২৮ এপ্রিল ২০২৪, ১৫ বৈশাখ ১৪৩১, ১৮ শাওয়াল ১৪৪৫
`


বিহারে বর্ণভিত্তিক জনমিতি তুমুল নাড়া খাবে ব্রাহ্মণ্যবাদী ভারত

লালু প্রাসাদ যাদব ও নরেন্দ্র মোদি - ফাইল ছবি

ভারতে বর্ণপ্রথা নামের বিষবৃক্ষের শিকড় মাটির অতল গভীরে প্রোথিত। এতটাই গভীরে যে, তা উপড়ে ফেলা সুদূরভবিষ্যতেও কখনো সম্ভব হবে এমন আশা করাও বাতুলতা। আড়াই হাজার বছরের বেশি সময় ধরে এটি লালন করে এসেছে উচ্চবর্ণের একটি সংখ্যালঘু শ্রেণী। সংখ্যালঘু হলেও তারাই সমগ্র ভারতে সমাজ ও রাষ্ট্রের প্রতিটি ক্ষেত্রে নিরঙ্কুশ আধিপত্য চালিয়ে যাচ্ছে।

গণতন্ত্র রাষ্ট্রের সব নাগরিককে এক ধরনের সাম্যের নিশ্চয়তা দেয়। কিন্তু গত পৌনে এক শতকের স্বাধীন ভারতে যে গণতন্ত্রের চর্চা চলে আসছে তা সংখ্যালঘু উচ্চবর্ণের স্বার্থের সাথে আপস করেছে। এই আপসরফা হয়েছে সুকৌশলে। সংবিধানে সব নাগরিকের সমান অধিকারের স্বীকৃতি দেয়া হয়েছে। সব নাগরিককে ভোটের অধিকার দেয়া হয়েছে। কিন্তু অলিখিতভাবে নি¤œবর্ণের মানুষ (তফসিলি জাতি ও তফসিলি উপজাতি এবং অন্যান্য পিছিয়ে পড়া জাতিগোষ্ঠী) ও ধর্মীয় সংখ্যালঘুদের (মুসলিম, খ্রিষ্টান, শিখ ও অন্যান্য) বলতে গেলে বানানো হয়েছে দ্বিতীয় শ্রেণীর নাগরিক। আমাদের আজকের আলোচ্য ভারত রাষ্ট্রের সাম্প্রদায়িক চরিত্র তুলে ধরা নয়। কথা বলব জাতিভেদ হটানোর সম্ভাবনা নিয়ে।

পরমাণু শক্তিধর ভারত এখন বৈজ্ঞানিক গবেষণায় বেশ এগিয়ে। চাঁদে নিজের তৈরি মহাকাশযান পাঠাচ্ছে, হাইড্রোজেন ফুয়েল সেলের গাড়ি উদ্ভাবন করছে, প্রযুক্তিতে বিশ^বাসীর দৈনন্দিন জীবনে প্রভাব রাখছে। রাজনীতিকরা দেশটিকে বৃহত্তম গণতন্ত্রের দেশ বলতে গর্ববোধ করেন। বলিউডের ছায়াছবি বিশ^বাসীর সামনে ভারতকে বিশে^র অন্যসব উন্নত সমৃদ্ধ ও উদার মানবিক রাষ্ট্রগুলোর সমকক্ষ বলে তুলে ধরছে। ফলে বর্ণবাদ তথা জাতপাতের বিভাজনে দেশটি কোন অন্ধকার গর্তে ডুবে আছে তা বাইরের বিশ^ জানতে পারছে না। মানুষে মানুষে বিদ্বেষ, বিভাজন, বৈষম্যের এই বিষাক্ত ছোবল কতদূর বিস্তৃত তার প্রমাণ, এখনো সে দেশের সর্বত্র নিম্নবর্ণের মানুষেরা অস্পৃশ্য বলেই গণ্য। এমন অনেক জায়গা আছে যেখানে তাদের ছায়াও যাতে উচ্চবর্ণের মানুষের গায়ে না পড়ে সেজন্যে গ্রামগঞ্জে আলাদা সড়ক আছে। পাশাপাশি দুটি রাস্তা। একটি উঁচু করে তৈরি, সেটি উচ্চবর্ণের লোকেদের জন্য। আরেকটি নিচুতে অস্পৃশ্যদের যাতায়াতের জন্য। নীচু জাতের লোকদের আলাদা বাজার, আলাদা দোকানপাট, আলাদা পানির ব্যবস্থা। সরকারি হাসপাতালে, স্কুলে, চাকরিতে আলাদা আয়োজন। সবই কিন্তু অলিখিত। বাইরের কেউ এসে জানতেই পারবে না। কারণ এসব বলার সাহস করলে চরম দণ্ড পেতে হবে। কিন্তু বাস্তবতা এটাই যে, পৌরাণিক দশাননের দেশে কারো ঘাড়ে দু’টি মাথা নেই।
আমরা ভারতের নিন্দা করতে এসব প্রসঙ্গের অবতারণা করছি না। দেশটির অতি সাম্প্রতিক একটি গুরুত্বপূর্ণ ঘটনার বিশ্লেষণ আমাদের উদ্দেশ্য। কী সেই ঘটনা?

গত ২ সেপ্টেম্বর সোমবার ভারতের বিহার রাজ্যে একটি আদমশুমারির ফলাফল প্রকাশ করা হয়েছে। রাজ্যের মুখ্যমন্ত্রী নীতিশ কুমার তার বহুল প্রতীক্ষিত জাতভিত্তিক জনগণনার (caste survey) ফল প্রকাশ করেন। এই জনগণনা বা আদমশুমারি কেন গুরুত্বপূর্ণ সেটা বোঝা দরকার।
সারা ভারতে জাতভিত্তিক জনগণনা প্রথম হয়েছিল ১৯৩১ সালে ইংরেজ আমলে। স্বাধীনতার পর ১৯৫৩ সালে প্রথম জাতভিত্তিক জনগণনা করা হয়। ১৯৫৫ সালের মার্চ মাসে সেই কমিশনের রিপোর্ট পেশ করা হয়। রিপোর্টে ভারতে ২,৩৯৯টি জাতিগোষ্ঠী চিহ্নিত করা হয় যার মধ্যে ৮৩৭টি ‘সবচেয়ে পিছিয়ে পড়া’। সেই রিপোর্ট ডিপ ফ্রিজের বরফের নিচে গুঁজে দেয় শাসক শ্রেণী।


১৯৭৯ সালে মোরারজি দেশাই সরকার আবার জাতিগোষ্ঠীর শুমারির জন্য বিন্দেশ^রী মণ্ডলকে প্রধান করে কমিশন গঠন করেন। মণ্ডল কমিশন ১৯৮০ সালে সরকারের কাছে রিপোর্ট জমা দেয়। ততদিনে মোরারজি দেশাইয়ের পতন হয় এবং ইন্দিরা গান্ধী ক্ষমতায় আসেন। ইন্দিরা গান্ধী ও তার ছেলে রাজীব গান্ধীর শাসনকালে সেই রিপোর্ট আলোর মুখ দেখেনি। ধামাচাপা দিয়ে রাখা হয়। তবে ভিপি সিংয়ের সরকার ক্ষমতায় এসে ১৯৯০ সালের আগস্টে মণ্ডল কমিশনের রিপোর্ট গ্রহণ ও বাস্তবায়নের ঘোষণা দেন। মণ্ডল কমিশন ওবিসি (other backward classes) বা ‘অন্যান্য পিছিয়ে পড়া শ্রেণীর মানুষের জন্য সরকারি সব দফতরে ২৭ শতাংশ পদ সংরক্ষণের সুপারিশ করেছিল। এতে উচ্চশ্রেণীর হিন্দুরা মরণপণ বিরোধিতা শুরু করে। বিশ^বিদ্যালয়ের ছাত্ররা গায়ে আগুন ধরিয়ে আত্মহত্যা করতে থাকে। অগ্নিসংযোগ ও ভাঙচুর চলতে থাকে বেশুমার। বঙ্গভঙ্গ রদ করতে পশ্চিমবঙ্গের হিন্দু দাদারা যেমন হাতে অস্ত্র তুলে নিয়েছিল ঠিক সেরকম মরিয়া হয়ে ওঠে তারা। শুধু ইংরেজ না থাকায় অস্ত্র ধরেনি। প্রতিরোধের মুখে ভিপি সিং সরকার টালমাটাল অবস্থায় পড়ে। ভারতীয় জনতা পার্টি-বিজেপি সেসময় মণ্ডল কমিশনবিরোধী বিক্ষোভ থেকে কৌশলে মানুষের দৃষ্টি সরিয়ে নিয়ে যায় অযোধ্যার রাম মন্দির ইস্যুতে। এল কে আবাদভানি বাবরি মসজিদ অভিমুখে রথযাত্রার ঘোষণা দেন। এসব ডামাডোলে ভিপি সিং সরকারের পতন ঘটে। তবে এটা সত্য, ভিপি সিংই একমাত্র উচ্চশ্রেণীর হিন্দু শাসক যিনি সাহসের সাথে প্রান্তিক জনগোষ্ঠীর প্রাপ্য বুঝিয়ে দেয়ার চেষ্টা করেন।

স্বাধীনতার পর থেকে ভারতের শাসক শ্রেণী মূলত উচ্চবর্ণের হিন্দু ব্রাহ্মণরাই। তারা সমাজে সাধারণভাবে এমন একটি ধারণা তৈরি করেছেন যে, দেশটির সংখ্যাগরিষ্ঠ মানুষ হিন্দু এবং তাদের উচ্চবর্ণের প্রতিনিধিরা দেশ শাসনের প্রকৃত হকদার। দেশের সব সম্পদেও তাদের হিস্যা বেশি থাকবে এটাই স্বাভাবিক। কিন্তু এ ধারণা যে সত্য নয় সেটি সমাজের সবাই জানে। বরং সুবিধাবঞ্চিত, পশ্চাৎপদ হতদরিদ্র নিম্নবর্ণের মানুষ, তফসিলি জাতিগোষ্ঠী, দলিত, ক্ষুদে নৃগোষ্ঠী বা উপজাতীয়রাই সম্মিলিতভাবে দেশটিতে সংখ্যাগরিষ্ঠ। এ সত্য সরকারিভাবে সবসময় অস্বীকার করা হয়েছে। নিম্নবর্ণের মানুষের উন্নয়নের প্রশ্ন উপেক্ষিত থেকেছে উচ্চবর্ণের শাসক শ্রেণীর কাছে।

বিহারই প্রথম রাজ্য যেটি এই জনমিতি করল চরম বিরোধিতার মুখে। কেন্দ্রের বিজেপি সরকার ছিল এর বিরুদ্ধে। একের পর এক মামলা দেয়া হয়। যুক্তি দেখানো হয়, এ শুমারি দেশকে বিভক্তির দিকে ঠেলে দেবে। একপর্যায়ে পাটনা হাইকোর্ট শুমারির উদ্যোগ স্থগিত করে দেন। পরে সুপ্রিম কোর্ট অনুমতি দেন। ভারতের প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদি এখনো বলছেন, এটি বিভক্তি সৃষ্টি করবে। তারা যে শত শত বছর ধরে বর্ণপ্রথার নামে মানুষকে বিভক্ত করে রেখেছেন, অধিকার বঞ্চিত করছেন, সে কথা একবারও উচ্চারণ করেন না।
বিহারের জনমিতির ফলাফল

জানা গেল, ওই রাজ্যে মোট জনসংখ্যার প্রায় ৮২% গঠন করে ওবিসি (অন্যান্য অনগ্রসর শ্রেণী-other backward classes), ইবিসি (অত্যন্ত অনগ্রসর শ্রেণী-Extremely Backward Classes) এবং তফসিলি জাতি ( Gmwm- Scheduled Castes) গোষ্ঠীর লোকেরা।
রাজ্যের মোট জনসংখ্যা ১৩ কোটি সাত লাখের কিছু বেশি, এর মধ্যে Extremely Backward শ্রেণীর-ইবিসি মানুষ (৩৬ শতাংশ), এরাই সমাজের বৃহত্তম অংশ। আর অন্যান্য অনগ্রসর শ্রেণীর- ওবিসি মানুষের সংখ্যা ২৭.১৩ শতাংশ এবং তফসিলি-এসসি জাতিগোষ্ঠীর মানুষ ১৯.৬৫ শতাংশ।
সমীক্ষায় দেখা যায়, ওবিসি গোষ্ঠীতে যাদবরা আবার বৃহত্তম অংশ। যা মোট জনসংখ্যার ১৪ দশমিক ২৬ শতাংশ। এই অংশের এক সদস্য তেজস্বী যাদব এখন রাজ্যের উপ-মুখ্যমন্ত্রী। তার আরেক ভাইও মন্ত্রী।
তফসিলি জাতি নামে পরিচিত দলিতদের সংখ্যা রাজ্যের মোট জনসংখ্যার ১৯.৬৫ শতাংশ। এ রাজ্যে তফসিলি উপজাতি বলেও একটি শ্রেণী আছে যাদের মোট সংখ্যা মাত্র ২২ লাখের মতো (১.৬৮%)।

সবচেয়ে মজার তথ্য হলো, যারা রাষ্ট্রের সব ক্ষমতা ও সুবিধা পেয়ে আসছে, সেই উচ্চ শ্রেণীর মানুষের সংখ্যা এমনকি দলিতদের চেয়েও কম, ১৫ দশমিক ৫২ শতাংশ মাত্র। অথচ এদের হাতেই প্রতিনিয়ত ভয়ঙ্কর নিপীড়ন নির্যাতনের শিকার হন দলিতরা। এমনকি যেকোনো সময়, যেকোনো অজুহাতে দলিত ঘরের মেয়ে বা বউদের প্রকাশ্যে ধর্ষণ, গণধর্ষণ এবং পুড়িয়ে হত্যার মতো ঘটনা ঘটায় উচ্চ শ্রেণীর মানুষেরা। তথাকথিত এই উচ্চ শ্রেণীর অপরাধীদেরও কোনো বিচার-আচার হয় না। কারণ থানা, পুলিশ, অফিস, আদালত তাদেরই দখলে।
সমীক্ষার তথ্যমতে, রাজ্যের নিরঙ্কুশ সংখ্যাগরিষ্ঠ মানুষ হিন্দু- প্রায় ৮২ শতাংশ। আর মুসলমান আছে ১৭ দশমিক ৭০ শতাংশ।

সমীক্ষার সম্ভাব্য প্রভাব
তাৎক্ষণিক প্রভাব হলো, জনগণনার এই ফলাফল আগামী নির্বাচনে মোদি সরকারের পতন ঘটাতে এবং বিরোধী ইন্ডিয়া জোটকে ক্ষমতায় এনে দিতে সহায়ক হতে পারে। দ্বিতীয়ত এটি সমগ্র ভারতে জাতভিত্তিক জনগোষ্ঠীর শুমারির দাবি তীব্রতর করবে। তৃতীয়ত, এর ফলে পিছিয়ে পড়া জনগোষ্ঠী তাদের প্রাপ্য আদায়ে বিপুল নৈতিক ও রাজনৈতিক শক্তি পাবে। বিপন্ন ব্রাহ্মণ্যবাদ যদি বাধা দেয়ও, তবু সমগ্র দেশে একটি বড় অংশের মানুষের চাহিদা কারণে একসময় এমন শুমারি করতেই হবে। আমাদের ধারণা, এই মুহূর্তে না হলেও, ভারতের সব রাজ্যে এ ধরনের সমীক্ষা হওয়ার পর কোনো একদিন প্রান্তিক জাতিগোষ্ঠীর লোকেরা হয়তো সংগঠিত হয়ে দেশের রাজনীতি, অর্থনীতি, শিক্ষা-সংস্কৃতিসহ সর্বক্ষেত্রে ব্রাহ্মণদের হটাতে সক্ষম হবে। সেটি হবে সত্যিকারের বৈপ্লবিক পরিবর্তন। আর তখনই ভারত হবে প্রকৃত গণতান্ত্রিক দেশ। আর্য আগমনের আগে ভারতে তো ছিল কোল ভিল ডোম মুচি, যাদব, দলিতসহ আজকের সব প্রান্তিক জনগোষ্ঠীরই রাজত্ব। ইতিহাস ঘুরে আসুক।

আপাতত আমরা লালু প্রসাদ যাদব (ইন্ডিয়া জোটের অন্যতম নেতা) ও নরেন্দ্র মোদির (হিন্দু ব্রাহ্মণ্যবাদের প্রতিনিধি) দ্বৈরথ দেখার অপেক্ষায় থাকি ২০২৪ সালের নির্বাচনে।

mujta42@gmail.com

 


আরো সংবাদ



premium cement
পঞ্চগড়ে গ্রেফতার ১০ মুসলমানকে অবিলম্বে মুক্তি দিন : খতমে নবুওয়াত রামেক হাসপাতালের দুদকের অভিযান চট্টগ্রামে ৪৮ ঘণ্টার পরিবহন ধর্মঘট প্রত্যাহার নোয়াখালীতে গরমে শ্রেণিকক্ষে অসুস্থ হয়ে পড়ল ১৮ শিক্ষার্থী থাইল্যান্ডের পররাষ্ট্রমন্ত্রীর আকস্মিক পদত্যাগ রাজশাহীর তাপমাত্রা ৪২ ডিগ্রি, হিটস্ট্রোকে যুবকের মৃত্যু বরিশালে যাত্রীবেশে উঠে চালকের গলায় ছুরি, প্রতারক দম্পতি গ্রেফতার রাজশাহীর পদ্মা নদীতে গোসলে নেমে আরো ২ শিশুর মৃত্যু ব্যাটিং ব্যর্থতায় ভারতের কাছে বাংলাদেশের হার এনজিওর টাকা তুলতে গিয়ে সড়ক দুর্ঘটনায় গৃহবধূ নিহত ভিজিএফবঞ্চিতদের মানববন্ধনে উপজেলা ভাইস চেয়ারম্যানের নেতৃত্বে হামলা, আটক ২

সকল