২৯ এপ্রিল ২০২৪, ১৬ বৈশাখ ১৪৩১, ১৯ শাওয়াল ১৪৪৫
`


বীর মুক্তিযোদ্ধা এয়ার ভাইস মার্শাল (অব:) সুলতান মাহমুদ

এয়ার ভাইস মার্শাল (অব:) সুলতান মাহমুদ - ফাইল ছবি

মহান স্বাধীনতাযুদ্ধে জীবন বাজি রেখে যারা আমাদের জন্য স্বাধীন বাংলাদেশ উপহার দিয়েছিলেন তাদেরই অন্যতম বীর মুক্তিযোদ্ধা এয়ার ভাইস মার্শাল (অব:) সুলতান মাহমুদ ইহধামের মায়া ত্যাগ করে মহান সৃষ্টিকর্তা আল্লাহ রাব্বুল আলামিনের কাছে ফিরে গেলেন ১৪ আগস্ট ২০২৩। স্বাধীনতাযুদ্ধের অকুতোভয় এ বীর সেনানী ছিলেন স্থল ও আকাশযুদ্ধের অসাধারণ এক কমান্ডার। তিনি ছিলেন অত্যন্ত খোদাভীরু ও অসাধারণ ধর্মপ্রাণ ব্যক্তিত্ব ইসলামী জীবন বিধানের একনিষ্ঠ অনুসারী।

১৯৪৪ সালে ফেনী জেলার ছাগলনাইয়া উপজেলার নিজকুনজরা মজলিস বাড়িতে (নানাবাড়ি) জন্মগ্রহণ করেন সুলতান মাহমুদ। পৈতৃক বাড়ি ফেনীর দাগনভূঁইয়া উপজেলায়। তার বাবার নাম নূরুল হুদা এবং মায়ের নাম আঙ্কুরের নেছা। শিশুকালে তিনি নানার বাড়ি নিজকুনজরা গ্রামের বিখ্যাত মজলিস বাড়িতে বড় হয়েছেন। শৈশবে তার নাম ছিল জামাল। একই গ্রামের নিজকুনজরা সরকারি প্রথমিক বিদ্যালয়ে প্রাথমিক শিক্ষা লাভ করেন। স্ত্রীর নাম ফেরদৌস আরা মাহমুদ। তাদের এক মেয়ে ও এক ছেলে। তাদের তিন ভাইয়ের মধ্যে অন্য দু’জন কামাল মাহমুদ এবং জহির উদ্দিন মাহমুদ মামুন। মামুন বাংলাদেশের একটি শিল্প গ্রুপ ইমপ্রেস-এর প্রধান। স্বাধীনতাযুদ্ধে সাহসিকতার সাথে যুদ্ধ করার জন্য বাংলাদেশ সরকার তাকে ‘বীর উত্তম’ খেতাব দেয়। স্বাধীনতা ও মুক্তিযুদ্ধে বিশেষ অবদানের জন্য ২০১৮ সালে তিনি ‘স্বাধীনতা পদক’ লাভ করেন।

পাকিস্তান বিমানবাহিনীতে যোগদান : সুলতান মাহমুদ ১৯৬২ সালের ১ জুলাই বিমানবাহিনীর জিডি পাইলট হিসেবে সে সময়ের পাকিস্তান এয়ারফোর্স অ্যাকাডেমি থেকে কমিশন লাভ করেন। তার নম্বর ছিল ২৬৭ঋ। ১৯৭১ সালে সুলতান মাহমুদ পাকিস্তানি বিমানবাহিনীর মৌরীপুর বিমানঘাঁটিতে কর্মরত ছিলেন। এর অবস্থান ছিল করাচিতে। তখন তার পদবি ছিল ফ্লাইট লেফটেন্যান্ট। মুক্তিযুদ্ধে যোগ দিতে মে মাসে সেখান থেকে পালিয়ে শ্রীলঙ্কা হয়ে ঢাকায় আসেন তিনি। ঢাকা থেকে ভারতে যাওয়ার পথে পাকিস্তানি সেনাবাহিনী তাকে আটকের চেষ্টায় তাড়া করে। এ অবস্থায় দাউদকান্দি ফেরিঘাটের কাছে তিনি সাঁতরে মেঘনা নদী পার হন। অনেক বাধাবিপত্তি পেরিয়ে শেষ পর্যন্ত ভারতে পৌঁছাতে সক্ষম হন।

মুক্তিযুদ্ধে অসাধারণ অবদান : ভারতে তখন সমবেত হয়েছেন পাকিস্তানি বিমানবাহিনীর আরো কয়েকজন বাঙালি। তারা মুক্তিযুদ্ধের সর্বাধিনায়ক আতাউল গণি ওসমানীর কাছে অনুরোধ করেন, মুক্তিবাহিনীর জন্য বিমান উইং গঠনের। কিন্তু বাস্তবে তা তখন করা সম্ভব ছিল না। এ অবস্থায় সুলতান মাহমুদ বসে থাকলেন না। যোগ দেন স্থল যোদ্ধাদের সাথে। তিনি প্রথমে যুদ্ধ করেন ২ নম্বর সেক্টরে। পরে ১ নম্বর সেক্টরে। তিনি দুই নম্বর সেক্টর ও পরে সেক্টর একের কমান্ডিং অফিসার হিসেবে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করেন সেই সময়ের স্কোয়াড্রন লিডার সুলতান মাহমুদ। বেশ কয়েকটি অপারেশনে তিনি সাহসিকতার সাথে অংশ নেন। এর মধ্যে চট্টগ্রামের মদুনাঘাট বিদ্যুৎ সাব-স্টেশন ধ্বংসের অপারেশন উল্লেখযোগ্য। মদুনাঘাট বিদ্যুৎ স্টেশনটির অবস্থান চট্টগ্রাম কাপ্তাই সড়কের হালদা নদীর পশ্চিম পাশে। সেখানে ছিল পাকিস্তানি সেনাবাহিনীর একটি দল। সাব-স্টেশনের চার দিকের বাংকারে ছিল তাদের অবস্থান। অক্টোবর মাসের শেষে এক দিন সুলতান মাহমুদের নেতৃত্বে একদল মুক্তিযোদ্ধা সেখানে অতর্কিতে আক্রমণ করে। তাদের আক্রমণে সাব-স্টেশনটি ধ্বংস হয়। কিন্তু পাকিস্তানি সেনাবাহিনীর পাল্টা আক্রমণে সুলতান মাহমুদ আহত ও তার এক সহযোদ্ধা শহীদ হন। সেদিন তিনি যথেষ্ট রণকৌশল ও বীরত্ব প্রদর্শন করেন। এরপর তিনি আর স্থলযুদ্ধে অংশ নিতে পারেননি।

কিলো ফ্লাইটের নেতৃত্ব : একাত্তরের ২৮ সেপ্টেম্বর ভারতের নাগাল্যান্ডের ডিমাপুরের একটি পরিত্যক্ত বিমানঘাঁটিতে গঠন করা হয় বাংলাদেশ বিমানবাহিনীর প্রথম কিলো ফ্লাইট। তার উদ্ভাবনী ধারণা ও উদ্দীপনা কিলোবাহিনী প্রতিষ্ঠায় অনুপ্রাণিত করে। সুলতান এই গেরিলা বিমানবাহিনীর অধিনায়ক ছিলেন। বেসামরিক বিমানে অস্ত্রের শুঁটি তৈরি করে তারা ৫০টির ওপরে উড়েছিল। ১০ জন পাইলট, ৬৭ জন টেকনিশিয়ান, একটি এলয়েড থ্রি হেলিকপ্টার, একটি অটার ও একটি ডিসি থ্রি ডকোডা উড়োজাহাজ নিয়ে যার যাত্রা শুরু, প্রশিক্ষণ চলে দুই মাস। কিলোফ্লাইটের নেতৃত্ব দিয়েছিলেন সুলতান মাহমুদ। ১৯৭১ সালের ৩ ডিসেম্বর প্রথম অভিযানে ভারতের কৈলাসটিলা বিমানঘাঁটি থেকে মাঝরাতে অত্যন্ত সাহসিকতার সাথে বাংলার আকাশসীমায় প্রবেশ করে সফল অভিযান পরিচালনা করেন কিলোফ্লাইটের সদস্যরা। নারায়ণগঞ্জের গোদনাইল তেলের ডিপোতে সফল আঘাত হানে স্কোয়াড্রন লিডার সুলতান মাহমুদ ও ফ্লাইট লেফটেন্যান্ট বদরুল আলমের নেতৃত্বে একটি এলয়েড হেলিকপ্টার।

১৯৭১ সালের ৩ ডিসেম্বর মুক্তিবাহিনীর বিমান উইংয়ের মাধ্যমে প্রথম যে আক্রমণ পরিচালনা করা হয়, এর একটির দায়িত্ব ছিল তার ওপর। তার নেতৃত্বে পরিচালিত হয় গোদনাইল অপারেশন। এ অপারেশনে তার সহযোদ্ধা ছিলেন বদরুল আলম। তারা একটি অ্যালুয়েট হেলিকপ্টারের সাহায্যে নারায়ণগঞ্জের গোদনাইল তেলের ডিপোতে আক্রমণ চালান। ভারতের কৈলাসটিলা বিমানঘাঁটি থেকে পূর্বনির্ধারিত সময়ের মধ্যেই তারা গোদনাইলে পৌঁছাতে সক্ষম হন। নির্ধারিত দূরত্বে পৌঁছেই শুরু করেন আক্রমণ। সেদিন তারা হেলিকপ্টার থেকে ১৪টি রকেট নিক্ষেপ করে ইএসএসওর দু’টি তেলের ডিপো সম্পূর্ণভাবে ধ্বংস করে দেন। আরো কয়েকটি আংশিক ক্ষতিগ্রস্ত হয়। সুলতান মাহমুদ পরে সিলেট, কুলাউড়া, কুমিল্লা, ভৈরব, শমশেরনগরসহ আরো কয়েক স্থানে হেলিকপ্টারের সাহায্যে আক্রমণে অংশ নেন। মুক্তিযুদ্ধের শেষ পর্যায়ে তিনি ও সাহাবউদ্দিন আহমেদ, বীর উত্তম এক দিন হেলিকপ্টারে সিলেট শহরের অবস্থা পর্যবেক্ষণ করছিলেন। বিমানবন্দরে অবতরণ করা মাত্র তারা পাকিস্তানি সেনাবাহিনীর আক্রমণের মুখে পড়েন। হেলিকপ্টারে কয়েকটি গুলি লাগে। সুলতান মাহমুদ অত্যন্ত সাহসিকতার সাথে হেলিকপ্টারটি নিয়ে পাকিস্তানি সেনাদের কবল থেকে বেরিয়ে যান।

বিমানবাহিনী প্রধান : বাংলাদেশ বিমানবাহিনীকে সুসংগঠিত ও শক্তিশালী বাহিনী হিসেবে গড়ে তোলার ক্ষেত্রে তার অসামান্য অবদান আছে। সুলতান মাহমুদ স্বাধীনতার পর ধাপে ধাপে এয়ার ভাইস মার্শাল পদে উন্নীত হন। বাংলাদেশ বিমানবাহিনীর প্রধান হিসেবে ২৩ জুলাই ১৯৮১ থেকে ২২ জুলাই ১৯৮৭ পর্যন্ত দায়িত্ব পালন করেন।

ইন্তেকাল : ১৪ আগস্ট সোমবার রাত ৮টা ৪০ মিনিটে রাজধানীর একটি হাসপাতালে এ ধর্মপ্রাণ ইন্তেকাল করেন। তার মৃত্যুতে শোক জানিয়েছেন রাষ্ট্রপতি মো: সাহাবুদ্দিন এবং প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা।

গত ১৭ আগস্ট বৃহস্পতিবার এ বীর মুক্তিযোদ্ধা, বিমানবাহিনীর সাবেক প্রধান এয়ার ভাইস মার্শাল সুলতান মাহমুদ, বীর উত্তমের নামাজে জানাজা অনুষ্ঠিত হয়। ওই দিন জোহরের নামাজের পর গুলশান আজাদ মসজিদে তার প্রথম নামাজে জানাজা অনুষ্ঠিত হয়। এরপর তার প্রতি রাষ্ট্রীয় সম্মান জানানো হয় বেলা ৩টার পর বিএএফ বাশার বেইজ প্যারেড গ্রাউন্ডে। সেখানেই হয় দ্বিতীয় জানাজা। এরপর তাকে বিমানবাহিনীর বিএএফ শাহীন কবরস্থানে দাফন করা হয়।

বাংলাদেশ যত দিন এ পৃথিবীর বুকে টিকে থাকবে, দেশের মানুষ এ বীর মুক্তিযোদ্ধা ও আল্লাহ ভীরু এ ব্যক্তিত্বকে স্মরণ ও দোয়া করবেন। মহান আল্লাহ সুবাহানু ওয়া তায়ালার কাছে তার রূহের মাগফিরাত কামনা করছি।

পরিকল্পনামন্ত্রী এম এ মান্নানের স্মৃতিচারণ : সুলতান মাহমুদ ও আমি একই স্কুলে (সারগোদা) পড়াশোনা করেছি, তাকে স্মরণ করে স্মৃতিচারণ করলেন পরিকল্পনামন্ত্রী এম এ মান্নান। গত ১৫ আগস্ট মন্ত্রী বীর মুক্তিযোদ্ধা ও সাবেক মন্ত্রী, বিমানবাহিনীর সাবেক প্রধান বীর উত্তম এয়ার ভাইস মার্শাল সুলতান মাহমুদের মৃত্যুতে গভীর শোক ও দুঃখ প্রকাশ করেন। এম এ মান্নান তার হাইস্কুল জীবনের কথা স্মৃতিচারণ করে বলেন, সুলতান মাহমুদ ও তিনি একই স্কুলে পড়াশোনা করেছেন।

সুলতান মাহমুদ তার জ্যেষ্ঠ সহপাঠী ও বন্ধু ছিলেন। ছাত্রজীবনে তিনি অমায়িক ব্যবহার করতেন ও অত্যন্ত বন্ধুবৎসল ছিলেন। বাংলাদেশের স্বাধীনতা সংগ্রামে অংশগ্রহণ করে তিনি বীরত্বপূর্ণ অবদান রাখেন এবং বাংলাদেশের দ্বিতীয় সর্বোচ্চ সামরিক উপাধি বীর উত্তম খেতাব এবং পরে মর্যাদাপূর্ণ স্বাধীনতা পদকে ভূষিত হন। দেশাত্মবোধ ও সাহসিকতাপূর্ণ কাজে সুলতান মাহমুদের অবদানের কথা বাঙালি জাতি চিরদিন স্মরণ রাখবে। মন্ত্রী মরহুমের রূহের মাগফিরাত কামনা করেন এবং তার শোকাহত পরিবারের প্রতি গভীর সমবেদনা জানান।

Email: hoque2515@gmail.com


আরো সংবাদ



premium cement