০৪ মে ২০২৪, ২১ বৈশাখ ১৪৩১, ২৪ শাওয়াল ১৪৪৫
`


হুমায়ুনের সমাধিতে

-

পাখির ডাকে খুব ভোরে আমাদের ঘুম ভাঙল। নাজিম ভাইয়ের তাড়া পেয়ে ঝটপট তৈরি হয়ে বেড়িয়ে পড়লাম। গত রাতে আমরা পাঁচজন আগ্রা থেকে দিল্লি এসে পৌঁছি। এখন আমাদের গন্তব্য নিজামুদ্দিনে অবস্থিত মুঘল সম্রাট হুমায়ুনের সমাধিস্থল। হিন্দিতে যাকে বলা হয় ‘হুমায়ুন কা মাকবারা’। গ্রুপ লিডার মেহতাব ভাইয়ের পেছনে ফুটপাথ ধরে হাঁটতে লাগলাম আমরা। সকালের মনোরম পরিবেশটা খুব ভালো লাগছিল। প্রধান সড়কে এসে বাসে উঠে বসলাম। সকালের বাতাস বইছে এলোমেলো। দিল্লির রাস্তার দু’পাশে নাম না জানা হাজারো ফুলের সমারোহ। নানা রঙ ও বর্ণের। বাতাসের ঝাপটায় মাঝে মধ্যে হেলেদুলে উঠছে পাশের ঝাউ বীথিকা। মনোমুগ্ধকর এমন পরিবেশে শাফিক ভাইয়ের সাথে গল্পে মেতে উঠলাম। গল্পে গল্পে আধা ঘণ্টার মাথায় পৌঁছে গেলাম নিজামুদ্দিন। খানিকটা পথ হেঁটে পৌঁছলাম হজরত নিজামুদ্দিন র:-এর মাজার হোটেলে। সকালের নাস্তা সেরে মেহতাব ভাই আমাদের নিয়ে চললেন মাজারের পূর্ব দিকে। প্রধান সড়ক ছেড়ে নেমে এলাম টিনের চালা সরু গলিতে। দুই মিনিট পর পৌঁছে গেলাম সম্রাট হুমায়ুনের মাকবারার গেটে। টিকিট কেটে ভেতরে প্রবেশ করলাম আমরা। দু’জন রক্ষী সবাইকে চেক করে প্রবেশের অনুমতি দিলেন। ভেতরে ঢুকে চারপাশের সৌন্দর্য দেখে অভিভূত হয়ে গেলাম। সবুজে ছাওয়া খোলা আর পরিচ্ছন্ন প্রান্তর। ছোট আকৃতির গাছপালা চারপাশে। পাখিরা মনের সুখে গান গাইছে। এসব সমাধিক্ষেত্রটির সৌন্দর্য বাড়িয়েছে দ্বিগুণ। আনন্দে একেকজন একেক দিকে ছোটাছুটি করতে লাগলাম। কেউ সেলফি তোলায় ব্যস্ত হয়ে পড়ল। ইংল্যান্ড থেকে আসা পর্যটকদের সাথেও সেলফি তুললাম কয়েকটা।
প্রবেশপথের ডান দিকে ইশা খাঁর মাজার। এটি হুমায়ুনের সমাধি এলাকার ভেতরেই। মাজারের সামনে দাঁড়িয়ে জিয়ারত করলাম। অনেকগুলো কবরের মাঝ বরাবর ঈশা খাঁ শুয়ে আছেন। তিনি ছিলেন দিল্লির আফগান শাসক শের শাহের সভাসদ।
কয়েক কদমে এগিয়ে গেলাম সামনে। প্রথমে পাথুরে একটি ছোট গেট পেরোলাম। সামনে আছে বিশাল আকৃতির আরো দুটো গেট। সমাধি রাস্তার দু’পাশে লম্বা গাছ। গাছের ছায়ায় ইটের তৈরি বসার বেঞ্চি। ঘুরে ক্লান্ত হয়ে গেলে বিশ্রামের জন্য এ সুব্যবস্থা। এক পাশে বিশাল সাইনবোর্ডে পুরো সমাধির নকশা দেয়া আছে। নকশাটা দাঁড়িয়ে আয়ত্ত করে নিলাম মোটামুটি। সামনে এগোতেই নজর পড়ল সাদা বেলে পাথরে নির্মিত বিশাল গেটের ওপর। গেট পেরোতেই ছোট্ট ঝরনা আমাদের আমন্ত্রণ জানাল। শীতল পানিতে হাতটা ভিজিয়ে এগিয়ে গেলাম তৃতীয় গেটের কাছে। এ গেটটি লাল বেলে পাথরে নির্মিত। অনেকটা তাজমহলের গেটের মতো। নান্দনিক চিত্রকর্মে ভরপুর পুরো দেয়াল। গেট পেরোতেই সম্রাট হুমায়ুনের সুবিশাল সমাধি দেখে বিস্ময়ে হতবাক হয়ে গেলাম।
অনেকে বলেন, হুমায়ুনের সমাধি ভালো করে দেখলে নাকি তাজমহল দেখার আর প্রয়োজন হয় না। কারণ এটার আদলেই তৈরি হয়েছিল তাজমহল। পার্থক্য কেবল তাজমহল সাদা বেলে পাথরে তৈরি আর এটা লাল বেলে পাথরের। দিল্লিতে কুতুব মিনার ও লাল কেল্লার পরে সবচেয়ে বেশি বিদেশী পর্যটকের আনাগোনা হয় এখানেই। পাশেই একটা নেমপ্লেটে পড়লাম এর সংক্ষিপ্ত নির্মাণের ইতিহাস।
তাজমহল নির্মাণেরও শতবর্ষ আগে (১৫৬৫ খ্রিষ্টাব্দ) হুমায়ুনের স্ত্রী হামিদা বানু বেগম তার প্রয়াত স্বামীর স্মৃতির উদ্দেশ্যে ‘হুমায়ুন কা মাকবারা’ বা হুমায়ুনের সমাধি নামে এর নির্মাণকাজ শুরু করেন। এটি নির্মাণ করতে প্রায় সাত বছর সময় লাগে। মুঘলরা উদ্যানময় সমাধিক্ষেত্র পছন্দ করতেন। তারই নমুনা দেখা যায় মুঘলদের অন্যান্য সমাধিতেও। তবে সব মুঘল সম্রাটের এরকম উদ্যান-সমাধি জোটেনি। দিল্লির প্রাণকেন্দ্রে অবস্থিত এ উদ্যান-সমাধিক্ষেত্রের স্থপতি ছিলেন মিরাক মির্জা গিয়াথ। এ জায়গাটি হুমায়ুনের বেশ পছন্দ ছিল। তাই তিনি তার জীবদ্দশায়ই এর কাছাকাছি পুরনো কিল্লা নির্মাণ করেছিলেন (১৫৩৩ সালে)। তা ছাড়া, তিনি খাজা নিজামুদ্দিন আউলিয়ার র: খুব ভক্ত ছিলেন। হামিদা বানু বেগম হয়তো সম্রাটের অন্তিম ইচ্ছার কথা জানতেন। তাই মৃত্যুর পর তাকে এখানেই সমাহিত করেন। বিশাল এই এলাকার অংশবিশেষে হুমায়ুনের কবর হওয়ারও কমপক্ষে কুড়ি বছর আগে থেকেই কবরস্থান ছিল। বেশ কিছু কবর এখনো আছে। যমুনার তীর পর্যন্ত এ সমাধিক্ষেত্রের বিস্তার। এ কবরের স্তম্ভের ওপর দাঁড়ালে একসময় দিল্লি শহর একনজরে দেখা যেত।
সমাধিক্ষেত্রটি বেশ উঁচুতে। গম্বুজবিশিষ্ট লাল বেলে পাথরের বিশাল কক্ষের ভেতরে মূল কবর। খাড়া সিঁড়ি বেয়ে ওপরে উঠে এলাম। সমাধির আশপাশেও একটুখানি খোলা জায়গা। সেখানে ২০-২৫টির কবরের মতো উঁচু স্থান। সম্রাট পরিবারের কবর হবে হয়তো। পাশে কোনো শিলালিপি নেই। চারপাশটা ঘুরে দেখলাম। পেছনের দিকের দেয়ালে আয়াতুল কুরসি খোদাই করে লেখা হয়েছে। দাঁড়িয়ে কতক্ষণ দেখলাম নান্দনিক সেই চিত্রকর্ম। এবার ভেতরে প্রবেশের পালা। দক্ষিণ দিকের দরজা দিয়ে বিশাল হলরুমে ঢুকলাম। মাঝ বরাবর সাদা বেলে পাথরে আবৃত সম্রাট হুমায়ুনের সমাধি। মাত্র সাড়ে তিন হাত মাটির নিচে শুয়ে আছেন মুঘল বংশের প্রতাপশালী দ্বিতীয় সম্রাট। আশপাশে তার স্ত্রী হামিদা বানু বেগমসহ রাজ পরিবারের আরো বেশ কয়েকজনের কবর। বাইরে বাতাস না থাকলেও অদ্ভুতভাবে ভেতরে বইছে হু হু বাতাস। কিছু দোয়া-ওজিফা পাঠ করে বেরিয়ে এলাম বাইরে। সমাধির পুরো এলাকা মোটা দেয়াল দিয়ে ঘেরা। চারপাশে চারটে গেট থাকলেও কেবল একটিই খোলা থাকে সবসময়। দক্ষিণ-উত্তরপাশ ঘেঁষে নজর আটকাল সুবিশাল দুটি মসজিদে। এগুলো বানিয়েছিলেন মুঘল সম্রাট শাহজাহান। এখানে এসে কবর জিয়ারত করে নামাজ আদায় করতেন তিনি। কিন্তু এখন মসজিদ দুটিতে নামাজ পড়ার কোনো ব্যবস্থা নেই। অবাক দৃষ্টিতে তাকিয়েই রইলাম এসব ইমারতের দিকে। অসাধারণ সব কারুকার্য। মুসলিম বাদশাহদের এ স্মৃতিচিহ্ন মুহূর্তের জন্য আমাদের যেন ফিরিয়ে নিয়ে গেল সেই অতীতে।
সমাধির দক্ষিণপাশে একটুখানি সবুজ প্রান্তর। ঘন গাছগাছালিতে পরিপূর্ণ জায়গাটি পাখির কলরবে মুখরিত। দুপুরের ক্লান্ত সময়টায় গাছের ছায়ায় বসে গল্পে মেতে রইলাম কতক্ষণ। বেলা পড়তেই ফিরে চললাম গন্তব্যে।
সাভার, ঢাকা


আরো সংবাদ



premium cement
অর্থনীতিতে পিএইচডি ডিগ্রি অর্জন করলেন শিব্বির আহমদ রাজশাহী পশ্চিমাঞ্চল রেলওয়ের শিডিউল বিপর্যয়, ভোগান্তি যাত্রীদের গণহত্যা বন্ধ করে ফিলিস্তিনকে পূর্ণাঙ্গ স্বাধীন ও সার্বভৌম রাষ্ট্র হিসেবে স্বীকৃতি দিতে হবে : ছাত্রশিবির দোয়ারাবাজারে মইন হত্যাকারীদের গ্রেফতারের দাবিতে এলাকাবাসীর বিক্ষোভ উপজেলা নির্বাচন : দ্বিতীয় ধাপে ৬১ জনকে বহিষ্কার করলো বিএনপি গাজায় ইসরাইলি গণহত্যার প্রতিবাদে সিলেটে শিবিরের বিক্ষোভ মিছিল ঝালকাঠিতে পারিবারিক দ্বন্দ্বে হত্যা, বাবা ও ভাই গ্রেফতার বন্যাবিধ্বস্ত কেনিয়া ও তানজানিয়ায় ঘূর্ণিঝড় সতর্কতা জারি রাজধানীতে লেকে গোসলে নেমে ২ কিশোরের মৃত্যু ইসরাইলের ওপর কঠোর হতে বাইডেনের প্রতি ডেমোক্রেট কংগ্রেস সদস্যদের আহ্বান আশুলিয়ায় ঝুট ব্যবসা দখল নিতে ৬ জনকে কুপিয়ে জখম

সকল