২৯ এপ্রিল ২০২৪, ১৬ বৈশাখ ১৪৩১, ১৯ শাওয়াল ১৪৪৫
`


ওয়্যার কোর্স, স্বাধীনতাযুদ্ধের দূরদর্শী পরিকল্পনা

ওয়্যার কোর্স, স্বাধীনতাযুদ্ধের দূরদর্শী পরিকল্পনা - ফাইল ছবি

প্রায় এক লাখ সুপ্রশিক্ষিত পাকিস্তানি হানাদার বাহিনীর বিরুদ্ধে ইস্টবেঙ্গল রেজিমেন্টের মাত্র পাঁচটি ইউনিটের ভগ্নাংশ ও স্বল্পসংখ্যক অফিসারের নেতৃত্বে যুদ্ধ করে দেশমুক্ত করা এক দুঃস্বপ্ন বৈ কিছু নয়। কিন্তু তারপরও প্রচণ্ড আত্মবিশ্বাসী, দুঃসাহসী, দেশপ্রেমিক বাঙালি অফিসার ও সৈনিকরা জীবনের মায়া ত্যাগ করে শুধু প্রতিরোধ যুদ্ধ শুরুই করলেন না; অসংখ্য তরুণ, ছাত্র, যুবক, কৃষক, শ্রমিক যারা দেশমাতৃকার মুক্তির জন্য স্বেচ্ছাসেবক হয়ে এগিয়ে এসেছেন তাদেরকে প্রশিক্ষণ দেয়াও শুরু করলেন তারা। এ বিরাট সংখ্যক মুক্তিযোদ্ধাকে নেতৃত্ব দেয়ার জন্য প্রয়োজন সুপ্রশিক্ষিত কমিশনড অফিসারের; এ চিন্তা থেকেই মুক্তিযুদ্ধের সর্বাধিনায়ক জেনারেল ওসমানির মাথায় আসে War Course চালুর পরিকল্পনা।

৪ এপ্রিল তেলিয়াপাড়া চা-বাগানের ঐতিহাসিক মিটিংয়ে মুক্তিযুদ্ধকে একক নেতৃত্বের (জেনারেল এমএজি ওসমানী-সর্বাধিনায়ক) অধীনে আনা, যুদ্ধক্ষেত্রকে বিভিন্ন সেক্টর/অঞ্চলে ভাগ করে কমান্ডারদের অধীনে ন্যস্ত করা হয় এবং মুক্তিযুদ্ধকালীন একটি জাতীয় সরকার গঠনের সুপারিশ করা হয়। সে অনুসারে ১৯৭১ সালের ১০ এপ্রিল রাজনৈতিক নেতারা সৈয়দ নজরুল ইসলামকে অস্থায়ী রাষ্ট্রপতি করে গণপ্রজাতন্ত্রী বাংলাদেশ অস্থায়ী সরকার গঠন করা হয়। যা মুজিবনগর সরকার বা প্রবাসী বাংলাদেশ সরকার নামেও পরিচিত।
২৭ মার্চ কিংবদন্তি সমরনায়ক মেজর জিয়াউর রহমানের স্বাধীনতার ঘোষণা ও সেনাবাহিনীর নেতৃত্বে জনগণের প্রতিরোধযুদ্ধ শুরু হলেও মুক্তিযুদ্ধ পরিচালনার জন্য মুক্তিবাহিনী গঠন ও সমন্বয়, আন্তর্জাতিক সম্প্রদায়ের সমর্থন আদায় এবং ভারত সরকার ও সেনাবাহিনীর সাথে সাংগঠনিক সম্পর্ক রক্ষায় অস্থায়ী বাংলাদেশ সরকারের ভূমিকা ছিল অপরিসীম।

সারা দেশকে প্রথমে ছয়টি ও পরে ১২-১৫ জুলাই কলকাতায় অনুষ্ঠিত সেক্টর কমান্ডার্স কনফারেন্সে পুরো বাংলাদেশকে ১১টি সেক্টরে ভাগ করে সুপরিকল্পিতভাবে মুক্তিযুদ্ধ পরিচালিত হয়। কিন্তু লক্ষাধিক পাকিস্তানি সৈন্যের বিরুদ্ধে ইস্টবেঙ্গল রেজিমেন্টের মাত্র পাঁচ ব্যাটালিয়ন, ইপিআর, পুলিশ ও স্বল্প প্রশিক্ষিত মুক্তিযোদ্ধা নিয়ে শক্ত প্রতিরোধ গড়ে তোলা সহজ হবে না বলে ঊর্ধ্বতন কমান্ড বুঝতে পারেন। তাই যুদ্ধক্ষেত্রে নেতৃত্ব আরো সুদৃঢ় করার প্রয়োজনীয়তাও ভীষণভাবে অনুভূত হয়। এ ছাড়া আসন্ন বর্ষাকালের মধ্যেই দেশব্যাপী যুদ্ধ ছড়িয়ে দেয়ারও প্রয়োজনীয়তা উপলব্ধি করেন তারা। ইস্টবেঙ্গল রেজিমেন্টের আরো কয়েকটি ব্যাটালিয়ন ও ব্রিগেড গঠনেরও সিদ্ধান্ত হয়। সে জন্য প্রয়োজন হয় সুপ্রশিক্ষিত কমিশনড অফিসার, যারা হাজার হাজার গণযোদ্ধার নেতৃত্ব দেবেন। অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ এসব সামরিক পরিকল্পনা বাস্তবায়নের লক্ষ্যে মুজিবনগর সরকার একটি ‘নিয়মিত বাংলাদেশ সেনাবাহিনী’ গঠনের উদ্যোগ নেয় যার প্রথম ধাপ হিসেবে প্রয়োজন হয়ে পড়ে একটি মিলিটারি একাডেমির।

অস্থায়ী ‘বাংলাদেশ মিলিটারি একাডেমি’ প্রতিষ্ঠা: জেনারেল ওসমানির বিশেষ অনুরোধে স্বাধীন বাংলা সরকারের সদর দফতর থেকে নিয়মিত বাংলাদেশ সেনাবাহিনীর নেতৃত্ব দেয়ার লক্ষ্যে কমিশনড অফিসার তৈরির প্রশিক্ষণের জন্য একটি অস্থায়ী মিলিটারি একাডেমি প্রতিষ্ঠার সিদ্ধান্ত হয়। ভারত সরকারের সহযোগিতা ও অনুমোদনে শিলিগুড়ির উত্তর-পূর্বে, জলপাইগুড়ির ডুয়ার্স রিজার্ভ ফরেস্টের পার্বত্য জঙ্গলে ভুটান সীমান্তের কাছে অবস্থিত ছিল মূর্তি প্রশিক্ষণ শিবিরটি। ভুটান হয়ে ভারতে প্রবেশ করা মূর্তি নদীর পাশে অস্থায়ী মিলিটারি একাডেমি স্থাপনের সিদ্ধান্ত চূড়ান্ত হয়। ওই স্থানে আগে থেকেই ‘মুজিব ক্যাম্প’ নামে বড় সংখ্যক মুক্তিযোদ্ধার নিয়মিত প্রশিক্ষণ চলছিল। এটিকে নতুন করে সংগঠিত করা হয় ‘মুজিব উইং’ এবং ‘ভাসানী উইং’ নামে। ‘ভাসানী উইং’ হয় অস্থায়ী একাডেমি। এ একাডেমিতে ’৬৫ সালের পাক-ভারত যুদ্ধের সময় প্রচলিত ‘ওয়্যার কোর্স’-এর আদলে ১৪ সপ্তাহের প্রশিক্ষণ কর্মসূচির ‘বাংলাদেশ ওয়্যার কোর্স’ চালুর সিদ্ধান্তও অনুমোদিত হয়। প্রশিক্ষণের সার্বিক দায়িত্ব গ্রহণ করেন ভারতীয় বাহিনীর অফিসাররা।

দুর্দশাগ্রস্ত জীবন: এখানে পদাতিক ব্যাটালিয়নের সৈনিকদের থাকার জন্য আগে থেকেই দু’টি পুরোনো টিনশেড বিদ্যমান ছিল। ক্যাডেটদের জন্য তেমন কোনো মানসম্মত সুযোগ-সুবিধা ছিল না। ফলে তাদের অবর্ণনীয় দুর্ভোগ ও অসহনীয় কষ্ট স্বীকার করতে হয়। ইন্ডিয়ান সেনাবাহিনীর অফিসার ব্রিগেডিয়ার আর পি সিংহ, যিনি ক্যাপ্টেন অবস্থায় এখানে প্রশিক্ষকের দায়িত্ব পালন করেছেন, তার বর্ণনামতে: ‘These cadets did not enjoy the facilities which were provided to their counterparts in IMA and OTA. They were accommodated in temporary huts with bamboo walls and the roof was corrugated-galvanized tin sheets. In the hot and humid weather of July to September 1971, living condition in these barracks was miserable. There was no electricity and hence no fans. At night the cadets had to light up the barracks with hurricane lanterns to studz and prepare their uniforms etc. for the next day's classes.’
’৬৫ সালের পাক-ভারত যুদ্ধের সময় পাকিস্তান মিলিটারি একাডেমিতে স্বল্প সময়ে কমিশনড অফিসার তৈরির জন্য প্রচলিত ‘ওয়্যার কোর্সের’ অভিজ্ঞতা বা কনসেপ্ট মাথায় ছিল। সে আদলেই স্বাধীনতাযুদ্ধে আমাদের প্রয়োজন পূরণের লক্ষ্যে ‘বাংলাদেশ ওয়্যার কোর্স’ চালু করা। ইন্ডিয়ান মিলিটারি একাডেমি ও ‘অফিসার্স ট্রেনিং একাডেমি’র প্রশিক্ষণ সিলেবাস ও সূচি সংক্ষিপ্ত করে এ একাডেমিতে ১৪ সপ্তাহের প্রশিক্ষণ সিলেবাস প্রণয়ন করা হয়।

একাডেমির প্রথম বাংলাদেশ ওয়্যার কোর্সের জন্য জেন্টলম্যান ক্যাডেট নির্বাচন করার লক্ষ্যে জুন মাসের প্রথমেই সর্বাধিনায়ক জেনারেল ওসমানীর চিফ অব স্টাফ লেফটেনেন্ট কর্নেল মুহাম্মদ আবদুর রবের নেতৃত্বে একটি বিশেষ কমিটি সবগুলো সেক্টর পরিদর্শন করেন এবং সেনাবাহিনীর কমিশনড অফিসার হওয়ার যোগ্যতাসম্পন্ন যুদ্ধরত তরুণদের মধ্য থেকে মেধা ও যোগ্যতার ভিত্তিতে কেবল ইচ্ছুকদের বাছাই করা হয়। শিক্ষিত, মেধাবী, নেতৃত্বের গুণাবলিসম্পন্ন দুর্ধর্ষ চৌকস ৬০ জন তরুণকে চূড়ান্তভাবে বেছে নেয়া হয়। পরে পাকিস্তান মিলিটারি একাডেমি (পিএমএ) থেকে ৪৭ পিএমএ লং কোর্সের একজন জেন্টলম্যান ক্যাডেট পালিয়ে এসে এ কোর্সে যোগ দেন। এই ৬১ জন গেরিলা ক্যাডেটকে আধুনিক সমর শিক্ষায় পারদর্শী করে কমিশন দেয়ার লক্ষ্যে মূর্তিতে অবস্থিত অস্থায়ী বাংলাদেশ মিলিটারি একাডেমিতে পাঠানো হয়। ৩০ জুন থেকে দিন-রাত ১৪ সপ্তাহের কঠিন ও চ্যালেঞ্জিং প্রশিক্ষণ শুরু হয় ক্যাডেটদের।

প্রথম বাংলাদেশ ওয়্যার কোর্সের সমাপনী কুচকাওয়াজ: ৯ অক্টোবর ১৯৭১ মুক্তিযুদ্ধের ইতিহাসের একটি স্মরণীয় দিন। ১৪ সপ্তাহের টানা কঠিন প্রশিক্ষণ ও পরিশ্রমের পূর্ণাঙ্গ বাস্তব রূপ পেলো এদিন। এ দিন পাসিং আউট প্যারেড বা সমাপনী কুচকাওয়াজ শুরু হলো দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের সময়ে নির্মিত এয়ার ফিল্ডে সকাল সাড়ে ৮টায়। বাংলাদেশ সেনাবাহিনী তথা সামরিক বাহিনীর সর্বপ্রথম ঐতিহাসিক এই কুচকাওয়াজ প্রধান অতিথি হিসেবে পরিদর্শন করেন গণপ্রজাতন্ত্রী বাংলাদেশের অস্থায়ী সরকারের অস্থায়ী রাষ্ট্রপতি সৈয়দ নজরুল ইসলাম। উপস্থিত ছিলেন প্রধানমন্ত্রী তাজউদ্দীন আহমদ, সর্বাধিনায়ক জেনারেল আতাউল গনি ওসমানী, উইং কমান্ডার আবদুল করিম খন্দকার (পরবর্তীতে বিমানবাহিনী প্রধান ও মন্ত্রী), ৬ নম্বর সেক্টর কমান্ডার মুহাম্মদ খাদেমুল (এম কে) বাশার (পরবর্তীতে বিমানবাহিনী প্রধান) ও মুজিবনগর সরকারের বিশিষ্ট ব্যক্তি ও সংশ্লিষ্ট ভারতীয় সেনা অফিসাররা। সেকেন্ড লেফটেনেন্ট হিসেবে কমিশন লাভ করেন বাংলাদেশ সেনাবাহিনীর ‘প্রথম ওয়্যার কোর্সের ৬১ জন দুর্দান্ত, দুঃসাহসী গেরিলা যোদ্ধা। অস্থায়ী রাষ্ট্রপতি সৈয়দ নজরুল ইসলাম ও ডিফেন্স সেক্রেটারি তৌফিক-ই-এলাহী স্বাক্ষরিত ‘পার্চমেন্ট (কাগজের) কমিশন (Parchment Commission) সার্টিফিকেট’ দিয়ে তাদেরকে ভূষিত করা হয়েছিল। এ কোর্সে প্রথম স্থান অধিকার করে ‘C-in-C's Cane’ অর্জন করেন সেকেন্ড লেফটেনেন্ট সাইদ আহমেদ (পরবর্তীতে মেজর জেনারেল ও ডিভিশন কমান্ডার)। একটি দেশ সৃষ্টির সূচনার সাথে ওতপ্রোতভাবে জড়িত বাংলাদেশ সেনাবাহিনীর অত্যন্ত গৌরবময় এ ঐতিহাসিক দিনে ছিল না জৌলুসময় কোনো আনুষ্ঠানিকতা, ছিল না কোনো ‘ফ্যানফেয়ার’, ছিল না ‘মিলিটারি ব্যান্ড’, ছিল না সাধারণ ‘ভোজের’ আয়োজনও! এ গেরিলা অফিসারদের ছিল না মাথার টুপি, বেল্ট, কোনো সাজ-সজ্জা; দেয়া হয়েছিল কেবল ‘খাকি ট্রাউজার ও শার্ট’ আর এক জোড়া ‘জঙ্গল বুট’। বিশ্বের সামরিক ইতিহাসে এত সাধারণ ও দীনহীন পাসিং আউট প্যারেড হয়তো ছিল এটিই।

কমিশন লাভের পরপরই এই দুর্ধর্ষ অফিসারদের বদলি করা হয় যুদ্ধরত বিভিন্ন সেক্টর ও ইস্টবেঙ্গল রেজিমেন্টের বিভিন্ন ব্যাটালিয়নে। তারা সবাই ইস্টবেঙ্গল রেজিমেন্টের ইউনিটে বা পদাতিক বাহিনীতে যোগ দেন। এ তরুণ অফিসারদের অসাধারণ রণনৈপুণ্যে ও সমরকৌশলে যুদ্ধক্ষেত্রের পুরো চিত্রই পাল্টে যায়। পুরো মুক্তিযুদ্ধ তীব্র গতি লাভ করে। প্রথম বাংলাদেশ ওয়্যার কোর্সের অন্যতম উজ্জ্বল এক অফিসার ছিলেন বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের জ্যেষ্ঠ পুত্র শেখ কামাল। কমিশন পাওয়ার পর তিনি মুক্তিযুদ্ধের সর্বাধিনায়ক জেনারেল এমএজি ওসমানীর একান্ত ব্যক্তিগত সচিব বা এডিসি হিসেবে যোগ দেন এবং সুনামের সাথে দায়িত্ব পালন করেন বলে জানা যায়। এ দায়িত্ব শেষে তার বদলি হয় ২ ইস্ট বেঙ্গল রেজিমেন্টে।
হানাদার বাহিনীর সাথে সম্মুখসমরে এ কোর্সের তিন জন অফিসার শাহাদত বরণ করেন। তারা হলেন, শহীদ বীর উত্তম লেফটেনেন্ট আবু মঈন মুহাম্মদ আশফাকুস সামাদ, শহীদ বীর বিক্রম লেফটেনেন্ট খন্দকার আজিজুল ইসলাম ও শহীদ লেফটেনেন্ট সেলিম কামরুল হাসান। অসামান্য অবদানের জন্য এ কোর্সের একজন ‘বীর উত্তম’, দুজন ‘বীর বিক্রম’ ও ১৭ জন ‘বীর প্রতীক’ খেতাব অর্জন করেন। আমাদের সেনাবাহিনীতে যখন মাত্র ২৮-২৯ জন জেনারেল ছিলেন, তাদের মধ্যে এ কোর্সেরই ছিলেন চারজন, মেজর জেনারেল সাইদ আহমেদ বীর প্রতীক, মেজর জেনারেল জামিল ডি আহসান বীর প্রতীক, মেজর জেনারেল মাসুদুর রহমান বীর প্রতীক ও মেজর জেনারেল খন্দকার নূরন্নবী।

দ্বিতীয় বাংলাদেশ ওয়্যার কোর্স: প্রথম বাংলাদেশ ওয়্যার কোর্সের ৬১ জন গেরিলা ক্যাডেটের প্রশিক্ষণ চলাকালীনই জেনারেল ওসমানী ও পলিসিমেকারেরা আরো কোর্স পরিচালনার সিদ্ধান্ত নেন। অস্থায়ী বাংলাদেশ সরকার তা অনুমোদন করে। ফলে দ্বিতীয় ওয়্যার কোর্সের ক্যাডেট নির্বাচন কমিটি বিভিন্ন সেক্টর ও ইউনিট পরিদর্শন করে আরো ৭০ জন তরুণ অভিজ্ঞ, সুশিক্ষিত ও যোগ্যতাসম্পন্ন চৌকস গেরিলাযোদ্ধাকে নির্বাচিত করা হয়। নভেম্বরের প্রথম সপ্তাহে তাদের পাঠানো হয় এডহক বাংলাদেশ মিলিটারি একাডেমি মূর্তিতে। ১৬ ডিসেম্বর বিজয় অর্জনের সুসংবাদ তখন সবার মুখে মুখে। কিন্তু ১৪ সপ্তাহের প্রশিক্ষণ সম্পন্ন করার সিদ্ধান্ত গৃহীত হয়। ফলে ১৯৭২ সালের ফেব্রুয়ারির মাঝামাঝি পর্যন্ত সেখানে তাদের প্রশিক্ষণ সম্পন্ন করা হয়। সমাপনী কুচকাওয়াজের জন্য দু’দিন তাদের রিহার্সেল প্যারেডও অনুশীলন করা হয়। কিন্তু তা অনুষ্ঠিত না হয়ে ক্যাডেটদেরকে কমিশনড অফিসার হিসেবে স্বীকৃতি দেয়ার সিদ্ধান্ত আটকে যায়। এমতাবস্থায় তাদের মনোবলে দারুণ আঘাত লাগে।

হয়তো বিজয় অর্জনের পর বাংলাদেশ সরকার নানা গুরুত্বপূর্ণ কাজে ব্যস্ত হয়ে পড়ে এবং সেনাবাহিনীও সুসংহত অবস্থানে ছিল না। কমান্ড চ্যানেল সম্পূর্ণভাবে প্রতিষ্ঠিত হয়নি। কেননা, সেনাবাহিনী সদর দফতর ছিল ভারতীয় সেনাবাহিনীর দখলে। যাই হোক, অনেকে ভুলে গেলেও জেনারেল ওসমানী তো ভুলে যাননি। তিনি সব যোগাযোগ করেই সেকেন্ড ওয়্যার কোর্সের ক্যাডেটদেরকে স্বাধীন দেশে আনার ব্যবস্থা করেন।
এরপর বাংলাদেশ সরকারের সিদ্ধান্ত অনুযায়ী ফেব্রুয়ারির শেষের দিকে সাতটি ট্রাকে করে মূর্তি থেকে শিলিগুড়ি বর্ডার দিয়ে বাংলাদেশের পঞ্চগড় হয়ে রংপুর সেনানিবাসে আনা হয়। এখানে তাদেরকে মেজর মেসবাহ ও মেজর নওয়াজেশ অভ্যর্থনা জানান। একদিন রংপুরে অবস্থানের পর তাদেরকে ট্রেনে করে ঢাকা সেনানিবাসে নিয়ে আসা হয়। এখানে প্রায় ২৪ জন ক্যাডেট সেনাবাহিনীতে যোগ দিতে অনিচ্ছুক হয়ে চলে যান। অবশিষ্ট ৪৬ জনকে নিয়েই সেকেন্ড ওয়্যার কোর্সের কঠিন প্রশিক্ষণের দ্বিতীয় অধ্যায় শুরু হয়। ৪৬ ব্রিগেড কমান্ডার কর্নেল নাজমুল অস্থায়ী ব্যাটল স্কুলে (২ ইস্ট বেঙ্গল রেজিমেন্ট পরিচালিত) বর্ধিত প্রশিক্ষণের সার্বিক তত্ত্বাবধানে নিয়োজিত ছিলেন।

দ্বিতীয় বাংলাদেশ ওয়্যার কোর্সের সমাপনী কুচকাওয়াজ: প্রশিক্ষণ শেষে ৪৬ জন ক্যাডেটের বহু লালিত স্বপ্নের দিন সমাপনী কুচকাওয়াজ অনুষ্ঠানের সিদ্ধান্ত হয়। ঢাকা সেনানিবাসের বর্তমান সিগন্যাল মসজিদের বিপরীতে ২ ইস্ট বেঙ্গলের প্রশিক্ষণ মাঠে সেকেন্ড ওয়্যার কোর্সের সমাপনী কুচকাওয়াজের মাধ্যমে স্বাধীন বাংলাদেশের অস্থায়ী মিলিটারি একাডেমির প্রথম পাসিং আউট প্যারেড অন্ুিষ্ঠত হয়। দিনটি ছিল ১৯৭২ সালের ৫ আগস্ট। সরকারপ্রধান বঙ্গবন্ধু তখন চিকিৎসার জন্য লন্ডনে। তাই এ প্যারেডে প্রধান অতিথি ছিলেন রাষ্ট্রপতি বিচারপতি আবু সাঈদ চৌধুরী। এ ছাড়াও মন্ত্রিপরিষদের অধিকাংশ সদস্য, সিনিয়র রাজনীতিক এবং ঊর্ধ্বতন সামরিক ও বেসামরিক অফিসাররা উপস্থিত ছিলেন এ জৌলুসময় কুচকাওয়াজ অনুষ্ঠানে। প্যারেড কমান্ডার ছিলেন ব্যাটালিয়ন সিনিয়র আন্ডার অফিসার (বিএসইউও) মোদাচ্ছের হোসেন খান বীর প্রতীক। যিনি প্রথম স্থান অধিকারী হিসেবে রাষ্ট্রপতির কাছ থেকে ‘সোর্ড অব অনার’ গ্রহণ করেন। উল্লেখ্য, মোদাচ্ছের হোসাইন খান ছিলেন পাকিস্তান মিলিটারি একাডেমির ৪৭তম লং কোর্সের ক্যাডেট। স্বাধীনতা যুদ্ধের মাঝামাঝি সময়ে তিনি তার মায়ের অসুস্থতার কারণে ছুটিতে এসে পাকিস্তানে ফেরত না গিয়ে যোগ দেন মুক্তিযুদ্ধে।

বঙ্গভবনে রাষ্ট্রপতি কর্তৃক র্যাংক ব্যাজ প্রদান: সমাপনী কুচকাওয়াজ অনুষ্ঠিত হলেও সেদিন তারা সেকেন্ড লেফটেনেন্ট হিসেবে র্যাংক ব্যাজ পরিধান করতে পারেননি। কেননা, লন্ডন থেকে বঙ্গবন্ধু নির্দেশ দেন যে, সেকেন্ড ওয়্যার কোর্সের অফিসারদেরকে যেন বঙ্গভবনে আমন্ত্রণ জানিয়ে ভোজসভার মাধ্যমে সম্মানিত করে রাষ্ট্রপতি স্বয়ং র্যাংক ব্যাজ পরিয়ে দেন। সুতরাং সে অনুযায়ী ৬ আগস্ট মহামান্য রাষ্ট্রপতি ৪৬ জন সেকেন্ড লেফটেনেন্টের সে বহুল প্রতীক্ষিত কমিশন ও র্যাংক প্রদান করেন। যা বাংলাদেশ সামরিক বাহিনীর ইতিহাসে বিরল ঘটনা।

দ্বিতীয় বাংলাদেশ ওয়্যার কোর্সের মোট আটজন কর্মকর্তা স্বাধীনতা যুদ্ধে তাদের অসামান্য ও দুঃসাহসিক অবদান রাখার জন্য বীরত্বসূচক উপাধিতে ভূষিত হন। এরা হলেন-মেজবাহ উদ্দিন আহমেদ বীর বিক্রম, কাজী কামাল উদ্দিন আহমেদ বীর বিক্রম ও কামরুল হক স্বপন বীর বিক্রম (ক্র্যাক প্লাটুন থেকে দুজন) ও পাঁচজন ‘বীর প্রতীক’-মোদাচ্ছের হোসাইন খান, সৈয়দ ইকরামুল হক খন্দকার, এম হুমায়ুন কবির চৌধুরী, রওশন ইয়াজদানি ভূঁইয়া ও জাহাঙ্গীর ওসমান ভূঁইয়া। এ কোর্স থেকে মেজর জেনারেল হয়েছেন Alm Fazlur Rahman; Jiban Kanai Das. এ কোর্সের মেধাবী দুঃসাহসী ও চৌকস অফিসাররা বাংলাদেশ সেনাবাহিনী ও দেশ গঠনে অনন্য অবদান রেখেছেন। এ কোর্সের পরিচিত মুখ Major General Alm Fazlur Rahman, যিনি রৌমারি-পাদুয়া যুদ্ধের সিংহপুরুষ হিসেবে বিশেষভাবে পরিচিত।
বাংলাদেশের স্বাধীনতাযুদ্ধ ও ওয়্যার কোর্স দু’টি একই সূত্রে গাঁথা। অন্য কোনো কোর্সের এত বেশি সংখ্যক অফিসার মুক্তিযুদ্ধে অংশগ্রহণ করার সুযোগ পাননি।

বর্তমান বাংলাদেশ মিলিটারি একাডেমি (বিএমএ) স্বাধীনতা যুদ্ধের সময়ে প্রতিষ্ঠিত অস্থায়ী মিলিটারি একাডেমিরই ধারাবাহিকতার ধারক ও বাহক।
* তথ্যের কোনো অসঙ্গতি ঘটে থাকলে সংশোধন কাম্য। এ বিষয়ে অভিজ্ঞ সিনিয়রদের প্রতি তথ্য দিয়ে সাহায্য করার অনুরোধ করছি।

Email: hoque2515@gmail.com


আরো সংবাদ



premium cement