২৯ এপ্রিল ২০২৪, ১৬ বৈশাখ ১৪৩১, ১৯ শাওয়াল ১৪৪৫
`


বাংলাদেশের পত্রিকায় ভারত প্রতিনিধির প্রভাব

বাংলাদেশের পত্রিকায় ভারত প্রতিনিধির প্রভাব। - ছবি : সংগৃহীত

চীন-ভারত আন্তর্জাতিক সম্পর্কের একটি বড় সংবাদ। ভারতের তুলনায় পাকিস্তান অর্থনৈতিক শক্তিতে পিছিয়ে পড়লেও এখনো এই দেশ দুটির সম্পর্কও খবরে গুরুত্ব রাখে। বাংলাদেশের একটি পত্রিকা দেশগুলোর আন্তঃসম্পর্কের খবর তাদের দিল্লি প্রতিনিধির বরাতে প্রচার করে দেয়। সংবাদ উপস্থাপনার চেয়ে খবরে ভারতপ্রীতি প্রতিফলিত হয়। একজন সাংবাদিকের মানবিক দুর্বলতা স্বাভাবিক। তিনি দেশপ্রেম দ্বারা উদ্বুদ্ধ হতে পারেন। ধর্মীয় আবেগও তার ওপর ভর করতে পারে। পত্রিকাটির দিল্লি প্রতিনিধি প্রতিবেদন লেখার ক্ষেত্রে এসবের উপরে উঠে পেশাদারিত্ব দেখাতে পারেন না। অন্যদিকে বাংলাদেশের পত্রিকাটি কোনো বাছ বিচার ছাড়া হুবহু তার পাঠানো খবর ছাপিয়ে দিচ্ছে।

খবরে যখন দুটো পক্ষ থাকে তখন উভয়ের মতামত দরকার হয়। এই সাংবাদিকেরা চীন ও পাকিস্তানের সংশ্লিষ্ট অংশের মতামত নেয়ার প্রয়োজন মনে করেন না। পত্রিকাটির কলকাতায়ও প্রতিনিধি রয়েছে। অথচ অন্যতম সুপার পাওয়ার চীন ও পাকিস্তানে তাদের কোনো প্রতিনিধি নেই। প্রতিদিন এই তিন দেশের খবর তারা তাদের ভারত প্রতিনিধির বরাতে ছাপিয়ে দিচ্ছে। আরএসএস, বজরংসহ উগ্র সাম্প্রদায়িক শক্তিগুলোর প্রতিনিধি নরেন্দ্র মোদি। সীমান্ত বিরোধে তিনি প্রায় জোশ নিয়ে বক্তব্য দেন। এসবের মধ্যে সারবত্তার চেয়ে হিন্দু উত্থানের আবেগ থাকে। এ ধরনের ধর্মীয় আবেগের স্থান নেই বাংলাদেশে। এ দেশের মানুষ অখণ্ড ভারতের চিন্তার সাথে একমত পোষণ করেন না, যে কারণে ভারত থেকে পাকিস্তান হয়ে বাংলাদেশের সৃষ্টি হয়েছে। এই পত্রিকাসহ বাংলাদেশের গণমাধ্যমের বড় একটা অংশ তাদের ভারত প্রতিনিধির পাঠানো মোদির জোশ হুবহু সংবাদ আকারে ছাপিয়ে দিচ্ছে।

এসব খবরের বেশির ভাগই বৈশ্বিক সংবাদমাধ্যম প্রচার করে। সবপক্ষের স্বার্থ প্রতিফলিত হয় ওইসব খবরে। তারা পাকিস্তান ও চীনের সংশ্লিষ্ট সূত্রের উপযুক্ত মর্যাদাসহ এসব খবর পরিবেশন করে। প্রতিষ্ঠিত আন্তর্জাতিক সংবাদমাধ্যমকে এড়িয়ে এভাবে একপেশে খবর প্রচার করে দেয়া কোনোভাবে পত্রিকাটি নিজের প্রতি সুবিচার করে না। কিছু ক্ষেত্রে ভারত প্রতিনিধির বরাতে পত্রিকাটি এমন খবর ছাপে যা বাংলাদেশের জনগণের স্বার্থের পরিপন্থী। সম্প্রতি মোদির আমেরিকা সফর নিয়ে তাদের দিল্লি প্রতিনিধির খবর বড় করে ছাপিয়েছে। অথচ এই সাংবাদিক মোদির সফরসঙ্গী ছিলেন না। মোদির সফর নিয়ে আন্তর্জাতিক গণমাধ্যমে খবর ছিল।

বাংলাদেশে গণতন্ত্র ও মানবাধিকারের সঙ্কট চলছে। মানুষ ভোটাধিকার হারিয়েছে, গুম ও বিনা বিচারে হত্যা থেকে রেহাই পাচ্ছে না মানুষ। এই অবস্থায় যুক্তরাষ্ট্র সাধারণ মানুষের অধিকার অর্জনের পক্ষে দাঁড়িয়েছে। তাদের নানামুখী উদ্যোগের কারণে এখন পর্যন্ত ভোটাধিকার উদ্ধার না হলেও মানবাধিকার প্রতিষ্ঠায় বেশ অগ্রগতি হয়েছে। দেশটির প্রণীত ভিসানীতি এ দেশের রাজনৈতিক অঙ্গনে বিরোধীদের জন্য স্পেস তৈরি করেছে। আশা করা যাচ্ছে, দেশের গণতান্ত্রিক ব্যবস্থা অচিরে উন্মুক্ত হতে যাচ্ছে। ঠিক এই সময় দেখা গেল, পত্রিকাটির দিল্লি প্রতিনিধির বরাতে একটি রিপোর্ট করা হলো, তাতে বাংলাদেশের জনগণের স্বার্থহানিকর এমন উপাদান রয়েছে।

সেই ঢাউস প্রতিবেদনের মূল কথা হচ্ছে, বাংলাদেশে গণতন্ত্রের স্বার্থে যুক্তরাষ্ট্রের নেয়া পদক্ষেপ অকার্যকর করে দেবে ভারত। মোদির আসন্ন আমেরিকা সফরে এ লক্ষ্যে গুরুত্বপূর্ণ কর্মতৎপরতা নিচ্ছে দেশটি। এরই মধ্যে মোদির যুক্তরাষ্ট্র সফর শেষ হয়েছে। সবাই জেনে গেছেন ভারত যুক্তরাষ্ট্রের সাথে আলোচনায় নিজেদের স্বার্থের বাইরে বাংলাদেশের আওয়ামী লীগ সরকারের পক্ষে কোনো ধরনের দরকষাকষি করেনি। ওই বৈঠকে ভারতের পক্ষ থেকে পাকিস্তান এবং আমেরিকার পক্ষ থেকে মিয়ানমার নিয়ে উদ্বেগ দেখানো হয়েছে।

বাংলাদেশ নিয়ে গোপনে মোদি বাইডেনের কাছে কোনো আব্দার করেছেন তারও ইঙ্গিত কোথা থেকে মিলেনি। মোট কথা এটা প্রমাণিত, এই দ্বিপক্ষীয় আলোচনায় হাসিনা সরকার স্থান পায়নি। পত্রিকাটি এবং তার নয়াদিল্লি প্রতিনিধি যে প্রতিবেদন রচনা করেছেন তা একটা প্রপাগান্ডা ছিল, তা তার দুই সপ্তাহ পর পত্রিকাটির আরেকটি প্রতিবেদন প্রমাণ করেছে। তাতে ওই প্রতিনিধি জানাচ্ছেন প্রতিবেশী রাজনীতিতে ভারত কম জড়াচ্ছে। আবার বলা হচ্ছে, ভারত প্রতিবেশী দেশের সব রাজনৈতিক দলের সাথে মিলে কাজ করবে। অথচ এই প্রতিনিধি আগের প্রতিবেদনে ১৮ জুন কী লিখেছিলেন তা আমরা একটু পর্যালোচনা করে দেখি।

ওইদিন ‘মোদির আলোচনায় থাকছে বাংলাদেশ’ শিরোনামে দিনের প্রধান সংবাদ করে পত্রিকাটি। চার কলাম এ সংবাদের পাশাপাশি আরো চারটি সাইড স্টোরি জুড়ে দেয়া হয় তার সাথে। সবমিলে পাতার অর্ধেকজুড়ে এসব সংবাদ। এগুলোর মূল সুর হচ্ছে, ভিসা নীতিসহ যুক্তরাষ্ট্র সরকার গণতন্ত্র উদ্ধারে যেসব পদক্ষেপ নিচ্ছে সেগুলো সামনে অকার্যকর হয়ে যাবে। এই প্রতিবেদনের লক্ষ্য এ প্রপাগান্ডা ছড়িয়ে দেয় ভারতীয় পৃষ্ঠপোষকতায় সরকার আবারো সুযোগ পাবে ক্ষমতায় থেকে যাওয়ার।

দিল্লি প্রতিনিধি লিখেছেন, প্রধানমন্ত্রী মোদি যুক্তরাষ্ট্রকে বোঝাবেন আঞ্চলিক স্বার্থে হাসিনার ক্ষমতাসীন থাকার অর্থ কী। তার ক্ষমতাসীন থাকা না-থাকার ওপর আঞ্চলিক বিচ্ছিন্নতাবাদী ও ধর্মীয় মৌলবাদী শক্তির মাথাচাড়া দেয়া না-দেয়ার প্রশ্নটা যে গভীর সম্পর্কযুক্ত, সে কথা বাইডেনকে মোদি জানাবেন।’ তিনি আরো লিখেছেন, ‘যুক্তরাষ্ট্রকে ভারত বোঝাবে, আঞ্চলিক সুস্থিতি নষ্ট হয় এমন কিছুর জন্য বাংলাদেশকে জোরাজুরি করাটা ঠিক হবে না।’ এগুলো মোদির মনের কথা। তিনি সঙ্গোপনে ঠিক করে রেখেছেন বাইডেনকে একান্তে বলবেন। মনের এ কথা সর্বোচ্চ মোদির সভাসদ জানতে পারেন। বাইরের কেউ জানার কথা নয়। পত্রিকাটির দিল্লি প্রতিনিধি এই অগ্রিম ভাষ্য কোথায় থেকে সংগ্রহ করলেন তার কোনো সূত্রের উল্লেখ নেই। প্রতিবেদনে তিনি আরো দাবি করেছেন, বাংলাদেশকে (হাসিনাকে) এই বিষয়ে আশ্বস্ত করা হয়েছে যে, আসন্ন সফরে এ নিয়ে প্রেসিডেন্ট বাইডেনের সাথে মোদি অবশ্যই মতবিনিময় করবেন।

প্রতিবেদনে উভয় দেশের ক‚টনৈতিক সূত্র, সরকারের বিভিন্ন পর্যায়ের দায়িত্বশীল কর্মকর্তাকে সাংবাদিক তার খবরের উৎস দাবি করেছেন। তবে একটি সুনির্দিষ্ট তথ্যসূত্রও উল্লেখ করতে পারেননি। প্রতিবেদনের এক জায়গায় স্বীকার করে নেয়া হয়েছে, আগের দু’টি নির্বাচন ঠিক হয়নি। এমনকি আমেরিকার চাপানো নিষেধাজ্ঞা ও ভিসানীতি একটি অবাধ সুষ্ঠু নিরপেক্ষ ও অংশগ্রহণমূলক নির্বাচন অনুষ্ঠানের লক্ষ্যে দেয়া হয়েছে তা-ও বলা হয়েছে। কিন্তু তার মন্তব্যধর্মী এ বিশাল প্রতিবেদনে বারবার খোঁড়া যুক্তি দাঁড় করানোর চেষ্টা করেছেন, ভারত সরকার এমন একটা কিছু করতে যাচ্ছে গণতন্ত্র পুনঃপ্রতিষ্ঠায় আমেরিকান উদ্যোগ কাজ করবে না। ন্যূনতম পক্ষে এ রাস্তা থেকে যুক্তরাষ্ট্র সরে আসবে।

পুরো প্রতিবেদনকে একটি গোয়েবলসীয় ধ্রুপদী প্রপাগান্ডা ছাড়া অন্য কিছু বলার উপায় নেই । একই প্রতিবেদকের ২ জুলাই পরিবেশিত পত্রিকাটির আরেকটি প্রতিবেদন সেটা প্রমাণ করে। মোদি সরকারের ৯ বছর পূর্তি উপলক্ষে, দেশটির পররাষ্ট্রমন্ত্রী এস জয়শঙ্করের বক্তব্য তিনি সংবাদ করে পাঠিয়েছেন। পত্রিকাটি এই খবরও অত্যন্ত গুরুত্ব দিয়ে প্রথম পাতায় ছেপেছে। শঙ্কর তাতে মন্তব্য করেছেন, ‘প্রতিবেশী দেশগুলোর সব রাজনৈতিক দল ও সব সরকারের সঙ্গে একভাবে কাজ করার ক্ষমতা ও দক্ষতা আজকের ভারত আয়ত্ত করেছে।’ বাংলাদেশের সরকার ও বিরোধীদের সাথে সমান সম্পর্ক ভারত বজায় রাখেনি। তাই শঙ্করের কথাটি বাংলাদেশের ক্ষেত্রে ভুল। তবে বাংলাদেশের জন্য স্পষ্টত বার্তা হচ্ছে তারা আর কেবল একটি দলের সাথে একতরফা সম্পর্ক রেখে সব ডিম এক ঝুড়িতে রাখার ঝুঁকি নেবে না।

একই কারণে পত্রিকাটিতে ১৮ জুন প্রকাশিত দিল্লি প্রতিনিধির প্রতিবেদনটির সংবাদমূল্য নেই। এটিতে সংবাদের কোনো উপাদানও নেই। এ ধরনের কল্পকাহিনী রচনার ভিন্ন উদ্দেশ্য ছিল। সাধারণত রাজনৈতিক দলগুলো পরিস্থিতি ভিন্ন খাতে প্রবাহিত করতে এমন ভিত্তিহীন মনগড়া প্রচারণা চালায়। তাদের অস্তিত্বের প্রয়োজনে। একজন সাংবাদিক ও একটি নিরপেক্ষ জাতীয় পত্রিকা এমন কাজ করবে কেন? বিশেষ করে পত্রিকাটি বাংলাদেশের যখন এক নাম্বার অবস্থানে রয়েছে। ধরে নিলাম, দিল্লি প্রতিনিধির মোটিভ তারা বোঝেনি কিন্তু এ ধরনের একটি বিশাল প্রতিবেদনের জন্য কেন এত বড় স্পেস ব্যবহার করবে? এটি একটি আশঙ্কার ব্যাপার।

বাংলাদেশের সংবাদমাধ্যম ও সাংবাদিকদের বিরুদ্ধে নাগরিকদের অভিযোগের অন্ত নেই। দেশ ও জনগণের স্বার্থে তারা সাংবাদিকতা করেন না। বিচ্ছিন্ন কিছু ব্যক্তি সাংবাদিকতাকে কেবল তাদের নিজেদের স্বার্থসিদ্ধিতে ব্যবহার করেন। এ সরকারের আমলে দেশে যে বিপুল দুর্বৃত্ত সম্প্রদায় গড়ে উঠেছে তার একটা অংশ সাংবাদিক শ্রেণী। অন্যদিকে সংবাদমাধ্যমের বড় অংশটি ভারতের বিষয়ে সংবাদ প্রচারে সেন্সরশিপ আরোপ করে রেখেছে। সরকার প্রতিবেশীর সাথে বহু চুক্তি করেছে। এমনকি সরকারপ্রধান নিজে বলেছেন, ভারতকে এতটা দিয়েছে, ভুলতে পারবে না। সংবাদমাধ্যমে এ নিয়ে বাংলাদেশের স্বার্থরক্ষায় কোনো সংবাদ দেখা যায় না। ট্রানজিট, ট্রানশিপমেন্ট, বন্দর, ইজারা সীমান্ত হত্যা নিয়ে আমাদের সংবাদমাধ্যম রিপোর্ট করতে শরম পায়। আবার জনগণের বিরুদ্ধে যায় কিন্তু ভারতের লাভ হয় এমন সংবাদ করতে বড়ই উৎসাহী।

jjshim146@yahoo.com


আরো সংবাদ



premium cement