০৭ মে ২০২৪, ২৪ বৈশাখ ১৪৩১, ২৭ শাওয়াল ১৪৪৫
`


উপকূলীয় বাঁধ এখনই জরাজীর্ণ

-

ঘূর্ণিঝড়ের প্রভাবে দেশের উপকূলীয় বাঁধগুলো জরাজীর্ণ হয়ে পড়েছে। বর্ষা মৌসুমের আগেই জরুরি ভিত্তিতে সংস্কার করা না হলে কোটি কোটি টাকার সম্পদসহ বহু জনপদ নদীতে বিলীন হয়ে যাওয়ার আশঙ্কা রয়েছে।
এবারের ‘বুলবুল’ ঝড়ে ২৪ জনের প্রাণহানি ঘটেছে। ভেঙে গেছে কয়েক লাখ ঘরবাড়ি। তবে এবার ঝড় সুন্দরবনকে কালাপাহাড়ের মতো আগলে রেখে ছিল। প্রায় ৬ দশমিক ১৭ হাজার বর্গকিলোমিটারজুড়ে গড়ে ওঠা সুন্দরী ও গেওয়াসহ নানা বৃক্ষের মজবুত বেষ্টনী আর অসংখ্য নদীনালার এ অরণ্য বছরের পর বছর ধরে বাংলাদেশের মানুষ ও অন্যান্য প্রাণীর প্রাণ ও সম্পদ রক্ষা করে আসছে। সুন্দরবন বাংলাদেশের প্রাণবৈচিত্র্যের অপরিহার্য অংশ। সর্বনাশা ঘূর্ণিঝড়ে উপকূলীয় এলাকা বিশেষ করে সাতক্ষীরা, খুলনা, বরগুনা, পিরোজপুর, ভোলা প্রভৃতি লণ্ডভণ্ড হয়ে পড়েছে। এসব জেলায় জানমালের ব্যাপক ক্ষতি হয়েছে। যতখানি আশঙ্কা করা হয়েছিল মহান আল্লাহ তায়ালার অশেষ রহমতে ক্ষতি ততখানি না হলেও নেহায়েত কম নয়। বিভিন্ন এলাকার বেড়িবাঁধ ভেঙে বন্যায় মানুষ পানিবন্দী হয়ে পড়েছিল।
ওয়ার্ল্ড ব্যাংক গ্রুপের ২০১৭ সালের গবেষণা ঝড়-জলোচ্ছ্বাস থেকে বাংলাদেশ রক্ষা করার জন্য ম্যানগ্রোভ বনের কথা তুলে ধরা হয়। ম্যানগ্রোভ প্রজাতির ভিন্নতা, তাদের ঘনত্ব এবং এই বনের প্রস্থের ওপরেই ঝড়-জলোচ্ছ্বাস থেকে সুরক্ষায় বিষয়টি জড়িত বলে ওই গবেষণায় উল্লেখ করা হয়েছে। বলা হয়েছে, ৫০ মিটার থেকে দুই কিলোমিটার চওড়া ম্যানগ্রোভ বন জলোচ্ছ্বাসের উচ্চতাকে কমাতে পারে দুই কিলোমিটার চওড়া বাইন ও কেওড়া বন পানির ২৯ শতাংশ থেকে ৯২ শতাংশ গতিবেগ হ্রাস করতে পারে। সুন্দরবনের বিভিন্ন গাছের ঘনত্ব এবং তাদের শিকড় ও কাণ্ডের ওপর জরিপ করে ওই গবেষণাপত্রে বলা হয়েছে যে, কেওড়া, বাইন আর সুন্দরী গাছ যেকোনো উচ্চতার জলোচ্ছ্বাসের গতিবেগ কমিয়ে দেয়ার ক্ষেত্রে অত্যন্ত কার্যকর। উল্লিখিত গবেষণাপত্রে ম্যানগ্রোভের কোন গাছ কোথায় রোপণ করতে হবে, সে ব্যাপারেও দিকনির্দেশনা আছে। ক্রমবর্ধমান চরে কেওড়া আর বাইন গাছ এবং জোয়ারভাটার জায়গায় গরান, গেওয়া ও সুন্দরী গাছ লাগাতে বলা হয়েছে। গবেষণাপত্রে বেড়িবাঁধের কথা উল্লেখ করা হয়েছে এবং নদী বরাবর বেড়িবাঁধের গুরুত্ব দেখানো হয়েছে। নদী বরাবর বেড়িবাঁধের ধার দিয়ে ম্যানগ্রোভ গাছ লাগানোর কথা এতে বলা হয়েছে।
ঘূর্ণিঝড় ও জলোচ্ছ্বাস মোকাবেলায় সুন্দরবনকে সংরক্ষণ করা অত্যন্ত প্রয়োজন। সেই সাথে গোটা উপকূলীয় এলাকায় নদী বরাবর উঁচু বাঁধ নির্মাণসহ তার পাশ দিয়ে ম্যানগ্রোভ গাছের ঘন চওড়া বন থাকা দরকার। এ ধরনের বাঁধ ও ম্যানগ্রোভ বন তৈরি করতে পারলে ভবিষ্যতে ঘূর্ণিঝড়গুলো থেকে ক্ষয়ক্ষতি কমে যাবে।
উপকূলীয় পাঁচ হাজার কিলোমিটার বেড়িবাঁধের মধ্যে চার হাজার কিলোমিটারই ঝুঁকিপূর্ণ। বাঁধগুলো জরাজীর্ণ অবস্থায় টিকে থাকা বিস্ময়কর ব্যাপার। এসব বাঁধ সংস্কার করা না হলে আগামী বর্ষা মৌসুমে বিস্তীর্ণ জনপদ নদীতে বিলীন হয়ে যাওয়ার আশঙ্কা রয়েছে। তবে বাঁধ ভেঙে যাওয়ার পর বসতভিটা এবং ফসল ভেসে যাওয়ার পর সংস্কার ও নির্মাণের কোনো প্রয়োজন হয় না। অনেক সময় কোটি কোটি টাকা বরাদ্দ দেয়া হলেও বাঁধের কাজে যৎসামান্য ব্যয় করা হয়। মোটা অঙ্কের টাকা ‘ভাগাভাগি’ হয়ে যায়। সরকারের পক্ষ থেকে যে কোটি কোটি টাকা ব্যয় করা হয়, তা সরকারের কেন্দ্র থেকে এবং সরাসরি মনিটরিং করা উচিত। বিদ্যমান বাঁধগুলো মজবুত করে গড়ে তুলতে হবে। বাঁধের দুর্বল পয়েন্টগুলো চিহ্নিত করে সংস্কার করতে হবে যথাসময়ে।
ঘূর্ণিঝড়ের দুর্বল আঘাতেই উপকূলীয় অঞ্চল নড়বড়ে হয়ে গেছে। কোথাও কোথাও বাঁধ ভেঙে বিস্তীর্ণ এলাকা প্লাবিত হয়েছে। আমরা বহুবার বলেছি, উপকূলীয় বাঁধসহ দেশের অভ্যন্তরে বিভিন্ন এলাকার বাঁধগুলো দৃঢ় ও মজবুত করে গড়ে তুলতে। যেসব বাঁধ নির্মিত হয়েছে, সেগুলো নিয়মিত সংস্কার করতে হবে। তবে পানি উন্নয়ন বোর্ড এ ব্যাপারে উদাসীন। প্রতিবছর বাঁধ নির্মাণ ও সংস্কারে কোটি কোটি টাকা ব্যয় করা হলেও বোর্ডের কর্মকর্তারা বাঁধগুলোর উন্নয়ন করছেন না। এসব বাঁধের বেশির ভাগই যে, কত নাজুক অবস্থায় রয়েছে তা ঝড়-বৃষ্টি ও বন্যা হলেই বোঝা যায়। তখন সংশ্লিষ্ট এলাকার মানুষ স্বতঃপ্রণোদিত হয়ে বাঁধ রক্ষায় নেমে পড়ে।
এ ক্ষেত্রে পাউবোর ভূমিকা খুবই দায়সারা। তাদের আচরণে মনে হয়, তাদের কথা হলোÑ যেমনই হোক আমরা বাঁধ নির্মাণ করে দিয়েছি, তা রক্ষার পুরো দায়িত্ব তোমাদের। আমাদের আর কোনো দায়িত্ব নেই।’ অথচ জনগণের অর্থ দিয়ে বাঁধ নির্মাণ করা হয়। এমনভাবে নির্মাণ করা হয়েছে যেন তা বালুর বাঁধ এবং বন্যায় ও জোয়ারের পানিতে সহজেই ভেসে যায়। তাহলে অসাধু কর্মকর্তাদের লাভ। তাদের মনে এই প্রবণতা বিরাজমান থাকা অন্যায়। বাঁধ নির্মাণ ও সংস্কারে পুনরায় অর্থ বরাদ্দ হলে তাদের পকেট ভারী হবে। মানুষ, ঘরবাড়ি, ফসলি জমি, গবাদিপশু ভেসে গেল কি না তা নিয়ে তাদের মাথাব্যথা কেন থাকবে না?
বছরের পর বছর বাঁধ নিয়ে এসব ‘খেলা’ চলছে। উপকূলীয় এলাকাসহ দেশের নানা অঞ্চলে যে লক্ষ্য নিয়ে বাঁধ নির্মাণ করা হয়েছে তা যদি সততার সাথে নির্মাণ ও সংস্কার করা হতো তাহলে অনেক প্রাণ এবং সম্পদ রক্ষা পেত। বুলবুলের কারণে ধান, আলু, পেঁয়াজ, আম, লিচু, তরমুজ, সূর্যমুখী ক্ষেত, বাদাম, ভুট্টা, কাঁচামরিচ, পানের বরজ, কলাগাছ শাকসবজিসহ বিভিন্ন মৌসুমি ফসল নষ্ট হয়েছে। বাতাসে মাটির সাথে লেপ্টে গেছে ধান। তলিয়ে গেছে আধাপাকা ফসল। বৃষ্টির পানিতে ফসল ও ঘের ভেসে গেছে। সাতক্ষীরা, বাগেরহাট, বরগুনাসহ কয়েক স্থানে বাঁধ ভেঙে প্লাবিত হয়েছে।
দেশের ১৮ কোটি জনসংখ্যার মধ্যে প্রায় পাঁচ কোটি মানুষ বাংলাদেশের নদীবেষ্টিত উপকূলীয় এলাকায় বসবাস করে। কিন্তু উপকূলীয় এলাকা এখন অরক্ষিত। বিশেষ করে, টেকসই বাঁধ না থাকায় জানমালের ব্যাপক ক্ষয়ক্ষতি হচ্ছে। প্রতি বছর উপকূলীয় বাঁধ ভেঙে নদীর পানিতে বিস্তীর্ণ এলাকা প্লাবিত হয়ে জানমালের হচ্ছে ব্যাপক ক্ষয়ক্ষতি। বিশেষ করে দেশের দক্ষিণাঞ্চলের জেলাগুলোতে এ সমস্যা প্রকট। ডজনখানেক জেলা রয়েছে উপকূলীয় এলাকায়। এসব উপকূলীয় এলাকায় জেলে, কৃষক, বাওয়ালী কামার, কুমারসহ বিভিন্ন শ্রেণিপেশার লোক বসবাস করে। জাতীয় অর্থনীতিতে তারা গুরুত্বপূর্ণ অবদান রাখেন। বিশেষ করে দেশের মৎস্য সম্পদের দুই-তৃতীয়াংশ চাহিদা পূরণ করে থাকেন উপকূলীয় জেলেরা। সাগর কিংবা স্থানীয় নদ-নদী থেকে মৎস্য সম্পদ আহরণ করে তারা স্থানীয় চাহিদা পূরণ করে বৈদেশিক মুদ্রা অর্জন করে আসছেন দীর্ঘ দিন থেকে। বিশেষ করে, হিমায়িত চিংড়ি রফতানি করে বাংলাদেশ কোটি কোটি টাকার বৈদেশিক মুদ্রা অর্জন করছে। এ পেশার সাথে উপকূলীয় দুই কোটি মানুষ জড়িত। পাশাপাশি বিভিন্ন জাতের ফসল প্রচুর পরিমাণে উৎপাদন করা হয়। তা দেশের খাদ্য ঘাটতি পূরণে বিশেষ ভূমিকা রাখে। কিন্তু উপকূলীয় বাঁধগুলো এত জরাজীর্ণ যে, এসব এলাকার কোটি কোটি মানুষ চরম আতঙ্ক ও উদ্বেগ-উৎকণ্ঠার মধ্যে দিনাতিপাত করছেন। শুধু সাতক্ষীরা ও খুলনা উপকূলীয় এলাকাতেই সাড়ে ৮০০ কিলোমিটার বাঁধ জরাজীর্ণ হয়ে পড়েছে।
সাতক্ষীরা জেলার গাবুরা ইউনিয়নের অবস্থাটা খুবই করুণ। নদীবেষ্টিত এ ইউনিয়নের ‘ওয়াপদা বাঁধ’ ভেঙে দ্বীপটি নদীতে বিলীন হয়ে যেতে পারে। অবিলন্বে ১০০ ফুট প্রশস্ত বাঁধ নির্মাণ না করা হলে ইউনিয়নটি মানচিত্র থেকে হারিয়ে যাওয়ার আশঙ্কা রয়েছে। এখানকার ৪০ হাজার মানুষ চরম উদ্বেগ-উৎকণ্ঠার মধ্যে দিনাতিপাত করছেন।
১৯৬৯ সালে বঙ্গোপসাগরের তরঙ্গ থেকে রক্ষা করার জন্য মূলত এসব বাঁধ নির্মাণ করা হয়েছিল। এসব বাঁধের স্থায়িত্ব ধরা হয় ২০ বছর। কিন্তু ৫০ বছর উত্তীর্ণ হয়ে যাওয়ার পরও যথাযথভাবে এগুলোর সংস্কার করা হয়নি। ফলে বিশাল বিস্তৃত এলাকা এখন অরক্ষিত। ১৯৮৮ সালের ২৯ নভেম্বর হারিকেন ঝড়, ২০০৭ সালের ১৫ নভেম্বর সিডর এবং ২০০৯ সালের ২৫ মে আইলা ঝড়ে উপকূলীয় এলাকা লণ্ডভণ্ড হয়ে যায়। তিন শতাধিক লোকের প্রাণহানি ঘটে এবং হাজার হাজার বসতবাড়ি নদীতে বিলীন হয়ে যায়। এর পর থেকে উপকূলীয় বাঁধ জরাজীর্ণ। এসব বাঁধ সংস্কার জরুরি। এ দিকে বঙ্গোপসাগরে চর পড়ায় জোয়ারের পানিতে উচ্চতা আগের তুলনায় অনেক বেড়েছে। আগে পাঁচ-ছয় ফুট উঁচু রাস্তা দিয়ে জোয়ারের পানি থেকে লোকালয় রক্ষা করা যেত।
২০১৭ সালের নভেম্বরে বিশ্বব্যাংকের বাংলাদেশে ঝড় থেকে সুরক্ষায় ম্যানগ্রোভ বনের ভূমিকা’ শীর্ষক গবেষণায় দেখা গেছে, ১৯৭৭ সাল থেকে ২০১৬ সালের মধ্যে বাংলাদেশে ৪৮টি বড় ধরনের ঘূর্ণিঝড় আঘাত হেনেছে। এর মধ্যে ১৯৬৬ সালেই আঘাত করেছিল ২০টি ঘূর্ণিঝড়। এসব ঝড় উপকূল দিয়ে দেশে প্রবেশ করেছে। এর বেশির ভাগ ঢুকেছিল খুলনা, চট্টগ্রাম, বাগেরহাট, বরিশাল অঞ্চল দিয়ে। দেশের বিস্তীর্ণ এলাকায় বোরো ধান ও ফসল ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে ঝড়ে।
বাংলাদেশে ইতিহাসে সর্বাধিক প্রলয়ঙ্করী হিসেবে গণ্য করা হয়, ১৯৭০ ও ১৯৯১ সালের ঘূর্ণিঝড়কে। ১৯৭০ সালের ১২ নভেম্বর সর্বোচ্চ ২২৪ কিলোমিটার বেগে চট্টগ্রামে ঘূর্ণিঝড় আঘাত হানে। জলোচ্ছ্বাসের উচ্চতা ছিল ১০ থেকে ৩৩ ফুট। এ ঝড়ে প্রাণ হারায় পাঁচ লাখ মানুষ। ১৯৯১ সালের ২৯-৩০ এপ্রিলের ঘূর্ণিঝড়ে এক লাখ ৩৮ হাজার মানুষ মারা যায়। বরিশাল বা বাকেরগঞ্জের প্রবল ঘূর্ণিঝড়ে প্রাণ হারিয়েছে দুই লাখ মানুষ। তখন ৪০ থেকে ৪৫ ফুট উঁচু জলোচ্ছ্বাস হয়েছে। ১৯৬০ সালের ৩১ অক্টোবর প্রবল ঘূর্ণিঝড়ে ছয় লাখ ১৪৯ জন নিহত হয়। ৬.১ মিটার উঁচু জলোচ্ছ্বাস ছিল সে সময়ে। ১৯৬০ সালের ৩১ অক্টোবর চট্টগ্রামে ২০ ফুট উচ্চতার জলোচ্ছ্বাস হয়েছিল। ১৯৬৬ সালে চট্টগ্রামে ১ অক্টোবর ২০-২২ ফুট উচ্চতার জলোচ্ছ্বাস ও প্রবল ঘূর্ণিঝড় হয়। ২০০৮ সালে ঘূর্ণিঝড় নার্গিস মিয়ানমারে আঘাত হানে। এতে বহু ক্ষতি হয়। ২০১৩ সালের ১৬ মে নোয়াখালী ও চট্টগ্রাম উপকূলে জলোচ্ছ্বাসের ঘূর্ণিঝড় মহাসেন হানা দেয়। ২০১৫ সালের ৩০ জুলাই চট্টগ্রাম-কক্সবাজার উপকূলে পাঁচ-সাত ফুট উচ্চতার ঘূর্ণিঝড়। ২০১৬ সালে ২১ মে বরিশাল-চট্টগ্রামের উপকূলে পাঁচ-সাত ফুট উচ্চতার ঘূর্ণিঝড় রোয়ানু এবং ২০১৭ সালে চট্টগ্রাম কক্সবাজার উপকূলে প্রবল ঘূর্ণিঝড় মোরা আঘাত হানে। হ
লেখক : সাংবাদিক

 


আরো সংবাদ



premium cement