২৯ এপ্রিল ২০২৪, ১৬ বৈশাখ ১৪৩১, ১৯ শাওয়াল ১৪৪৫
`


জলাবদ্ধতায় চট্টগ্রাম নগরী পরিত্যক্ত হওয়ার আশঙ্কা

জলাবদ্ধতায় চট্টগ্রাম নগরী পরিত্যক্ত হওয়ার আশঙ্কা - ফাইল ছবি

বন্দরনগরী চট্টগ্রাম এপ্রিল থেকে আগস্ট পর্যন্ত জলাবদ্ধতায় তলিয়ে গেছে অন্তত ১২ বার। শুধু আগস্টে ছয়বার তলিয়ে যায়। প্রতি বছর চট্টগ্রাম শহর এভাবে ১০ থেকে ১৪ বার ডুবে যায়। অপরিকল্পিত কাজ ও সরকারি সংস্থাগুলোর মধ্যে সমন্বয়হীনতায় চট্টগ্রাম নগরের জলাবদ্ধতা নিরসনে চলমান চারটি প্রকল্পের কাজ স্থবির হয়ে পড়েছে। আগামী দুই বছরেও জলাবদ্ধতা সমস্যার সমাধান হবে আশা করা যায় না। গত ছয় বছরে এসব প্রকল্পের পেছনে প্রায় ছয় হাজার কোটি টাকা খরচ হলেও জলাবদ্ধতার সমাধান করা যায়নি। সময় যায়, খরচ বাড়ে, প্রকল্প শেষ হয় না। জোয়ার ও ভারী বর্ষণে দিন দিন জলাবদ্ধতা বেড়ে চলেছে। রেগুলেটর (জোয়ার প্রতিরোধক ফটক) নির্মাণ করা হলেও কাক্সিক্ষত সুফল পাওয়া যাচ্ছে না। বিশেষজ্ঞরা মনে করেন, কোনো ধরনের সম্ভাব্যতা যাচাই ছাড়াই জোড়াতালির মাধ্যমে ওই প্রকল্প গ্রহণ করা হয়। আসলে জলাবদ্ধতা প্রকল্প বাস্তবায়নে সিডিএর সক্ষমতাও প্রশ্নবিদ্ধ।

২০১১ থেকে ২০২০ সাল পর্যন্ত জলাবদ্ধতায় চাক্তাই, খাতুনগঞ্জ, আছাদগঞ্জ, আগ্রাবাদ ও রিয়াজুদ্দিন বাজারে প্রায় তিন হাজার কোটি টাকার ক্ষতি হয়েছে। এবারের ক্ষতির পরিমাণ বহুগুণ বেশি। নগরের আগ্রাবাদে চট্টগ্রাম মা ও শিশু হাসপাতালের নিচতলা পানিতে ডুবে গেলে হাসপাতালের রোগীর স্বজনদের জন্য রাখা আসনগুলো পানিতে তলিয়ে যায়। সামান্য বৃষ্টিতে নগরের ডিসি সড়কসহ ২ নম্বর গেট, চকবাজার, কাতালগঞ্জ, বাদুরতলা, কাপাসগোলা, মুরাদপুর, বাকলিয়া, চান্দগাঁও, বাকলিয়া, বহদ্দারহাট, হালিশহরের ওয়াপদাসহ নগরের ১৫টি এলাকায় জলাবদ্ধতা সৃষ্টি হয়। জলাবদ্ধতার কারণে কোনো কোনো এলাকায় নয় থেকে ১০ ঘণ্টা পর্যন্ত পানি স্থির থাকে। জলাবদ্ধতা নগরজীবনকে দুর্বিষহ করে তুলছে।

কর্তৃপক্ষ সূত্রে জানা গেছে, চট্টগ্রাম নগরের জলাবদ্ধতা দূর করতে চট্টগ্রাম উন্নয়ন কর্তৃপক্ষ (সিডিএ) দু’টি, সিটি করপোরেশন একটি ও পানি উন্নয়ন বোর্ড একটি করে প্রকল্প বাস্তবায়ন করছে। চার প্রকল্পের মোট ব্যয় ধরা হয়েছে ১১ হাজার ৩৪৪ কোটি টাকা। ছয় বছরে এসব প্রকল্পের আওতায় খরচ হয়েছে পাঁচ হাজার ৯৪১ কোটি টাকা। জোয়ার ও ভয়াবহ জলাবদ্ধতার কারণে নগরের ৫০ শতাংশ এলাকা তলিয়ে যায় এবং ২০ লাখ মানুষ পানিবন্দী হয়ে পড়েন। এই চারটির মধ্যে সবচেয়ে বড় প্রকল্পটি হচ্ছে সিডিএর। পাঁচ হাজার ৬১৬ কোটি টাকার এ প্রকল্প একনেকে অনুমোদিত হয় ২০১৭ সালের আগস্টে। কোনো ধরনের সম্ভাব্যতা যাচাই ছাড়া প্রকল্পটি নেয়া হয়। পরে প্রকল্পটি বাস্তবায়নের দায়িত্ব দেয়া হয় সেনাবাহিনীর ৩৪ ইঞ্জিনিয়ার কনস্ট্রাকশন ব্রিগেডকে। খালগুলো পরিকল্পিতভাবে পুনর্খনন, সম্প্রসারণ ও উন্নয়নের মাধ্যমে চট্টগ্রাম নগরের জলাবদ্ধতা নিরসন ছিল প্রধান উদ্দেশ্য। এ প্রকল্পের আওতায় নগরের ৩৬টি খাল খনন, এর দুই পাশে প্রতিরোধ দেয়াল ও রাস্তা, নালা-নর্দমা ও ব্রিজ-কালভার্ট নির্মাণ, পাঁচটি খালের মুখে রেগুলেটর স্থাপন ও তিনটি জলাধার নির্মাণ। ২০২০ সালের জুনে কাজ শেষ হওয়ার কথা থাকলেও তা হয়নি। ২০২৩ সালের জুলাই পর্যন্ত সবচেয়ে বড় এ প্রকল্পের অগ্রগতি ৮৬ শতাংশ।

নগরী বারবার ডুবলেও প্রকল্প বাস্তবায়নকারী মূল দুই সংস্থা সিটি করপোরেশন ও সিডিএর মধ্যে সমন্বয় নেই; বরং জলাবদ্ধতার দায় একে অপরের কাঁধে চাপাতে ব্যস্ত। নগরে জলাবদ্ধতা নিরসন প্রকল্পের কাজে সিডিএ সমন্বয় করছে না অভিযোগ তুলে ক্ষোভ জানিয়ে ৬ আগস্ট ফেসবুকে পোস্ট দেন মেয়র রেজাউল করিম চৌধুরী। তিনি বলেন, এ প্রকল্পে সিটি করপোরেশনের ভূমিকা নেই। তারা (সিডিএ) করপোরেশনকে কোনো কিছুই জানায়নি। ইচ্ছেমতো কাজ করছে। এত বড় একটি প্রকল্প, চট্টগ্রামবাসীর বাঁচা-মরারও প্রশ্ন, এরপরও তারা সমন্বয় করছে না। ৯ আগস্ট সংবাদ সম্মেলন করে সিডিএর চেয়ারম্যান এম জহিরুল আলম দোভাষ সিটি করপোরেশনের সক্ষমতা নিয়ে প্রশ্ন তুলে বলেন, চট্টগ্রাম সিটি করপোরেশন জলাবদ্ধতার কাজ ঠিকভাবে করতে না পারায় তার দায়িত্ব সিডিএকে দেয়া হয়েছে। মেয়রও ভুল তথ্য দিয়ে সিডিএকে দোষারোপ করছেন। আর প্রকল্প বাস্তবায়নে সিডিএর কোনো গাফিলতি নেই। (প্রথম আলো, ১৮ আগস্ট-২০২৩)
চট্টগ্রামের ২ নম্বর গেট, ষোলশহর, মুরাদপুর, শুলকবহর, বারইপাড়া, বহদ্দারহাট, চান্দগাঁও, বাকলিয়া ও চাক্তাই এলাকায় জলাবদ্ধতা দূর করতে বহদ্দারহাটের বারইপাড়া থেকে বলিরহাট পর্যন্ত নতুন খাল খননের সুপারিশ করা হয়েছিল। প্রতি বছর এসব এলাকা ভারী বর্ষণের সময় কোমর সমান পানিতে ডুবে যায়। ২০১৪ সালের জুনে তিন কিলোমিটার দীর্ঘ এ খাল খননের অনুমোদন দিয়েছিল একনেক। ৯ বছর চললেও খালটির খননকাজ শেষ করতে পারেনি চট্টগ্রাম সিটি করপোরেশন। ৩২৬ কোটি টাকার প্রকল্পটি বাস্তবায়নে এখন খরচ করতে হচ্ছে এক হাজার ৩৬২ কোটি টাকা। গত জুন পর্যন্ত খরচ হয়েছে এক হাজার ১৭৫ কোটি টাকা।

সিটি করপোরেশনের হিসাবে চট্টগ্রাম নগরে উন্মুক্ত নালা-নর্দমা ও খালে ঝুঁকিপূর্ণ স্থান রয়েছে পাঁচ হাজার ৫২৭টি। এর মোট দৈর্ঘ্য ১৯ হাজার ২৩৪ মিটার। চট্টগ্রাম সিটি করপোরেশন ও সিডিএর অব্যবস্থাপনা এবং নিরাপত্তায় ঘাটতির ফলে খাল-নালায় পড়ে প্রতিনিয়ত মারা যাচ্ছে মানুষ। খাল ও নালার বহু জায়গায় কোনো বেষ্টনী প্রাচীর নেই। মাঝে মধ্যে নালার স্ল্যাবও ভেঙে গেছে। ২০২১ সালের ২৭ সেপ্টেম্বর রাতে চক্ষু চিকিৎসকের কাছে গিয়েছিলেন আন্তর্জাতিক ইসলামী বিশ্ববিদ্যালয় চট্টগ্রামের (আইআইইউসি) ছাত্রী শেহেরীন মাহমুদ সাদিয়া (১৯)। সাথে ছিলেন মামা জাকির হোসেন ও নানা হাজী জামাল। এরপর মামা-নানার সাথে বাসায় ফিরছিলেন সাদিয়া। কিন্তু ফুটপাথ থেকে পিছলে নালায় পড়ে যান। রাত ৩টায় নালা থেকে তার লাশ উদ্ধার করেন ফায়ার সার্ভিসের কর্মীরা। কিন্তু ফুটপাথের সাথে নালা যুক্ত হলেও সেখানে ছিল না কোনো ধরনের নিরাপত্তাবেষ্টনী। অপর দিকে, মোটরসাইকেলে করে স্বামীর সাথে বাড়ি ফেরার সময় সড়কের গর্তের কারণে ছিটকে পড়ে মৃত্যু হয় কলেজছাত্রীর।

২০২১ সালের ২৫ আগস্ট বৃষ্টির সময় বাস থেকে নেমে পানিমগ্ন ফুটপাথ দিয়ে হাঁটতে গিয়ে পা পিছলে পাশের খালে পড়ে যান এক যাত্রী। সবার সামনে মুহূর্তে মুরাদপুরে চশমা খালে তলিয়ে যান। তাকে উদ্ধার করা সম্ভব হয়নি। এর আগে গত বছর ৩০ জুন জলাবদ্ধতার সময় নগরের মেয়রগলি এলাকায় চশমা খালে পড়ে যায় একটি সিএনজিচালিত অটোরিকশা। এতে অটোরিকশাচালক মো: সুলতান (৩৪) ও যাত্রী খাদিজা বেগমের (৬৫) মৃত্যু হয়। হঠাৎ পা পিছলে ৬ ডিসেম্বর বিকেলে চিটাগং শপিং কমপ্লেক্স এলাকায় চশমা খালে বন্ধু রাকিবের সাথে বোতল কুড়াতে নেমে মো: কামাল উদ্দিন (১২) নামে এক শিশু নিখোঁজ হয়। তলিয়ে যাওয়ার তিন দিন পর ৯ ডিসেম্বর নগরের মোহাম্মদপুর এলাকায় মির্জাখালে কামালের লাশ পাওয়া যায়। নগরের ষোলশহর এলাকায় পাহাড়ধসে বাবা-মেয়ের মৃত্যু হয়েছে। পাহাড়ে ঝুঁকিপূর্ণ বসতি বেড়েছে ১০ গুণ। চট্টগ্রাম সিটি করপোরেশন ও চট্টগ্রাম উন্নয়ন কর্তৃপক্ষ- কেউ এর দায় নেয়নি। এসব মৃত্যুর জন্য উল্টো পরস্পরকে দায়ী করে আসছে সংস্থা দু’টি। সংস্থা দু’টির ভূমিকায় চট্টগ্রামের বাসিন্দাদের মধ্যে তীব্র ক্ষোভ সৃষ্টি হয়েছে। সরকারি এক তদন্ত প্রতিবেদনে নগরের উন্মুক্ত নালা-খালে পড়ে মৃত্যুর ঘটনায় চট্টগ্রাম সিটি করপোরেশন ও চট্টগ্রাম উন্নয়ন কর্তৃপক্ষের গাফিলতিকে দায়ী করা হয়েছে। কিভাবে বন্ধ হবে মৃত্যুর এই মিছিল।

চট্টগ্রাম নগরের জলাবদ্ধতা সাধারণ মানুষের দুর্ভোগের কারণ। এতে মানুষ বিক্ষুব্ধ হয়ে উঠছে। সংস্থা দুটোর মধ্যে সমন্বয়হীনতার অবসান ঘটাতে হবে। বিশেষজ্ঞরা চট্টগ্রামের জলাবদ্ধতা নিরসনে পাহাড় কাটা বন্ধ, খাল খনন, নালা-নর্দমা পরিষ্কার, জলাধার পুনরুদ্ধার ও নির্মাণ, বর্জ্য ব্যবস্থাপনায় গুরুত্ব দেয়ার পরামর্শ দিয়েছেন। অবশ্য, দ্রুত নিরাপত্তাবেষ্টনী গড়ে তুলতে না পারলে আরো মানুষের মৃত্যু হতে পারে।

লেখক : কলামিস্ট ও গবেষক
drkhalid09@gmail.com


আরো সংবাদ



premium cement