০২ মে ২০২৪, ১৯ বৈশাখ ১৪৩১, ২২ শাওয়াল ১৪৪৫
`


বিলুপ্তির পথে ‘জাতীয় ফুল শাপলা’

-

লাল-সবুজের বাংলাদেশে ‘জাতীয় ফুল শাপলা’ এখন প্রায় বিলুপ্তির পথে। দেখা মিলছে না শালুকেরও। সুনামগঞ্জে বর্ষার শেষ মৌসুমে হাওরের আনাচে-কানাচে পড়ে থাকা জলাভূমি, পুকুর-ডোবা, নদী-নালা ও খাল-বিলে শাপলাগাছ দেখা যেত। আর এই জলজ উদ্ভিদ শাপলাগাছে প্রস্ফুটিত থাকত ফুটন্ত শাপলা ফুল। শরৎ ও হেমন্তকালে গ্রামীণ হাওর এলাকায় অপরূপ নয়নাভিরাম সৌন্দর্যে শোভিত হতো। কালের আবর্তনে এখন এমন অপরূপ সৌন্দর্য আর চোখে পড়ে না।

এই জলজ উদ্ভিদ কোনো প্রকার পরিচর্যা ছাড়াই গ্রামগঞ্জের পুকুর, ডোবা, জলাশয়ে জন্মে থাকে। শাপলা ফুল ফোটার পর কিছু দিনের মধ্যে ফল জন্ম নেয়। আর ওই ফলের ভেতরে থাকে কালো কালো দানা। এটিকে ভিন্ন এলাকায় লোকজন ভিন্ন নামে ডাকে- ‘ড্যাপ, ভেট, চাউলিয়া ইত্যাদি। একাধিক গুণগত মানের এই শাপলার ডাঁটা যেমন সবজি হিসেবে খাওয়া যায়, অন্য দিকে শাপলার মূল ফল ড্যাপ খেতেও ভিন্নরকম স্বাদ অনুভব হয়। শাপলার চাল রোদে শুকিয়ে মহিলারা ভাজত ড্যাপের খৈ, যা খেতেও ভিন্নরকম মজাদার। বর্ষা শেষে ছেলে-মেয়েরা ডোবা নালা থেকে কুড়িয়ে আনত শাপলার ভেট আর শালুক। আগুনে পুড়ে ও সিদ্ধ করে শালুক খেতে দারুণ স্বাদ, যা খুবই পুষ্টিকর খাদ্য হিসেবে জানা গেছে।
বৃহত্তর সিলেটের সব জেলায় শাপলা ফুলের ডাঁটা ও ভেটের বেশ চাহিদা রয়েছে। তরকারি হিসেবে সুস্বাদু এই জলজ উদ্ভিদ শাপলা। আগে বর্ষা মৌসুমে বিভিন্ন হাটবাজারে এই শাপলা সবজি হিসেবে ব্যাপক বিক্রি হতো। কিন্তু সুনামগঞ্জের সুনামগঞ্জ সদর, জামালগঞ্জ, তাহিরপুর, ধর্মপাশা, বিশ্বম্ভরপুর, দিরাই, শাল্লা, জগন্নাথপুর, দক্ষিণ সুনামগঞ্জসহ সব ক’টি উপজেলার হাওরে আগের মতো শাপলার দেখা মিলছে না। হাওর এলাকায় বিলুপ্ত প্রায় এই শাপলা এখন স্মৃতির আয়নায় কাল্পনিকভাবেই প্রস্ফুটিত হয়ে আছে। কারণ হিসেবে দেখা গেছে, আগের সব পুকুর, নদী, খাল ভরাট করে মানুষের নানামুখী কর্মকাণ্ড ও কৃষিতে অতিমাত্রায় আগাছা নাশক ওষুধ প্রয়োগের কারণে শাপলার জন্মস্থলগুলো ধ্বংস হয়ে যাচ্ছে।
হাওর এলাকা ঘুরে দু-একটি পুকুরে, ডোবায়, ঝিলে ও বোরো জমির ক্ষেতে কিছু শাপলা ফুটে থাকতে দেখা গেছে। যার মধ্যে এলাকায় কয়েকটি পুকুরে ও হাওরের উজান জমিতে কিছু শাপলা ফুল চোখে পড়লেও আগের মতো নয়। বীর মুক্তিযোদ্ধা সন্তান রফিকুল ইসলাম বলেন, হাওরে শাপলা ফুল নেই। আমাদের শিশুরা পাঠ্যবইয়ে জাতীয় ফুল শাপলা ফুলকে জানে। কিন্তু বাস্তবে কয়জন শিশু শাপলা ফুল দেখছে। লক্ষ্মীপুর গ্রামের সমাজকর্মী মো: মহিবুর রহমান বলেন, আমরা ছোটবেলায় হাওরে প্রচুর পরিমাণ শাপলা-শালুক দেখেছি, খাইছি, সৌন্দর্য উপভোগ করেছি। এখন আমাদের সন্তানরা শাপলা ফুল বাস্তবে দেখেই না। কিছু দেখলেও অধিকাংশ শিশু বই ছাড়া শাপলা ফুল দেখেই না বলে মন্তব্য করেন। তারা সরকারিভাবে জাতীয় ফুল শাপলা চাষ করতে সংশ্লিষ্ট কর্তৃপক্ষকে আহ্বান জানান। না হয় এমন একসময় আসবে, আমাদের ভবিষ্যৎ প্রজন্ম শুধু জাতীয় ফুল শাপলা জানবে কিন্তু বাস্তবে তা দেখবে না।

শাপলা মূলত বর্ষার শেষ থেকে শরৎ-হেমন্তকালে গ্রাম-গঞ্জের পুকুর, ডোবা, জলাশয়গুলোতে জন্মে থাকে। হাওরের নিচু জমিগুলোতে বিভিন্ন ধরনের ফসল চাষ হচ্ছে। ফলে শাপলা জন্মানোর সুযোগ পাচ্ছে না। আর পুকুর জলাশয়গুলো পরিষ্কার করে বাণিজ্যিকভাবে মাছ চাষের কারণে পুকুরগুলোতেও শাপলার বংশবিস্তারের সুযোগ পাচ্ছে না। তাই আগের মতো আর শাপলা দেখা যায় না। এ দিকে কৃষি বিভাগ সূত্রে জানা গেছে, সুনামগঞ্জের বিস্তৃত হাওর এলাকাতে বাণিজ্যিকভাবে শাপলা চাষের সুযোগ রয়েছে। এতে করে বেকার সমস্যা সমাধান হতে পারে। রাস্তার ধারের পতিত খালগুলো শাপলা উৎপাদনের মাধ্যম হিসেবে ব্যবহৃত হতে পারে। এতে করে সৌন্দর্য বৃদ্ধির পাশাপাশি শাপলা সবজি হিসেবে চাহিদা মিটাতে পারে।
এ ব্যাপারে জামালগঞ্জ উপজেলা কৃষি কর্মকর্তা মো: আলাউদ্দিন বলেন, জামালগঞ্জ উপজেলায় পতিত জমি ও গর্ত জমিতে মাছচাষ করার কারণে জাতীয় ফুল শাপলা এখন বিলুপ্তির পথে।
সুনামগঞ্জের কৃষি বিভাগের উপ-পরিচালক বিমল চন্দ্র সোম মুঠো ফোনে বলেন, সুনামগঞ্জের হাওরে জমি পতিত না থাকায় ও পুকুর, ডোবা-জলাশয়ে মাছ চাষের কারণে শাপলার বংশবিস্তার হচ্ছে না। তবে সরকারিভাবে চাষের উদ্যোগ নিয়ে এই জাতীয় ফুল ধরে রাখা খুবই প্রয়োজন।


আরো সংবাদ



premium cement