২৯ এপ্রিল ২০২৪, ১৬ বৈশাখ ১৪৩১, ১৯ শাওয়াল ১৪৪৫
`


শাসনতন্ত্রের পূর্ণাঙ্গ বাস্তবায়ন দাবি করছি

শাসনতন্ত্রের পূর্ণাঙ্গ বাস্তবায়ন দাবি করছি - ফাইল ছবি

আমরা কোনো দল ও নেতার পক্ষে বা বিপক্ষে নই। যে গণতান্ত্রিক শাসনতন্ত্র বর্তমান সরকারের ভিত্তি সেই গণতান্ত্রিক শাসনতন্ত্র বঙ্গবন্ধু নিজের উদ্যোগেই প্রণয়ন করেছিলেন এবং জাতীয় পরিষদে সেই শাসনতন্ত্র গৃহীত হয়েছিল। আইনমন্ত্রী ড. কামাল হোসেনকে ইংল্যান্ডে পাঠালেন তাদের শাসনতন্ত্র বিশেষজ্ঞদের পরামর্শ নিতে। আনন্দ-উৎসবের মধ্য দিয়ে জাতি সংসদীয় গণতন্ত্রের শাসনতন্ত্র পেয়েছিল। ১৯৭২ সালের সেই শাসনতন্ত্রের অধীনে ১৯৭৩ সালে নির্বাচনও অনুষ্ঠান করেছিলেন।

দেশের অবস্থাও কঠিন ছিল। অভ্যন্তরীণ দুর্বলতার জন্য সরকার বিভিন্নমুখী ব্যর্থতার সম্মুখীন হয়। তাকে বোঝানো হলো নিজের হাতে সর্বক্ষমতা নিলেই সরকার সফল হবে। বিপ্লবী চরিত্রের একদলীয় শাসনব্যবস্থা তথা বাকশাল চালু করা হলো। ১৯৯০ সালের গণআন্দোলনের পর গঠিত বিএনপি সরকার আওয়ামী লীগের সহায়তায় ১৯৭২ সালের গণতান্ত্রিক সেই শাসনতন্ত্রের ভিত্তিতে সরকার পরিচালনা শুরু করে। আওয়ামী লীগও এই শাসনতন্ত্রের অধীনে একাধিকবার সরকার গঠন করেছে।

আমরা এ কথা বারবার স্মরণ করিয়ে দিয়েছি যে, গণতান্ত্রিক দেশগুলোর সহযোগিতা ছাড়া পৃথিবীর কোথাও বিকাশমান গণতন্ত্র টিকে থাকতে পারে না। আমাদের সাহায্য দরকার। এই বার্তাই আমরা গণতান্ত্রিক বিশে^র কাছে পৌঁছে দেয়ার চেষ্টা করেছি।

আমরা মনে করি, শুধু আমেরিকা নয়, পুরো বিশে^র গণতান্ত্রিক দেশগুলো গণতান্ত্রিক শাসনতন্ত্রের বাস্তবায়নের পক্ষে আছে। আমরা নতুন কোনো শাসনতন্ত্রের দাবি করছি না। সরকার গৃহীত গণতান্ত্রিক শাসনতন্ত্রের পূর্ণাঙ্গ কার্যকর করতে চাচ্ছি। সরকার গণতান্ত্রিক শাসনতন্ত্রের অধীনে থাকবে কিন্তু জনগণের অধিকারবিষয়ক অংশবিশেষ চাপা রাখবে, তা হতে পারে না।
এ জন্য যখন যুক্তরাষ্ট্রের ভিসানীতি কয়েকজন, আইনপ্রয়োগকারী সংস্থার শীর্ষ অফিসারদের ওপর আরোপ করা হলো, তখনই তাদের কঠিন স্বভাব নমনীয় হতে শুরু করল। সরকারি অফিসাররা (ঢ়ঁনষরপ ংবৎাধহঃং) ভালো করেই জানেন, জনগণের সেবা তাদের শাসনতান্ত্রিক দায়িত্ব ও কর্তব্য। কিন্তু মুষ্টিমেয় অফিসার তাদের ক্ষমতার অপব্যবহার করে আনন্দ পান। জনগণ যে তাদের কাছে কতটা অসহায় সেটিই তাদের ফুটানির বিষয়।

গুপ্তহত্যা ও জোর করে অপহরণে সন্ত্রাসী প্রক্রিয়ার বিরুদ্ধে সাহস যোগানোর জন্য যুক্তরাষ্ট্র এবং পশ্চিমা দেশগুলোর প্রতি আমরা যে কতটা কৃতজ্ঞ, সে কথা ভাষায় প্রকাশ করার ক্ষমতা নেই আমাদের।
আমাদের মধ্যে কিছুটা হলেও সাহস এসেছে এই ভেবে যে, ব্যক্তির মৌলিক অধিকারগুলো নিয়ে স্বাধীন দেশের নাগরিকদের প্রাপ্ত মর্যাদা নিয়ে বাঁচার নিশ্চয়তা থাকবে। মনে মনে এটাও ভেবেছি যে, পৃথিবী ছোট হয়ে আসছে, দূরত্ব আর দূরত্ব নেই। কোনো দেশের প্রকৃত অবস্থা গোপন রাখার সুযোগ নেই। গণতান্ত্রিক শাসনব্যবস্থা তথা জনগণের শাসন প্রতিষ্ঠায় কোনো দেশই সে অর্থে একা থাকার কথা নয়। মানবাধিকার রক্ষার জন্য জাতিসঙ্ঘসহ অনেক আন্তর্জাতিক প্রতিষ্ঠান রয়েছে। তারা এখন সরকারের ওপর চাপ সৃষ্টি করে যাচ্ছে যাতে সন্ত্রাসী রাজনীতি বন্ধ হয়। সরকার গণতান্ত্রিক শাসনতন্ত্র অস্বীকার করছে না।

বাংলাদেশে গুপ্তহত্যা এবং জোর করে গুমের শাসন চালাতেও অসুবিধা হয়নি। বিদেশী সরকার বিশেষের কাছ থেকে প্রশংসা পেতেও অসুবিধা হয়নি। তাই দোষ শুধু আমাদের একার নয়। জনগণ প্রদত্ত সংবিধানের অধীনেই বর্তমান আওয়ামী লীগ সরকার শপথ নিয়ে শুধু নির্বাচন পদ্ধতির ব্যাপারে শাসনতন্ত্রের সংশোধন করেছে। মূল গণতান্ত্রিক শাসনতন্ত্র অপরিবর্তিত রেখেছে অর্থাৎ বিচার বিভাগের স্বাধীনতাসহ ব্যক্তির মৌলিক অধিকারসমূহ সংরক্ষিত আছে। খুন-গুমের সন্ত্রাসী রাজনীতির কারণে মৃত্যুর ঝুঁকি নিয়ে প্রতিবাদ করাও সম্ভব ছিল না। এভাবেই গণতান্ত্রিক প্রতিষ্ঠানগুলোকে ভয়ভীতির মধ্যে অসহায় অবস্থায় রাখা হলো।

কিন্তু নির্বাচন সম্পর্কিত শাসনব্যবস্থায় এমন সংশোধনী আনা হলো যাতে জনগণের ভোট ছাড়াই সরকারি কর্মচারীদের সহায়তায় নির্বাচনে বিজয়ী হতে আওয়ামী লীগের কোনো বাধাই থাকল না। বিদেশীদের বোঝাতে চাইলেন যে, প্রধানমন্ত্রীর নিজস্ব জনপ্রিয়তার জন্যই জনগণ তাকে বারে বারে নির্বাচনে বিজয়ী করছে। ঘরে-বাইরে কিছু সরকারি কর্মকর্তা ভাবলেন, সরকার আমাদের হাতের পুতুল। রাষ্ট্রীয় বাড়তি সুযোগ-সুবিধা আমাদেরই প্রাপ্য।

আমরা অবাক হই, কেমন করে এ দেশে এত হীন ও নীচ হুকুম তামিল করার জন্য আমাদের নিজেদের শিক্ষিত লোকেরা এতটা নিষ্ঠুর ও দাসসুলভ আচরণ করতে পারে!
আওয়ামী লীগের নেতারাও অবাধ নির্বাচনের নিশ্চয়তা দিচ্ছেন এবং সহজভাবেই বলে যাচ্ছেন, আওয়ামী লীগ সরকারের অধীনেই নিরপেক্ষ নির্বাচন হবে। মূল শাসনতন্ত্রের নির্বাচনসংক্রান্ত বিধিবিধান এমনভাবে সংশোধন করা হয়েছে যে, সরকার সংশোধিত শাসনতন্ত্রের ভিত্তিতে নির্বাচনকালীন সরকার হিসেবে আওয়ামী লীগ সরকারই ক্ষমতায় থাকবে। পার্লামেন্টেরও অবলুপ্তি হবে না।

গুপ্তহত্যা ও গুমের সন্ত্রাসী তৎপরতার ভয়ে ব্যক্তির মৌলিক অধিকার, বিচার বিভাগের স্বাধীনতা বাস্তবে অকার্যকর হয়ে গেছে। সরকার শাসনতন্ত্র দেখিয়ে বলতে পারছে যে, গণতান্ত্রিক অধিকারসমূহ রক্ষার শাসনতান্ত্রিক নিশ্চয়তা রয়েছে।

বিভিন্ন ষড়যন্ত্রের মাধ্যমে বঙ্গবন্ধুর অনুপস্থিতির সুযোগে বাংলাদেশ একটি পৃথক রাষ্ট্র হিসেবে প্রতিষ্ঠা লাভের পর বঙ্গবন্ধু সংসদীয় গণতন্ত্রের শাসনতন্ত্র প্রবর্তন করেন। কিন্তু কত আগ্রহ নিয়ে তিনি সংসদীয় গণতান্ত্রিক শাসনতন্ত্র প্রণয়ন করেছিলেন তা অনেকেরই জানা।
গণতন্ত্রের সাফল্যের জন্য কেবল অবাধ নির্বাচনই যথেষ্ট নয়। গণতন্ত্র বিনির্মাণে আমাদের আন্তর্জাতিক সাহায্য ও সহযোগিতা দরকার হবে। প্রচলিত শাসনতন্ত্রের মাধ্যমেই তা সম্ভব।

সর্বস্তরে দুর্নীতির ব্যাপক বিস্তৃতি ও ক্ষমতার অপব্যবহার করে অবাধ সুবিধা গ্রহণ করার ফলে গণতান্ত্রিক নেতৃত্ব ও রাজনীতির ক্ষেত্রে বিরাট সঙ্কট সৃষ্টি হয়। রাজনীতিবিদের ছদ্মবেশ ধারণ করে বিত্তবান হওয়ার ব্যবসায় পরিণত হবার কারণে রাজনীতি দূষিত হয়েছে মারাত্মকভাবে। আমরা তাই কোনো দল বা নেতার সমর্থক নই। আমরা গণতান্ত্রিক শাসনতন্ত্রের পূর্ণাঙ্গ বাস্তবায়ন চেয়েছি।
আগে কখনো জনগণ এত নিরাপদে ব্যাংক ডাকাতি ও অর্থ পাচার হতে দেখেনি। নিঃস্বার্থ হতে না পারলে রাজনীতিবিদ হওয়া যায় না। তাই দলীয় রাজনীতিতে স্থান তারাই পাবেন যারা দলীয় রাজনীতির ঊর্ধ্বে উঠে গণতান্ত্রিক নেতৃত্ব গড়বেন। জন্মগতভাবে কেউ রাজনৈতিক নেতা হতে হলে তাকে প্রথমেই নিঃস্বার্থবাদী হতে হবে। তার সরকারি দায়িত্ব পালনের যোগ্যতা অবশ্যই থাকতে হবে।

আওয়ামী লীগের জন্য গণতন্ত্রের মানসপুত্র হিসেবে হোসেন শহীদ সোহরাওয়ার্দী সাহেবের মতো একজন নেতা পাওয়া অত্যন্ত সৌভাগ্যের বিষয়। তিনি তরুণদেরকে দলীয় রাজনীতিতে পেশিশক্তি হিসেবে দেখতে চাননি। তরুণদের পেশিশক্তি হিসেবে ব্যবহার করা কোনো রাজনৈতিক দলের উচিত নয়।

সরকার যে শাসনতন্ত্রের ভিত্তিতে ক্ষমতায় আছে আমরা সেই শাসনতন্ত্রের বাস্তবায়নের ওপর গুরুত্ব দিচ্ছি। বিপদ দেখা দিয়েছে সরকারের নির্বাচন চুরির তথ্য ফাঁস হবার কারণে। এখন সরকারের শাসনতান্ত্রিক বৈধতার প্রশ্নই উঠেছে। গণতান্ত্রিক শাসনতন্ত্রের অধীনে খুন-গুমের শাসন তো চলতে পারে না। গণতান্ত্রিক শাসনতন্ত্র নির্বাচন চুরির বৈধতা দিতে পারে না। সরকার শাসনতান্ত্রিক সঙ্কট সৃষ্টি করেছে। দেশে এখন কোনো শাসনতন্ত্রসম্মত সরকার আছে কি না তার উত্তর সরকারকেই দিতে হবে।
সঙ্কটের গভীরতা অনেক বিলম্বে হলেও সরকার বুঝতে পেরেছে। তাই তাদের বলতে হচ্ছে, বিএনপি ক্ষমতায় আসলে পাঁচ মিনিটের মধ্যে আওয়ামী লীগ নিশ্চিহ্ন হয়ে যাবে। সরকার যে, জনসমর্থনহীন সে কথাই বলা হয়েছে।

আমাদের বিশ্লেষণে সরকার এখনো শান্তিপূর্ণ সমাধান খুঁজতে পারে। সরকার স্বেচ্ছায় পদত্যাগ করে গণতান্ত্রিক প্রক্রিয়ার অংশীদার হতে পারে।
পরিবর্তন যে আসছে তা সরকারের কাছে অজানা নয়। সুষ্ঠু নির্বাচনের মাধ্যমে শাসনতান্ত্রিক সঙ্কট উত্তরণের সদিচ্ছা থাকতে হবে। আমাদের সম্মিলিত প্রচেষ্টা ব্যর্থ হলেও গণজাগরণের আশঙ্কা থেকে যাবে। পরিবর্তন হতেই হবে। জনগণের ওপর নানা ধরনের নির্যাতন চালানো হয়েছে। তারা এখন দুুঃসহনীয় আর্থিক সঙ্কটে রয়েছে। ধৈর্যের সীমাও শেষ হয়েছে।

আমরা এই মিথ্যা ভাবমর্যাদা নিয়ে বেঁচে থাকতে চাই না যে, বাংলাদেশ একটি ছাগল-পাগলের দেশ... যেখানে বিচার নেই, যেখানে জ্ঞানী-গুণীদের কোনো কদর নেই। ড. ইউনূস নিজেও স্বীকার করবেন যে, বাংলাদেশের সবশ্রেণীর মানুষ তাকে নিয়ে কত গর্বিত।

লেখক : সিনিয়র আইনজীবী, বাংলাদেশ সুপ্রিম কোর্ট


আরো সংবাদ



premium cement