০২ মে ২০২৪, ১৯ বৈশাখ ১৪৩১, ২২ শাওয়াল ১৪৪৫
`


সমকালীন প্রসঙ্গ

ড. ইউনূস ও বাঙালির রসবোধ

ড. ইউনূস - ফাইল ছবি

বাঙালির রসবোধ হাল আমলে ড. ইউনূসকে নিয়ে যেভাবে উপচিয়ে পড়ছে অমনটি গত ১০০ বছরে ঘটেনি। আর ঘটবেই বা কী করে! আমাদের দেশে তো ড. ইউনূসের মতো কোনো ছেলে সন্তান ইতঃপূর্বে জন্মাননি আর তার মতো করে কেউ তো নোবেল পুরস্কারও পাননি। তার খ্যাতি-সফলতা ও লড়াই করে ৮০ বছরের বেশি সময় বেঁচে থাকার রেকর্ডও দ্বিতীয়টি নেই। ফলে তার শত্রুরা অনায়াসে বলতে পারে যে- লোকটির লজ্জা-শরম বলে কিছু নেই। তা না হলে এতদিন কেউ বেঁচে থাকে আর বুড়ো বয়সী একটি শরীর নিয়ে কেউ দুনিয়া চষে বেড়ায়! তিনি যদি শুধু চষে বেড়াতেন তা না হয় সহ্য করা যেত কিন্তু ক’দিন পরপর তিনি যে দুনিয়া কাঁপানো কাণ্ডকারখানা ঘটিয়ে ফেলেন তা আর কাহাতক সহ্য করা যায়!

হাল আমলে ড. ইউনূসের কর্মকাণ্ড বিশেষ করে ১৮৩ জন বিশ্ববরেণ্য রাষ্ট্রনায়ক ও নোবেল লরিয়েটের কাছ থেকে টাকা-পয়সা দিয়ে বিবৃতি এনেছেন বলে তার প্রতিপক্ষরা যেভাবে হইচই করছেন তার মধ্যে আবহমান বাংলার জমিনে লুকিয়ে থাকা বাঙালি চরিত্রের অসাধারণ রসের হাঁড়ি উন্মোচিত হয়েছে। বাঙালির রস বলতে আমরা গোপাল ভাঁড়, ভানু বন্দ্যোপাধ্যায় প্রমুখকে বুঝি। গত শতাব্দীতে সারা দুনিয়ার রসের হাঁড়ি বলতে আমরা চার্লি চ্যাপলিনকে বুঝতাম। চলমান শতকে মিস্টার বিন কিংবা থ্রি স্টুজেজের কীর্তিকলাপ দুনিয়ার মানুষকে হাসায়। কিন্তু বাঙালি ওসবের ধার ধারে না। তারা গোপাল ভাঁড় কিংবা ভানু বন্দ্যোপাধ্যায়ের আদলে শতভাগ বাঙালি সংস্কৃতিতে নির্মিত রসঘন চিত্রনাট্য ছাড়া কিছুতেই রঙতামাশা করতে রাজি নয়। ফলে পশ্চিমা দুনিয়ার রসবোধ মানব সভ্যতার বিবর্তন ঘটিয়ে তাদের ক্রমেই অধিকতর সভ্যতার দিকে চালিত করে। আর অন্য দিকে আমাদের রঙ রস উল্টো বিবর্তন ঘটিয়ে দেশ-কাল-জাতিকে রসের সাগরে ভাসিয়ে রসাতলে ডুবিয়ে নিত্যনতুন ইতিহাস রচনা করে চলেছে।

ড. ইউনূসকে নিয়ে হাল আমলে কী সব রসাত্মক ঘটনা ঘটছে তার কিছু নমুনা পেশ করলেই বোঝা যাবে। পত্রিকায় এসেছে, তার বিরুদ্ধে এ যাবৎকালে মোট ১৬৩টি মামলা করা হয়েছে। ৮৩ বছর বয়সে ড. ইউনূসের শরীরে কতটুকু তেল আছে তা পরীক্ষা করার জন্য যে আয়োজন চলছে সেখানে বাঙালির বিবেক বুদ্ধি-ন্যায়নীতি, আবেগ, অনুভূতি, চিন্তা-চেতনা, কথা বলার শক্তি সামর্থ্য, সাহস প্রদর্শনের অনীহা, ভয়-দ্বিধা-সঙ্কোচের অপূর্ব মহড়া ও সর্বোপরি তামাশা দেখার রসায়নগুলোর মধ্যে অদ্ভুত ক্রিয়া-প্রতিক্রিয়া শুরু হয়েছে। ফলে তিনি ৮৩ বছরের বৃদ্ধ শরীর নিয়ে শ্রম আদালতের ছয়তলার সিঁড়ি বেয়ে কিভাবে উঠেন-কিভাবে অস্বস্তিকর প্রচণ্ড গরমে ঘণ্টার পর ঘণ্টা আদালতে দাঁড়িয়ে থাকেন তা দেখার জন্য এবং বোঝার জন্য নাকে নস্যি লাগিয়ে দাঁত বের করে কিলকিলিয়ে খিলখিলিয়ে হেসে গড়াগড়ি দেয়ার মতো রসিক মানব-মানবী এই মুহূর্তে অন্য কোনো জাতিগোষ্ঠীর মধ্যে পাওয়া না গেলেও গাঙ্গেয় বদ্বীপে যে ওসব প্রাণীর অভাব নেই তা কিন্তু দিব্যি দিয়ে বলা যাবে না।

বাঙালির মেধা ও মননশীলতা যে কোন পর্যায়ের তা আমরা সহজেই অনুভব করতে পারি গ্রাম-বাংলার চ্যাংড়া পোলাপানের কাণ্ডকারখানা দেখে। তারা বর্ষাকালে উদোম শরীরে ঘণ্টার পর ঘণ্টা সাঁতার কাটে এবং বড় হয়ে ভাবতে থাকে তাদের মতো সাঁতারু দুনিয়ায় নেই। তালপাতার বল খেলে তারা ম্যারাডোনার চেয়েও বড় ফুটবল তারকার ভাব নিয়ে চলাফেরা করে। তারা হাডুডু-গোল্লাছুট-দাঁড়িয়াবান্দা-ডাংগুলি এবং কানামাছি ভোঁ ভোঁ খেলায় ব্যুৎপত্তি অর্জন করে প্রশ্ন করে মোহাম্মদ আলী ক্লে¬ কেন সর্বকালের সেরা ক্রীড়াবিদ হবেন! এ দেশের লেখকরা মনে করেন তাদের সাহিত্যে নোবেল না দিয়ে সুইডিশ নোবেল কমিটি মারাত্মক ভুল করে চলছে। এক শ্রেণীর রাজনীতিবিদ মনে করেন আব্রাহাম লিঙ্কন, উইনস্টন চার্র্চিল, জন অ্যাডামসরা যদি বাংলাদেশে রাজনীতি করতেন তবে ডাব্বা মারতেন সকালে ও বিকেলে এবং অতঃপর ব্যর্থ হয়ে উন্মাদের মতো কিছু দিন ঘুরে পাবনার মানসিক হাসপাতালে ভর্তি হতেন।

বাঙালি চিত্রকররা পাবলো পিকাসো, লিউনার্দো দ্য ভিঞ্চি অথবা ভিনসেন্ট ভ্যানগগ-রেমব্রন্ট-গিলবার্ট স্টুয়ার্ড প্রমুখ চিত্রকরের চিত্রকর্ম নিয়ে পৃথিবীবাসী কেন এত নাচানাচি করে তা ভেবে হরহামেশা মেজাজ হারিয়ে ফেলে। বাঙালি সাংবাদিকরা ভাবে টাকা হলে সব সম্ভব। বৃদ্ধ কামুক রুপার্ট মারডকের সিএনএন-ফক্স নিউজ, দ্য টাইমস অব লন্ডন, ওয়াল স্ট্রিট জার্নাল প্রভৃতি পত্রিকায় চাকরি করে গণতন্ত্র ও মানবাধিকার নিয়ে নিবন্ধ লেখা মানায় না। ইহুদিবাদের ইকোনমিস্ট কিংবা আরবি রাজতন্ত্রের হাতিয়ার আলজাজিরায় প্রকাশিত কোনো খবর বিশ্বাস করা যে অপরাধ তা প্রমাণ করার জন্য সুবে বাংলার ভাড়াটিয়া সাংবাদিকরা যেভাবে ছুটোছুটি করেন সেই দৃশ্যের মধ্যে যে রসের হাঁড়ি খুঁড়ে পাওয়া যায় তা চার্লি চ্যাপলিনের কোনো সিনেমাতেও দেখা যায় না। বাঙালির আত্মতুষ্টি এবং হামবড়া ভাব নিয়ে দেশের ১৭ কোটি মানুষ যেভাবে দাঁতে দাঁত চেপে প্রতিদিন ধৈর্য-সহ্য ও সংযমের পরিচয় দিয়ে যাচ্ছে তাতে করে ড. ইউনূসের মতো কয়েক হাজার প্রবীণ বিশ্বমানের সম্মানিত মানুষকে যদি প্রকাশ্য রাজপথে দোররা মারা হয় এবং তাদের বিরুদ্ধে যদি শিশু নির্যাতনের অভিযোগ আনা হয় তবুও কেউ দাঁতের পাটি খুলে জিহ্বা নেড়ে হালকা শব্দে উহ্ উচ্চারণ করার পরিবর্তে ক্ষমতার পক্ষে খিস্তিখেউড় করবে না- এমন নিশ্চয়তা আমি দিতে পারব না। ফলে এই মুহূর্তে ড. ইউনূসকে নিয়ে যা কিছু হচ্ছে তার মধ্যে অবাক হওয়ার মতো কিছু দেখছি না; বরং বাঙালির প্রত্যয়-সাহস ও যোগ্যতা দেখে রীতিমতো শিহরিত হচ্ছি।

আলোচনার শুরুতে বলেছিলাম যে, বিশ্ববরেণ্য ১৮৩ জন মহামানব ড. ইউনূসের পক্ষে বিবৃতি দিয়েছেন। তাদের সেই বিবৃতিকে চ্যালেঞ্জ জানিয়ে বাংলাদেশের ৫০ জন সম্পাদক এক বিবৃতি প্রকাশ করেন। এই সম্পাদকরা মনে করছেন ১৮৩ জন মহামানব আসলে কিছুই বোঝেন না। তারা নাবালক অথবা বেকুবের মতো ড. ইউনূসের পক্ষে স্বাক্ষর করেছেন। কেউ কেউ অভিযোগ করছেন যে, ড. ইউনূসের টাকা খেয়ে ওরা ১৮৩ জন এক মঞ্চে হাজির হয়ে বাংলাদেশের পুরো সিস্টেম নিয়ে যে প্রশ্নবোধক চিহ্ন এঁকেছেন সেই প্রশ্নের দাঁতভাঙা জবাব দেয়ার হিম্মত সারা দুনিয়ার মধ্যে কেবল সেই সব সম্পাদকের রয়েছে। মার্কিন প্রেসিডেন্ট বারাক ওবামা, হিলারি ক্লিনটন, আল গোর, জাতিসঙ্ঘের সাবেক মহাসচিব বান কি মুনসহ শতাধিক নোবেল পুরস্কারপ্রাপ্ত ব্যক্তি যে চরম অর্থকষ্টের কারণে ড. ইউনূসের পোষ্য তাঁবেদার অথবা ক্রীড়নক হিসেবে আন্দোলনে নামার হুমকি দিয়েছেন এমন যুগান্তকারী চিন্তাবিদ, মহামানব-অতি মানবরা যে বাংলার জমিনে পয়দা হয়েছেন তা ভেবে আত্মতুষ্টিতে জমিনের সব প্রাণী খুশিতে গড়াগড়ি করছে।

৫০ কৃতী সম্পাদকের পদাঙ্ক অনুসরণের জন্য রাজভোগপ্রত্যাশী বিভিন্ন শ্রেণী-পেশার বুদ্ধিজীবী রীতিমতো দৌড় শুরু করেছেন। ড. ইউনূসের পক্ষে বিবৃতিদাতারা কত টাকা নিয়েছেন- কিভাবে নিয়েছেন- কেন নিয়েছেন এসব নিয়ে গবেষণা এবং জরিপকর্ম যুগপৎভাবে চালানোর জন্য রাজভোগের দোকানদারের কাছে ভোগীরা ভিড় করে চলেছেন। বিবৃতিদাতারা কী ভুল করেছেন এবং তাদের নৈতিক অধঃপতন কোন পর্যায়ে তা নির্ধারণের জন্য একটি বিশেষজ্ঞ প্যানেল দিন-রাত অবিরত চেষ্টা চালিয়ে যাচ্ছে। সমুচা ও সিঙ্গারার মধ্যে পার্থক্য কী! সিঙ্গারার মধ্যে কেন আলু থাকে- বিহারে কেন লালু থাকে- এসব অতি গুরুত্বপূর্ণ বিষয় বাদ দিয়ে কিছু লোক বারাক ওবামা ও হিলারি ক্লিনটনের নৈতিক অধঃপতনের কারণ বের করার জন্য অশ্ব-মেধ-যজ্ঞ শুরু করে দিয়েছেন।

ড. ইউনূসের পক্ষে যারা বিবৃতি দিয়েছেন তাদের মধ্যে যারা ইয়েল-ডাভার্ড প্রভৃতি বিশ্ববিদ্যালয় থেকে আইনশাস্ত্রে সর্বোচ্চ ডিগ্রি নিয়ে দুনিয়ার সেরা উকিল হিসেবে স্বীকৃতি পেয়েছিলেন তারা কেন ইউনূসের টাকা খেয়ে আইন ভুলে গেলেন তা নিয়ে রাজভোগী আইনজ্ঞরা মহা চিন্তায় পড়ে গেছেন। অনেকে বলার চেষ্টা করছেন, ওরা কোনো আইনই জানে না। টাকার কাছে বিবেক বন্ধক রেখে মানুষ এ জঘন্য কর্ম করতে পারে তা বাংলাদেশের নীতিবাগীশ রাজভোগীদের যারপরনাই সংক্ষুব্ধ-বিক্ষুব্ধ-বিরক্ত ও অস্থির করে তুলেছে। ফলে ইউনূসবিরোধীরা অস্থিরতার কবলে পড়ে এমন সব রসের হাঁড়ি হররোজ দেশবাসীকে উপহার দিচ্ছেন যা গত ১০০ বছরেও বঙ্গবাসী দেখেনি।
উল্লিখিত বাৎচিতের রসের হাঁড়ির তাণ্ডবে আমার মন-মস্তিষ্কের সাধারণ মানবীয় শক্তি ক্রমেই লোপ পাচ্ছে। আমি হয়তো অনাগত দিনে অনেক কিছু ভুলে যাবো। তাই বিদেয়বেলায় শুধু একটি প্রশ্ন রেখে যাই, টাকা দিয়ে বিবৃতি কেনা ড. ইউনূসের টাকার জোর বেশি নাকি ইউনূসবিরোধীদের টাকার জোর বেশি। ড. ইউনূসের পক্ষে বিবৃতিদাতারা যে পরিমাণ অর্থ পেয়েছেন তার পরিমাণ বেশি নাকি যারা তার বিরুদ্ধে বিবৃতি দিয়েছেন তাদের আর্থিক মানদণ্ড বেশি!

লেখক : সাবেক সংসদ সদস্য


আরো সংবাদ



premium cement