২৭ এপ্রিল ২০২৪, ১৪ বৈশাখ ১৪৩১, ১৭ শাওয়াল ১৪৪৫
`

অর্থনীতিতে ডলারের মূল্য বৃদ্ধির প্রভাব

অর্থনীতিতে ডলারের মূল্য বৃদ্ধির প্রভাব। - ছবি : সংগৃহীত

কোনো দেশের পণ্য এবং সেবার চাহিদা ও জোগানের ভিত্তিতে যেমন ওই পণ্য ও সেবার দাম নির্ধারিত হয় তেমনি মুদ্রার চাহিদা সরবরাহের ভিত্তিতেও ওই মুদ্রার মান নির্ধারিত হয়। মুদ্রার এই মান নির্ধারণে সংশ্লিষ্ট দেশের কেন্দ্রীয় ব্যাংক বিভিন্ন মেয়াদে মুদ্রানীতি ঘোষণা করে থাকে। আন্তর্জাতিক মুদ্রা তহবিল (আইএমএফ) বিভিন্ন দেশের মুদ্রামানের হ্রাস-বৃদ্ধি পর্যবেক্ষণ করে। এর সাথে স্বপ্রতিষ্ঠিত আন্তর্জাতিক মুদ্রা, ডলারের মূল্যমানের কাজও যেন আইএমএফ করে থাকে। এ কথা সত্যি, যুক্তরাষ্ট্রের মুদ্রা ডলার অনেক বছর ধরে বিশ্ব অর্থনীতিকে নিয়ন্ত্রণ করছে। আন্তর্জাতিক ব্যাংকগুলোয় বৈদেশিক মুদ্রার ক্ষেত্রে মার্কিন ডলারের অংশ ৬৪ শতাংশের বেশি। ইউরো প্রায় ২০ শতাংশ। চীনের ইউয়ান, ইয়েন (৫.২ শতাংশ) এবং পাউন্ড স্টার্লিং (৪.৯ শতাংশ) শেয়ার লাভ করতে সক্ষম হয়েছে। ডলার যুক্তরাষ্ট্রের অর্থনীতির শক্তিকে প্রতিফলিত করে। ফলে বাণিজ্যের স্বার্থে বিশ্বের প্রায় সব দেশ বিভিন্ন সময়ে ডলারের বিপরীতে নিজেদের মুদ্রার অবমূল্যায়ন বা সমন্বয় করতে হয়। মুদ্রার অবমূল্যায়ন হলে মোটা দাগে আমদানি ব্যয় বেড়ে যায়; রফতানি আয় বৃদ্ধি পায়, রেমিট্যান্স প্রবাহ বৃদ্ধি পায়। ডলারের বিপরীতে দেশীয় মুদ্রার মান কমে গেলে অর্থনীতিতে তার কী প্রভাব পড়ে এ বিষয়ে বিস্তারিত আলোচনাই আজকের লেখার বিষয়বস্তু।

ডলারের মূল্য নির্ধারিত হয় যেভাবে
বাজারে পর্যাপ্ত পণ্য না থাকলে এর দাম যেমন বেড়ে যায়, একইভাবে যখন অর্থনীতিতে ডলারের সরবরাহ বেশি হয় তখন ডলারের দাম কমে যায়। আবার আন্তর্জাতিক বাজারে ডলারের চাহিদা বেড়ে গেলে ডলারের দামও বেড়ে যায়। অর্থাৎ পণ্যের মতোই ডলারের চাহিদা ও সরবরাহের ভারসাম্যের ভিত্তিতেই ডলারের দাম বাড়ে-কমে।

বাংলাদেশে ডলার ও টাকার বিনিময় হার স্বাধীনতার পর থেকে সরকার নির্ধারণ করে দিত। টাকাকে রূপান্তরযোগ্য ঘোষণা করা হয় ১৯৯৪ সালে। ২০০৩ সালে এই বিনিময় হারকে করা হয় ভাসমান ব্যবস্থা। তবে বিনিময় হার ভাসমান হলেও পুরোপুরি তা বাজারভিত্তিক থাকেনি। বাংলাদেশ ব্যাংক এ ব্যাপারে অনুসরণ করে আসছে ‘ম্যানেজড ফ্লোটিং রেট’ নীতি। ১৯৭১ সালে প্রতি এক ডলার সমান ছিল সাড়ে সাত থেকে আট টাকা। গত ২০২২ সালের ফেব্রুয়ারি মাসে ডলার ছিল ৮৬ টাকা; বর্তমানে বাংলাদেশ ব্যাংকের বিক্রির বাইরে আমদানিকারকদের জন্য ১০৪ টাকা ও রেমিটারদের জন্য ১০৭ টাকা দাম রয়েছে। খোলাবাজারে এক ডলারের দাম ১১৫ টাকা। এ ছাড়াও আইএমএফ ঋণের শর্ত অনুযায়ী ডলারের দাম বাজারের ওপর পুরোপুরি ছেড়ে দিতে হবে। সেই মাফিক কেন্দ্রীয় ব্যাংকের প্রচেষ্টা হলো, ‘জুনের মধ্যে যদি আমরা লক্ষ্যমাত্রা হারে পৌঁছাতে পারি, তাহলে আমরা একীভ‚ত বাজার হারের খুব কাছাকাছি থাকব।’ তাতে ডলারের দাম কোথায় পৌঁছাবে তা তখনই বলা যাবে।

ডলারের বিপরীতে মুদ্রার অবমূল্যায়নের প্রভাব
মুদ্রার অবমূল্যায়ন নেতিবাচক না ইতিবাচক, সেই সিদ্ধান্ত দেশ অনুযায়ী আপেক্ষিক। অর্থনীতির তত্ত্ব বলে, অবমূল্যায়ন হলে রফতানি বাড়ে। আর অতিমূল্যায়ন হলে রফতানি ক্ষতিগ্রস্ত হয়। কিন্তু বাস্তবে কী পরিমাণ এর লাভ-ক্ষতি, তা নিয়ে নানা মতভেদ আছে। এ বিষয়ে আইএমএফের এক গবেষণায় বলা হয়, একটি দেশের মুদ্রামানের ১০ শতাংশ অবমূল্যায়ন করা হলে দেশটির জিডিপির ১ দশমিক ৫ শতাংশ রফতানি বৃদ্ধি পায়। তাত্ত্বিকভাবে স্থানীয় মুদ্রার অবমূল্যায়ন হলে রফতানিকারক ও প্রবাসীরা লাভবান হন। কারণ ডলারের বিপরীতে আগের থেকে বেশি হারে টাকা পাওয়া যায়। আবার মুদ্রার অবমূল্যায়নের ফলে সামগ্রিক চাহিদা বৃদ্ধি পায়। কারণ রফতানি বৃদ্ধি পেলে এবং আমদানি কমলে সামগ্রিক চাহিদা বাড়ে। সাধারণ দৃষ্টিতে সামগ্রিক চাহিদা বৃদ্ধির প্রভাবে প্রকৃত জিডিপি ও মূল্যস্ফীতি বাড়ে। আমদানির চেয়ে রফতানি বেশি হওয়ায় দেশে মুদ্রা ঘাটতির পরিমাণও কমে।

অন্য দিকে মুদ্রার অবমূল্যায়ন আমদানি ব্যয় বাড়িয়ে দেয়। কারণ আমদানিকারকদের আগের থেকে বাড়তি অর্থ দিয়ে ডলার কিনতে হয়। এ ছাড়া কোনো দেশে স্থির মজুরি প্রবৃদ্ধি থাকলে অবমূল্যায়ন হলে প্রকৃত মজুরি কমে যায়। দেশের যেসব রফতানিকারক পণ্য উৎপাদনের জন্য কাঁচামাল আমদানি করেন, তারাও পড়েন বিপাকে। কারণ কাঁচামালের মূল্য বৃদ্ধি পাওয়ায় পণ্য উৎপাদনের ব্যয় বেড়ে যায়। আবার স্বল্পমেয়াদে মূল্যস্ফীতির আশঙ্কা থাকায় মানুষের প্রকৃত আয় কমে যায়।

করোনা অতিমারী ও রাশিয়া-ইউক্রেন যুদ্ধের ফলে ডলারের বাজার টালমাটাল। বিপরীতে বিভিন্ন দেশের মুদ্রার দরপতন হচ্ছে তার চেয়েও অধিক হারে। এই পতনের তালিকায় বাংলাদেশও রয়েছে। বিশ্বে এমন কিছু পণ্য রয়েছে যা কেবল ডলারেই কিনতে হয়। যেমন- অপরিশোধিত তেলসহ আন্তর্জাতিক বাণিজ্যের ৮৫ শতাংশ ক্ষেত্রে মার্কিন ডলার ব্যবহার করা হয়। বিশ্বব্যাপী প্রায় ৪০ শতাংশ ঋণ ডলারে অনুমোদিত হয়। অন্য দিকে বিশ্বের ১৮০টিরও বেশি দেশের মুদ্রার বেশির ভাগই কেবল নিজ নিজ দেশের মধ্যে ব্যবহৃত হয়, ফলে এর কোনো আন্তর্জাতিক মূল্য নেই।

ডলারসঙ্কটে বাংলাদেশের মূল্যস্ফীতিতে প্রভাব
বাংলাদেশ এখন বৈশ্বিক অর্থনীতির সাথে অতীতের যেকোনো সময়ের চেয়ে বেশি যুক্ত। ইউক্রেন-রাশিয়া যুদ্ধের ফলে বিশ্ববাজারে পণ্যের দাম বৃদ্ধির কারণে ব্যালেন্স অব পেমেন্টে ঘাটতি দেখা দিয়েছে। ডলারের দাম বেশি হলে সেসব দেশের আমদানি খরচ বাড়ে। অথচ সাধারণ মানুষ ডলারের দাম বৃদ্ধির আগে যে পরিমাণ উপার্জন করতেন এখনো তাই করছেন। ফলে মূল্যস্ফীতি হয় এবং বৈদেশিক মুদ্রার রিজার্ভ কমে যায়। আমদানি পণ্যের জন্য অতিরিক্ত ডলার খরচ করতে হয়; যার ফলে দাম বেড়ে যায়। কিন্তু যদি আমদানি পণ্যের দাম সর্বোচ্চ পর্যায়ে বাড়িয়ে দেয়া হয়, তাহলে দেশের প্রবৃদ্ধির ও কর্মসংস্থানের ওপর এর প্রভাব পড়বে। তাই একটি নিখুঁত ভারসাম্য অর্জন করতে হবে, যাতে অর্থনীতিতে এর নেতিবাচক প্রভাব না পড়ে। এ কারণে আমদানিনির্ভর দেশগুলোয় বিদেশী পণ্য ব্যয়বহুল হয়। ডলারের দাম বৃদ্ধি বা টাকার দরপতন বিদেশী শিক্ষা ও ভ্রমণকে আরো ব্যয়বহুল করে তোলে। টিউশন ফি ও ফ্লাইটের টিকিট ডলারে পরিশোধ করতে হয়। অতিরিক্ত অর্থ খরচ করতে হয়।

ডলারের মূল্য বাড়ায় রেমিট্যান্স প্রবাহ কমার বৈশ্বিক প্রবণতা দেখা দেয় অনেক সময়। কারণ ডলারের মূল্য হঠাৎ অনেক বেড়ে গেলে দেশের ব্যাংকিং চ্যানেলে ডলারের মূল্য এবং খোলাবাজারের ডলারের দামে বেশ পার্থক্য দেখা দেয়। ফলে প্রবাসীরা হুন্ডির মাধ্যমে ডলার পাঠাতে উৎসাহী হন যা বৈদেশিক মুদ্রা রিজার্ভকে আরো প্রভাবিত করে।

ডলারসঙ্কটে বাংলাদেশের বিদ্যুৎ-জ্বালানি খা
বাংলাদেশে বিদ্যুৎ ও জ্বালানি খাতে ডলারসঙ্কটের প্রভাব প্রকট হচ্ছে। জ্বালানি পণ্যের বকেয়া বিল পরিশোধে এ মুহূর্তে অন্তত ১০০ কোটি ডলার দরকার। পিডিবির কাছে বেসরকারি বিদ্যুৎ উৎপাদনকারী কোম্পানিগুলোর পাওনা অন্তত ১৫০ কোটি ডলার যা পরিশোধ করতে না পারায় জ্বালানি আমদানি করে চাহিদা অনুযায়ী, বিদ্যুৎ উৎপাদন হচ্ছে না। ডলারসঙ্কট দীর্ঘায়িত হলে ব্যাহত হতে পারে এলএনজি আমদানি। ডলার দিতে পারছে না বাংলাদেশ ব্যাংক, কারণ বিদ্যুৎ-জ্বালানির পাশাপাশি অতি প্রয়োজনীয় পণ্য- সার, খাদ্যসহ বিভিন্ন ক্ষেত্রে ডলার সহায়তা দিতে হচ্ছে। আবার দেশের বৈদেশিক মুদ্রার রিজার্ভ ধারাবাহিকভাবে কমে ৩০ বিলিয়নের নিচে নেমেছে।

বন্ধ কয়লা আমদানি : বিল বকেয়া থাকায় পায়রা বিদ্যুৎকেন্দ্রের কয়লা সরবরাহ বন্ধ করে দিয়েছে চীনা কোম্পানি। ফলে ৫ জুন পুরোপুরি বন্ধ হয়ে যায় এ কেন্দ্রটি। কয়লা আমদানি বাবদ পায়রার ২৯ কোটি ৮০ লাখ মার্কিন ডলার বকেয়া রয়েছে। এ দিকে কয়লা আমদানি করতে না পারায় গত ২৩ এপ্রিল থেকে প্রায় ২২ দিন বন্ধ ছিল রামপাল বিদ্যুৎকেন্দ্র। কেন্দ্রটি থেকে ৫০০-৬০০ মেগাওয়াট বিদ্যুৎ পাওয়া গেলেও এখন অর্ধেক বিদ্যুৎ পাওয়া যাচ্ছে। একই কারণে দুই মাস ধরে উৎপাদন বন্ধ ছিল বরিশাল ৩০৭ মেগাওয়াট কেন্দ্রটিতে।

সঙ্কটে গ্যাস : পেট্রোবাংলা এলএনজি আমদানির বিল, এলএনজি টার্মিনালের চার্জ এবং দেশে কর্মরত বহুজাতিক তেল-গ্যাস কোম্পানির (আইওসি) প্রায় ২৫ কোটি ডলার বিল দিতে পারছে না। কাতার থেকে ২০ কার্গো এলএনজি আমদানির বিল নির্ধারিত সময়ে পরিশোধ করতে পারেনি পেট্রোবাংলা। এ জন্য চার কোটি ৩১ লাখ টাকা জরিমানা দিতে হয়েছে। বিবিয়ানা ও জালালাবাদের বিক্রি করা গ্যাসের ১১টি বিল সময়মতো শোধ করতে পারেনি পেট্রোবাংলা। এ জন্য ২৪ লাখ ১২ হাজার ৯৯১ ডলার জরিমানা দাবি করেছে যুক্তরাষ্ট্রের শেভরন। বহুজাতিক কোম্পানি তাল্লোর গ্যাস ও কনডেনসেট বিক্রির দু’টি বিল এবং সামিটের এলএনজি প্রক্রিয়াকরণ ইউনিট (এফএসআরইউ) ভাড়ার বিল নির্ধারিত সময়ে দিতে পারেনি পেট্রোবাংলা। নির্ধারিত সময়ের মধ্যে আইওসির বিল দিতে ব্যর্থ হলে লাইবরের (লন্ডন ইন্টার ব্যাংক অফার রেট) সাথে ১ থেকে দেড় শতাংশ এবং এলএনজি বিল পরিশোধ করতে ব্যর্থ হলে ৪ থেকে ৫ শতাংশ হারে জরিমানা পরিশোধ করতে হবে।

জ্বালানি তেল আমদানিও সঙ্কটে : জ্বালানির মূল্য পরিশোধ করতে না পারায় কোম্পানিগুলো তেল পাঠাবে না বলেছে। প্রতি মাসে প্রায় পাঁচ লাখ টন পরিশোধিত এবং এক লাখ টন অপরিশোধিত জ্বালানি তেল আমদানি করতে হয়। গত ১১ মে পর্যন্ত সরবরাহকারী প্রতিষ্ঠানগুলোর পাওনা দাঁড়িয়েছে প্রায় ৩০ কোটি ডলার। বকেয়া পরিশোধ না করায় মে মাসে ৩০ হাজার টনের একটি ডিজেল কার্গো এ দেশ বাতিল করে ভিড়ল সিঙ্গাপুর। বকেয়া পরিশোধ না হলে জুন মাসে চারটি কার্গোতে ৯০ হাজার টন ডিজেল এবং ২৫ হাজার টন ফার্নেস অয়েল সরবরাহ করবে না প্রতিষ্ঠানটি। গত ১০ মে ইন্দোনেশিয়া তাদের পাওনা ১২ কোটি ২৫ লাখ ডলার পরিশোধ না করলে জুন মাসে ৬০ হাজার টন ডিজেল ও ২৫ হাজার টন ফার্নেস অয়েল সরবরাহ করবে না। জুন মাসে ইন্ডিয়ান অয়েল করপোরেশনের ৪৫ হাজার টন ডিজেল ও ১৫ হাজার টন বিমানের জ্বালানি জেট এ-১ সরবরাহের কথা থাকলেও বকেয়ার কারণে আমদানিসূচি চূড়ান্ত করেনি। ভারতের নুমালিগড় রিফাইনারিকে চার কোটি ১১ লাখ ডলার পরিশোধ করতে হবে এ বছর। ইন্ডিয়ান অয়েলকে ডিজেল ও জেট ফুয়েল বাবদ দিতে হবে ১৪ কোটি ৭২ লাখ ডলার। এ পরিস্থিতিতে রাষ্ট্রায়ত্ত ব্যাংকগুলো ভারতীয় কোম্পানিগুলোকে রুপিতে অর্থ পরিশোধ করার উদ্যোগ নেয়ার অনুরোধ জানিয়েছে বিপিসি।

ডলারসঙ্কট কেন কাটছে না
ডলারসঙ্কট কাটাতে তুলনামূলক কম প্রয়োজনীয় বা বিলাসবহুল পণ্যের এলসিতে শতভাগ পর্যন্ত মার্জিন নির্ধারণ ও শুল্কহার অনেক বাড়ানো হয়েছে। ওভার ইনভয়েসিং বা আন্ডার ইনভয়েসিং করছে কি না, তা যাচাই করছে কেন্দ্রীয় ব্যাংক। ফলে চলতি অর্থবছরের মার্চ পর্যন্ত আমদানি ১২ শতাংশ কমেছে। একই সময়ে রফতানি ৭ দশমিক ৭৬ শতাংশ বেড়েছে। রেমিট্যান্স বেড়েছে ৪ দশমিক ৭৮ শতাংশ। এর পরও সঙ্কট প্রকট হওয়ার মূল কারণ, বিদেশী ঋণ ব্যাপকভাবে কমেছে। সুদসহ আগের দেনা পরিশোধের চেয়ে নতুন ঋণ আসছে কম। এসব কারণে গত মার্চ পর্যন্ত আর্থিক হিসাবে ২২২ কোটি ডলারের ঘাটতি তৈরি হয়েছে; আগের অর্থবছরের একই সময়ে যেখানে উদ্বৃত্ত ছিল এক হাজার ১৯২ কোটি ডলার। শুধু এ কারণে বৈদেশিক মুদ্রার সামগ্রিক লেনদেন ভারসাম্যে ঘাটতি আগের অর্থবছরের একই সময়ের তুলনায় বেড়ে ৮১৭ কোটি ডলারে ঠেকেছে, যা গত অর্থবছরে ছিল মাত্র ৩১০ কোটি ডলার।

বাংলাদেশ ব্যাংক রিজার্ভ থেকে চলতি অর্থবছরে প্রায় ১৩ বিলিয়ন ডলার বিক্রি করা হয়েছে, যা গত অর্থবছরে ছিল ৭ দশমিক ৬২ বিলিয়ন ডলার। বর্তমানে রিজার্ভ রয়েছে ৩০ বিলিয়ন ডলার; আইএমএফের হিসাবে নিট রিজার্ভ ২০ বিলিয়ন ডলার। আইএমএফ থেকে ঋণের প্রথম কিস্তি এরই মধ্যে ছাড় হয়েছে। দ্বিতীয় কিস্তি ছাড় হতে পারে নভেম্বরে। তবে এর আগে অনেক শর্ত মানতে হবে, যেমন- বৈদেশিক মুদ্রার রিজার্ভ হিসাব করতে বিভিন্ন তহবিলে জোগান দেয়া অর্থ দেখানো যাবে না। আবার আগামী এক বছরে যে পরিমাণ দেনা রয়েছে, তা বাদ দিয়ে নিট রিজার্ভের হিসাব করতে হবে। এই হিসাব অনুযায়ী চলতি বছরের জুনে নিট রিজার্ভ অন্তত ২৪ দশমিক ৪৬ বিলিয়ন ডলার থাকতে হবে। আগামী সেপ্টেম্বরে আরো বাড়িয়ে ২৫ দশমিক ৩২ বিলিয়ন ডলারে উন্নীত করতে হবে। নিট রিজার্ভ বাড়াতে রফতানি উন্নয়ন তহবিলে (ইডিএফ) জোগান দেয়া তহবিলের আকার সাত বিলিয়ন থেকে কমিয়ে এরই মধ্যে ৪ দশমিক ৭৭ বিলিয়ন ডলারে নামানো হয়েছে। পর্যায়ক্রমে ইডিএফের আকার আরো কমানো হবে।

প্রয়োজন একটি সর্বজনীন মুদ্রা
বর্তমানে মুদ্রার অবমূল্যায়ন বিশ্বব্যাপী মহামারী হিসেবে আবির্ভূত হয়েছে। জেপি মর্গানের তথ্যানুযায়ী, ডলারের নমিনাল কার্যকর বিনিময় হার ২০২২-এর মধ্যে ১২ শতাংশ বৃদ্ধি পেয়েছে। একই সময়ের মধ্যে ইয়েনের কার্যকর হার ১২ শতাংশ, পাউন্ডের ৯ এবং ইউরো ৩ শতাংশ হ্রাস পেয়েছে। শুধু ডলারের বিপরীতে হিসাব করলে পাউন্ড স্টার্লিং ২১ শতাংশ, ইয়েনের ২০ এবং ইউরো ১৬ শতাংশ অবমূল্যায়িত হয়েছে। এই মুদ্রার অবমূল্যায়নের অন্যতম কারণ, দীর্ঘস্থায়ী মহামারীর ফলে সরবরাহ শৃঙ্খলা বিঘ্নিত হওয়া এবং সর্বশেষে ইউক্রেন- রাশিয়া যুদ্ধ।

অবমূল্যায়নের তুলনায় জীবিকা নির্বাহের ব্যয় বেশি বেড়ে যাওয়ায় সাধারণ মানুষ অনেক কষ্টে আছে। বিভিন্ন মুদ্রা, বিশেষ করে ডলারের ওপর নির্ভরতা ও সর্বজনীন মুদ্রার অভাব এ পরিস্থিতি আরো খারাপ করে তুলেছে। অতীতে বেশির ভাগ দেশ সোনার মান অনুসরণ করে মুদ্রার বিনিময় হার নির্ধারণ করত, কিন্তু সোনার মান নিয়ে মুদ্রার বিনিময় আন্তর্জাতিক বাণিজ্যের জন্য ক্রমেই অসুবিধাজনক হয়ে ওঠে। এ কারণেই ১৯৪৪ সালের ব্রেটন উডস চুক্তির মাধ্যমে মার্কিন ডলারকে একটি দেশের মুদ্রার মান প্রতিষ্ঠার মানদণ্ডে পরিণত করেছিল। এতে চুক্তিবদ্ধ দেশগুলোকে তাদের মুদ্রার মান নির্ধারণে সোনার পরিবর্তে ডলার ব্যবহার করতে সম্মত হয়। ডলারের বিপরীতে তাই একটি সর্বজনীন মুদ্রা গ্রহণের ধারণা দীর্ঘদিন আলোচনায় আছে। কিন্তু আজ অবধি তা অধরাই রয়ে গিয়েছে। একটি সর্বজনীন মুদ্রা গ্রহণ করতে পারলে বাণিজ্য আরো সহজ হয়ে উঠবে, যা ইইউ সদস্য দেশগুলো ইউরোকে তাদের সরকারি মুদ্রা হিসেবে গ্রহণ করার সময় ঘটেছিল। একক মুদ্রা হলে মূল্যের বিনিময় হার পরিবর্তন করা কঠিন হয়ে উঠবে এবং দেশগুলো তাদের রফতানিকে কৃত্রিমভাবে সস্তা করতে পারবে না। স্থিতিশীল মূল্যের সাথে তারা দীর্ঘমেয়াদি অর্থনৈতিক উন্নয়নে আরো বেশি বিনিয়োগ করতে পারবে।

লেখক : অর্থনীতিবিদ, গবেষক ও কলামিস্ট
ইমেইল : mizan12bd@yahoo.com


আরো সংবাদ



premium cement