২৭ এপ্রিল ২০২৪, ১৪ বৈশাখ ১৪৩১, ১৭ শাওয়াল ১৪৪৫
`

অভিন্ন নদী, ভারতের পানিনীতি ও বাংলাদেশ

অভিন্ন নদী, ভারতের পানিনীতি ও বাংলাদেশ। - ছবি : সংগৃহীত

গঙ্গা-ব্রহ্মপুত্র-মেঘনা (জিবিএম) অববাহিকা বিশ্বের বৃহত্তম জলজ অঞ্চলগুলোর অন্যতম। বাংলাদেশ, ভুটান, চীন, ভারত এবং নেপালজুড়ে বিস্তৃত এই অববাহিকা। প্রায় ৫০ কোটি মানুষ প্রত্যক্ষ বা পরোক্ষভাবে এই অববাহিকার ওপর নির্ভরশীল। কিন্তু এ অববাহিকা সঙ্কটের ইন্ধনে পরিণত হতে চলেছে। জিবিএম অববাহিকার দেশগুলোর পরিকল্পনাধীন বাঁধের সংখ্যা ৪১৪টি। এর মধ্যে নেপালে ২৮৫টি, ভারতে ১০৮টি, ভুটানে ১২টি, চীনে আটটি ও বাংলাদেশে একটি। ব্রহ্মপুত্র নদের চীনা অংশ ইয়ারলুং স্যাংপো থেকে পীত নদীতে বছরে ২০ হাজার কোটি ঘনফুট পানি সরিয়ে নেয়ার পরিকল্পনা রয়েছে চীনের।

অন্য দিকে, ন্যাশনাল রিভার লিংকিং প্রজেক্টের (এনআরএলপি) আওতায় ৯ হাজার ৬০০টি খাল খননের মাধ্যমে নিজ সীমানার ৪৪টি নদীকে সংযুক্ত করার পরিকল্পনা রয়েছে ভারতের।

চীন ও ভারতের মধ্যে সহযোগিতার অভাব একটি চলমান বাস্তবতা। তবে নয়া দিল্লি ও ঢাকার মধ্যে বিশেষ বন্ধুত্বের আওয়াজ উভয় তরফে শোনা যায়। বিজিএম অববাহিকায় বসবাস করেন ভারতের জনসংখ্যার ৪৭% আর বাংলাদেশের জনসংখ্যার ৪০%। উভয় দেশের খাদ্যনিরাপত্তা, পানি সরবরাহ, শক্তি উৎপাদন ও ইকোসিস্টেমের সাথে এই অববাহিকার সম্পর্ক গভীর। কিন্তু নদী ব্যবস্থাপনায় দুই পক্ষের সহযোগিতা বাড়বে তো দূরে থাক, বরং তা জটিলতার আবর্তে পাক খাচ্ছে। ১৯৯৬ সালে সম্পাদিত হয় গঙ্গা পানি চুক্তি (GWT) সেটিসহ আন্তঃসীমান্ত নদীগুলির উপর অতীতের যৌথ পদক্ষেপগুলো সাধারণত অ্যাড-হক, অস্থির, এবং বিতর্কে জর্জরিত। যার ফলে পানি বিভাজনের চ্যালেঞ্জ থেকে যায় অমীমাংসিত। উভয় দেশই চ্যালেঞ্জগুলোকে জাতীয় নিরাপত্তার ইস্যু হিসেবে দেখে। কিন্তু আন্তঃসীমান্ত নদীর স্বাভাবিক প্রবাহের সুরক্ষা এবং বাংলাদেশের ন্যায্য পাওনার বিষয়টি অবজ্ঞা করছে ভারত। ভারত আন্তঃসীমান্ত নদী থেকে একতরফাভাবে পানি সরায় এবং বাঁধ নির্মাণ করে।

বাংলাদেশ-ভারত যৌথ নদীর ওপর ভারতের তৈরি প্রধান অবকাঠামো ফারাক্কা বাঁধ। ১৯৬১ সালে গঙ্গা নদীর ওপর এই বাঁধ নির্মাণের কাজ শুরু হয়। শেষ হয় ১৯৭৫ সালে। সেই বছর ২১ এপ্রিল থেকে বাঁধ চালু হয়।
১৯৫১ সালের ২৯ অক্টোবর এ সম্পর্কে উদ্বেগ জানায় তৎকালীন পাকিস্তান সরকার। ১৯৫২ সালে প্রত্যুত্তরে ভারত জানায় যে, পরিকল্পনাটি মাত্র প্রাথমিক পর্যায়ে রয়েছে এবং এর বিরূপ প্রতিক্রিয়া সম্পর্কে পাকিস্তানের উদ্বেগ সম্পূর্ণ অনুমাননির্ভর। এরপর উভয় দেশের বিশেষজ্ঞ থেকে শুরু করে সরকারপ্রধান পর্যন্ত বিভিন্ন পর্যায়ে গঙ্গার প্রবাহ বণ্টনের ব্যাপারে বহুবার আলোচনা হয়েছে। এই ব্যারাজ বাংলাদেশে জলপ্রবাহকে ক্ষতিকারকভাবে প্রভাবিত করবে, এমন আপত্তি প্রত্যাখ্যান করে ভারত।

১৯৭১ সালে স্বাধীনতার পর বাংলাদেশ-ভারত আলোচনা নতুন করে শুরু হয়। ১৯৭২ সালে গঠিত হয় ভারত-বাংলাদেশ যৌথ নদী কমিশন (JRC)। ১৯৭৪ সালের ১৬ মে উভয় দেশের প্রধানমন্ত্রীর বৈঠকে সিদ্ধান্ত হয় যে, গঙ্গার পানি ভাগাভাগির প্রশ্নে উভয় দেশের ঐকমত্য ও চুক্তির আগে ফারাক্কা বাঁধ চালু হবে না। ১৯৭৫ সালে ফারাক্কা বাঁধের ফিডার ক্যানাল পরীক্ষার জন্য মাত্র ১০ দিনের জন্য (২১ এপ্রিল থেকে ৩১ মে) ফারাক্কা বাঁধ চালু করার অনুমতি চায় ভারত। দেশটি বলেছিল, এ সময়ে গঙ্গা থেকে ৩১০-৪৫০ কিউবিক মিটার/সেকেন্ড পানি প্রত্যাহার করবে। সরল বিশ্বাসে বাংলাদেশ অনুমতি দিয়েছিল। তারপর যে ফারাক্কা চালু করে পানি প্রত্যাহার শুরু হলো, আর বন্ধ হলো না। বাংলাদেশের আপত্তি কানেই নেয়নি তারা। ফলে বাংলাদেশ জাতিসঙ্ঘের শরণাপন্ন হয়। ১৯৭৬ সালের ২৬ নভেম্বর জাতিসঙ্ঘ সাধারণ পরিষদের বিবৃতির ভিত্তিতে ভারত আদিষ্ট হয় জরুরি ভিত্তিতে বাংলাদেশের সাথে আলোচনায় বসে ন্যায্যতার ভিত্তিতে পানি সমস্যার সমাধান নিশ্চিত করার জন্য। এরপর বহু চড়াই-উৎরাই শেষে ১৯৯৬ সালের ১২ ডিসেম্বর সরকার ভারতের সাথে গঙ্গার পানি নিয়ে ৩০ বছরের চুক্তি হয়। চুক্তিতে কথা ছিল অন্তত ২৭ হাজার কিউসেক পানি পাবে বাংলাদেশ। কিন্তু সে পরিমাণ পানি বাংলাদেশ পায়নি কখনো।

ফারাক্কার অভিশাপ চারদিকে স্পষ্ট। বাংলাদেশের কৃষি, মৎস্য, বন, শিল্প, নৌপরিবহন, পানি সরবরাহ বিপন্ন। দেশের সমগ্র দক্ষিণ-পশ্চিমাঞ্চলে নিদারুণ দুর্বিপাক। দক্ষিণাঞ্চলে চার কোটি, উত্তরাঞ্চলে প্রায় দুই কোটি মানুষের জীবনে এর ক্ষতিকর প্রভাব পড়েছে। এখানকার সেচব্যবস্থার বিপন্নতা, মাটির উর্বরতা কমে যাওয়া, পানির স্তর অস্বাভাবিকভাবে নিচে নেমে যাওয়া, প্রায় ২ হাজার কিলোমিটার নৌপথ বন্ধ, প্রাণবৈচিত্র্যের বিনাশ, হাজার হাজার জেলে কর্মসংস্থান হারানো, কৃষিজমিতে লবণাক্ততা বৃদ্ধি, সুন্দরবনের ১৭ শতাংশ লবণাক্ততায় হারিয়ে যাওয়া ফারাক্কার অভিশাপের কিছু দিক মাত্র। ফারাক্কার কারণে ১৯৭৫ থেকে ১৯৯২ সাল পর্যন্ত বাংলাদেশের সামগ্রিক ক্ষতি হয়েছে এক লাখ আট হাজার ৫০০ কোটি টাকা। এরপর থেকে আজ পর্যন্ত প্রতি বছর প্রায় পাঁচ হাজার কোটি টাকার ক্ষতির কবলে পড়ছে বাংলাদেশ।

তিস্তা নদীর দ্বন্দ্বেও বাংলাদেশের পানির অধিকার উপেক্ষিত হচ্ছে। নীলফামারীর তিস্তা নদীর উজানে ভারত জলপাইগুড়ি জেলার মালবাজার মহকুমায় ১৯৯৮ সালে তৈরি করে গজলডোবা বাঁধ। এ বাঁধের আগে বাংলাদেশ তিস্তা অববাহিকায় ২৫০০ কিউসেক পানি পেতো। এখন পানি প্রবাহের পরিমাণ ৪০০ কিউসেকেরও কম। তিস্তা পরিণত হয়েছে মৃত নদীতে।

বলা হয়, বাংলাদেশে আছে ৫৭টি হচ্ছে আন্তঃসীমান্ত নদী। যার মধ্যে ৫৪টি বাংলাদেশ ও ভারতে আর তিনটি বাংলাদেশ ও মিয়ানমারে অভিন্ন। তবে নদী গবেষক মাহবুব সিদ্দিকী দেখিয়েছেন, আন্তঃসীমান্ত নদ-নদীর সংখ্যা শতাধিক। নদী বিশেষজ্ঞ ম. ইনামুল হকের মতে, এমন নদীর সংখ্যা ১৭১ এর অধিক।

অভিন্ন নদীগুলোর প্রায় প্রতিটিতে এবং এর উপনদীগুলোতেও ভারত অসংখ্য প্রকল্প নির্মাণ করেছে, করছে। ইতোমধ্যে দেশটির ২৯ রাজ্যের ২২টিতেই নদী অববাহিকায় নির্মাণ করা হয়েছে বড় বড় পাঁচ হাজার বাঁধ। এর মধ্যে অন্তত তিন হাজার বাঁধ গত ৫০ বছরে নির্মিত। ভারতের বাঁধ ও পানিপ্রকল্পসমূহ গঙ্গা-পদ্মা অববাহিকা, ব্রহ্মপুত্র-যমুনা অববাহিকা এবং বরাক ভ্যালিতে পানি রুদ্ধ করছে, করার প্রকল্প বাস্তবায়ন করছে। এসব অববাহিকার শাখা নদীগুলো গোটা বাংলাদেশকে নদীমাতৃক দেশে পরিণত করেছে। দুধকুমারি, খোয়াই, সুমেশ্বরী, মণু, গোমতি, মুহুরি, ধরলা ইত্যাদি নদীর ওপর ভারতীয় অবকাঠামো রয়েছে।

বাংলাদেশের স্বাধীনতা যুদ্ধের সময় ১১টি সেক্টরের ওপর আরডিআরসির একটি গবেষণায় দেখা যায়, ১৯৭১ সালে নদ-নদীর সংখ্যা ছিল এক হাজার ২৭৪টি। ২০২১ সালে এসে মৃত্যু হয়েছে ৫০৪ নদীর। ২০২৩ এ এসে নদী রক্ষা কমিশন জানাচ্ছে, দেশে এখন নদীর সংখ্যা ৭৫৬টি। কেবল গত দু’বছরেই বাংলাদেশ হারিয়েছে ১৪টি নদী। শুধু ফারাক্কা বাঁধের কারণে অন্তত ১০০ নদীর মৃত্যু হয়েছে।

বাংলাদেশ অব্যাহতভাবে চেষ্টা করছে তিস্তাসহ যৌথ নদীর পানি বণ্টনে চুক্তিতে আসার জন্য। কিন্তু বাস্তবতা হলো কোনো চুক্তি এ অবধি ভারতের একতরফা পানি প্রত্যাহার রোধ করেনি, বাংলাদেশের ন্যায্য পানিপ্রাপ্তিতে অগ্রগতি আনেনি, অতীতের চুক্তিতে সমতা অস্বীকৃত হয়েছে, যা বাংলাদেশের পক্ষে বেশি প্রতিকূল বলে প্রমাণিত হয়েছে। সর্বশেষ ২০১০ সালের মার্চে দিল্লিতে তিস্তার পানিবণ্টন চুক্তির ব্যাপারে ঐকমত্যে পৌঁছেছিল দুই দেশ। কিন্তু পশ্চিম বঙ্গের আপত্তির কথা বলে চুক্তিটি আজও স্বাক্ষরিত হয়নি।

ভারত স্বভাবগতভাবে চাইছে পানি সমস্যার সমাধানে না আসতে। ফলে এর প্রক্রিয়ায় অসঙ্গতি থাকলে তো চলবে না। কিন্তু আমাদের হাতে কি অভিন্ন নদীসমূহের পানি নিয়ে প্রকৃত তথ্য ও রেকর্ড রয়েছে? নদীগুলোর ব্যাপারে কি হাইড্রোলজিক্যাল জরিপ হতে পারে না? পর্যাপ্ত ও ভালোমানের ডেটা আমাদের থাকতে হবে। যেমন গঙ্গা-ব্রহ্মপুত্র-যমুনা বেসিনের মোট বৃষ্টিপাতের পরিবর্তিত ধারা বা ট্রেন্ড নির্ণয়, স্রোতের প্রবাহ, ভূ-পৃষ্ঠ ও ভূগর্ভস্থ পানির স্তর, পানির গুণমান, যৌথ নদীগুলোর পরিবর্তিত জলধারণ ও নিষ্কাশন ক্ষমতা নির্ণয়, দূষণ পরিস্থিতি পর্যবেক্ষণ এবং নদীগুলোর গ্রীষ্ম ও বর্ষাকালীন প্রবাহ সংশ্লিষ্ট তথ্যসমূহ। কিন্তু এই তথ্যগুলো সহজে পাওয়া যায় না। সমস্যা হলো শুধু বাংলাদেশের নয়, ভারতের হাইড্রোলজিক্যাল তথ্যও পেতে হবে। এ ক্ষেত্রে ভারতের সহযোগিতা প্রয়োজন। বাংলাদেশ-ভারত যৌথ নদী কমিশনের কাজের মধ্যে এটা গুরুত্বপূর্ণ। কিন্তু মুশকিল হলো এক দশক ধরে যৌথ নদী কমিশনের কোনো বৈঠকই হয়নি। বাংলাদেশের সাথে ভারতসহ নেপাল, ভুটান ও চীনের মতো পানি বণ্টনকারী দেশগুলোর মধ্যে দ্বিপক্ষীয় বৈজ্ঞানিক সহযোগিতা সব দেশকেই উপকৃত করবে। স্যাটেলাইট থেকে প্রাপ্ত তথ্য এ ক্ষেত্রে সহজ এক সহায়তা।

বাংলাদেশকে সনাতন প্রক্রিয়া থেকে মুখ ফিরিয়ে নতুন বাস্তবতাকে পাঠ করতে হবে। ফারাক্কা ব্যারাজ স্থাপনের পক্ষে ভারতের তরফে কলকাতা সমুদ্রবন্দরের নাব্য বৃদ্ধির কথা বলা হলেও ফারাক্কা এখন পশ্চিমবঙ্গ, বিহার ও উত্তরপ্রদেশের কিছু এলাকায় নিয়মিত বন্যার সৃষ্টি করছে। ক্ষতিগ্রস্ত জনগণ ফারাক্কা বাঁধ ভেঙ্গে দেয়ার দাবিতে প্রায়ই মিছিল করেন। বিহারের মুখ্যমন্ত্রী নীতিশ কুমার কেন্দ্রীয় সরকারের কাছে ফারাক্কা বাঁধ সরিয়ে স্থায়ী সমাধান চেয়ে আসছেন। অপর দিকে গঙ্গার পানিবণ্টন বিষয়ে ১৯৯৬ সালে স্বাক্ষরিত চুক্তি বাংলাদেশকে ফারাক্কার অভিশাপ থেকে রক্ষা করতে পারেনি। ফলে এ বাঁধ সরিয়ে ফেলার দাবি এ দেশের জনগণেরও। এ পরিস্থিতিতে ফারাক্কার মাধ্যমে পানি প্রত্যাহার প্রক্রিয়া পুরোপুরি বন্ধ করাটাই উভয়ের জন্য ভালো।

বরাক নদীর ওপর টিপাইমুখ বাঁধ হতে যাচ্ছে বাংলাদেশের জন্য ‘আরেক ফারাক্কা’। এর ভয়াবহতা নিয়ে সীমান্তের উভয় দিকে বাস্তব আশঙ্কা রয়েছে। আসাম, মণিপুরের বিপুল অঞ্চল এর দ্বারা ক্ষতির কবলে পড়বে। তবে সবচেয়ে বেশি বিপন্ন হবে বাংলাদেশ; সিলেট অঞ্চল। ভারত সরকার টিপাইমুখ বাঁধের প্রক্রিয়া বহুদূর এগিয়ে নিয়েছে। এখানে বাংলাদেশ নির্বিকার থাকতে পারে না। এ প্রশ্নে জনসচেতনতা বৃদ্ধি যেমন দরকার, তেমনি দরকার বাংলাদেশ সরকারের ক্রিয়াশীল প্রয়াস।

উত্তর-পূর্ব ভারতের অরুণাচল, আসাম, মেঘালয় ও মণিপুরে ব্রহ্মপুত্র নদ ও তার বিভিন্ন উপনদী ও শাখানদীর উপর ভারত সরকারের কথিত ১৪৮টি বাঁধ ও ব্যারাজ নির্মাণ করছে। গঙ্গা ও ব্রহ্মপুত্রের পানি দক্ষিণ ও পশ্চিম ভারতের দিকে প্রেরণের উদ্দেশ্যে প্রণীত ভারতীয় আন্তঃনদী সংযোগ প্রকল্প বা আইআরএলপি নামক এক বিশাল নদী অবরোধমূলক প্রকল্প আরেক ভয়াবহ দুঃস্বপ্ন। এর প্রতিবাদ চলমান ভারতের নানা অঞ্চলে। এ প্রকল্প বাংলাদেশের উপর একটি মহাদুর্যোগই নিশ্চিত করবে। এর প্রতিকারে সরকারকে এখনই সক্রিয় হওয়া উচিত।
ভারতের সাথে চুক্তির অভিজ্ঞতা যেখানে তিক্ত, সেখানে সনাতন চুক্তিধারায় নবায়ন জরুরি। ইতোপূর্বে সম্পন্ন চুক্তি ও সমঝোতা স্মারকগুলো ছিল দ্বিপক্ষীয়। যা ব্যর্থ প্রমাণিত হয়েছে। বাংলাদেশকে অবশ্যই চুক্তিতে আন্তর্জাতিক তৃতীয় পক্ষের অংশগ্রহণের চিন্তা করতে হবে। ছয় দশক আগে বিশ্বব্যাংকের মধ্যস্থতায় ভারত ও পাকিস্তান সিন্ধু নদীর পানি চুক্তি সই করে। এর আলোকে এখনো উভয় দেশ পানি ভাগাভাগি করছে। তবে বাংলাদেশের সাথে কোনো চুক্তিতে তৃতীয় পক্ষের উপস্থিতিতে রাজি হচ্ছে না ভারত। কিন্তু বাংলাদেশ কি চেষ্টা করছে? এখনো দ্বিপক্ষীয় নীতিতে আটকে থাকছি আমরা, যা আত্মঘাতী।

ইতোমধ্যে এ প্রক্রিয়া থেকে উপকৃত হবার সুযোগ হাতছাড়া করেছে বাংলাদেশ। ভারত বাংলাদেশ থেকে যা পাবার, সবই পেয়ে গেছে। ভারতের উদ্বেগ ছিল বাংলাদেশে ঢুকে পড়া সে দেশের বিচ্ছিন্নতাবাদীদের নিয়ে। ২০০৯ সালে শেখ হাসিনা সরকার এ উদ্বেগ দূর করেছেন। ভারতের আরেক চাহিদা ছিল ট্রানজিট। বাংলাদেশ তাও দিয়েছে; রেল ট্রানজিট, নৌ ট্রানজিট, রাস্তার ট্রানজিট, বাস ট্রানজিট এবং বিদ্যুতের ট্রানজিট। কিন্তু বিনিময়ে কী নেবো, সেই কাণ্ডজ্ঞানের পরিচয় দিইনি।

এমতাবস্থায় বাংলাদেশকে অবশ্যই সমাধানের চেষ্টায় বৈচিত্র্য আনতে হবে। সমুদ্র জলসীমা নিয়ে ভারত আলোচনায় রাজি হচ্ছিল না, তখন আন্তর্জাতিক আদালতে গিয়ে নিজের অনুক‚লে রায় আনতে সক্ষম হয় বাংলাদেশ। গঙ্গা নিয়ে যে চুক্তি হয়েছিল, তার পেছনেও ছিল নিরাপত্তা পরিষদের বিবৃতি। বিদ্যমান প্রেক্ষাপটে বাংলাদেশ ‘কনভেনশন অন বায়োলজিক্যাল ডাইভারসিটি’ ফোরামে নালিশ করতে পারে, বিভিন্ন আন্তর্জাতিক ফোরামের শরণাপন্ন হতে পারে। জাতিসঙ্ঘ পানি প্রবাহ কনভেনশন ১৯৯৭-এর ধারা ৫, ৭, ১ ও ৭, ২ ধারায় অববাহিকার ওপর নির্ভরশীল দেশ, মানুষ ও প্রকৃতির ক্ষতি না করার সুস্পষ্ট নির্দেশনা দেয়া আছে। আন্তর্জাতিক আইন বাংলাদেশের অধিকারের পক্ষে। এমতাবস্থায় ফারাক্কা বাঁধের কারণে বাংলাদেশের যে ক্ষতি হয়েছে, সেই ক্ষতিপূরণের দাবি অনুচ্চারিত থাকছে কেন?

আন্তঃসীমান্ত নদী সমস্যার সমাধানের চেষ্টায় বৈচিত্র্যের কথা যখন বলছি, তখন মনে রাখতে হবে এ অঞ্চলের নদীগুলোর সাথে চীন, নেপাল, ভুটানও জড়িত। সবার অংশগ্রহণে সমস্যার সমাধানের প্লাটফর্মের চিন্তা করতে পারে বাংলাদেশ।

ভারত চীনের পানি প্রত্যাহারে ত্যক্ত, বিব্রত। কিন্তু ভারতের পানি প্রত্যাহার চীনের পানি প্রত্যাহারের কৌশলকেই আন্তর্জাতিক অঙ্গনে ভিত্তি দেয়। ভারত যদি বাংলাদেশের সাথে ন্যায্যতার দৃষ্টান্ত স্থাপন করে, তাহলে চীনের বিপরীতে আন্তর্জাতিক অঙ্গনে তার নৈতিক অবস্থান তৈরি হয়। কিন্তু এখন ব্যাপারটা হলো, ভারত যা করছে বাংলাদেশের সাথে, সে কাজটাই চীন করছে ভারতের সাথে।

শেষ বিচারে বাংলাদেশের সাথে সুপ্রতিবেশীসুলভ আচরণে ভারতেরই লাভ!

লেখক : কবি, গবেষক
71.alhafij@gmail.com


আরো সংবাদ



premium cement