২৯ এপ্রিল ২০২৪, ১৬ বৈশাখ ১৪৩১, ১৯ শাওয়াল ১৪৪৫
`


ঐক্য ও সংহতির চেতনা

ঐক্য ও সংহতির চেতনা - নয়া দিগন্ত

এ কথা অনস্বীকার্য যে, মুসলিম উম্মাহ এক অবিভাজ্য ঐক্যবদ্ধ সত্তা। একই মানবদেহের বিভিন্ন অঙ্গ-প্রত্যঙ্গের মতো মুসলিম ভ্রাতৃত্ববোধের পরিচয়। ইসলামে ঐক্য ও সংহতির চেতনা মূলত তাওহিদভিত্তিক। মহান আল্লাহর একত্বের আদর্শ থেকে মানবজাতি ও মুসলিম উম্মাহর ঐক্য উৎসারিত। সৃষ্টিবৈচিত্র্যের মধ্যে ঐক্যের মূল সূত্র হচ্ছে তাওহিদ ও রিসালাত। মানুষ মূলত এক তবে ভাষা, বর্ণ, গোত্র, অঞ্চল ও ভৌগোলিক পার্থক্যগুলো মানুষকে বিশিষ্টতা দান করেছে, কিন্তু পার্থক্য শ্রেষ্ঠত্বের মাপকাঠি নয় বা মর্যাদার মানদণ্ডও নয়। পারস্পরিক পরিচিতিকে সুদৃঢ় করতে এ পার্থক্য ও স্বাতন্ত্র্য। ইসলাম মুমিনদের একই পরিবারের সদস্যরূপে চিহ্নিত করেছে। বর্ণ, ভাষা, গোত্র, অঞ্চল ও ভৌগোলিক সীমারেখা ও সংহতির চেতনা মুসলিম উম্মাহর ঐক্যের পথে প্রতিবন্ধক নয়। ইসলামী আদর্শ ঘিরে মুসলিম সংহতি আবর্তিত। গোটা দুনিয়ার ঈমানদার জনগোষ্ঠী নিয়ে গড়ে উঠেছে মুসলিম ভ্রাতৃসমাজ।

ইসলাম ঐক্য ও সংহতির ব্যাপারে শুধু নীতিগত ধারণা দিয়ে ক্ষান্ত হয়নি; বরং সুস্পষ্ট ভাষায় ঐক্য প্রতিষ্ঠার উপর সবিশেষ জোর দিয়েছে। এমনকি যারা মতবিরোধে লিপ্ত হয়ে বিবাদে জড়িয়ে পড়ে তাদের জন্য আল্লাহর কঠিন আজাবের দুঃসংবাদও আছে। মুসলিম উম্মাহর শক্তির ভিত্তি হচ্ছে তাকওয়া ও দ্বিতীয় ভিত্তি হচ্ছে পারস্পরিক ঐক্য। ইতস্তত বিক্ষিপ্ত ও বিচ্ছিন্ন শক্তি কুরআনের শিক্ষা ও নবীর আদর্শকে আঁকড়ে ধরলে মুসলিম জাতি দুর্দমনীয় শক্তির অধিকারী হবে ও মরণোন্মুখ জাতি ফিরে পাবে নবপ্রাণ।

ইসলাম ঐক্য, সংহতি ও ভ্রাতৃত্ববোধের যে বৈপ্লবিক নজির স্থাপন করেছে তা ইতিহাসে বিরল। অমুসলিম মনীষীরা পর্যন্ত ইসলামী ভ্রাতৃত্ববোধের উচ্ছ্বসিত প্রশংসা না করে পারেননি। ভারতীয় জাতীয় কংগ্রেসের এককালের জাঁদরেল সভানেত্রী সরোজিনি নাইডোর মন্তব্য এ ক্ষেত্রে প্রণিধানযোগ্য, ‘ইসলামের অবিচ্ছেদ্য ঐক্য যা স্বাতন্ত্র্যসূচকভাবে একজন মানুষকে ভাই হিসেবে বরণ করে নেয়- এটি দেখে আমি বারবার অভিভূত হয়েছি। এ সত্য প্রমাণিত হবে যখন আপনি লন্ডনে একজন মিসরীয়, একজন আলজেরিয়ান, একজন ভারতীয়, একজন তুর্কিকে দেখবেন। কার মাতৃভূমি মিসরে, আর কার মাতৃভূমি ভারতে এটি মোটেই বড় কথা নয় (Sarojini Naido, The Ideals of Islam. Vide speeches and Writings of Sarojini Naido, Madras.1918, P. 169.).

মুসলিম উম্মাহর বিভিন্ন ব্যক্তি, গোষ্ঠী ও দলের মধ্যে ভিন্নমত সৃষ্টি হওয়া দোষের নয়। যেখানে বুদ্ধি, প্রজ্ঞা ও সততা রয়েছে সেখানে মতের ভিন্নতা সৃষ্টি হতে বাধ্য। কারণ ভিন্নমত বুদ্ধি ও সততা থেকে উদ্ভূত হয়। মতের ভিন্নতা আছে বলে ইসলাম পরামর্শের উপর সবিশেষ গুরুত্বারোপ করেছে। তবে এ কথা মনে রাখতে হবে, মত ও পথের ভিন্নতা থাকলেও মনজিলে মাকসুদ কিন্তু এক ও অভিন্ন। মতদ্বৈধতাকে সুনির্দিষ্ট পরিসীমার মধ্যে আবদ্ধ রাখতে হবে। কারণ, মতদ্বৈধতা যদি বিরুদ্ধবাদিতায় রূপান্তরিত হয়, তাহলে ঐক্যের ভিত ধসে পড়তে বাধ্য। মুসলিম সমাজের কোনো জামাত বা দলের সব সদস্য প্রতিটি কাজে ও প্রতিটি কথায় ঐকমত্য পোষণ করবে, এটি অসম্ভব। আল্লামা মুফতি মুহাম্মদ শফী রহ: এ প্রসঙ্গে বলেন, ‘আদর্শিক সমস্যা ও মাসায়েলে মতের ভিন্নতা ক্ষতিকর নয়; এটিকে মিটিয়ে ফেলার প্রয়োজনও নেই, আর সহজে মেটানোও যায় না। মতের ভিন্নতা ইসলামী ঐক্যের পরিপন্থী নয়; কারো জন্য ক্ষতির কারণও নয়। মতদ্বৈধতা একটি স্বাভাবিক ও প্রকৃতিগত ব্যাপার যা থেকে মানবজাতির কোনো গোষ্ঠী খালি ছিল না আর খালি থাকতে পারেও না। মতদ্বৈধতা যদি স্বীয় পরিসীমার মধ্যে থাকে, তাহলে কখনো কোনো দল ও জাতির জন্য ক্ষতিকর হতে পারে না; বরং অনেক সময় এটি ইতিবাচক ফল বয়ে আনে। (মুফতি মুহাম্মদ শফী, ওয়াহাদাতে উম্মত, লাহোর, পৃষ্ঠা-৯)

মতদ্বৈধতা ও মতবিরোধ (ঝগড়া) এক জিনিস নয়। মতদ্বৈধতা রহমতস্বরূপ, আর মতবিরোধ আত্মঘাতী মহাপাপ। ইজতেহাদি বিষয়ে মতদ্বৈধতার জন্য কোনো পক্ষকে নিন্দাবাদ করা শরিয়তে জায়েজ নেই। যেসব বিষয়ে সাহাবায়ে কেরাম, তাবেইন ও আইম্মায়ে মুজতাহিদিনদের মধ্যে মতদ্বৈধতা রয়েছে তা খতম করা অসম্ভব। কারণ উভয়ের ইজতিহাদের ভিত্তি হচ্ছে কুরআন ও সুন্নাহ।

ঐক্য ও সংহতির ব্যাপারে ইসলামের ঘোষণা স্পষ্ট ও দ্ব্যর্থহীন হওয়া সত্ত্বেও দুর্ভাগ্যজনকহারে মুসলমানরা পারস্পরিকভাবে বিচ্ছিন্ন। এ দূরত্ব দিন দিন প্রকটতর হতে চলেছে। এ বাস্তবতা বাংলাদেশের ধর্মীয়-রাজনৈতিক পরিপ্রেক্ষিতে যেমন সত্য তেমনি আন্তর্জাতিক পরিসরেও। বর্তমান বিশ্বের মুসলিম রাষ্ট্রগুলোর মধ্যে ক্ষুদ্র ক্ষুদ্র স্বার্থ নিয়ে বিবাদ ও মতবিরোধ রয়েছে। এ বিভেদ ও বিচ্ছিন্নতার সুযোগ কাজে লাগিয়ে মুসলিম রাষ্ট্রগুলোকে বিভিন্ন বলয়ে বিচ্ছিন্ন করে রাখা হয়েছে। মুসলিম রাষ্ট্রগুলো ঐক্যের মাধ্যমে শক্তিশালী ব্লকে যাতে পরিণত হতে না পারে তার জন্য তাগুতি শক্তি তাদের মেশিনারি এবং স্টাবলিশমেন্ট নিয়ে অত্যন্ত সক্রিয় ও সচেতন। ইরান-ইরাক যুদ্ধ, ইরাকের কুয়েত দখল, ফিলিস্তিন সমস্যা, উপসাগরীয় দেশে মার্কিন ঘাঁটি, লিবিয়া ও ইরাকে গণহত্যা, সুদান ও আফগানিস্তানে আগ্রাসন, কসোভোয় অ্যাথনিক ক্লিঞ্জিং, রোহিঙ্গাদের নিপীড়ন প্রভৃৃতি সাম্রাজ্যবাদী শক্তির চক্রান্তের ফসল। ঐক্য ও সংহতির অভাবজনিত কারণে মুসলমানরা বিভিন্ন ফিরকায় বন্দী হয়ে পড়েছেন। ধর্মীয় চিন্তাদর্শনের ক্ষেত্রে বিভিন্ন সিলসিলার অনুসারীরা একে অপর থেকে এত দূরযোজনে অবস্থান করছেন যে, তাদের ঐক্যের বন্ধনে জমায়েত করা রীতিমতো দুঃসাধ্য না হলেও নিশ্চিতভাবে কষ্টসাধ্য। প্রত্যেকে নিজেকে একমাত্র হক জামাত ও অন্যদের বাতিল এবং গোমরাহ ফিরকাহ মনে করায় ঐক্যপ্রক্রিয়া জটিল আকার ধারণ করেছে। ফলে পবিত্র কুরআন ও সুন্নাহর ভিত্তিতে ইসলামী সমাজ এবং রাষ্ট্রব্যবস্থা প্রতিষ্ঠার মতো এত গুরুত্বপূর্ণ ইস্যুতে এসব মাসলাকের অনুসারীরা এক প্ল্যাটফর্মে জমায়েত হতে পারছেন না।

১৯৪৭ সাল থেকে আজ পর্যন্ত দীর্ঘ ৭৬ বছরে তৎকালীন পাকিস্তানে ও বর্তমান বাংলাদেশে ইসলামী হুকুমত প্রতিষ্ঠিত হয়নি; খিলাফত আলা মিনহাজিন নবুওয়তের আদলে রাষ্ট্রীয় ও সামাজিক ব্যবস্থা প্রবর্তন কেবল স্বপ্ন রয়ে গেল। ঐক্যপ্রক্রিয়া যে একেবারে চলেনি তা নয়। সময়ের তাগিদে সমমনা ইসলামী রাজনৈতিক দলগুলোর মধ্যে জোট ও মৈত্রী হয়েছে। অনেক সময় এ প্রয়াস ছিল খণ্ডিত, ফলে ইপ্সিত লক্ষ্য অর্জিত হয়নি।

এখানে একটি বিষয় পরিষ্কার হওয়া প্রয়োজন যে, বিভিন্ন মাসলাক বা চিন্তাদর্শনের অনুবর্তী হয়ে আল্লাহপাকের সন্তুষ্টি অর্জন মোটেও দোষের নয়, কিন্তু অনুদার মানসিকতা, অতিমাত্রায় দলপ্রীতি, অন্যদের প্রতি হীন ধারণা, অহংবোধ, পদলোভ, ‘একলা চলো’ নীতি ইত্যাদি কর্মকাণ্ড যা ঐক্যের পথে বিঘœ সৃষ্টি করে তা সন্দেহাতীতভাবে নিন্দনীয় ও গর্হিত। বাংলাদেশে ইসলাহি ময়দানে ও ইসলামী রাজনীতির অঙ্গনে তৎপর বিভিন্ন জামাত ও দলের অনুসারী সবাই কুরআন-সুন্নাহ ও খতমে নবুওয়ত আকিদায় বিশ্বাসী। আহলে হাদিস ছাড়া সবাই হানাফি মাজহাবের অনুসারী। ফলে এসব জামাত ও মাসলাকের অনুসারীদের মধ্যে কুরআন-সুন্নাহ, মাজহাব, দ্বীন ও সংস্কৃতির পরিমণ্ডলে গভীর সামঞ্জস্য থাকা সত্ত্বেও একে অপরের মধ্যে বিভেদের প্রাচীর বিরাজ করছে- এটিই আশ্চর্য। উম্মতের ঐক্য ও সংহতি মূলত পারস্পরিক ঐক্যের ওপর নির্ভরশীল। কিন্তু কিছু ক্ষেত্রে একই মাসলাকের অনুসারীদের মধ্যেও ঐক্যের অভাব পরিলক্ষিত হয়। বিভিন্ন মাসলাক ও তরিকায় বিশ্বাসী ইসলামী রাজনৈতিক দলগুলো যদি কুরআন ও সুন্নাহভিত্তিক রাষ্ট্রব্যবস্থা প্রতিষ্ঠার ইস্যুতে ঐক্যবদ্ধ প্ল্যাটফর্মে জমায়েত হতে পারে, তাহলে জাতীয় রাজনীতির ক্ষেত্রে একটি স্বতন্ত্র ধারা সৃষ্টি হবে। দেশের অপরাপর রাজনৈতিক শক্তি ঐক্যবদ্ধ ইসলামী জোটকে সমীহ করে চলবে, এমনকি অভিন্ন প্রতীকে নির্বাচন করার পরিবেশও সৃষ্টি হতে পারে। এককভাবে ইসলামপন্থীরা সরকার গঠন করতে না পারলেও কোয়ালিশন সরকার গঠন করা সহজসাধ্য হবে। ঐক্য ও সংহতি ছাড়া কোনো ইসলামী দল এককভাবে সংসদ নির্বাচনে সংখ্যাগরিষ্ঠতা অর্জন করতে পারবে না।

লেখক : অতিথি অধ্যাপক, আন্তর্জাতিক
ইসলামী বিশ্ববিদ্যালয়, চট্টগ্রাম
drkhalid09@gmail.com


আরো সংবাদ



premium cement