রার্থী ডোনাল্ড ট্রাম্প বলেছেন, ইসরাইলের উচিত যুদ্ধ শেষ করা। তিনি বলেন, ‘গত ৭ অক্টোবর ইসরাইলে চালানো হামাসের হামলা আমার দেখা সবচেয়ে কষ্টের মুহূর্ত।’ সোমবার ইসরাইলি সংবাদমাধ্যম ইসরাইলি হায়োমকে দেয়া এক সাক্ষাৎকারে তিনি এসব কথা বলেন। সাক্ষাৎকারে ট্রাম্পের কাছে জানতে চাওয়া হয় যদি আপনার পরিবার হামাসের হত্যাযজ্ঞের শিকার হতো তাহলে আপনি কেমন প্রতিক্রিয়া জানাতেন- এর জবাবে ট্রাম্প বলেন, ‘আমি আপনাদের (ইসরাইলের) মতোই প্রতিক্রিয়া জানাতাম। এটা ভয়াবহ হামলা ছিল। মানুষ ইসরাইলের আগ্রাসন নিয়ে কথা বলে কিন্তু ৭ অক্টোবর হামাসের হামলা নিয়ে কথা বলে না; আমি খুবই বিরক্ত হই।’
তবে ইসরাইলের যুদ্ধ বন্ধ করা উচিত মন্তব্য করে ট্রাম্প বলেন, ‘ইসরাইলকে অনেক বেশি সতর্ক হতে হবে কারণ আপনারা অনেক বৈশ্বিক সমর্থন হারাচ্ছেন।’
উল্লেখ্য, ডোনাল্ড ট্রাম্প সব সময়ই তার সময়ে যুক্তরাষ্ট্রের দূতাবাস জেরুজালেমে স্থানান্তরের বিষয়ে কৃতিত্ব তুলে ধরেন এবং নিজেকে ইসরাইলের সমর্থক বলে দাবি করেন। ক্ষমতায় থাকাকালীন ইসরাইলের সাথে আরব দেশগুলোর সম্পর্ক স্বাভাবিক করতেও বিশেষ ভূমিকা রাখে ট্রাম্প প্রশাসন।


আরো সংবাদ



premium cement