২৭ এপ্রিল ২০২৪, ১৪ বৈশাখ ১৪৩১, ১৭ শাওয়াল ১৪৪৫
`

জাদু

-

বাজারে টিন পিটিয়ে লাঠি খেলার প্রচার করা হচ্ছে। হই হই কাণ্ড, রই রই ব্যাপার। লাঠি খেলা, লাঠি খেলা, লাঠি খেলা। এক বিরাট লাঠি খেলা।
লোকজন বেশ অবাক হয়ে মনোযোগ দিয়ে শুনছে। এই ডিজিটাল যুগে টিন পিটিয়ে প্রচার ভাবাই যায় না। ব্যতিক্রমই বলতে হয়। আগামী ১৬ ডিসেম্বর হাতিগাড়া গ্রামে ঐতিহাসিক লাঠি খেলা অনুষ্ঠিত হবে। এবারের লাঠি খেলার মূল আকর্ষণ ওস্তাদ জিনাল সর্দারের শূন্যে উড়ে যাওয়া। এ অঞ্চলের মধ্যে হাতিগাড়া গ্রামে লাঠি খেলোয়াড় সবচেয়ে বেশি। এ গ্রামের লাঠি খেলোয়াড়রা শুধু গ্রামেই নয়, দেশের জাতীয়পর্যায়ের অনুষ্ঠানেও অংশ নিয়ে তাদের খেলা প্রদর্শন করে ব্যাপক সুনাম কুড়িয়েছে।
ছোটবেলায় দেখতাম বাজারে টিন পিটিয়ে বিলে পলো দিয়ে মাছ ধরার দিন-ক্ষণ ঘোষণা করা হতো। মাছ ধরার দিন যেন উৎসব শুরু হয়ে যেত। গ্রামের জোয়ান বুড়ো মিলে সবাই যেত বিলে মাছ ধরতে। কেউ কেউ বড় মাছ ধরে হিরো হয়ে যেত। শত শত মানুষ পলো নিয়ে একসাথে বিলে নামত মাছ ধরতে। এখন এসব ইতিহাস। এখনকার শিশুরা পলো কী জিনিস তা চিনতেই পারে না।
অনেক দিন পর বাড়ি গিয়েছি। একসাথে কয়েক দিনের ছুটি। যেন ঈদের ছুটি। বন্ধুরা সব বাজারে আড্ডা দিচ্ছি। বাজারে ব্যতিক্রম প্রচারের টিম লিডার সাইদুলের সাথে দেখা। ইঞ্জিনিয়ার কাকা আপনের কলি থাহা লাগবিনি। আপনে আমাগরে গেস্ট। হুনচ্যান তো, ওস্তাদ জিনাল সর্দার কলি আহাশে উড়বি! বললাম, তাই নাকি! হ্যাঁ কাকা। সিরিয়াস খেলা। সাইদুল ৫০০ টাকা চাঁদা নিয়ে চলে যাওয়ার পর পাশ থেকে এক মাঝবয়সী লোক পানের পিক ফেলে খেঁকিয়ে উঠল-ব্যাটা শালাদের ভাঁওতাবাজি। পলাইয়া থাহে কয় আহাশে উড়বি...।
চৌধুরী বাড়ির মোড়ে বিকেল থেকেই ব্যাপক লোকসমাগম হয়েছে। মাগরিবের পর থেকে খেলা শুরু হয়। চলে রাত ১২টা পর্যন্ত। ব্যান্ড দল বাজনা বাজাচ্ছে। নারী-পুরুষ দাঁড়ানোর আলাদা আলাদা স্থান করে দেয়া হয়েছে। বাঁশের খুঁটি পুঁতে রশি লাগিয়ে মাঝখানে খেলোয়াড়দের কোর্ট বানানো হয়েছে। খেলার শুরুতে জুনিয়ররা খেলে থাকে। নানান অঙ্গভঙ্গি। লাঠির সাহায্যে নানান কৌশল দেখাচ্ছে ওরা। ইউনুস জোয়ান খেলোয়াড়। সে যেমন সুন্দর খেলে, তেমনি দারুণ জোকারি করে। হাসাতে হাসাতে দর্শকের পেটে খিল ধরিয়ে দেয়। ইউনুস পা উল্টো করে হাতের ওপর হেঁটে খেলা দেখায়। কুপি বাতির আগুন গিলে খেয়ে বাতি নিভিয়ে ফেলে। আবার ফুঁ দিয়ে বাতি জ্বালিয়ে দেয়। দর্শকেরা ব্যাপক করতালি দেয়। সারা শরীর দিয়ে ঘোড়ার ডিম বের করে আবার গিলে খায়, দর্শকেরা খুব মজা পায়।
হ্যাজাকের আলোয় খেলা চলছে। রাত আস্তে আস্তে বাড়তে থাকে। খেলাও জমতে থাকে। সিনিয়র খেলোয়াড়রা খেলা শুরু করে। সিনিয়র খেলোয়াড়রা খেলার শুরুতে একজন অপরজনের সাথে বাহাস করে, হাঁক ডেকে তর্ক করে। তারপর লাঠি খেলে। দলপতি জিনাল সর্দার কোর্টে নামেন। সবাই করতালি দিয়ে তাকে স্বাগত জানায়। জুনিয়র খেলোয়াড়রা ওস্তাদের পায়ে কদমবুচি করে। ওস্তাদ তাদের মাথায় হাত বুলিয়ে দোয়া করে দেন। ওস্তাদ জিনাল সর্দার দুই হাতে দুই লাঠি নিয়ে খেলা দেখাতে শুরু করেন। সর্দার বুড়ো হয়ে গেলেও তার লাঠি ঘুরানোর স্টাইল দুর্দান্ত। জিনাল সর্দারের সামনে কোনো খেলোয়াড় দাঁড়াতেই সাহস পায় না। দেশের বিখ্যাত খেলোয়াড়। জাতীয় খেলায় অংশ নিয়ে গোল্ড মেডেল পেয়েছেন। দর্শক মুহুর্মুহু করতালি দেয়। ধীরে ধীরে খেলা শেষ হয়ে আসে। দর্শকেরা বুঝতে পারে ওস্তাদের শূন্যে উড়ার সময় হয়ে গেছে। চার দিকে পিনপতন নীরবতা নেমে আসে। ওস্তাদের সারা শরীর মোটা রশি দিয়ে বেঁধে ফেলা হয়। ওস্তাদকে মাটিতে শুইয়ে ১০-১২ জন জোয়ান খেলোয়াড় চেপে ধরে রাখে।
সবার দৃষ্টি ঘের দেয়া তরুণদের দিকে। কী হয়! কী হয়! সত্যি ওস্তাদ উড়তে পারবে নাকি সব ভাঁওতাবাজি? হঠাৎ সবার দৃষ্টি আকাশের দিকে চলে যায়। সত্যি সত্যি জিনাল সর্দার আজ আকাশে উড়তে পেরেছে। সে শূন্য থেকে হাঁক দিচ্ছে, ইঞ্জিনিয়ার সাহেব দ্যাখেন, আজ আমি সত্যি সত্যি আকাশে উড়তে পেরেছি। সবাই অবাক! শূন্যে তাকিয়ে রয়। তার হাতে হারিকেন। মৃদু আলো জ্বলছে। সে আলোয় তার হাসিমাখা মুখ দেখা যাচ্ছে। সে আবার বলছে, আজ আমার সাধনা সফল হয়েছে। এখন থেকে আমি আকাশেই উড়ে বেড়াব। আমরা সবাই আকাশের দিকে তাকিয়ে থাকি। জিনাল সর্দার আস্তে আস্তে শূন্যে মিলে যেতে থাকেন...।
কেন্দ্রীয় প্রিয়জন, ঢাকা।


আরো সংবাদ



premium cement