২৯ এপ্রিল ২০২৪, ১৬ বৈশাখ ১৪৩১, ১৯ শাওয়াল ১৪৪৫
`


সমকালীন প্রসঙ্গ

ঘৃণা

ঘৃণা - নয়া দিগন্ত

ঘৃণা নিয়ে বিস্তারিত লেখার আগে মহাকবি আল্লামা ইকবালের একটি অমিয় বাণী উল্লেখ করা প্রয়োজন। তিনি বলেন, মানুষের মধ্যে যারা ক্ষমতাধর তারা অনেকেই নিজেদেরকে ঈশ্বরের অবতার মনে করেন। আর যারা অতি ক্ষমতাধর তারা নিজেদের ঈশ্বর দাবি করে বসেন। অন্যদিকে, ক্ষমতাধর ও অতি ক্ষমতাধরদের হাতে নিপীড়িত হতে হতে মানুষ যখন মজলুম হয়ে পড়ে তখন তারা ধীরে ধীরে সব মানবীয় গুণাবলি যথা- সাহস-শক্তি, বিবেক-বাকশক্তি, চিন্তাশক্তি, প্রতিবাদ করার হিম্মত হারাতে হারাতে এতটাই নিয়তিনির্ভর হয়ে পড়ে যে, তারা নিজেদের সব কিছু সত্যিকার ঈশ্বরের কাছে সমর্পণ করে একেবারে খামোশ হয়ে যায়।

আল্লামা ইকবালের উল্লিখিত প্রসঙ্গে আজকের শিরোনাম ঘৃণার কী সম্পর্ক তা আরো স্পষ্ট করার জন্য মানবজাতির সর্বকালের সেরা মরমি সাধক ও কবি জালাল উদ্দিন রুমির একটি বক্তব্য উল্লেখ করতে চাই। তিনি বলেন, আমরা যা শুনি তার পেছনেও একটি বিপরীত শব্দ থাকে যা শোনা যায় না এবং যা কখনো মানুষের মুখ দিয়ে বের হয় না আর সেটি হলো হৃদস্পন্দন বা হৃদয়ের কথা। মাওলানা রুমির বক্তব্যের ভাবার্থ হলো, মানুষের হৃদয়ে যে কথা অনুরণিত হয় তা দিয়েই মানুষ পরিচালিত হতে থাকে। কেউ হয়তো আপনার শরীরের দখল নিতে পারে- জবানকে বাধ্য করতে পারে কিংবা আপনার শ্রবণশক্তির ওপর জোর খাটাতে পারে কিন্তু মানুষের হৃদয়ের স্পন্দন পাল্টে দেয়ার কোনো ক্ষমতা বা প্রযুক্তি আজ পর্যন্ত আবিষ্কৃত হয়নি।

আলোচনার এ পর্যায়ে শিরোনামের প্রেক্ষাপট ও সেই প্রেক্ষাপটের সাথে আল্লামা ইকবালের এবং মাওলানা জালালউদ্দিন রুমির অমিয় বাণীর কী সম্পর্ক তা নিয়ে সংক্ষেপে কিছু বলে নিই। হাল আমলের বাংলাদেশে নির্বাচন নামের কিছু ঘটানোর জন্য যে চেষ্টা-তদবির হচ্ছে তার পক্ষে-বিপক্ষে কথা বলার জন্য টেলিভিশন চ্যানেলগুলো প্রতি রাতেই প্রায় শ’খানেক আলোচনা অনুষ্ঠানের আয়োজন করে থাকে যা কি না টকশো নামে ব্যাপক পরিচিত। আমি সেই ২০০৯ সাল থেকেই টেলিভিশন টকশোতে নিয়মিত কথাবার্তা বলে থাকি- যার ধারাবাহিকতায় অতি সম্প্রতি বাংলাভিশন টেলিভিশনের মধ্যরাতের অনুষ্ঠান নিউজ অ্যান্ড ভিউজে আজকের শিরোনাম প্রসঙ্গে আলোচনা করি।

সময়স্বল্পতার কারণে ঘৃণা নিয়ে বিস্তারিত বলতে পারিনি বিধায় আজকের নিবন্ধে ঘৃণার চেহারা-চরিত্র, কারণ-প্রেক্ষাপট ও পরিণাম নিয়ে সাধ্যমতো আলোচনা করব। যে অনুষ্ঠানে আমি ঘৃণা নিয়ে কথা বলেছিলাম সেখানে আমার সহ-আলোচক বলার চেষ্টা করছিলেন যে, ২০২৪ সালের ৭ জানুয়ারি যে নির্বাচন হওয়ার প্রপাগান্ডা চালানো হচ্ছে সেখানে আওয়ামী লীগ অন্তত দেশের ৬৫ শতাংশ ভোটারকে অনুনয়-বিনয় করে কিংবা প্রয়োজন পড়লে কোলে করে এনেও যদি ৪০ শতাংশ ভোটার উপস্থিতি নিশ্চিত করতে পারে তবে পশ্চিমা দুনিয়ার দাবি মতো- অংশগ্রহণমূলক নির্বাচন হয়ে যাবে। সহ-আলোচক বলার চেষ্টা করেন যে, সারা দেশে বিএনপির ৩৫ শতাংশ ভোট রয়েছে। এসব ভোটারের কেউ যদি ভোটকেন্দ্রে না-ও আসেন তবুও তো ৬৫ শতাংশ লোক অবশিষ্ট থাকবেন যাদের কাছে প্রার্থীরা প্রচার চালাতে পারবেন।

আমার সহ-আলোচকের সহজ-সরল হিসাবের বিপরীতে আমি বলতে পারতাম যে, বিএনপির ৩৫ শতাংশ ভোটের সাথে জামায়াতের ১২ শতাংশ, হেফাজতের ১০ শতাংশ ও চরমোনাইয়ের ৮ শতাংশ যোগ করলে মোট ভোটার সংখ্যা দাঁড়ায় ৬৫ শতাংশ। সুতরাং আওয়ামী লীগের ভাগে যদি মাত্র ৩৫ শতাংশ ভোট থাকে তা ভোটের মাঠে নৌকা-বনাম ডামি বনাম স্বতন্ত্র-বিদ্রোহীতে ভাগ করলে একেক ভাগে কত শতাংশ পড়ে। এর সাথে যদি জাতীয় পার্টিসহ নয়া কিংস পার্টি যোগ করেন তবে ৩৫ শতাংশ ভোটকে ১০ ভাগে বিভক্ত করতে হবে। এরপর যদি ভোটার উপস্থিতি সর্বোচ্চ ৭০ শতাংশও ধরেন তবে ৩৫ শতাংশের মধ্যে মাত্র সাড়ে ২৪ শতাংশ লোক ভোটকেন্দ্রে আনা যেতে পারে। এবার সাড়ে ২৪ কে ১০ ভাগে ভাগ করলে প্রার্থীরা কে কত পাবেন তা নিয়ে গবেষণা করলে অন্তত কয়েক বছর সময় পার হয়ে যাবে।

চলমান দুর্বোধ্য সময়ে মানুষের ধৈর্য সহ্য এতটা স্পর্শকাতর হয়ে পড়েছে, যার কারণে কথা বলতে কিংবা লিখতে গিয়ে আমি সর্বদা সতর্কতা অবলম্বন করি যাতে করে কেউ যেন হঠাৎ আমার ওপর আক্রমণাত্মক হয়ে না পড়েন। এখনকার দিনে হাতের চেয়ে হাতিয়ার, বিবেকের চেয়ে হিংস্রতা এবং বিচার-বিবেচনার চেয়ে তাঁবেদারি এতটা বেড়েছে, যার কারণে চেহারা সুরতে মানবরূপ থাকলেও অনেকের মধ্যে হিংস্র প্রাণীর বৈশিষ্ট্য গিজ গিজ করে; আর এ কারণে আকার ইঙ্গিতে-ঘুরিয়ে পেঁচিয়ে বিভিন্ন মহামানবের রেফারেন্স ব্যবহার করে আলোচনার চেষ্টা চালাই। আমার কৌশলের পরাকাষ্ঠা দেখাতে গিয়েই প্রথমে মাওলানা জালালউদ্দিন রুমির অমিয় বাণীর অবতারণা করতে গিয়ে আমি বলি যে, নির্বাচন নিয়ে যাই প্রচার করা হোক না কেন, তা কাজে আসবে না। বরং নির্বাচন নিয়ে মানুষের হৃদয়ের যে স্পন্দন সেখানে যদি ঘৃণা থাকে তবে শত চেষ্টা করেও ভোটকেন্দ্রে ভোটারদের উপস্থিত করা যাবে না। বাংলাদেশের ৩০০টি সংসদীয় আসনের প্রতিটিতে যদি গড়ে ৫০০ ভোটকেন্দ্র থাকে তবে সারা দেশে কমবেশি ১৫ হাজার ভোটকেন্দ্র রয়েছে। মানুষের মনে যদি ভোট সম্পর্কে বেদনা থাকে এবং আয়োজকদের বিরুদ্ধে ঘৃণা থাকে তবে ভোটার আমদানির সব চেষ্টা ব্যর্থ হবে। এমনকি ১৫ হাজার ভোটকেন্দ্রে দুনিয়া কাঁপানো বিনোদন তারকা যথা- মাইকেল জ্যাকসন, ম্যাডোনা-সাকিরা-জেনিফার লোপেজ, এ আর রহমান প্রমুখের ১৫ হাজার কার্বন কপি কিংবা ডামি কপি তৈরি করে কনসার্ট আয়োজন করা হয় সে ক্ষেত্রে অনেকে হয়তো গান শুনতে আসবেন কিন্তু গানের সুরে মনের ঘৃণা দূর করে ভোটকেন্দ্রের ভোট বুথে ঢুকবেন না ভোট দেয়ার জন্য।

আমার উল্লিখিত বক্তব্য শোনার পর সহ-আলোচক বলার চেষ্টা করেন যে, আওয়ামী লীগের প্রতি মানুষের রাগ আছে, ক্ষোভ আছে, বিরক্তি আছে কিন্তু ঘৃণা নেই। যদি ঘৃণা থাকত তবে মানুষ সরকারের বিরুদ্ধে রাস্তায় নেমে বিক্ষোভ করত এবং সরকারের পতন ঘটাত। এসব কথার উত্তরে আমি ঘৃণা সম্পর্কে সামান্য আলোচনা করতে গিয়ে আল্লামা ইকবালের উক্তিটি সামনে নিয়ে আসি। কিন্তু সময়ের অভাবে ঘৃণা সম্পর্কে বিস্তারিত ব্যাখ্যা করতে পারিনি বিধায় আজকের নিবন্ধে সেই চেষ্টা শুরু করলাম ইনশা আল্লাহ।

আলোচনার শুরুতেই বলে নিই যে, মানুষের মনে যেই মুহূর্তে ঘৃণার বীজ রোপিত হয় তখন তা ক্যান্সারের মতো তার সব কিছু নিঃশেষ করে ফেলে। তার আশা-আকাক্সক্ষা, কাম-ক্রোধ, বেঁচে থাকার স্বপ্ন ধীরে ধীরে নিঃশেষ হয়ে যায়। মানুষ তখন প্রতিবাদের ভাষা হারিয়ে ফেলে, স্বপ্ন দেখতে ভুলে যায়, প্রতিবাদ করার পরিবর্তে দাসত্ব মেনে নেয় এবং বেঁচে থাকার পরিবর্তে মৃত্যুকে মুক্তির উপায় মনে করে। ঘৃণাকবলিত মানুষের কাজকর্ম করার ক্ষমতা থাকে না, উদ্ভাবনী ক্ষমতা শূন্যে নেমে আসে এবং উদ্যম বলতে যা বোঝায় তা মানুষের শরীর-মন-মস্তিষ্ক থেকে বের হয়ে যায়। মানুষ অতিমাত্রায় নিয়তিনির্ভর হয়ে পড়ে এবং জীবনের শেষ প্রান্তে এসে অভিশাপ দেয়ার ক্ষমতাও হারিয়ে ফেলে।

মানব মনের ঘৃণার উল্লিখিত বৈশিষ্ট্য দেখে আপনি নিশ্চয়ই আন্দাজ করতে পারছেন যে, বিদ্রোহ-বিপ্লব, মারামারী, দ্বন্দ্ব-ফ্যাসাদ এমনকি খুন-খারাবির মতো ঘটনা মানুষ তখনই ঘটায় যতক্ষণ পর্যন্ত তার মধ্যে মানবিক সত্তা থাকে এবং সেই সত্তার কারণে মানুষ বেঁচে থাকতে চায় এবং বাঁচার তাগিদে নিজ নিজ বুদ্ধি-বিবেক ও কৌশলে যাকে তার জন্য অর্থাৎ তার বেঁচে থাকার জন্য প্রয়োজন তাই করে। অন্য দিকে, তার বেঁচে থাকার অবিরত চেষ্টার বিরুদ্ধে যা কিছু সামনে পায় তা ছলে-বলে-কৌশলে পরাস্ত করার জন্য সর্বোচ্চ চেষ্টা-তদবির করে থাকে। কিন্তু মানুষ যখন সব কিছুতে ব্যর্থ হয় এবং কোনো উপায় খুঁজে না পায় তখন বাঁচার আশা বাদ দিয়ে মনের মধ্যে ঘৃণার বীজ বপন করে ধীরে ধীরে জীবনযুদ্ধের অধিক্ষেত্র থেকে নিজেদেরকে গুটিয়ে নেয়।

ঘৃণা সম্পর্কে উল্লিখিত বৈশিষ্ট্যের সাথে এবার আল্লামা ইকবালের বক্তব্য মেলানোর চেষ্টা করুন। প্রথমত, ঘৃণা সৃষ্টি হওয়ার ক্ষেত্রে দেশ-কাল সমাজে দুটো শ্রেণী পয়দা হয়। একটি অত্যাচারী এবং আরেকটি অত্যাচারিত। এই দু’টি সম্প্রদায়ের বিরোধে অত্যাচারী সম্প্রদায় যেদিন থেকে নিজেদেরকে ঈশ্বরের প্রতিভু অথবা ঈশ্বর মনে করে জুলুম অত্যাচার করাকে নিজেদের দায়িত্ব-কর্তব্য এবং জীবনের অপরিহার্য নিত্যনৈমিত্তিক লীলাখেলা হিসেবে জ্ঞান করে এবং সমাজ সংসারে উপর্যুপরি প্রলয় ঘটাতে থাকে- সে অবস্থায় নির্যাতিতরা অসহায় হয়ে নিজেদেরকে গুটিয়ে ফেলে এবং মনের মধ্যে ঘৃণার বীজ বপন করে দিবারাত্র অভিশম্পাত করে নিজেদের সব কিছু ঈশ্বরের ওপর ন্যস্ত করে প্রলয়ের আশায় দিনাতিপাত করে। ফলে প্রকৃতিতে নিদারুণ এক শূন্যতার সৃষ্টি হয় এবং একই সময়ে অর্থনীতি, জীবনযাত্রা, সামাজিক সংহতি, রাষ্ট্রীয় সংহতি সব কিছু এলোমেলো হয়ে যায়।

প্রকৃতির স্বাভাবিক বৈশিষ্ট্যগুলোর মধ্যে প্রাচীনতম বৈশিষ্ট্যগুলো- প্রকৃতি শূন্যতা সহ্য করতে পারে না। নির্যাতিত সম্প্রদায়ের ছেড়ে দেয়া শূন্যস্থান পূরণের জন্য প্রকৃতি তার আপন খেয়াল ও খুশিমতো বিকল্প শক্তি তৈরি করে যারা অনায়াসে ক্ষমতাধর কিংবা অতি ক্ষমতাধরদেরকে কুপোকাত করে ফেলে। প্রকৃতির এই কর্মটি এতটা অলৌকিক এবং এতটা ঝড়োগতির যে, মানুষের দিব্যদৃষ্টি ও স্বাভাবিক মন-মানসিকতা দিয়ে ঘটনার এক মুহূর্ত আগেও আন্দাজ করা সম্ভব নয়।

লেখক : সাবেক সংসদ সদস্য


আরো সংবাদ



premium cement