২৯ এপ্রিল ২০২৪, ১৬ বৈশাখ ১৪৩১, ১৯ শাওয়াল ১৪৪৫
`


মানুষ ও ধর্ম

মানুষ ও ধর্ম - নয়া দিগন্ত

মনীষীগণ ধর্মকে নানাভাবে সংজ্ঞায়িত করেছেন। এক ধর্মের সাথে অপর ধর্মের প্রকৃতি ও বৈশিষ্ট্যে ভিন্নতার কারণে প্রতিটি ধর্মেরই রয়েছে আলাদা বৈচিত্র্য ও পৃথক ইতিহাস। কোনো ধর্ম তাওহিদবাদী, কোনোটা বহু ঈশ্বরবাদী, কোনোটা ইহজাগতিক আবার কোনোটা পারলৌকিক জীবনকে কেন্দ্র করে আবর্তিত। ধর্ম মানবজাতির একটি সর্বজনীন প্রতিষ্ঠান। সব যুগে ও সব দেশে ধর্মের অস্তিত্ব বিদ্যমান। সমাজবিজ্ঞানী জনস্টোন ধর্মের সংজ্ঞা দিতে গিয়ে বলেন, ‘ধর্ম হচ্ছে বিশ্বাস ও আচরণনির্ভর এমন এক পদ্ধতি যার মাধ্যমে সমাজের মানুষ অতি প্রাকৃত শক্তি এবং পবিত্র জগৎ সম্পর্কে ব্যাখ্যা দেয় এবং প্রতিক্রিয়া জ্ঞাপন করে।’ রিলিজিয়ন শব্দের অর্থ দাঁড়ায় এক বা একাধিক ঈশ্বর বা দেবতার অস্তিত্বের প্রতি বিশ্বাস ও ভক্তি, যিনি বা যারা এ বিশ্বকে তৈরি করেছেন এবং মানুষকে দিয়েছেন একটি আধ্যাত্মিক প্রকৃতি যা দেহের মৃত্যুর পরেও অব্যাহত থাকে (A.S Hornby, Oxford Advance Learners Dictionary, 1991, P. 1064)।

উপরিউক্ত সংজ্ঞাগুলো বিশ্লেষণ করলে প্রতীয়মান হয় যে, ধর্ম মূলত একটি সুগভীর বিশ্বাস এবং বিশ্বাসকে কেন্দ্র করে আবর্তিত এমন কিছু আচার আচরণের নাম যা দিয়ে সমাজবদ্ধ মানুষ তার জীবনের মৌলিক সমস্যাবলি মোকাবেলা করতে চায় এবং জীবন জিজ্ঞাসার জবাব খুঁজে পেতে চায়। মানবজীবনের গতিধারা অতি জটিল যেখানে রয়েছে আশা-নিরাশা, দুঃখ-বেদনা, হাসি-কান্না ও জন্ম-মৃত্যুর অবধারিত বিষয়াবলি। জীবনের উদ্দেশ্য কী? কোথায় এর পরিসমাপ্তি? মৃত্যু কী? তার পরই বা কী হয়? এসব প্রশ্ন মানুষকে ভাবিয়ে তোলে। ধর্ম এসব জীবন জিজ্ঞাসার জবাব দিতে চেষ্টা করে। বিজ্ঞানের প্রভূত উন্নতি সত্ত্বেও মানুষ এসব প্রশ্নের উত্তর খুঁজে পায়নি। তাই বলা হয়ে থাকে, ‘বিজ্ঞানের যেখানে শেষ ধর্মের সেখানে শুরু’ (ড. আনোয়ার উল্লাহ চৌধুরী, সমাজবিজ্ঞান, ১ম খণ্ড, পৃষ্ঠা-১১৫)।

মানুষের সাথে ধর্মের রয়েছে নিবিড় সম্পর্ক। ধর্মকে অবলম্বন করে মানুষ তার পার্থিব ও পারলৌকিক জীবন গড়ে তোলে। তাই মানবজীবনের বিভিন্ন পর্যায়ে ধর্মের প্রয়োজনীয়তা ও প্রভাব অত্যন্ত সুদূরপ্রসারী। ধর্ম মানুষের ব্যক্তি, পরিবার, সমাজ, অর্থনীতি, রাজনীতি ও সংস্কৃতির পরিমণ্ডলে গুরুত্বপূর্ণ স্থান দখল করে আছে। সামাজিক ও মানবিক মূল্যবোধ জাগ্রতকরণে ধর্ম তাৎপর্যপূর্ণ ভূমিকা পালন করে থাকে। স্রষ্টার কাছে জবাবদিহির ভয়াবহতা থেকে রক্ষা করে মুক্তির শ্যামল প্রান্তরে নিয়ে যায়। ধর্মীয় বিশ্বাসের কারণে মানুষ মূল্যবোধ পরিপন্থী অসৎকাজ থেকে নিবৃত্ত থাকে এবং পারলৌকিক পুরস্কারের প্রত্যাশায় সৎকাজ ও মহৎ কর্মকাণ্ডে মানুষকে উদ্বুদ্ধ করতে ধর্মের অবদান অনস্বীকার্য। সামাজিক ঐক্য ও সংহতি জোরদারে ধর্মের ভূমিকা অত্যন্ত সহায়ক। ধর্ম সামাজিক নিয়ন্ত্রণের এক শক্তিশালী মাধ্যম। কারণ, আইনের চোখে ধুলা দেয়া সম্ভব হলেও বিবেক ও ‘অতিপ্রাকৃত শক্তি’কে ফাঁকি দেয়া সম্ভব নয়। ধর্মের মাঝেই মানুষ জীবন ও জগতের সমাধান খোঁজে। মানবজীবনের প্রতিটি ক্ষেত্রে বিশেষত জন্ম, মৃত্যু, অন্ত্যেষ্টিক্রিয়া, যৌনকর্ম, বিয়ে, দাম্পত্যজীবন ইত্যাদিতে ধর্মবিশ্বাস ও ধর্মীয় আচারপদ্ধতির প্রতিফলন লক্ষ করা যায়। জাগতিক জীবনে আশাহত মানুষকে ধর্ম আশ্বাসের বাণী শোনায় এবং বেদনা ও যাতনা সইবার শক্তি জোগায়। জাতি, ধর্ম, বর্ণ, ভাষা, সংস্কৃতি ও সীমান্তের ব্যবধান দূর করতে ধর্মের ভূমিকা বিরাট। সুতরাং মানুষ ও ধর্ম পরস্পর অবিচ্ছিন্ন। ধর্মের প্রয়োজনীয়তা মানবসমাজে সব যুগে ও সব সময় ছিল। মানবজীবনে ধর্মের বহুমাত্রিক উপযোগিতা প্রাচীনকালের তুলনায় আধুনিককালে আরো বেশি অনুভূত হচ্ছে।

ইসলাম প্রচলিত অর্থে কেবল ধর্ম নয়, এক পূর্ণাঙ্গ দ্বীন। কুরআন-হাদিসের কোথাও ইসলামকে ধর্ম হিসেবে উল্লেখ করা হয়নি। কুরআনের পরিভাষায় ‘দ্বীন’ বলতে সেসব রীতি-পদ্ধতি, মূলনীতি ও বিধি-বিধানকে বোঝায় যা হজরত আদম আ: থেকে শুরু করে শেষনবী হজরত মুহাম্মদ সা: পর্যন্ত সব পয়গম্বরের মধ্যে সমভাবেই বিদ্যমান রয়েছে। সব পয়গম্বরের দ্বীন এক ও অভিন্ন। প্রথম নবী হজরত আদম আ: যে ধর্ম নিয়ে আসেন তারই নাম ইসলাম। তিনিই মানবজাতির ইতিহাসে প্রথম মানব, প্রথম নবী ও প্রথম রাসূল ছিলেন। যুগে যুগে, দেশে দেশে আল্লাহতায়ালা মানবজাতির ইহকালীন কল্যাণ ও পারলৌকিক নাজাতের উদ্দেশ্যে অগুনতি নবী ও রাসূল প্রেরণ করেন। সব আসমানি ধর্ম মূলত তাওহিদবাদী ও পৌত্তলিকতাবিরোধী। মানব ধর্ম হচ্ছে ইসলাম। কারণ, প্রত্যেক মানবশিশু স্বভাবধর্ম ইসলামের ওপর জন্মগ্রহণ করে, দুনিয়ায় এসে সে নিজ ধর্ম বেছে নেয়। একটি আসমানি ধর্ম প্রচারিত ও ক্রমবিকাশের পরকালের আবর্তে যখন বিকৃতি ও বিস্মৃতির অন্ধকারে হারিয়ে যেত, তখন আদমসন্তানের ধর্মচ্যুতি ঘটত।

আল্লাহ তায়ালা তখন নিজ আদেশ ও নিষেধ প্রচারার্থে নতুন নবী ও রাসূল প্রেরণ করতেন। আদম আ: থেকে নবুওয়তের এ ধারাবাহিকতা শুরু হয়ে হজরত মুহাম্মদ সা:-এর হাতে দ্বীনের পূর্ণতা পেয়েছে। রাসূলদের উপর আল্লাহ তায়ালা আসমানি কিতাব নাজিল করেছেন। এর মধ্যে চারটি কিভাব সর্বপ্রধান বলে বিবেচিত। এ কিতাব চারটির নাম তাওরাত, যবুর, ইঞ্জিল ও কুরআন। এ চারটি কিতাবের মধ্যে কুরআন সর্বশেষ ও সর্বশ্রেষ্ঠ কিতাব এবং কিয়ামত পর্যন্ত এটা অবিকৃত ও অপরিবর্তিত থাকবে। অন্য কিতাবসমূহ দুনিয়াতে আছে তবে নানারূপ পরিবর্তন ও পরিবর্ধন সাধিত হওয়ায় এগুলোকে আল্লাহর কালাম বলে শতভাগ দাবি করা যায় না। অপর দিকে, ইসলামই আল্লাহ তায়ালার মনোনীত পূর্ণাঙ্গ দ্বীন বা জীবনবিধান যা বিকৃতি ও বিস্মৃতির হাত থেকে রক্ষা পেয়েছে। পবিত্র কুরআনে আল্লাহ তায়ালা বলেন, ‘নিঃসন্দেহে ইসলামই আল্লাহর নিকট একমাত্র দ্বীন। আজ তোমাদের জন্য তোমাদের দ্বীন পূর্ণাঙ্গ করলাম ও তোমাদের প্রতি অনুগ্রহ সম্পূর্ণ করলাম এবং ইসলামকে তোমাদের দ্বীন মনোনীত করলাম’ (আল কুরআন ৩:১৯, ৫:০৩)। প্রত্যেক নবী ও রাসূলের আমলে যারা তাঁর প্রতি ঈমান এনেছে এবং তাঁদের আনীত শরিয়ত বা বিধিবিধানের অনুসরণ করেছে তারা সবাই মুসলমান ও মুসলিম নামে অভিহিত এবং তাঁদের ধর্মও ছিল ইসলাম। এ অর্থের দিকে লক্ষ্য করেই হজরত নূহ আ: বলেন, ‘আমি মুসলিম হওয়ার জন্য আদিষ্ট হয়েছি। মূসা বলেছিলেন, হে আমার সম্প্রদায়! যদি তোমরা আল্লাহতে ঈমান এনে থাকো, যদি তোমরা মুসলিম হও, তবে তোমরা আল্লাহর ওপর নির্ভর করো।’ (আল-কুরআন, ১০ : ৭২-৮৪)। এ কারণেই ইবরাহীম আ: নিজকে ও নিজ উম্মতকে উম্মতে মুসলিমা বলেছেন, ঈসা আ:-এর সহচরগণ এ অর্থের প্রতি লক্ষ্য করেই সাক্ষ্য দিয়ে বলেছিল, ‘সাক্ষী থাকুন যে, আমরা মুসলিম।’

আগেই উল্লিখিত হয়েছে যে, তাওহিদবাদী হিসেবে পরিচিত ইহুদি, খ্রিষ্টান ও মুসলমানদের নিজস্ব ধর্মগ্রন্থ রয়েছে, যা তাদের বিশ্বাসের বুনিয়াদ। মুসলমানগণ সব আসমানি কিতাব বিশেষত তাওরাত, যবুর, ইঞ্জিল ও কুরআনকে একই ধরনের ওহিলব্ধ ধর্মগ্রন্থ হিসেবে বিশ্বাস করেন ও সম্মানের চোখে দেখেন। এ ব্যাপারে কুরআনে সুস্পষ্ট নির্দেশ রয়েছে, ‘হে মুমিনগণ! তোমরা আল্লাহ, তাঁর রাসূল, তিনি যে কিতাব তাঁর রাসূলের প্রতি অবতীর্ণ করেছেন তাতে এবং যে কিতাব তিনি পূর্বে অবতীর্ণ করেছেন তাতে ঈমান আনো এবং কেউ আল্লাহ, তাঁর ফিরিশতা, তাঁর কিতাব, তাঁর রাসূল এবং আখিরাতকে প্রত্যাখ্যান করলে সে তো ভীষণ পথভ্রষ্ট হয়ে পড়বে।’ (আল কুরআন ৪:১৩৬)

কুরআন অন্যান্য নবী ও রাসূলের বিশেষত হজরত মূসা আ:, হজরত ঈসা আ:-এর অবতীর্ণ আল্লাহর বাণী সম্পর্কে সবিশেষ গুরুত্বারোপ করেছে। পক্ষান্তরে পাশ্চাত্যের সংখ্যাগুরু ইহুদি-খ্রিষ্টান সমাজ কুরআনকে আল্লাহর পক্ষ হতে নাজিলকৃত ধর্মগ্রন্থ হিসেবে স্বীকার করতে চান না। কুরআনের অনুসারী মুসলমানদের প্রতি তাদের নেতিবাচক দৃষ্টিভঙ্গি অনেক দুঃখজনক ঘটনার জন্ম দিয়েছে। খ্রিষ্টানরা মুসলমানদের মনে করে প্রধান শত্রু ও প্রবল বৈরী শক্তি। Kane J. Herbert-এর মন্তব্য এ ক্ষেত্রে প্রণিধানযোগ্য। ‘সপ্তম শতাব্দীতে ইসলামের আকস্মিক উত্থান ও দ্রুত বিস্তারের ফলে খ্রিষ্টান গির্জাগুলো নিশ্চিতভাবে বিরাট হুমকির সম্মুখীন হয়ে পড়ে জঙ্গি মিশনারি ধর্ম ইসলাম খ্রিষ্টবাদের জন্য আজও অত্যন্ত বিপজ্জনক এক প্রতিদ্বন্দ্বী (Kane J. Herbert, A Global View of Christian Mission, Michigan,1975, P. 49)। বস্তুত কুরআনে প্রচুর বৈজ্ঞানিক তথ্য রয়েছে এবং তার সবই সত্যভিত্তিক। কুরআনে বিজ্ঞানসংক্রান্ত একটি বক্তব্যও খুঁজে পাওয়া যাবে না যেটি বৈজ্ঞানিক সত্যের বিরোধী (ড. মরিস বুকাইলি, বাইবেল, কুরআন ও বিজ্ঞান, ঢাকা ৬ সংস্করণ, ১৯৯৫, পৃষ্ঠা ৭, ৮, ৩২৫)।

মানবজীবনে ধর্ম সান্ত¡না, মানসিক সুস্থতা ও ইতিবাচক সামাজিক পরিবর্তনের শক্তিশালী উৎস, নৈতিক বিশ্বাস ও আচরণের জন্য একটি মজবুত ভিত্তি এবং সম্প্রদায়ের অনুভূতি ও ঐতিহ্যের বন্ধনকে সুদৃঢ় করে। গবেষণায় প্রমাণিত এটি শারীরিক ও মানসিক স্বাস্থ্যকে প্রভাবিত করতে কার্যকর ভূমিকা রাখে।

লেখক : অতিথি অধ্যাপক, আন্তর্জাতিক ইসলামী বিশ্ববিদ্যালয়, চট্টগ্রাম


আরো সংবাদ



premium cement