০৮ মে ২০২৪, ২৫ বৈশাখ ১৪৩১, ২৮ শাওয়াল ১৪৪৫
`


বিবিএসে এক চাকরি, দুই বেতন

বিবিএসের গর্হিত প্রস্তাবনায় পরিকল্পনা কমিশনের আপত্তি; ‘রাজস্বে থেকে প্রকল্পের সুবিধা নেয়া যায় না ’
-

রাজস্ব খাতের জনবল হয়েও প্রকল্প থেকে সুবিধা পাচ্ছে পরিসংখ্যান ব্যুরোর জনবল। পরিসংখ্যান ব্যুরোর জনবলকে অতিরিক্ত দায়িত্ব দেয়ার মাধ্যমে প্রকল্পের সব সুবিধা প্রদান করা হচ্ছে বছরের পর বছর। ফলে প্রকল্পে নতুন করে জনবল নিয়োগ পাচ্ছে না। দীর্ঘ দিন ধরে ব্যুরোর প্রকল্পগুলো এভাবেই পরিচালিত হচ্ছে। অথচ এসআইডি সচিব এসব জানেন না বলে জানান। ইমপ্রুভিং লেবার মার্কেট ইনফরমেশন থ্রু ফোর্স সার্ভে প্রকল্পের প্রস্তাবনায় পরিসংখ্যান ব্যুরোর (বিবিএস) এ ধরনের ঘটনা বেরিয়ে এসেছে। রাজস্ব খাতের বাইরেও প্রতি মাসে গড়ে ১০ হাজার থেকে ৪০ হাজার টাকা পাবে। ওই প্রকল্পে বিবিএসের এই ধরনের গর্হিত প্রস্তাবনাকে অনুমোদন দেয়নি পরিকল্পনা কমিশনের আর্থ-সামাজিক অবকাঠামো বিভাগ। প্রকল্পের খাত ও ব্যয় সংশোধন করে যৌক্তিক প্রস্তাবনা পাঠাতে বলেছে বিভাগটি। কমিশন সূত্রে এ তথ্য জানা গেছে।
খোঁজ নিয়ে জানা যায়, পরিসংখ্যান ব্যুরোর প্রকল্পগুলোই তাদের জনবলকে অতিরিক্ত দায়িত্ব দিয়ে বাস্তবায়ন করা হয়। পিইসি করার মাধ্যমে অনুমোদনের জন্য প্রায় ২১ কোটি টাকা ব্যয়ে চার বছরে বাস্তবায়নের জন্য ইমপ্রুভিং লেবার মার্কেট ইনফরমেশন থ্রু ফোর্স সার্ভে প্রকল্প প্রস্তাবনা পাঠানো হয় পরিকল্পনা মন্ত্রণালয়ের আর্থ-সামাজিক অবকাঠামো বিভাগে। উদ্দেশ্য হলো, প্রকল্পের আওতায় দেশের কর্মক্ষম শ্রমশক্তির জরিপ করা। এতে করে কর্মক্ষম জনসংখ্যা, কর্মে নিযুক্ত জনসংখ্যা, শ্রমশক্তির বাইরের জনসংখ্যা ও বেকার জনসংখ্যার তথ্য পাওয়া যাবে।
পর্যালোচনায় দেখা যায়, রাজস্ব খাতে বেতনের বাইরেও প্রকল্প থেকে জনপ্রতি মাসে ১০ হাজার টাকা থেকে ৪০ হাজার টাকা পাবে। পরিসংখ্যান ব্যুরোর তথ্যানুযায়ী, ১০৭ জন নমুনা সংগ্রহকারী এক লাখ ২৩ হাজার নমুনা সংগ্রহ করবে। এটা করবে ব্যুরো। একজন নমুনা সংগ্রহকারী সপ্তাহে ২৪টি নমুনা সংগ্রহ করবে। প্রতি বছর নমুনা এলাকা থেকে নতুন নমুনাখানা নির্বাচন করে নমুনা সংগ্রহ করা হবে। বিবিএসে কর্মরত জনবল অতিরিক্ত দায়িত্ব হিসেবে এই কার্যাদি সম্পাদন করবে। তাই তাদেরকে এই অর্থ প্রদান করা হবে। ডাটা প্রসেসিং ১০ হাজার টাকা, ডিজাইন ১৫ হাজার টাকা, সেম্পলিং ফ্রেম গঠন ১৫ হাজার টাকা, ডাটা পর্যালোচনা ১৫ হাজার টাকা, ড্রাফট রিপোর্ট প্রস্তুত ২০ হাজার টাকা এবং ৪০ হাজার টাকা প্রস্তাব করা হয়েছে।
২১ কোটি টাকার প্রকল্পে ভ্রমণ খাতে বরাদ্দ ধরা হয়েছে প্রায় সাড়ে চার কোটি টাকা। অস্থায়ীভাবে নিয়োগকৃত জনবল, ব্যুরোর জনবল ও এসআইডির যেসব কর্মকর্তা প্রকল্পের কার্যক্রমের সাথে জড়িত থাকবেন তারা তদারকির জন্য ভ্রমণ করবেন। তাদের জন্য এই খরচ। অন্য দিকে, কর্মকর্তাদের জন্য এক হাজার টাকা এবং তথ্য সংগ্রহকারীদের জন্য ৩০০ টাকা হারে মাসিক মোবাইল বিল দেয়ার প্রস্তাব করা হয়।
পাঁচটি বিষয়ের জন্য প্রতিটিতে দুই-তিন জন মাস পরামর্শকের সংস্থান রাখা হয়েছে। মোট ২০ জন মাস পরামর্শক নিয়োগ দেয়া হবে, যাদের জন্য চার বছরে ৪০ লাখ টাকা বরাদ্দ ধরা হয়েছে। তবে আর্থ-সামাজিক অবকাঠামো বিভাগ থেকে অপ্রয়োজনীয় পরামর্শক বাদ দেয়ার জন্য বলা হয়েছে। অনিয়মিত শ্রম মজুরি খাতে আট কোটি ২৬ লাখ টাকা সংস্থান রাখতে হয়েছে। ১০৭ জনের জন্য প্রতি মাসে ২০ হাজার টাকা করে বেতন ধরা হয়েছে। এতে প্রয়োজন আট কোটি দুই লাখ ৫০ হাজার টাকা। আর কায়িক পারিশ্রমিকের জন্য দৈনিক মজুরি হিসেবে মোট সাড়ে ২৩ লাখ টাকা ধরা হয়েছে।
ব্যয় প্রস্তাবনায় দেখা যায়, ড্রাফট রিপোর্ট প্রস্তুতের জন্য ৪০ হাজার টাকা, এ খাতে আরো কয়েকবার ব্যয় দেখানো হয়েছে। রিপোর্ট রিভিউ বাবদ এক্সপার্ট ফি দেড় লাখ টাকা প্রস্তাব করা হয়েছে। এখানে পরামর্শকদের পাশাপাশি ব্যুরো, এসআইডি এবং বিশ্ববিদ্যালয়ের বিভিন্ন বিশেষজ্ঞকে রাখা হয়েছে। তাদেরকে সম্মানী বাবদ এই অর্থ। যদিও বিবিএস ও এসআইডি কর্মকর্তাদের এই ধরনের সম্মানী বা ফি প্রদানের কোনো সুযোগ নেই বলে পিইসি থেকে স্পষ্ট জানানো হয়েছে।
পিইসি বলছে, ব্যুরোর নিজস্ব জনবল দ্বারা যে কার্যাদি সম্পাদন করা হবে সেসব কাজের জন্য কোনো অর্থের সংস্থান রাখা যাবে না। কম্পিউটার ল্যাপটপ স্ক্যানার নতুন করে কেনার প্রস্তাবে আপত্তি জানিয়ে বলা হয়েছে ইতঃপূর্বে সমাপ্ত প্রকল্পের আওতায় ক্রয়কৃত ওই সব ব্যবহার করতে হবে এই প্রকল্পে। প্রায় সাড়ে চার কোটি টাকা ভ্রমণ খরচের ব্যাপারে বলা হয়েছে, ব্যুরোর কর্মকর্তাদের জন্য রাজস্ব খাতে ভ্রমণের জন্য নির্ধারিত বাজেট আছে। তাই অস্থায়ী ভিত্তিতে নিয়োগকৃতরাই শুধু এই ভ্রমণ খাতে ব্যয়ের সুবিধা পাবেন। এই ব্যয় বরাদ্দ কমাতে হবে। কর্মকর্তারা মোবাইল ভাতা পান, ফলে তাদেরকে এই সুবিধা থেকে বাদ দিতে হবে। ১০৭ জন তথ্য সংগ্রহকারীদের জন্য মোট আট কোটি ২৬ লাখ টাকা যে বরাদ্দ প্রস্তাব করা হয়েছে তা কমিয়ে আনার জন্যও বলা হয়েছে।
পরিসংখ্যান ব্যুরোয় কর্মরত ও সাবেক বেশ কয়েকজন কর্মকর্তার সাথে এই বিষয়ে আলাপকালে তারা অকপটে স্বীকার করে বলেন, ব্যুরোর প্রকল্পগুলো তাদের রাজস্ব খাতের নিজস্ব জনবল দিয়ে বাস্তবায়নের সংস্কৃতি দীর্ঘ দিন ধরে চলে আসছে। খুব বেশি দরকার না হলে তারা প্রকল্পের কাজ মাঠপর্যায়ের জনবলকে বাড়তি দায়িত্ব ও আর্থিক সুবিধা দিয়ে করিয়ে আনছে।
বিষয়টি জানার জন্য ব্যুরোর মহাপরিচালক মোহাম্মদ তাজুল ইসলামকে ফোন করা হলে তার বক্তব্য পাওয়া জায়নি।
পরিসংখ্যান ও তথ্য ব্যবস্থাপা বিভাগের (এসআইডি) সচিব সৌরেন্দ্র নাথ চক্রবর্তীর সাথে ফোনে এ ব্যাপারে জানতে চাইলে তিনি নয়া দিগন্তকে বলেন, রাজস্ব খাতে চাকরি করে কোনোভাবেই প্রকল্প থেকে বেতন বা সুবিধা নিতে পারবেন না।
বিবিএসে এ ধরনের ঘটনা ঘটছে বলা হলে তিনি বলেন, এমনটা হওয়ার কথা নয়। তারপরও আমি খোঁজ নেব। বিস্তারিত এখন বলতে পারব না। কারণ মিটিংয়ে আছি।
আর্থ-সামাজিক অবকাঠামো বিভাগের সদস্য (সচিব) আবুল কালাম আজদের সাথে গতকাল ফোনে প্রকল্পের ব্যাপারে জানতে চাওয়া হলে তিনি নয়া দিগন্তকে বলেন, রাজস্ব খাতের জনবল হয়ে প্রকল্প থেকে বেতনভাতা নেয়ার কোনো সুযোগ নেই। বিবিএস তাদের রাজস্ব খাতের জনবলকে প্রকল্পে যুক্ত করে সেখান থেকে তাদের বেতনভাতাসহ বিভিন্ন সুবিধা দেয়ার প্রস্তাব এই প্রকল্পে করেছে। এতে আমরা আপত্তি জানিয়েছি। বলেছি এটা সম্পূর্ণভাবে গর্হিত কাজ। তবে রাজস্ব খাতে যেসব সুবিধা নেই সেটি এই প্রকল্প থেকে নিতে পারে। তিনি বলেন, রিপোর্ট রিভিউ বাবদ এক্সপার্ট ফি দেড় লাখ টাকা ধরা হয়েছে, এটাকে যৌক্তিক পর্যায়ে কমিয়ে আনার জন্য বলা হয়েছে। এ ছাড়া অনেক খাত ও তার ব্যয় বরাদ্দ নিয়ে আপত্তি জানিয়ে প্রকল্প প্রস্তাবনা সংশোধন করে সঠিকভাবে করার জন্য বলা হয়েছে।


আরো সংবাদ



premium cement