২৮ এপ্রিল ২০২৪, ১৫ বৈশাখ ১৪৩১, ১৮ শাওয়াল ১৪৪৫
`


নিজেকে হারায়ে খুঁজি

নিজেকে হারায়ে খুঁজি - ফাইল ছবি

আমাদের কৈশোর ও তারুণ্য কেটেছে একুশের চেতনার মোড়কে। টগবগে তারুণ্য একুশে এলে যেন আরো বিচ্ছুরিত হতো পলাশ আর শিমুলের টকটকে লাল রঙের মতো। সকালে প্রভাতফেরি শেষে দুপুরে মসজিদ মন্দির গির্জায় বিশেষ মুনাজাত ও প্রার্থনা। বিকেল গড়িয়ে সন্ধ্যা এলে আলোচনা সভার আয়োজন। সব যেন অঙ্কের মতো। একটি ঘোরের ভেতর দিয়ে কাটত একুশের দিনটি। সবাই নিবেদিত হয়ে সম্মোহিতের মতো পরস্পরের হাত মিলিয়ে সব অনুষ্ঠানের আয়োজনে ব্যস্ত-সমস্ত হয়ে পড়ত। প্রায় দেখা যেত সকালের নাশতা খাওয়া হয়নি, কারণ নাশতা খেলে প্রভাতফেরিতে যাওয়া হবে না। দুপুরে খেতে এলে বিকেলের অনুষ্ঠান আয়োজনে বিঘ্ন ঘটবে। একাত্ম হয়ে একুশের মর্মবাণী হৃদয়ে ধারণ করে পালন করা হতো একুশের অনুষ্ঠানমালা। এর কারণ ছিল, একুশের মৌলিক শিক্ষা। বাংলাভাষার স্বাতন্ত্র্য ও মর্যাদা যথাযোগ্যভাবে প্রতিষ্ঠা করার অদম্য বাসনা আমাদের তারুণ্যকে প্রভাবিত করেছিল। দেশপ্রেমের শাশ্বত অনুভূতি উৎসাহ জুুগিয়েছিল এর মর্মবাণী ধারণ করতে।

ভাষার মর্যাদার সাথে সাথে নিজেদের স্বকীয় পরিচয় এবং স্বাতন্ত্র্যকে নতুন অভিধায় পরিচিত করার তীব্র আকাক্সক্ষাও একই সাথে কাজ করেছিল। নিজের চিন্তা-চেতনা স্বাধীনভাবে প্রকাশ করার অধিকারও জড়িয়ে ছিল। এর সাথে প্রাসঙ্গিকভাবে মতপ্রকাশের স্বাধীনতার চেতনা জড়িয়ে ছিল। যে আলোর পথ ধরে স্বাধীনতার বাণী লাখো প্রাণে আন্দোলিত হয়েছিল। এ চেতনাবোধ সৃষ্টির প্রতিষ্ঠান ছিল তমদ্দুন মজলিশ। প্রাণপুরুষ ছিলেন জ্ঞানতাপস ড. মুহম্মদ শহীদুল্লাহর সূচনাপত্র। তৎকালীন পূর্বপাকিস্তান পরিষদের সদস্য ও পূর্বপাকিস্তানের মুখ্যমন্ত্রী আবুল হোসেন সরকারের ভাষা বিল পাসের মাধ্যমে আজকের বাংলা একাডেমি গঠন- সব কিছু ছিল নিঃস্বার্থভাবে কেবল নিজস্ব ভাষা, সংস্কৃতি, স্বাতন্ত্র্য ও অধিকার প্রতিষ্ঠার মৌলিক লড়াইয়ের প্রকাশ।

আজ স্বাধীন দেশের মুক্ত বাতাসে রাজকীয় আয়োজনে একুশের আয়োজন দেখি। যে আয়োজনে আনুষ্ঠানিকতার প্রাচুর্য আছে। কিন্তু মনে হয় কোথায় যেন কিছু একটা নেই। আনুষ্ঠানিকতার আড়ালে আমাদের প্রাণের সংযোগটুকু হারিয়ে গেছে। হারিয়ে গেছে দেশপ্রেমের সুতীব্র অনুভূতি। নিজের অধিকারের কথা বলার স্বাধীনতার যে দীপ্ত আলোর ছটা ছিল একুশের চেতনায় আজ তা নিষ্প্রভ। মতপ্রকাশের স্বাধীনতা ক্রমে সঙ্কুুচিত। ভাষা আন্দোলনের সাথে দেশপ্রেমের যে নিবিড় বন্ধন, জাতীয় ঐক্য এবং স্বাধীনতার যে উজ্জীবিত প্রেরণা তা আজ খুঁজে পাওয়া ভার। দেশ গড়ার জাতীয় ঐক্য আজ খণ্ডিত। একুশে আজ করপোরেট কালচারের প্রকাশ, বাণিজ্যের মোক্ষম হাতিয়ার।

সুযোগসন্ধানীদের দু’পয়সা কামানোর সুবর্ণ সুযোগ। একুশে এলে নতুন ফ্যাশন নিয়ে নিজেকে একুশেপ্রেমী বানানোর প্রতিযোগিতার ভিড়ে একুশের চেতনা কোথাও আজ খুঁজে পাই না। বিশাল আয়োজনের বইমেলা নিতান্ত শহুরে জীবনাচারে পরিণত হয়েছে। বৃহত্তর জনগোষ্ঠীর সম্পৃক্ততা- দৃষ্টিকটুভাবে অনুপস্থিত। নিদেনপক্ষে প্রতিটি জেলা সদরে-বইমেলা বা বই প্রদর্শনীর ব্যবস্থা হলে এর অভাব খানিকটা হলেও পূরণ হবে। উৎসাহীরা পুরোনো বইয়ের সূত্র ধরে শেকড় সন্ধানের সুযোগ পেতেন, যা বর্তমান বইমেলার আদলে খুঁজে পাওয়া ভার। বইমেলায় ভাষা আন্দোলনের পূর্বাপর নিয়ে একটি প্রদর্শনী মঞ্চ থাকলে পরবর্তী প্রজন্মের কাছে এর ভাবমর্যাদা সঠিকভাবে ফুটে উঠত। এতে নতুন প্রজন্মের সাথে ইতিহাসের মেলবন্ধন গড়ে উঠতে পারত।

ফেব্রুয়ারি মাস এলে বাংলাপ্রেমী সাজার প্রতিযোগিতা দেখে বিস্মিত হই। এদের সন্তানাদি দেশের বাইরে অন্য পরিবেশে অন্য সাংস্কৃতিক আবহে বড় হচ্ছে। যারা এখনো সন্তান-সন্ততিকে দেশের বাইরে পাঠাতে পারেননি, তারা দেশের ভেতরে ইংরেজি মাধ্যমে পড়াশোনা করাচ্ছেন, বিশেষ শ্রেণীর সামাজিক মর্যাদায় অভিষিক্ত হবেন বলে। এরা নিজেরা এবং তাদের সন্তান-সন্ততিরা ইংরেজি, বাংলা, হিন্দি মিশিয়ে এক অবোধ্য ভাষার জন্ম দিয়ে বাংলাভাষার স্বাতন্ত্র্য রক্ষার লড়াই করছেন! ভাষা আন্দোলনের ৭০ বছর পেরিয়ে গেলেও অদ্যাবধি এর সঠিক ইতিহাস সংরক্ষণে কোনো তথ্যভাণ্ডার তৈরি করা সম্ভব হয়নি। এমনকি কেন্দ্রীয়ভাবে ভাষা আন্দোলনকেন্দ্রিক কোনো জাদুঘর তৈরি হয়নি।

বাংলা ভাষাকে বাণিজ্যিক ভাষায় রূপান্তরিত করার কোনো উদ্যোগ দৃষ্টিমান নয়- এতদিনেও। এ ব্যাপারে আমাদের ইলেকট্র্রনিক মিডিয়াগুলোর প্রতিযোগিতা দেখলে লজ্জায় মাথা হেঁট হয়ে আসে। ইলেকট্র্রনিক মিডিয়ায় অবলীলায় যে ভাষা ব্যবহৃত হচ্ছে তার ভাবার্থ বুঝতে হলে নতুন অভিধান রচনার প্রয়োজন হবে। এখানে বাংলা ভাষা সবচেয়ে করুণ অবস্থায়। সব কিছু দেখে আশঙ্কা হচ্ছে রাষ্ট্রীয় ও দাফতরিক ভাষা বাংলা হওয়া সত্ত্বে¡ও কেন জানি বাংলাকে অপাঙ্ক্তেয় করার, দ্বিতীয় বা তৃতীয় অবস্থানে ঠেলে দেয়ার একটি সূক্ষ্ম এবং দীর্ঘমেয়াদি কর্মযোগ চলছে সবার অগোচরে।

লেখক : চক্ষুরোগ বিশেষজ্ঞ
Email-shah.b.islam@gmail.com


আরো সংবাদ



premium cement