১৪ মে ২০২৪, ৩১ বৈশাখ ১৪৩১, ০৫ জিলকদ ১৪৪৫
`


গঠনমূলক কল্যাণ রাষ্ট্রের জনক মুহাম্মদ সা:

-

(শেষাংশ)

দারিদ্র্য বিমোচন ও জাকাতের বিধান জারি : একটি কল্যাণমুখী রাষ্ট্রে কোনো মানুষ না খেয়ে থাকতে পারে না, অন্নহীন-বস্ত্রহীন-নিরন্ন-ক্ষুধার্ত মানুষের আহাজারি কোনো কল্যাণমুখী রাষ্ট্রের বৈশিষ্ট্য হতে পারে না। রাসূলে আকরাম সা: সেই কল্যাণমুখী অর্থনীতির নিরাপত্তা দিয়েছিলেন এবং কুরআন মাজিদে আল্লাহ তায়ালা রাসূলকে চমৎকার এক বিধান দিয়েছেন- তোমাদের সবার সম্পদে যারা ‘সায়েল’ যারা ‘মাহরুম’ যারা প্রার্থনা করবে, আর যারা বঞ্চিত তাদের সবার অধিকার সম্পদশালীর সম্পদে আল্লাহই রেখে দিয়েছেন। ফলে অর্থনীতির সাম্যে এবং সম্পদের বণ্টনকে ভারসাম্যপূর্ণভাবে, সুবণ্টিত করে নাগরিকদের মধ্যে অর্থনৈতিক বৈষম্যহীন এক সমাজ কায়েম করার সে বিধান রাসূল সা:-এর কল্যাণমুখী রাষ্ট্রে ছিল। অর্থনৈতিক দৈন্যদশা বিদূরিত করে রাষ্ট্রের সার্বিক সাম্য ও ভ্রাতৃত্বের সৌধ নির্মাণের নিমিত্তে রাসূল সা: জাকাতের বিধান প্রবর্তন করেন। যাতে করে রাষ্ট্র থেকে দারিদ্র্য বিমোচনের পথ সুগম হয়। তিনি ধনী-দরিদ্রের পার্থক্য চিরতরে উৎখাত করেন।

রাষ্ট্রের আর্থ-সামাজিক অসঙ্গতি দূরীকরণ : রাসূল সা: আর্থ-সামাজিক অসঙ্গতি, প্রতারণা, মিথ্যাচার, দুর্নীতি, হঠকারিতা, মজুদদারি, কালোবাজারি, ইত্যাকার যাবতীয় অনাচার হারাম ঘোষণা করে সমাজ থেকে উচ্ছেদ করে একটি সুন্দর, পবিত্র রাষ্ট্রের বিনির্মাণ করেন। একবার হজরত বেলালের সামনে খেজুর স্তূপকৃত ছিল। রাসূল সা: জানতে চাইলে বেলাল বললেন, ভবিষ্যতের জন্য রাষ্ট্রের প্রয়োজনে জমা করা হয়েছে, রাসূল সা: বললেন, ‘হে বেলাল, সর্বময় ক্ষমতার মালিকের পক্ষ থেকে কোনো কিছুর আশঙ্কা করো না।’ (মানবতার বন্ধু মুহাম্মদ রাসূলুল্লাহ সা:, নঈম সিদ্দিকী, আকরাম ফারুক (অনুবাদক), মাওলানা আবদুস শহীদ নাসিম (অনুবাদক), পৃষ্ঠা-২৩৩)
সৌহার্দ্যপূর্ণ রাষ্ট্রের প্রতিষ্ঠা : সালামের প্রসারের মাধ্যমে সমাজে শান্তি ও সম্প্রীতি প্রতিষ্ঠা করেন। তিনি বলেন, ‘(ক্ষুধার্তকে) অন্নদান করবে এবং পরিচিত-অপরিচিত নির্বিশেষে সবাইকে (ব্যাপকভাবে) সালাম পেশ করবে।’ (রিয়াদুস সালেহিন, প্রাগুক্ত, নং-৮৪৯)
কটূক্তি বা গালি বন্ধ করতে তাগিদ দিতে বলেন, ‘আর যে ব্যক্তি কাউকে কাফের বলে ডাকে বা আল্লাহর দুশমন বলে, অথচ বাস্তবে যদি সে তা না হয়, তাহলে তার (বক্তার) উপর বর্তায়।’ (রিয়াদুস সালেহিন, প্রাগুক্ত, নং-১৮১৪)
শ্রমিকের মর্যাদা : মহানবী সা: শিক্ষা দিয়েছেন শ্রমিককে তার যথাযথ মর্যাদা দিতে হবে। তিনি বলেন, ‘যখন তুমি কোনো শ্রমিকের দ্বারা পরিশ্রম করাতে ইচ্ছা করো, তখন তার পারিশ্রমিক ঠিক করে নিও।’ (সুনানে আন নাসায়ি, আবু আবদুর রহমান আহমদ ইবনে শোয়াইব ইবনে আলী ইবনে সিনান আল-নাসাই, হাদিস নং-৩৮৫৭)

রাসূল সা: বলেছেন, ‘শ্রমিকের দেহের ঘাম শুকানোর আগে তোমরা তার মজুরি দাও।’ ( সুনানে ইবনে মাজাহ, প্রাগুক্ত, নং-২৪৪৩)
জনগণের জান-মালের নিরাপত্তা : তিনি প্রতিটি মানুষের জীবন ও সম্পদের নিরাপত্তা বিধান করেন। অন্যায়ভাবে কাউকে হত্যা করা এবং কারো সম্পদ গ্রাস করা যাবে না। সবার জীবন-সম্পদ পবিত্র আমানত- এ বিশ্বাসের ওপর সমাজ কাঠামোকে গড়ে তোলেন। তিনি ঘোষণা করলেন, ‘মুসলমান কর্তৃক নিরাপত্তা দানের অধিকার সবার ক্ষেত্রে সমান।’ (বুখারি, ইমাম মুহাম্মদ ইবনে ইসমাইল বোখারি রহ., হাদিস নং-১৮৭০)
শিক্ষা অর্জনে উৎসাহ প্রদান : ইলম বা জ্ঞান এমন মহামূল্যবান সম্পত্তি যা অর্জনে রাসূল সা: উৎসাহ দিতে গিয়ে ফরজ কাজের সাথে তুলনা করেছেন। জ্ঞানার্জনকে একটি উত্তম ইবাদত হিসেবে আখ্যায়িত করে বলেছেন, ‘যে ব্যক্তি এমন পথে গমন করে; যাতে সে বিদ্যা অর্জন করে, আল্লাহ তার জন্য জান্নাতের রাস্তা সহজ করে দেন।’ (হাফিজ আবু জাকারিয়া ইয়াহইয়া ইবন শারফ উদ্দিন, রিয়াদুস সালেহিন, হাদিস নং-১৩৮৯)

যে ইলম অর্জন করে ইসলামে তার গুরুত্ব বুঝাতে রাসূল সা: বলেন, ‘আলেমের ফজিলত আবেদের উপর ঠিক সেই রূপ; যেরূপ আমার ফজিলত তোমাদের উপর।’ (রিয়াদুস সালেহিন, প্রাগুক্ত, হাদিস নং-১৩৯৫)
কিন্তু মহানবী সা: এমন ইলমের তাগিদ দিয়েছেন যা শুধু কল্যাণ বা আল্লাহর সন্তুষ্টির ভিত্তিতে হবে। এর বিপরীতে ওই ইলম অর্জনের শাস্তিস্বরূপ বলা হয়েছে, ‘যে ব্যক্তি এমন কোনো জ্ঞানার্জন করল, যার দ্বারা আল্লাহর সন্তুষ্টি লাভ করা যায় না, তা সে কেবল পার্থিব স্বার্থ লাভের উদ্দেশ্যে অর্জন করল, কিয়ামতের দিন সে ব্যক্তি জান্নাতের সুগন্ধ পর্যন্ত পাবে না।’ (২২. রিয়াদুস সালেহিন, প্রাগুক্ত, হাদিস নং-১৩৯৯)
আইনের শাসন প্রতিষ্ঠা : বিভিন্ন প্রকার অবিচার-অনাচার দূরীকরণের জন্য বিশ্বনবী আইনের শাসন কায়েম করেন। আইনকে ব্যক্তিবিশেষ অথবা কোনো গোত্রের হাতে না দিয়ে কেন্দ্রীয় বিচার বিভাগের হাতে ন্যস্ত করেন। যেন আইন কারো ব্যক্তিস্বার্থে ব্যবহার না হয়। রাসূল সা: বলেন, ‘যে লোক এক বিঘত জমি অন্যায়ভাবে নিয়ে নেয়, (কিয়ামতের দিন) এর সাত তবক জমি তার গলায় লটকিয়ে দেয়া হবে।’ (বুখারি, প্রাগুক্ত, নং-২৪৫৩)
কল্যাণ রাষ্ট্র গঠনে পররাষ্ট্রনীতি : আন্তর্জাতিক নীতির ক্ষেত্রে, পররাষ্ট্রনীতির ক্ষেত্রেও রাসূল সা: বিদায় হজে কিছু চমৎকার নির্দেশনা দিয়েছেন। তিনি সব মানুষের, অমুসলিমদের এবং দেশে ও দুনিয়ার সব জায়গায় মানুষের জান-মাল-ইজ্জতের নিরাপত্তার জন্য মুসলমানদের জন্য আমানতের কথা বলেছেন। সমগ্র বিশ্বশান্তি ও কল্যাণের জন্য তিনি আহ্বান জানিয়েছেন। আল্লাহ তায়ালা বলেন- ‘সমগ্র মানবজাতির জন্য আপনি এসেছেন।’

‘কোনো এক পক্ষের শত্রুতা যেন তোমাদের ইনসাফ থেকে বিচ্যুত না করে।’ (সূরা মায়িদা, আয়াত-০২)
‘অপর পক্ষ যদি সন্ধি করতে চায়, তবে তোমরাও তার প্রতি অগ্রসর হও।’ (সূরা আনফাল, আয়াত-৬১)
গণতন্ত্র, জনমত, সংবিধান এসব ব্যাপারে রাসূল তার রাষ্ট্রকে উদাহরণ হিসেবে তৈরি করে ৫৭টি শর্তবিশিষ্ট ‘মদিনা সনদ’, পযধৎঃবৎ ড়ভ গধফরহধ যেটিকে বলা হয়, পৃথিবীর প্রথম লিখিত সংবিধান; যেখানে একটি স্বাধীন রাষ্ট্র হিসেবে, নবউত্থিত রাষ্ট্র হিসেবে, নগর রাষ্ট্র হিসেবে সেখানকার সব বিরোধী গোত্র, সমাজ, রাষ্ট্রের সাথে তিনি কীভাবে চুক্তিতে আবদ্ধ হন তার বর্ণনা আছে। ৫৭টি আর্টিকেল সেখানে ছিল। তার ভিত্তিতে লিখিত একটি সংবিধান কল্যাণমুখী রাষ্ট্রে তিনি তৈরি করেছেন।
আত্মরক্ষামূলক যুদ্ধ : ৬৩ বছরের মাক্কি ও মাদানি জীবনে তিনি রাষ্ট্রে শান্তিশৃঙ্খলা প্রতিষ্ঠার মাধ্যমে রিসালাতের দায়িত্ব সূচারুভাবে সমাপন করে গিয়েছিলেন। তিনি ইসলাম প্রচার করেছেন যেমন সমাজে শান্তি প্রতিষ্ঠার জন্য, তেমনি প্রতিরোধমূলক যুদ্ধ করেছেন রাষ্ট্রের শান্তি সুরক্ষার জন্য। জীবনে অনেক আত্মরক্ষামূলক যুদ্ধের মোকাবেলা করতে হয়েছে তাঁকে অথচ এর কোনোটিই আক্রমণাত্মক যুদ্ধ ছিল না। যুদ্ধক্ষেত্রে শায়িত বিধর্মীদের লাশকে তিনি শত্রুর লাশ নয়, মানুষের লাশ হিসেবে বিবেচনা করতেন এবং সে অনুযায়ী যথেষ্ট সম্মান দেখাতেন।

পরিশেষে আমরা বলতে পারি, প্রত্যেক মানুষকে ঈমান আনার পর মহান আল্লাহর দেয়া বিধান অনুযায়ী নিজের চরিত্রকে গঠন ও সালেহিনদের মতো যোগ্য করে গড়ে তুলতে হবে। কেননা, আল্লাহ ওয়াদা করছেন যারা ক্ষমতাপ্রাপ্ত হবে তারা হবে মুমিন। মহান আল্লাহ তায়ালা বলেন- ‘তোমাদের মধ্যে যারা বিশ্বাস করে ও সৎকাজ করে, আল্লাহ তাদের এ প্রতিশ্রুতি দিয়েছেন যে, তিনি তাদের পৃথিবীতে অবশ্যই প্রতিনিধিত্ব দান করবেন; যেমন তিনি প্রতিনিধিত্ব দান করেছিলেন তাদের পূর্ববর্তীদের এবং তিনি অবশ্যই তাদের জন্য তাদের ধর্মকে- যা তিনি তাদের জন্য মনোনীত করেছেন, সুদৃঢ় করবেন এবং তাদের ভয়ভীতির পরিবর্তে অবশ্যই তাদের নিরাপত্তা দান করবেন।’ (সূরা নূর, আয়াত-৫৫)
অতএব নিঃসন্দেহ আমরা বলতে পারি, রাসূল সা: প্রবর্তিত কল্যাণ রাষ্ট্রের সার্বভৌমত্বের ভিত্তি হচ্ছে- ‘Sovereignty belongs to the Almighty ALLAH’। বিশ্বনবীর কল্যাণ রাষ্ট্র গঠন করে যে আদর্শ স্থাপন করে গেছেন তা সারা বিশ্বের মানুষের জন্য অনন্য মডেল হিসেবে আজো চিরস্মরণীয় হয়ে রয়েছে। প্রখ্যাত দার্শনিক জর্জ বার্নার্ড শ রাসূল সা:-কে মানবতার ত্রাণকর্তা বলে আখ্যায়িত করে জোরালো ভাষায় স্বীকার করেছেন- ‘ইসলামই কেবল শান্তিময় পৃথিবী গড়তে সক্ষম।’ সমস্যাজর্জরিত বর্তমান বিশ্বে সামাজিক শান্তি ও মুক্তির পথ খুঁজতে গিয়ে তিনি যথার্থই বলেছেন, ‘মুহাম্মদ সা:-এর মতো কোনো ব্যক্তি যদি আধুনিক জগতের একনায়কত্ব গ্রহণ করতেন, তাহলে এমন এক উপায়ে তিনি এর সমস্যা সমাধানে সফলকাম হতেন, যা পৃথিবীতে নিয়ে আসত বহু কাক্সিক্ষত শান্তি।’ মহানবী মুহাম্মদ সা: অতি অল্প সময়ে স্বীয় প্রচেষ্টা অদম্য শক্তি বলে সব অনাচারের মূলোচ্ছেদ করে অসভ্য, দ্বিধাবিভক্ত সদা কলহপ্রিয় সে সময়ের সর্বাপেক্ষা অধঃপতিত আরব জাতিকে সুশৃঙ্খল রাষ্ট্র ব্যবস্থার মাধ্যমে ভ্রাতৃত্ব ও ঐক্যবন্ধনে সঙ্ঘবদ্ধ জাতিতে পরিণত করে অসাধারণ কৃতিত্বের পরিচয় দেন। এভাবেই তিনি পুরো বিশ্বে শান্তি প্রতিষ্ঠা করেন। তাই ফরাসি কবি আলফানসো দ্য লা মারটিনির সাথে একাত্ম হয়ে বলা যায়- ‘মুহাম্মাদ নামের এই মানুষটি শুধু সেনাবাহিনী, আইন, সাম্রাজ্য, লোকবল ও শাসকদেরই পরিচালনা করেননি, পাশাপাশি তৎকালীন বিশ্বের এক তৃতীয়াংশ জনগণকে তিনি পরিচালনা করেছেন।’ (তারিখু তুরকিয়া, লে মারটিনি, পৃষ্ঠা-২৮৬)

 

 

 


আরো সংবাদ



premium cement
শ্রম আইন সংশোধনে কিছু বিষয়ে নীতি-নির্ধারক পর্যায়ে সিদ্ধান্ত হবে : আইনমন্ত্রী রাণীনগরে অর্থাভাবে দুবাই প্রবাসী যুবকের লাশ দেশে ফেরাতে পারছেন না স্বজনরা আলমডাঙ্গায় স্বামীর মোটরসাইকেল থেকে পড়ে ট্রাকচাপা স্ত্রী নিহত হজযাত্রীদের কাছ থেকে কোরবানির টাকা নিলেই ব্যবস্থা যুক্তরাষ্ট্রের হুঁশিয়ারি সত্ত্বেও গাজায় চলছে প্রচণ্ড লড়াই বগুড়ায় স্কুলছাত্রকে বলাৎকারের অভিযোগ প্রথমবারের মতো পাকিস্তান সফর করবে আয়ারল্যান্ড ক্রিকেট দল জীবননগরে বিদ্যুৎস্পৃষ্ট হয়ে যুবকের মৃত্যু ৯৪ দিনেই হাফেজ ৯ বছরের নুসাইব বাংলাদেশের বিশ্বকাপ দলে চমক নেই, আলোচনা আছে নেতানিয়াহুকে গ্রেফতারের আহ্বান মার্কিন কংগ্রেস ওম্যানের

সকল