একটি দেশে নাগরিকদের সুন্দরভাবে বেঁচে থাকার জন্য রাষ্ট্র নাগরিকদের কিছু অধিকার নিশ্চিত করে থাকে, যেগুলোকে বলা হয় নাগরিক অধিকার। আর এ অধিকারগুলোর মধ্যে ভোক্তা অধিকার অন্যতম।
একজন নাগরিকের বেঁচে থাকার জন্য বিভিন্ন সুযোগ-সুবিধা প্রয়োজন। এর কিছু প্রদান করে থাকে পরিবার, কিছু করে রাষ্ট্র। তবে অন্যান্য অধিকার থেকে ভোক্তা অধিকার কিছুটা ভিন্ন।
যিনি উৎপাদিত পণ্য ও সেবা চূড়ান্ত ভোগের জন্য ক্রয় করেন, অর্থনীতির ভাষায় তাকে ভোক্তা বলে। সহজ ভাষায় বলতে গেলে, যিনি কোনো পণ্য ক্রয় করেন কেবল নিজে ভোগ করার জন্য; তিনিই ভোক্তা।
একজন ব্যক্তি যখন কোনো পণ্য ক্রয় করেন, তখন তার জানার অধিকার রয়েছে পণ্যটি কবে উৎপাদিত হয়েছে, কোথায় উৎপাদিত হয়েছে এবং এর কাঁচামাল কী কী, মূল্য কত ইত্যাদি।
এসব প্রশ্নের উত্তর দিতে একজন বিক্রেতা বাধ্য। যদি কোনো বিক্রেতা এসব প্রশ্নের উত্তর না দেন বা দিতে অপারগতা প্রকাশ করেন, তখন আইন অনুযায়ী তাতে ভোক্তা অধিকার ক্ষুণœ হয়। জাতিসঙ্ঘ স্বীকৃত ভোক্তা অধিকার আটটি।
এগুলো হলো- মৌলিক চাহিদা পূরণের অধিকার, তথ্য পাওয়ার অধিকার, নিরাপদ পণ্য বা সেবা পাওয়ার অধিকার, পছন্দের অধিকার, জানার অধিকার, অভিযোগ করা ও প্রতিকার পাওয়ার অধিকার, ভোক্তা অধিকার ও দায়িত্ব সম্পর্কে শিক্ষা লাভের অধিকার, সুস্থ পরিবেশের অধিকার।
ইসলাম একটি পরিপূর্ণ জীবন ব্যবস্থা। ‘এতে মানুষের জন্য যা অকল্যাণকর ও নিকৃষ্ট সেসব বস্তু, পণ্য ও বিষয় থেকে বিরত থাকতে নির্দেশ দেয়া হয়েছে।’ (আল কুরআন-৩ : ১৯) অতএব ইসলামের দৃষ্টিতে ভেজাল পণ্যের উৎপাদন, বিপণন ও সংরক্ষণ সম্পূর্ণরূপে নিষিদ্ধ ও অবৈধ। নিম্নে ভেজাল সম্পর্কে কুরআন ও সুন্নাহর দৃষ্টিভঙ্গি তুলে ধরা হলো-
পণ্যদ্রব্যের ভেজাল-প্রবণতার ফলে বিভিন্ন খাদ্যদ্রব্য অস্বাস্থ্যকর ও বিভিন্ন রোগের নিয়ামক শক্তিরূপে পরিণত হয়। খাবার থেকেই যেমন মানুষের রক্ত তৈরি হয় তেমনি তা থেকেই রোগের উৎপত্তি ঘটতে পারে। ফলে এর বিষাক্ত ছোবলে অসংখ্য মানুষ মৃত্যুর কোলে ঢলে পড়ে। কুরআন মাজিদে এ ধরনের গুপ্তহত্যাকে জঘন্য অপরাধ হিসেবে উল্লেখ করা হয়েছে। কুরআন মাজিদে উল্লেখ আছে, ‘এ কারণেই বনি ইসরাইলের প্রতি এ বিধান দিলাম যে, নরহত্যা অথবা দুনিয়ায় ধ্বংসাত্মক কর্ম করা হেতু ব্যতীত কেউ কাউকে হত্যা করলে সে যেন দুনিয়ার সব মানুষকে হত্যা করল।’ (আল-কুরআন-৫ : ৩২) খাদ্য ও পণ্যে ভেজাল দেয়ার ফলে শুধু যে ভেজালকারী ব্যক্তি অপরের ক্ষতিতে সচেষ্ট হয় তা-ই নয়; বরং সে নিজেও অন্যের ভেজালে আচ্ছাদিত হয়ে ক্ষতির সম্মুখীন হয়। কেননা, সে তো এ সমাজেরই একজন সদস্য। মহান আল্লাহ এমন কর্মকাণ্ডে নিষেধাজ্ঞা জারি করেছেন। কুরআন মাজিদে উল্লেখ আছে- ‘তোমরা একে অপরকে হত্যা করো না।’ (আল-কুরআন-৪ : ২৯) এ ছাড়া এ মর্মে হাদিস এসেছে, ‘নিজের কিংবা অন্যের ক্ষয়ক্ষতি করা যাবে না।’ (ইমাম ইবনে মাজাহ, আস-সুনান, পৃষ্ঠা-২৬১৭)
কোনো কিছু ক্রয় করার ক্ষেত্রে একজন ক্রেতা বিশ্বস্ত বিক্রেতা অন্বেষণকে বেশি গুরুত্ব দিয়ে থাকে যাতে তার ক্রয়কৃত পণ্যদ্রব্য ওজনে সঠিক, গুণগত মান সংরক্ষণ ও সাশ্রয়ী হয়। পণ্য বিক্রয়ে মাপে বা ওজনে কম দেয়া এক প্রকার ধোঁকা। জাহেলি যুগে মুনাফাখোররা এ কাজ করত। আল্লাহ তায়ালা বলেন- ‘তোমরা পরিমাণ ও ওজন ন্যায্যভাবে দেবে। আমি কাউকে সাধ্যের বাইরে ভার অর্পণ করি না।’ (আল-কুরআন-৬ : ১৫২) আল্লাহ তায়ালা আরো বলেছেন- ‘তোমরা মাপার কাজ যখন করবে তখন পূর্ণ করে মাপবে। আর সুদৃঢ় দাঁড়িপাল্লা দিয়ে ওজন করবে। এ নীতি অতীব কল্যাণকর এবং পরিণতির দিক দিয়ে খুবই উত্তম ও ভালো।’ (আল-কুরআন-১৭ : ৩৫) এ মর্মে আরো বলা হয়েছে-‘মাপে (ওজনে) যারা কম দেয় তাদের জন্য বড়ই দুঃখ। তারা যখন লোকদের কাছ থেকে কিছু মেপে নেয় তখন পুরোপুরি গ্রহণ করে আর যখন তাদের মেপে দেয় তখন কম দেয়। তারা কি ভেবে দেখে না যে, তারা যে কঠিন দিনে পুনরুত্থিত হবে সেদিন সব মানুষ রাব্বুল আলামিনের সামনে দাঁড়িয়ে যাবে।’ (আল-কুরআন-১ : ৬) এবং ‘তোমরা মাপে পূর্ণ মাত্রায় দেবে, লোকদের জন্য ক্ষতিকারক হয়ো না। আর সঠিক পাল্লায় ওজন করো। লোকদের দ্রব্যাদি কম দিও না এবং পৃথিবীতে সীমালঙ্ঘন করো না।’ (আল-কুরআন-১৮৩) রাসূল সা: বলেছেন, ‘কোনো জিনিস বিক্রি করলে মেপে বিক্রি করো এবং কোনো জিনিস ক্রয় করলে মেপে নাও।’ (বুখারি, খণ্ড-২, পৃষ্ঠা-৩৩৩) আর পণ্যে ভেজাল থাকলে তা ক্রেতার প্রতি অবমাননা ও অবমূল্যায়ন এবং প্রতারণার শামিল। এ মর্মে রাসূল সা: বলেন, ‘এর চেয়ে বড় বিশ্বাসঘাতকতা আর কিছুই নেই যে, তুমি এমন ব্যক্তির সাথে মিথ্যার আশ্রয় নেবে যে তোমাকে বিশ্বাস করে।’ (ইমাম আবু দাউদ, আস-সুনান, অধ্যায় আল-আদাব, পৃষ্ঠা-১৫৮৭) অন্য এক হাদিসে এসেছে, ‘যে ব্যক্তি আমাদের সাথে প্রতারণা করে, সে আমাদের অন্তর্ভুক্ত নয়।’ (মুসলিম, পৃষ্ঠা-৬৯৫) সুতরাং ভেজাল ব্যবসায়ী ইসলামের গণ্ডিবহির্ভূত বলে গণ্য হবে। আর ইসলামের দৃষ্টিতে সব মানুষ সমান। মানুষে মানুষে শ্রেণিবৈষম্য নেই। ধনী-গরিবের ভেদাভেদ নেই। ইসলাম সাম্যের মিছিলে সবাইকে আমন্ত্রণ জানিয়েছে। নামাজের সারিতে সব শ্রেণির মানুষের সমান অধিকার প্রতিষ্ঠা করেছে। প্রাণের ধর্ম ইসলামে অধিকারের বিভাজন নেই। রাজা-প্রজা সমান; বরং কোনো কোনো ক্ষেত্রে অতি সাধারণ মানুষের অধিকারকে বেশি গুরুত্ব দিয়েছে ইসলাম। দেশের নাগরিকদের সুখ ও শান্তিময় পরিবেশ নিশ্চিত করতে ইসলাম শাশ্বত সুন্দর বিধান দিয়েছে।
ইসলামের দৃষ্টিতে পণ্যের সঠিক তথ্য জানানো : পণ্য-সম্পর্কিত সঠিক ও বস্তুনিষ্ঠ তথ্য ভোক্তাকে অবগত করতে হবে। পণ্যের ত্রুটি গোপন রাখা অপরাধ। অনলাইনে পণ্য বিক্রির সময় আরো বেশি সতর্ক হতে হবে। যথাযথ গুণাগুণ ও দোষ বর্ণনা করতে হবে। মুহাম্মদ সা: বলেন, ‘মুসলমান ভাই ভাই। কোনো মুসলিমের জন্য বৈধ নয় যে সে তার ভাইকে না জানিয়ে তার কাছে ত্রুটিযুক্ত কোনো কিছু বিক্রি করবে।’ (সুনানে ইবনে মাজাহ)
ইসলামে মজুদদারি পাপ : অনেক ব্যবসায়ী পণ্য মজুদ করে। কম মূল্যে পণ্য ক্রয় করে অধিক লাভবান হওয়ার লক্ষ্যে বহু দিন ধরে পণ্য মজুদ করে। ফলে বাজারে পণ্যাভাব দেখা দেয়। চড়া মূল্য উঠে পণ্যের দাম। ভোক্তারা অসুবিধা ও কষ্টে পড়ে। ইসলাম পণ্য মজুদদারিকে অভিশপ্ত করেছে। তাকে পাপিষ্ঠ বলে ঘোষণা করেছে। হাদিসে এসেছে, ‘পাপিষ্ঠ ব্যক্তি ছাড়া কেউ মজুদদারি করে না।’ (মুসলিম-১৬০৫, সুনানে তিরমিজি-১২৬৭) অন্য হাদিসে এসেছে, ‘যে ব্যক্তি মুসলমানদের (সমাজে) খাদ্যদ্রব্য মজুদদারি করে, আল্লাহ তাকে কুষ্ঠরোগ ও দরিদ্রতার কশাঘাতে শাস্তি দেন।’ (ইবনে মাজাহ-২১৫৫)
ইসলামী চিন্তাবিদরা মনে করেন, নিত্যপ্রয়োজনীয় পণ্য মজুদকরণ রোধ করার পদ্ধতি হিসেবে রাষ্ট্রকর্তৃক ব্যবস্থা নিতে পারে। মজুদকারীর ওপর শাস্তি প্রয়োগ করা যেতে পারে। তবে রাষ্ট্রের জন্য ভবিষ্যৎ বিপদ মোকাবেলা ও জনকল্যাণার্থে প্রয়োজনীয় দ্রব্যাদি গুদামজাত করা বৈধ।
পণ্য সরবরাহকারী লাভবান হয় : কল্যাণ প্রার্থনায় সওয়াব আছে। মানুষের কল্যাণে নিবেদিতপ্রাণ ব্যক্তি ইসলামের শ্রেষ্ঠ মানুষ। মানুষের জন্য উত্তম পণ্যের ব্যবস্থাপনাকারীর উপর আল্লাহর রহমতে থাকবে। নির্ভেজাল ও উপকারী পণ্য আমদানিকারী রিজিকপ্রাপ্ত হয়। উমর ইবনে খাত্তাব রা: থেকে বর্ণিত- রাসূল সা: বলেন, ‘আমদানি পণ্য সরবরাহকারী ব্যবসায়ী রিজিকপ্রাপ্ত হয় এবং মজুদদার অভিশপ্ত।’ (ইবনে মাজাহ-২১৫৩)
ইসলামে ক্রয়-বিক্রয়ে প্রতারণা নিষিদ্ধ : প্রতিটি শহরে বাজার কমিটি আছে। বাজার কমিটির উচিত বাজার তদারকি করা। নির্বিঘœ বাজারব্যবস্থা উপহার দেয়া। পণ্যের কোনো ত্রুটি থাকলে ক্রেতাকে অবগত করা আবশ্যক। ত্রুটিযুক্ত পণ্য সামনে প্রদর্শন করতে হবে। দোষ-ত্রুটি গোপন রেখে কোনোভাবেই ক্রেতাকে ঠকানো যাবে না। আবু হোরায়রা রা: থেকে বর্ণিত- ‘রাসূল সা: একবার একটি খাদ্যদ্রব্যের স্তূপের কাছ দিয়ে যাচ্ছিলেন। তখন তিনি তাতে হাত ঢুকিয়ে দিলেন। তাঁর হাতে আর্দ্রতা অনুভব হলে বলেন, ‘হে খাদ্য বেপারী, এ কী?’ সে বলল, আল্লাহর রাসূল, এতে বৃষ্টির পানি লেগেছিল। তিনি বলেন, ‘সব খাদ্যের ওপর তা রাখলে না কেন? তাহলে লোকে তা দেখতে পেত।’ এরপর তিনি বলেন, ‘যে ব্যক্তি প্রতারণা করে সে আমাদের দলভুক্ত নয়।’ (তিরমিজি-১৩১৫, ইবনে মাজাহ-২২২৪) এভাবেই ইসলাম ভোক্তা অধিকার নিশ্চিত করেছে।
লেখক : কলাম লেখক ও গবেষক
আরো সংবাদ
-
- ৫ঃ ৪০
- খেলা
-
- ৫ঃ ৪০
- খেলা
-
- ৫ঃ ৪০
- খেলা
-
- ৫ঃ ৪০
- খেলা
-
- ৫ঃ ৪০
- খেলা
-
- ৫ঃ ৪০
- খেলা