২৬ এপ্রিল ২০২৪, ১৩ বৈশাখ ১৪৩১, ১৬ শাওয়াল ১৪৪৫
`

বৃদ্ধাশ্রমে দিনকাল

-

বাবা-মা নিজেদের সর্বস্ব দিয়ে সন্তান প্রতিপালন করেন। একসময় তারা বড় হয়। নিজেদের সংসার হয়। কিন্তু সে সংসারে ঠাঁই হয় না অসহায় বৃদ্ধ বাবা-মায়ের। তাদের ঠিকানা হয় বৃদ্ধাশ্রমে। এই রমজানে সংসার সন্তানদের কথা মনে করে তাদের কল্যাণ কামনায় দোয়া করেন তারা। অথচ সন্তান খোঁজ নেয় না একটিবার। এ নিয়ে লিখেছেন
আব্দুর রাজ্জাক

বিকেল গড়িয়ে সন্ধ্যার আয়োজনে ব্যস্ত প্রকৃতি; ম্লান আলোয় নিঃশব্দ-নিস্তব্ধ চার পাশ। অদূরে কোনো মসজিদের মাইক থেকে ভেসে আসছে পবিত্র কুরআন তিলাওয়াতের মোহনীয় সুরেলা ধ্বনি। ইফতারের সময় ঘনিয়ে এলেও এখানকার সবার মাঝেই বিরাজ করছে অন্য রকম নীরবতা। জীবন যেন স্থবির এখানে। বেশ কয়েকজন অসহায় বাবা-মায়ের শেষ আশ্রয়স্থল বৃদ্ধাশ্রমে প্রথম রোজার ইফতার আয়োজনে নেই বাড়তি কোনো উৎসাহ। শুধু রমজান মাস নয়, সারা বছরই বৃদ্ধাশ্রমের দেয়ালে ঘুরে ফেরে দীর্ঘশ্বাস। তখনো ইফতারের কিছুটা সময় বাকি। সব মুসলিম পরিবারে সে সময় হয়তো ইফতারের আয়োজন চলছে। কিন্তু সম্পূর্ণ ভিন্ন চিত্র দেখা গেল ওই বৃদ্ধাশ্রমে। নেই কোনো কোলাহল, কারো মাঝে নেই ইফতার নিয়ে বাড়তি কোনো আয়োজন।
রাজধানী ঢাকার পাশের একটি বৃদ্ধাশ্রম। প্রথম রোজার ইফতার। জীবনের শেষ সময়ে এসে পারিবারিক সমস্যাজনিত কারণে আশ্রয় নেয়া এসব বৃদ্ধ বাবা-মা সারা দিন রোজা রাখার পর ইফতারের সময় একত্রে বসে পড়েন ইফতারি খেতে। বয়স্ক পুনর্বাসন কেন্দ্রের ছোলা, মুড়ি, পিঁয়াজু, আলুর চপ, খেজুরসহ বিভিন্ন ধরনের ইফতারির আয়োজন করা হয়। কিন্তু স্বজনেরা থাকেন না পাশে। কেউ বলে না; ‘মা আরেকটু শরবত নাও; আরেকটু মুড়ি নাও’।
হঠাৎ একটি দীর্ঘশ্বাস ফেলে আনোয়ারা বেগম নামে ষাটোর্ধ্ব এক বৃদ্ধা বললেন, একদিন আমার সব ছিল। স্বামী-সন্তান, শ্বশুর-শাশুড়ি নিয়ে ছিল ভরা সংসার। এখন আমার কিছুই নেই। আমি নিঃস্ব, একা। ইফতারের কথা বলতেই থমকে যান এই বৃদ্ধা। বলেন, আগে রোজা মানেই ছিল এক অন্যরকম আনন্দ। শবে বরাতের পর থেকেই শুরু হয়ে যেত রোজার আমেজ। স্বামী-সন্তান নিয়ে একসাথে আনন্দ করতে করতে ইফতার করার মজাই ছিল আলাদা। সবার চাহিদা মতো ইফতারি বানাতাম। একসাথে বসে খেতাম। স্বামী-সন্তানদের মুখের হাসি দেখে প্রাণ জুড়িয়ে যেত। এখন রোজা কী আর ঈদ কী কিছুই বুঝি না। সব দিনই এক রকম লাগে। স্বামী নেই। দুই সন্তান প্রবাসে বসবাস করে। আমি বৃদ্ধাশ্রমে থাকি। আমার কেউ নেই। কিছুটা এগিয়ে গিয়ে বৃদ্ধাশ্রমের এক কোনায় বিশাল আকাশপানে শূন্যদৃষ্টিতে তাকিয়ে আছেন এক বৃদ্ধ। হাতে ধরে রেখেছেন মোবাইল ফোন। পরিচয় প্রকাশ ও ছবি না তোলার শর্তে ওই বৃদ্ধ জানান, একমাত্র সন্তান যদি তাকে ফোন করে। ফোন করে যদি না পায়। এ জন্যই তার এ অপেক্ষা। একমাত্র সন্তান প্রবাসী। স্ত্রী মারা গেছে এক যুগ আগে। এর বছর দুয়েক পরই সন্তান পাড়ি জমান বিদেশে। তখন থেকেই এই বৃদ্ধাশ্রমই তার ঠিকানা। আজ এক গ্লাস শরবত আর কলা খেয়েই ইফতার করেন তিনি।
ইফতার শেষে মাগরিবের নামাজ আদায় করে দীর্ঘ সময় দু’হাত তুলে মোনাজাত করলেন একজন বৃদ্ধা। তার কাছে যেতেই দেখা যায়, একান্ত চিত্তে কিছু প্রার্থনা করছেন সৃষ্টিকর্তার কাছে। পরে কথা বলে জানা যায়, আল্লাহর কাছে দোয়া করছেন সন্তানদের জন্য। ইফতারের পর দোয়া আল্লাহ কবুল করেন। আল্লাহ যেন তাদের ভালো রাখেন। এই বৃদ্ধার এক ছেলে দুই মেয়ে। প্রত্যেকেই তাদের সংসার, চাকরি নিয়ে ব্যস্ত। মাঝে মধ্যে বাবার খোঁজখবর নেন তারা। এত কিছুর পরও বৃদ্ধ অবিরত তার সন্তানদের জন্য সৃষ্টিকর্তার কাছে দোয়াই করেন।
এখানে বসবাসরতরা নিজ নিজ কক্ষে বসেই করেন ইফতার। একাকী তাদের এই জীবনের সঙ্গী হয় না কেউ। যারা নিবাসের মেসের খাবার খেতে আগ্রহী, তারা আগের দিন অর্ডার দিয়ে রাখেন ইফতারির। চাহিদা মতো ইফতারির সময় তাদের কক্ষে পৌঁছে দেয়া হয় খাবার। পিঁয়াজু, ছোলা, মুড়ি, বেগুনি, খেজুর থাকে এ তালিকায়। আর যারা মেসে খেতে আগ্রহী নন, তারা নিজেরাই প্রস্তুত করেন খাবার। সে ক্ষেত্রে অনেকে ভাত-মাছ বা কলা-চিঁড়াকেই বেছে নেন ইফতার হিসেবে। মাঝে মধ্যে বিভিন্ন সংগঠনের পক্ষ থেকে প্রবীণ নিবাসে দেয়া হয় বাহারি ইফতার। কিন্তু সেসবেও আগ্রহ নেই সেখানে বসবাসরতদের। কোনো কিছুতেই সুখ নেই তাদের। মনের মাঝে শুধু শূন্যতা। রোজার সেই দিনগুলোর স্মৃতিচারণ করতে গিয়ে চোখের পানি ফেলেছেন অনেকে। সবার গল্পই প্রায় একই রকম। একদিন তাদের সব ছিল। স্বামী-সন্তান, শ্বশুর-শাশুড়ি নিয়ে ছিল জমজমাট সংসার। প্রচণ্ড ব্যস্ততার মধ্য দিয়ে পার করেছেন জীবনের প্রতিটি মুহূর্ত। রোজার দিনের আনন্দমুখর পরিবেশ, স্বামী-সন্তান নিয়ে একসাথে সেহরি, ইফতারের কথা বলতে বলতে হয়েছেন আবেগাপ্লুত। অনেকে ইফতারি হাতে নিয়ে কেঁদে ফেলেন। জীবনের শেষ সময় কলিজার টুকরা সন্তান কিংবা আপনজন ছাড়া ইফতার করতে হবে, এটা তাদের কল্পনার বাইরে। অনেকে বলেন, এটা তাদের কপালের লিখন। এরপর আস্তে আস্তে নেমে আসে রাতের আঁধার; মনের গভীরে অনুভূত হয় এক বিশাল শূন্যতা। সব থেকেও যেন কিছুই নেই তাদের। আবার ভোর হয়; দিনের আলোয় চমকানো পৃথিবী অপেক্ষায় থাকে আরো একটি রাত্রির। বৃদ্ধাশ্রমের দেয়ালের চারপাশে প্রিয় মানুষের তরে ঘুরে ফেরে কিছু দীর্ঘশ্বাস।

 


আরো সংবাদ



premium cement
রাজশাহীতে মৌসুমের সর্বোচ্চ তাপমাত্রা ৪২ ডিগ্রি ছাড়াল যুক্তরাজ্যে বাংলাদেশী শ্রমিকদের ভিসা সহজ করার আহ্বান প্রবাসী প্রতিমন্ত্রীর চীন ও যুক্তরাষ্ট্রের প্রতিদ্বন্দ্বী না হয়ে অংশীদার হওয়া উচিত : শি জিনপিং ওকাব সভাপতি নজরুল ইসলাম, সম্পাদক জুলহাস আলম পাবনায় ১০ কোটি টাকার অনিয়মে ৩ ব্যাংক কর্মকর্তা কারাগারে চুয়েট ১১ মে পর্যন্ত বন্ধ, শিক্ষার্থীদের আন্দোলন স্থগিত নরসিংদীতে হিট স্ট্রোকে শিশুর মৃত্যু হিলিতে ভটভটি-মোটরসাইকেলের সংঘর্ষে নিহত ২ ‘গাজার ধ্বংসাবশেষ পরিষ্কার করতে ১৪ বছর লাগতে পারে’ সখীপুরে ছাগল চুরির মামলায় মা-ছেলে কারাগারে ‘অন্যায়ের সাথে নয়া দিগন্তের সাংবাদিকরা কখনোই আপোষ করেন না’

সকল