৩০ এপ্রিল ২০২৪, ১৭ বৈশাখ ১৪৩১, ২০ শাওয়াল ১৪৪৫
`


বাজেটে চিঁড়ে চ্যাপ্টা চার কোটি মধ্যবিত্ত

পণ্যমূল্য বেড়েই চলেছে ; ভ্যাটের আওতায় বেশির ভাগ পণ্য ; বাড়েনি করমুক্ত আয়সীমা
-

২০১৯-২০ অর্থবছরের জন্য প্রস্তাবিত বাজেটে বেশির ভাগ নিত্যপ্রয়োজনীয় পণ্যের ওপর ভ্যাট আরোপ করা হয়েছে। প্রত্যক্ষ কর তেমন না বাড়িয়ে বাড়ানো হয়েছে পরোক্ষ কর। ব্যাপক করারোপের ফলে মানুষের জীবনযাত্রার ব্যয় বাড়লেও বাড়ানো হয়নি করমুক্ত আয়সীমা। বাজেটের এমন চতুর্মুখী চাপে দেশের চার কোটি মধ্যবিত্তের এখন চিঁড়ে চ্যাপ্টা হওয়ার অবস্থা। চিন্তাচেতনা, বুদ্ধিমত্তা এবং উপার্জনের বিবেচনায় বিকাশমান মধ্যবিত্ত শ্রেণীকে অর্থনীতির চালিকাশক্তি বলা হলেও বাজেটের প্রভাবে সবচেয়ে বেশি চাপ পড়েছে তাদের ওপর।
বিভিন্ন পর্যায়ের মানুষের সাথে কথা বলে জানা যায়, প্রস্তাবিত বাজেট অনুমোদন পেতে আরো কয়েক দিন বাকি থাকলেও এখনই বাজেটীয় চাপে ভুগছেন মধ্যবিত্ত শ্রেণী। বাজারে বেশির ভাগ নিত্যপণ্যের দাম বেড়ে গেছে। যেসব পণ্যের ওপর নতুন করে শুল্ক-কর আরোপ করা হয়েছে সেগুলোর দাম তো বেড়েছেই, দাম বেড়েছে ভর্তুকি পাওয়া পণ্যেরও। তাদের দাবি, বাজেটের কারণে ব্যবসায়ীদেরও জীবনযাত্রার ব্যয় বাড়বে। বাড়তি খরচ জোগাতে ব্যবসায়ীরাও বাড়তি লাভ খুঁজবেন এটিই স্বাভাবিক। দাবির পক্ষে যুক্তি দেখিয়ে খিলগাঁও বাজারের মুদি দোকানি আরিফ বলেন, আমার সংসার খরচ বর্তমানে ৩০ হাজার টাকা। আমি টার্গেট করি মাসে ৪০ হাজার টাকা লাভ করলেই চলবে। সে অনুযায়ী ক্রয়মূল্যের ওপর লাভ বসাই। সব কিছুর দাম বেড়ে যাওয়ায় এখন আমার খরচ হবে মাসে ৪০ হাজার টাকা। আমাকে তো ৫০ হাজার আয় করতেই হবে। বাড়তি টাকা কোত্থেকে আসবে? কাস্টমারকেই তো দিতে হবে!
মানুষের খাদ্য তালিকার অন্যতম একটি পণ্য চিনি। বছরে চাহিদা প্রায় ১২ লাখ টন। এর সবচেয়ে বড় ভোক্তা মধ্যবিত্ত শ্রেণী। চলতি অর্থবছরের বাজেটে চিনি আমদানির ওপর ২০ শতাংশ নিয়ন্ত্রণমূলক শুল্ক রয়েছে। প্রস্তাবিত বাজেটে তা বাড়িয়ে ৩০ শতাংশ করা হয়েছে। এ ছাড়া প্রতি টন অপরিশোধিত চিনি আমদানির শুল্ক দুই হাজার টাকা থেকে বাড়িয়ে তিন হাজার এবং পরিশোধিত চিনির আমদানি শুল্ক চার হাজার ৫০০ টাকা থেকে বাড়িয়ে ছয় হাজার টাকা করা হয়েছে। এতে খুচরা পর্যায়ে চিনির দাম বেড়েছে কেজিতে ১০ টাকা।
মানুষের মৌলিক চাহিদার অন্যতম খাত আবাসন বা বাড়ি। বাড়ি নির্মাণে মৌলিক পণ্য রড। চলতি অর্থবছরের বাজেটে প্রতি টন রডে ৯০০ টাকা ভ্যাট রয়েছে। প্রস্তাবিত বাজেটে তা বাড়িয়ে দুই হাজার টাকা করা হয়েছে। এতে সামগ্রিকভাবে বাড়ি নির্মাণ ও ফ্ল্যাটের দাম বাড়বে। মধ্যবিত্তের যাতায়াতের অন্যতম মাধ্যমে সিএনজিচালিত অটোরিকশা। প্রস্তাবিত বাজেটে সিএনজি, মোটরসাইকেল এবং বেবি ট্যাক্সির টায়ার-টিউবের ওপর আমদানি শুল্ক ৩ থেকে বাড়িয়ে ৫ শতাংশ করা হয়েছে।
বাজেট প্রস্তাবনা অনুযায়ী, সিগারেট, বিড়ি, জর্দা, গুলসহ সব তামাক পণ্য, মোবাইল কল, এলপি গ্যাস, চিনি, আমদানি করা গুঁড়ো দুধ, গুঁড়া মসলা, টমেটো কেচাপ, চাটনি, ফলের জুস, মধু, টয়লেট টিস্যু, টিউব লাইট, চশমার ফ্রেম, সিআর কয়েল, জিআই তার, তারকাঁটা, স্ক্রু, ব্লেড, ট্রান্সফরমার, সানগ্লাস, রিডিং গ্লাস, আমদানি করা পার্টিকে বোর্ড, আমদানি করা সব ধরনের টায়ার ও স্মার্টফোনের দামও বাড়ার সম্ভাবনা রয়েছে।
তাছাড়া যাত্রীবাহী বাস, পণ্যবাহী ট্রাক, লরি, থ্রি হুইলার, অ্যাম্বুলেন্স ও স্কুলবাস ছাড়া সব গাড়ির রেজিস্ট্রেশন, রুট পারমিট, ফিটনেস সনদ ও মালিকানা সনদ গ্রহণ ও নবায়নে নিয়মিত চার্জের ওপর ১০ শতাংশ শুল্ক আরোপের প্রস্তাব করা হয়েছে। বাজেটে বাড়ানো হয়নি এমন পণ্যের যারা দাম বাড়াচ্ছেন তাদের যুক্তি, পরিবহন ব্যয় বাড়লে সব কিছুর দামই বেড়ে যায়। তাছাড়া সার্বজনীন ভ্যাট আদায়, মোবাইলের কলরেট এবং দৈনন্দিন জীবনে আরোপ করা নানা রকমের ট্যাক্স ব্যবসায়ীদের ওপর প্রভাব ফেলবে বলেও ধারণা সংশ্লিষ্টদের।
বাজেট পর্যালোচনায় দেখা যায়, গত তিন বছর ধরে ব্যক্তি শ্রেণীর ন্যূনতম করসীমা দুই লাখ ৫০ হাজার টাকায় অপরিবর্তিত রাখা হয়েছে। অর্থাৎ কোনো ব্যক্তির বার্ষিক আয় এই টাকার বেশি হলে তাকে কর দিতে হবে। উচ্চ পণ্যমূল্যের কারণে মানুষের খরচ বৃদ্ধির পরিপ্রেক্ষিতে মধ্যবিত্তদের স্বস্তি দিতে এই সীমা কিছুটা বাড়ানোর সুপারিশ করেছিলেন অর্থনীতিবিদরা এবং বিভিন্ন সংগঠন। কিন্তু সরকার সেটি আমলে নেয়নি। ভুক্তভোগীরা জানান, মধ্যবিত্তের উল্লেখযোগ্য একটি অংশের আয়ের অন্যতম উৎস হল সঞ্চয়পত্র। প্রস্তাবিত বাজেটে সঞ্চয়পত্রের মুনাফার ওপর উৎসে কর ৫ শতাংশ থেকে বাড়িয়ে ১০ শতাংশ করা হয়েছে। এটি মধ্যবিত্তের আয়ের ওপর সরাসরি প্রভাব ফেলছে। হিড়িক পড়েছে সঞ্চয়পত্র ভাঙানোর।
এবারের বাজেটে নিত্যব্যবহার্য পোশাকের ওপর ভ্যাট বাড়ানো হয়েছে। কেউ পোশাক কিনলে চলতি অর্থবছরে মোট দামের ৫ শতাংশ ভ্যাট দিতে হয়। প্রস্তাবিত বাজেটে তা আরো আড়াই শতাংশ বাড়িয়ে সাড়ে ৭ শতাংশ করা হয়েছে। এ ছাড়া পোশাক তৈরির ক্ষেত্রে দর্জির দোকানের মূল্য পরিশোধের ওপর নতুন করে ১০ শতাংশ ভ্যাট আরোপ করা হয়েছে। মোবাইল ফোনে কথা বলার ওপর সম্পূরক শুল্ক ৫ শতাংশ থেকে বাড়িয়ে ১০ শতাংশ করা হয়েছে। এতে মোবাইল ফোনে কথা বলার খরচ বাড়বে। এ ছাড়া স্মার্টফোন আমদানির ক্ষেত্রে শুল্ক ১০ শতাংশ থেকে বাড়িয়ে ২৫ শতাংশ করা হয়েছে। চলতি অর্থবছরের বাজেটে ভোজ্যতেলে ভ্যাট অব্যাহতি ছিল। নতুন বাজেটে এই অব্যাহতির সুযোগ প্রত্যাহার করা হয়েছে। এ ছাড়া শিশুখাদ্য গুঁড়োদুধ আমদানিতে শুল্ক বাড়ানো হয়েছে। এতে দুধের দামও বেড়ে গেছে।
অর্থনীতিবিদদের পর্যালোচনায়, বড় অঙ্কের বাজেট এবং আয় বাড়াতে সরকার মধ্যবিত্তকেই বেছে নিয়েছে। এবারের বাজেটে সবচেয়ে বেশি জোর দেয়া হয়েছে পরোক্ষ করের ওপর। জাতীয় রাজস্ব বোর্ডের (এনবিআর) মাধ্যমে আদায় হওয়া মোট তিন লাখ ২৫ হাজার কোটি টাকার করের মধ্যে ভ্যাট থেকে আসবে এক লাখ ২৩ হাজার কোটি টাকা। আর তা নি¤œবিত্ত, মধ্যবিত্ত ও উচ্চবিত্তের কাছ থেকে আদায় করা হবে। এ বছরও আয় বাড়ানোর ক্ষেত্রে মধ্যবিত্তদের টার্গেট করা হয়েছে। একজন পিপাসার্ত রিকশা চালক যদি রাস্তায় এক বোতল পানি কিনে খান তাকেও ধনীদের সমান ভ্যাট দিতে হবে।
এ ছাড়া বাজেটে ভ্যাট ও শুল্ক বাড়ানোর কারণে আরো যেসব পণ্যের দাম বাড়ছে তার মধ্যে উল্লেখযোগ্য হলো- ফলের জুস, গুঁড়োদুধ, বডি ¯েপ্র, আইসক্রিম, চশমা ও সানগ্লাস, বিড়ি-সিগারেট, ঘরের অ্যালুমিনিয়াম পণ্য, লঞ্চের কেবিন, মধু, জলপাইয়ের তেল, এলপি গ্যাস, আচার, চাটনি, টমেটো কেচাপ, ফলের জুস, কাগজ, টয়লেট টিস্যু। কারণ এসব পণ্যে আগে ট্যারিফ মূল্য ছিল। এখন ৫ শতাংশ হারে ভ্যাট আরোপ করা হয়েছে। অন্য দিকে এশিয়ার যেকোনো দেশ থেকে আমদানি করা এয়ারফ্রেশনার, টয়লেট সাবান, মশার কয়েল, এরোসল, সুপারি, চকোলেট, বিস্কুট, পটেটো চিপস, ফলের জুস, লিপস্টিক, আই শ্যাডো, আইলাইনার, আইব্রো, মাশকারা, পাউডার, ফেসক্রিম, শ্যাম্পু, কন্ডিশনার, টুথপেস্ট, শেভিং জেল, আফটার সেভ লোশন, স্যানিটারি ওয়্যার, টেবিল ওয়্যার, রেজার, মোটরসাইকেল ও দরজার তালা, সুইস সকেট, শেভার এবং শেভিং জেলের দাম বাড়বে। কারণ এশিয়া অঞ্চল থেকে আমদানি করা এসব পণ্যের ন্যূনতম মূল্য বাড়ানো হয়েছে।

 


আরো সংবাদ



premium cement