২৯ এপ্রিল ২০২৪, ১৬ বৈশাখ ১৪৩১, ১৯ শাওয়াল ১৪৪৫
`


বিশ্বায়নের চ্যালেঞ্জ মোকাবেলায় প্রযুক্তিগত শিক্ষার চর্চা

বিশ্বায়নের চ্যালেঞ্জ মোকাবেলায় প্রযুক্তিগত শিক্ষার চর্চা - প্রতীকী ছবি

গোটা বিশ্ব এখন মানুষের হাতের মুঠোয়। অর্থনৈতিক উন্নয়ন, যোগাযোগ ও তথ্যপ্রযুক্তির বদৌলতে বিভিন্ন জাতি, গোষ্ঠী, অঞ্চল ও দেশের ভৌগোলিক সীমানা সঙ্কোচিত হয়ে পৃথিবী গ্লোবাল ভিলেজে পরিণত হয়েছে। যোগাযোগের বিস্ময়কর উন্নয়ন, নতুন অর্থনৈতিক ব্যবস্থা, প্রযুক্তি বিপ্লব, উন্মুক্ত বাজার অর্থনীতি ও আন্তর্জাতিক বাণিজ্যের ফলে বিশ্বে যে নতুন পরিবর্তিত পরিস্থিতির (নিউ ওয়ার্ল্ড অর্ডার) উদ্ভব হয়েছে, এটিই বিশ্বায়ন বা গ্লোবালাইজেশন। সোভিয়েত ইউনিয়নের পতনোত্তরকালে ‘বিশ্বায়ন’-এর পরিভাষা ও প্রত্যয়ের বহুল ব্যবহার লক্ষ করা যায়। ধারণা করা হয়, কানাডার সমাজবিজ্ঞানী মার্শাল ম্যাকলুহানের ১৯৭০ সালে রচিত ওয়ার অ্যান্ড পিস ইন গ্লোবাল ভিলেজ এবং সাবেক মার্কিন প্রেসিডেন্ট জিমি কার্টারের জাতীয় নিরাপত্তা-বিষয়ক উপদেষ্টা যবগনিউ ব্যরিজেন্সকি রচিত আমেরিকান ইলেক্ট্রোনিক্যাল এজ নামক গ্রন্থে সর্বপ্রথম গ্লোবালাইজেশন শব্দের উৎপত্তি।

জাপানি গবেষক কেনিশি আওহানির মতে, ভৌগোলিক সীমানাবিহীন বিশ্বই বিশ্বায়ন, যেখানে প্রযুক্তির অকল্পনীয় উৎকর্ষের কল্যাণে অর্থনৈতিক ও বাণিজ্যিক তৎপরতায় ভৌগোলিক সীমান্ত বাধা হয়ে দাঁড়াবে না। গবেষক জন টম লিনসন বলেন, বিশ্বের সর্বত্র বিভিন্ন জাতি, সংস্কৃতি, সমাজ ও প্রতিষ্ঠানের দ্রুত বিনিময়ে উন্নয়নই ‘বিশ্বায়ন’। এক কথায় সব ধনী-দরিদ্র রাষ্ট্রের মধ্যে অর্থনৈতিক লেনদেনের বিস্তৃতির ক্ষেত্রে সীমানার প্রতিবন্ধকতা অতিক্রম করা হলো ‘বিশ্বায়ন’। যার ফলে প্রত্যেক রাষ্ট্র অন্যের বাজারে সহজে ও অবাধে প্রবেশ করতে পারে। মার্কিন গবেষক ফরিড ম্যান মনে করেন, আমেরিকানাইজেশন অব দ্য ওয়ার্ল্ড ইস গ্লোবালাইজেশন।

ইতিবাচক দিক
বিশ্বায়ন প্রক্রিয়ার অগ্রগতি, বিভিন্ন জাতিগোষ্ঠী ও রাষ্ট্রের মধ্যে পারস্পরিক সমঝোতা, গঠনমূলক সংলাপ, সাংস্কৃতিক লেনদেন, উৎপাদিত পণ্যের নতুন বাজার সৃষ্টি, সন্ত্রাস নির্মূল ও সামাজিক নিরাপত্তার দিগন্তকে বিস্তৃত করেছে। নতুন বিশ্ব ব্যবস্থাপনায় ‘আইনের শাসন’, ‘মানবাধিকার’, ‘সমতা’, ‘আন্তর্জাতিক আইনের নিয়ম-কানুন’, ‘সেক্যুলারিজম’, ‘গণতন্ত্র’ প্রভৃতির ধারণা ও প্রয়োগ বিভিন্ন দেশ এবং সমাজে ব্যাপক প্রভাব বিস্তার করেছে। মানুষের চিন্তা-চেতনা ও মননকে বিশ্বায়ন প্রবলভাবে নাড়া দিয়েছে। বিশ্বায়ন অভিযানের নেতৃত্বদানকারী দেশগুলো উন্নয়নশীল দেশের শ্রমিকদের অধিকার সংরক্ষণ, পরিবেশ প্রতিবেশের ভারসাম্য রক্ষা, রাষ্ট্রীয় স্বাধীনতার হেফাজত, স্বাস্থ্যপরিচর্যা প্রভৃতি বিষয়ে নজরদারি করে থাকে আর্থিক সহায়তা, কারিগরি সাহায্য ও বিশেষজ্ঞ সরবরাহের মাধ্যমে। বিশ্বায়নের লক্ষ্য হচ্ছে দরিদ্র ও উন্নয়নশীল দেশের রাষ্ট্রীয় নীতি ও অর্থনীতির নিয়ন্ত্রণ এবং পুঁজির অবাধ প্রবাহে সহযোগিতা প্রদান, যাতে দারিদ্র্য দূরীকরণ সহজতর হয়।

নেতিবাচক দিক
বিশ্বায়ন ‘বাজার অর্থনীতি’র গতি অবাধ ও মুক্ত করেছে। ফলে বহুজাতিক কোম্পানিগুলোর পরিধি ও কর্মক্ষেত্র অকল্পনীয়ভাবে বিস্তৃতি লাভ করেছে। প্রযুক্তির উন্নত সুবিধার ফলে বহুজাতিক কোম্পানিগুলোর পুঁজিবিনিয়োগ, কাঁচামাল সংগ্রহ, পণ্যদ্রব্য উৎপাদন ও বৈশ্বিক বিপণন প্রক্রিয়ার সামনে তৃতীয় বিশ্বের কোম্পানিগুলোর সামনে দাঁড়ানো অসম্ভব হয়ে পড়েছে। এ অসম প্রতিযোগিতায় তৃতীয় বিশ্বের শিল্প ও বাণিজ্য ব্যাপকভাবে চ্যালেঞ্জের সম্মুখীন। জাপান, জার্মান, ফ্রান্স, ব্রিটেন, ইতালি ও কানাডার মালিকানাধীন প্রায় তিন হাজার কোম্পানির উৎপাদিত পণ্য উন্নত ও তুলনামূলক সস্তা হওয়ায় সাধারণ ভোক্তা এসব পণ্যের প্রতি ঝুঁকে পড়ে। এতে দেশীয় পণ্য মার খায়, স্থানীয় পুঁজিবিনিয়োগ বাধাগ্রস্ত হয়ে পড়ে। ফলে স্বাভাবিক পথে দরিদ্র দেশের শিল্প-কারখানায় লালবাতি জ্বলে। এ ছাড়া বহুজাতিক কোম্পানিগুলো তৃতীয় বিশ্বে পুঁজি বিনিয়োগে অত্যন্ত আগ্রহী। কারণ, সেখানে সস্তায় শ্রম পাওয়া যায়। বহুজাতিক কোম্পানিগুলোর পুঁজি সারা বিশ্বে ঘুরে বেড়ায়। অথচ তৃতীয় বিশ্বের ‘শ্রম’ তা পারে না। অনেক সময় লক্ষ করা যায়, বহুজাতিক কোম্পানিগুলো হয়ে পড়ে গরিব দেশের আর্থ-রাজনীতির নেপথ্য শক্তি। আরো লক্ষণীয় যে, আইএমএফ এবং বিশ্বব্যাংক দরিদ্র ও উন্নয়নশীল দেশের ওপর তাদের প্রণীত নীতি চাপিয়ে দিয়ে বাজার অর্থনীতির প্রক্রিয়া মেনে নিতে বাধ্য করে। আইএমএফ ও বিশ্বব্যাংকের চাপে ভারী শিল্প বেসরকারি মালিকানায় ছেড়ে দিতে, গোল্ডেন হ্যান্ডশেকের মাধ্যমে শ্রমিক ছাঁটাই করতে ও নিত্যব্যবহার্য পণ্যসামগ্রীর মূল্যবৃদ্ধি করতে বিভিন্ন রাষ্ট্র বাধ্য হয়। তাদের প্রদত্ত ব্যবস্থাপত্র অন্যরা না মেনে পারে না। এতে দরিদ্র দেশে বাণিজ্য ঘাটতি দেখা দেয়।

বিশ্বায়ন প্রক্রিয়ায় মূল চালিকাশক্তি হলো পুঁজি। পুঁজির প্রবাহ এত অপ্রতিরোধ্য যে, রাষ্ট্রীয় ভূমিকা সেখানে অসহায় নীরব দর্শকের। পুঁজি বিনিয়োগ করে যেভাবে হোক অধিক মুনাফা অর্জন করা হলো বহুজাতিক কোম্পানিগুলোর লক্ষ্য। এতে যদি বিনিয়োগকৃত দেশের চাহিদা না মেটে অথবা সে দেশের লোক ভিক্ষুকে পরিণত হয় তাতে কিছু যায় আসে না। এটি বিশ্বায়নের নিষ্ঠুর, অনৈতিক ও অমানবিক দিক। বিশ্বের অন্যতম পুঁজি সম্রাট জর্জ সোর্স, যাকে রাশিয়া ও দক্ষিণ-পূর্ব এশিয়ার রাষ্ট্রগুলো তাদের অর্থনৈতিক সঙ্কট সৃষ্টির খলনায়ক হিসেবে চিহ্নিত করেছে; তিনি তার প্রকাশিত এক গ্রন্থে যে মন্তব্য করেছেন, তা এখানে প্রণিধানযোগ্য- ‘অচিরে উন্নয়নশীল রাষ্ট্রগুলোর নেতৃত্বে পুঁজিবাদের বিরুদ্ধে সামাজিক অভ্যুত্থান সৃষ্টি হতে পারে, ফলে পুঁজিবাদের ভিত ধসে পড়ার আশঙ্কা রয়েছে পুরো মাত্রায়।’

ওয়ামি জার্নাল ইংরেজি সংস্করণের প্রাক্তন সম্পাদক মুহাম্মদ ফসিহুল আলম বিশ্বায়নের নেতিবাচক দিকের ওপর আলোকপাত করতে গিয়ে বলেছেন- ‘মনে হচ্ছে সাবেক ঔপনিবেশিক শক্তির পরিকল্পনা রয়েছে তৃতীয় বিশ্বের দেশগুলোকে আরো সূক্ষ্মভাবে পুনঃঔপনিবেশিক করার। তাই তারা তৃতীয় বিশ্বের দেশগুলোর মন জয়ের ভিন্ন কৌশল নিয়েছে। বিশ্বায়নের মাধ্যমে সীমানাহীন বিশ্বে সাংস্কৃতিক আগ্রাসন এবং অর্থনৈতিক উপনিবেশকরণ ঘটে। এর মাধ্যমে তৃতীয় বিশ্বে দারিদ্র্য গাণিতিকভাবে বাড়ে। কখনো কখনো জ্যামিতিকভাবে বেড়ে যায়’।

নতুন এ বৈশ্বিক চিন্তার পথপরিক্রমায় বিশ্বায়ন একটি অবধারিত বাস্তবতা। এ বাস্তবতা থেকে উদ্ভূত চ্যালেঞ্জ মোকাবেলায় বাংলাদেশসহ তৃতীয় বিশ্বের রাষ্ট্রগুলোর সম্মিলিত প্রয়াস নিয়ে এগিয়ে আসতে হবে। ‘স্থির ও সুদৃঢ় শিক্ষার ভিত্তি’ হবে বিশ্বায়নের আধিপত্যের মোকাবেলায় একমাত্র হাতিয়ার। সুনির্দিষ্ট নীতিমালার ভিত্তিতে শক্তিশালী ব্লক প্রতিষ্ঠার মাধ্যমে কার্যকর বৈজ্ঞানিক প্রযুক্তিগত শিক্ষা ও চর্চা, বিভিন্ন সভ্যতা ও সংস্কৃতির মধ্যে সংলাপ, পারস্পরিক বোঝাপড়া, শান্তিপূর্ণ সহাবস্থান হচ্ছে আমাদের মতো উন্নয়নশীল দেশের মানুষের জন্য বিশ্বায়নের চ্যালেঞ্জ মোকাবেলায় কার্যকর সমাধান।

নোবেল বিজয়ী ড. মুহাম্মদ ইউনূস যথার্থই বলেছেন- ‘বুদ্ধির বাজারে আমাদের নিজেদের আকর্ষণীয় করে তুলতে হবে। আমাদের শিক্ষাব্যবস্থাকে তার জন্য উপযুক্ত করে গড়ে তুলতে হবে। শিক্ষাব্যবস্থাকে এমন হতে হবে, যেটি শিক্ষার্থীকে নিজের বুদ্ধি শাণিত করার সুযোগ দেবে; বিশ্বের জ্ঞানের সাথে তাকে সংযুক্ত করে দেবে এবং রসাস্বাদনের উপযুক্ত করে দেবে। কল্পনাশক্তিকে পাখা মেলে বিচরণ করার সুযোগ দেবে : তথ্যপ্রযুক্তির মাধ্যমে বিশ্বের যেকোনো স্থানে যেকোনো বিষয়ে তাৎক্ষণিক আদান-প্রদানের আয়োজন করে দেবে।’

আমাদের সম্ভাবনাময় জনসংখ্যাকে বুদ্ধি, শিক্ষা ও প্রযুক্তি চর্চার মাধ্যমে যদি মানবসম্পদ রূপে গড়ে তুলতে পারি, আন্তর্জাতিক প্রযুক্তির জগতে গৌরবোজ্জ্বল অবদান রাখতে সক্ষম হবো। বিশ্বায়নের বিরোধিতা নয়; বরং নতুন বিশ্বব্যবস্থায় নিজেকে খাপ খাইয়ে নিতে হবে আমাদের বুদ্ধি, মননশীলতা ও শিক্ষার মাধ্যমে। জ্ঞান, বুদ্ধি ও কৌশল আমাদের বিশ্বায়নের চালেঞ্জ মোকাবেলায় সাহসী সৈনিকরূপে প্রেরণা জোগাবে। চীনের বৃহত্তর জনগোষ্ঠী যেভাবে হার্ডওয়্যার ও ভারতের বিপুল জনগোষ্ঠী যেভাবে সফটওয়্যার উৎপাদন করে বিশ্বে নিজেদের আসন গড়ে তুলেছে, আমরাও তা থেকে শিক্ষা নিতে পারি।

লেখক : অতিথি অধ্যাপক, আন্তর্জাতিক
ইসলামী বিশ্ববিদ্যালয়, চট্টগ্রাম
drkhalid09@gmail.com


আরো সংবাদ



premium cement