২৯ এপ্রিল ২০২৪, ১৬ বৈশাখ ১৪৩১, ১৯ শাওয়াল ১৪৪৫
`


ইসলামী রাষ্ট্রব্যবস্থার বৈশিষ্ট্য

ইসলামী রাষ্ট্রব্যবস্থার বৈশিষ্ট্য - নয়া দিগন্ত

সারা বিশ্বময় আজ বেজে উঠেছে অশান্তি ও নৈরাজ্যের দামামা, দেখা দিয়েছে সন্ত্রাস ও অস্থিতিশীলতার অশনি সঙ্কেত। ব্যক্তি, পরিবার ও সমাজে আজ নিরাপত্তাহীনতার প্লাবন। রাষ্ট্রীয় পর্যায়ে আদর্শিক নেতৃত্বের অভাবহেতু হানাহানি। বস্তুবাদী শিক্ষা ও ভোগবাদী সভ্যতার প্রভাবে নৈতিকতাবোধ পরাভূত। দেশে দেশে শাসকগোষ্ঠীর স্বেচ্ছাচারিতায় মানবাধিকার ভূলুণ্ঠিত। আল্লাহর আরশ কাঁপছে বিপন্ন ও অধিকারহারা মানুষের করুণ আহাজারিতে। কেন এমনটি হলো? এর কারণ খুঁজতে হবে। সমাধান পেতে হবে। বাদশাহী শাসনের নামে ফিরআউনি শাসন, পোপের শাসনের নামে নিপীড়নমূলক শাসন, জনগণের শাসনের নামে বহুদলীয় স্বৈরশাসন, সামরিক শাসনের নামে ফ্যাসিবাদী শাসন ও বঞ্চিতদের শাসনের নামে একনায়কত্বের শাসন বিশ্ববাসীকে হতাশা, অস্বস্তি ও ধ্বংসের প্রান্তসীমায় এনে দাঁড় করিয়েছে। মানুষের গড়া এসব আইনের শাসনের আরো কত বিচিত্র নাম রয়েছে! এসব শাসন হচ্ছে আল্লাহর আইনের শাসনের বিকল্প পদ্ধতি। মানুষের ওপর মানুষের প্রভুত্ব সৃষ্টির ম্যাকিয়াভেলিয়ান কৌশল।

আল্লাহর আইনের প্রতিপক্ষ হিসেবে মানবরচিত আইন ও শাসনব্যবস্থা যুগে যুগে মানবজাতির শান্তি ও কল্যাণ সাধনে ব্যর্থ হয়েছে। বর্তমান যুদ্ধ-বিক্ষুব্ধ বিশ্ব তার প্রমাণ। পৃথিবীর এমন কোনো মহাদেশ খুঁজে পাওয়া যাবে না, যেখানে প্রতিবেশী রাষ্ট্রের সাথে অপর রাষ্ট্রের, সরকারি বাহিনীর বিদ্রোহী গেরিলাদের অথবা দুই ধর্মীয় মতাবলম্বীদের মধ্যে সংঘর্ষ, যুদ্ধ বা দাঙ্গা-বিরোধ চলছে না। এ ক্ষেত্রে আল্লাহ প্রদত্ত আইন এবং একে ভিত্তি করে বিশ্বনবী সা: প্রবর্তিত প্রশাসন ও রাষ্ট্রব্যবস্থা মানুষের মুক্তির একমাত্র গ্যারান্টি হতে পারে।

বিশ্ববিখ্যাত গ্রিক পণ্ডিত প্লেটো তার সুবিখ্যাত দ্য রিপাবলিক গ্রন্থে ‘আইডিয়াল স্টেট’ তথা একটি আদর্শ রাষ্ট্রের কথা বললেও বস্তুত তা ছিল কাল্পনিক। কারণ বিশ্বের কোথাও প্লেটোর কথিত আদর্শ রাষ্ট্র বাস্তবরূপ পরিগ্রহ করেনি। পক্ষান্তরে, মানবতার মুক্তির দিশারি বিশ্বনবী হজরত মুহাম্মদ মুস্তাফা সা: মদিনাকেন্দ্রিক যে বিশ্বজনীন ‘কল্যাণরাষ্ট্র’ প্রতিষ্ঠা করেন তা পৃথিবীর ইতিহাসে বিরল। ইসলাম মনিব ও ভৃত্য থেকে শুরু করে রাষ্ট্রপ্রধান থেকে সিপাহি পর্যন্ত সবাইকে এমন এক সাম্য ও ন্যায়ভিত্তিক রাষ্ট্রব্যবস্থার পতাকাতলে সমবেত করে; যেখানে আইনের দৃষ্টিতে সবার অধিকার সমান, অপরাধ প্রমাণিত হওয়া সাপেক্ষে প্রশাসনিক দণ্ড ধনী-গরিব নির্বিশেষে সবার জন্য কার্যকর। কেউ খাবে আর কেই অভুক্ত থাকবে, কেউ বিচারের সম্মুখীন হবে আর কেউ বিনাবিচারে পার পেয়ে যাবে- মানবরচিত শাসন ও রাষ্ট্রব্যবস্থার এমন ফাঁকফোকর ও ত্রুটি থেকে এটি সম্পূর্ণ মুক্ত। তাওহিদ ও রিসালাতভিত্তিক ইসলামী রাষ্ট্রব্যবস্থা বিশ্বমানব সমাজকে এমন এক প্রশাসনিক ঐক্যে মিলিত করে যেখানে কেবল আমলাতান্ত্রিক খবরদারিতে নয়; বরং প্রজাতন্ত্রের প্রত্যেক কর্মচারী আল্লাহর কাছে জবাবদিহির প্রেরণা থেকে রাষ্ট্রীয় কর্তব্য পালনকে নিজের জীবন ও সম্পদের মতো মূল্যবান মনে করে। এটি ইসলামী রাষ্ট্রব্যবস্থার মূল বৈশিষ্ট্য।

বর্তমান যুগ যন্ত্রের যুগ। যেকোনো যন্ত্র দেখলে আমরা অতি সহজে বুঝতে পারি, যন্ত্র প্রস্তুতকারক আপন পদ্ধতি ও প্রণালীসহকারে এটিকে নির্মাণ করেছেন। এর নির্মাণকৌশল ও ব্যবহারপ্রণালী প্রস্তুতকারকের পূর্বনির্ধারিত। তাই প্রস্তুতকারকের নির্দেশ মোতাবেক যন্ত্র ব্যবহার করতে হয়। যদি কেউ মনগড়া পদ্ধতিতে যন্ত্র পরিচালনা করতে চায়, তবে যন্ত্রটি বিনষ্ট হয়ে ব্যবহারের অনুপযোগী হবে এবং অনেক সময় ব্যবহারকারী নিজেও হতে পারে বিপদের সম্মুখীন। এ বিশ্বচরাচর মহান আল্লাহর সৃষ্টি। মানব, মানবীয় জীবন ও এর সব কর্মকাণ্ড আল্লাহর মাখলুক। সুতরাং আল্লøাহর সৃষ্ট যন্ত্র এ পৃথিবীকে আল্লাহর আইন মোতাবেক পরিচালনা করা যুক্তিসঙ্গত। এর বিপরীত সব অযৌক্তিক ও অপ্রাকৃতিক। এ জন্য পৃথিবীর স্রষ্টা মহান আল্লাহ কুরআনুল কারিমে নিজে স্পষ্ট ভাষায় ঘোষণা করেছেন- ‘আল্লাহর আইন অনুযায়ী যারা শাসনক্ষমতা পরিচালনা করে না, তারা ফাসিক, জালিম ও কাফির।’ (সূরা আল-মায়িদা-৪৪, ৪৫ ও ৪৭)

বর্তমানে গোটা দুনিয়ায় পাশ্চাত্য বস্তুবাদী সভ্যতা ও ইসলামী সভ্যতার মধ্যে মোকাবেলা হচ্ছে, আর সংঘর্ষ হচ্ছে আল্লাহর আইনের শ্রেষ্ঠত্ব ও মানুষের তৈরি আইনের নেতৃত্ব নিয়ে। এটি সভ্যতা ও সংস্কৃতির যুদ্ধ এবং দু’টি বিপরীতমুখী প্রাকৃতিক ও অপ্রাকৃতিক শাসনপদ্ধতির দ্বন্দ্ব। প্রতিটি জায়গায় বস্তুবাদী সভ্যতা ও মানুষের তৈরি আইন- এ দুই পাথরের নিচে মানুষ পিষ্ট হতে চলেছে। মর্দে মুমিন সীমান্তের সার্বক্ষণিক প্রহরায় নিয়োজিত তাকে অহোরাত্র জাগ্রত থাকতে হবে এবং মজবুতভাবে স্থির থাকতে হবে, যাতে প্লাবনের স্রোতে ভেসে না যায়। সতর্ক থাকতে হবে যাতে ঈমানি ঘূর্ণিঝড়ের সন্ধিক্ষণে তাকে তন্দ্রা স্পর্শ না করে।

আল্লাহর আইনের লক্ষ্য হচ্ছে মহান আল্লাহ তায়ালার সন্তুষ্টি অর্জন এবং উদ্দেশ্য হচ্ছে চতুর্বিধ : প্রথম উদ্দেশ্য- দ্বীন প্রতিষ্ঠা অর্থাৎ দ্বীন ইসলামকে শক্তিশালী ও সুদৃঢ় করা এবং প্রকাশ্যে দ্বীন ইসলামের বিধিবিধান জারি করা।
দ্বিতীয় উদ্দেশ্য- শান্তি প্রতিষ্ঠা অর্থাৎ দেশের জনগণ যাতে স্বাধীনভাবে, সুখে ও শান্তিতে জীবনযাপন করতে পারে, কোনো প্রকার ভয় ও ভীতি যাতে জনগণকে স্পর্শ করতে না পারে সে জন্য প্রয়োজনীয় ব্যবস্থা গ্রহণ করা।

তৃতীয় উদ্দেশ্য- দ্বীনের বিজয় দ্বীন ইসলামের দাওয়াত ও তাবলিগের জন্য কার্যকরী ব্যবস্থা গ্রহণ করা, যাতে দ্বীন ইসলাম অপরাপর ধর্মের ওপর বিজয়ী হয় এবং শ্রেষ্ঠত্ব অর্জন করে।
চতুর্থ উদ্দেশ্য- ইনসাফ প্রতিষ্ঠা আল্লাহর বান্দাদের ন্যায় ও ইনসাফের পূর্ণ নিশ্চয়তা প্রদান করা। ‘কোনো ব্যক্তি আইনের ঊর্ধ্বে নয়’-এ পরম সত্য কঠোরভাবে বাস্তবায়িত করা। রাষ্ট্রপ্রধান থেকে সাধারণ মানুষ প্রত্যেককে আইনের কাছে জবাবদিহি করতে বাধ্য করা। আল্লাহর আইন ও মানুষের তৈরি আইনের মধ্যে মৌলিক পার্থক্য রয়েছে। মানুষের আইন ইহজাগতিক সুখ ও শান্তির উদ্দেশ্যে রচিত, পক্ষান্তরে আল্লাহর আইন ইহজাগতিক শান্তির নিশ্চয়তা ও পারলৌকিক মুক্তির প্রতিশ্রুতি দেয়। আল্লাহর আইনের অধীনে পরিচালিত শাসনব্যবস্থায় আল্লাহ তায়ালার পরম সন্তুষ্টি অর্জন থাকে মুখ্য, পক্ষান্তরে মানুষের তৈরি আইনে তা গৌণ। এ জন্য আল্লাহ প্রদত্ত আইন অর্থাৎ কুরআন ও হাদিসে বর্ণিত বিধিবিধানের অনুসরণ দুনিয়ার সংশোধন ও আখিরাতের কামিয়াবির জন্য অপরিহার্য।

আল্লাহর আইনের প্রয়োজনীয়তা ও গুরুত্ব সম্পর্কে রাসূলুল্লাহ সা:-এর অসংখ্য বাণী ও নির্দেশ হাদিসের নির্ভরযোগ্য গ্রন্থগুলোয় সংরক্ষিত রয়েছে। আল্লাহর আইনের শাসনব্যবস্থাকে বোঝানোর জন্য হাদিস ও ফিকহের গ্রন্থগুলোর বিভিন্ন পরিভাষা ব্যবহার করা হয়েছে। এ শাসনব্যবস্থাকে কখনো ‘খিলাফত’, কখনো ‘ইমারত’ বা কখনো ‘ইমামত’ বলা হয়েছে। ঐশী আইনের শাসনব্যবস্থা মানুষের অধিকার নিশ্চিত করে, জালিমের ওপর মজলুমের বিজয় ঘটায় এবং অভাবগ্রস্ত মানুষকে অন্ন-বস্ত্রের গ্যারান্টি দেয়। এ শাসনব্যবস্থা হচ্ছে আল্লাহর অশেষ নিয়ামতের ছায়াস্বরূপ। হজরত ওমর রা: থেকে বর্ণিত- রাসূলুল্লাহ সা: বলেন, ‘সুলতান (অর্থাৎ আল্লাহর আইনের শাসনের প্রবর্তক) জমিনে আল্লাহর রহমতের ছায়াস্বরূপ। আল্লাহর বান্দাদের মধ্যে যারা মজলুম তার ন্যায়-ইনসাফের প্রত্যাশায় তাদের আশ্রয় নেয়। যদি সে ন্যায়ভিত্তিক বিচার করে আল্লøাহর পক্ষ থেকে সে প্রতিদান পাবে এবং জনগণের উচিত ইনসাফের জন্য কৃতজ্ঞতা প্রকাশ করা।’

আবদুল্লাহ ইবনে আব্বাস রা: থেকে বর্ণিত- রাসূলুল্লাহ সা: বলেন, ‘ন্যায়পরায়ণ ইমামের (অর্থাৎ আল্লাহর আইনের শাসক) একটি দিন ৬০ বছর নফল ইবাদতের চেয়ে উত্তম। হক ও ইনসাফের ভিত্তিতে একজন অপরাধীকে সাজা প্রদান ৪০ দিন উপকারী বৃষ্টিপাত হওয়ার চেয়েও অধিক বরকতময়। উপর্যুক্ত হাদিস থেকে এটি প্রমাণিত হয়, আল্লাহর আইনভিত্তিক শাসনব্যবস্থা এক প্রকার ইবাদত। যারা এ দায়িত্ব পালন করেন তাদের উচ্চতর মর্যাদাদানের প্রতিশ্রুতি রয়েছে। আবু সাঈদ খুদরি রা: থেকে বর্ণিত- রাসূলুল্লাহ সা: বলেন, ‘কিয়ামতের দিন আল্লাহর কাছে অতিপ্রিয় ও নিকটতম ব্যক্তি হবেন ইমামে আদিল তথা ন্যায়পরায়ণ শাসক আর সবচেয়ে অভিশপ্ত ও দূরে থাকবে জালিম শাসক।’

আল্লাহর আইনভিত্তিক শাসনব্যবস্থা আল্লাহর এক অফুরন্ত নিয়ামত, এক অবারিত রহমত। রাসূলুল্লাহ সা: ও খোলাফায়ে রাশিদিনের শাসনকাল তার বাস্তব নজির। নামাজভিত্তিক সমাজ, জাকাতভিত্তিক অর্থব্যবস্থা, সৎ কাজের প্রবর্তন ও অসৎ কাজের পথ রুদ্ধকরণের মাধ্যমে এমন এক প্রশাসনিক কাঠামো তারা গড়ে তুলেছিলেন যেখানে সত্যিকার শান্তি, সমৃদ্ধি ও স্থিতিশীলতা বিরাজ করেছিল। প্রতিটি মানুষ পেয়েছিল অন্ন, বস্ত্র, বাসস্থান ও শিক্ষার গ্যারান্টি। বিচারব্যবস্থা ছিল এমন ন্যায়ানুগ ও পক্ষপাতহীন যে, স্বয়ং রাষ্ট্রপ্রধানও আদালতের কাঠগড়ায় দাঁড়িয়ে ফরিয়াদির দায়েরকৃত অভিযোগের জবাব দিতে বাধ্য ছিলেন। জনগণ তাদের অভাব, অভিযোগ ও ফরিয়াদ নিয়ে সরাসরি শাসকদের সাথে সাক্ষাৎ করে আর্জি পেশ করতে পারত।

লেখক : অতিথি অধ্যাপক, আন্তর্জাতিক ইসলামী বিশ্ববিদ্যালয়, চট্টগ্রাম
drkh+alid09@gmail.com


আরো সংবাদ



premium cement