২৯ এপ্রিল ২০২৪, ১৬ বৈশাখ ১৪৩১, ১৯ শাওয়াল ১৪৪৫
`


সুসন্তান বনাম কুসন্তান

লেখক গোলাম মাওলা রনি। - ফাইল ছবি

সমস্যাটি অনাদিকালের। মানুষ যখন সভ্যতার সূচনা করতে বনবাদাড় থেকে বের হয়ে এলো এবং বসতি স্থাপন করে পরিবার প্রথা চালু করল, ঠিক তখন থেকেই সমস্যাটির শুরু যা ক্রমবর্ধমান হারে কেবল বেড়েই চলেছে। আজকের দিনে সারা দুনিয়ার এক নম্বর মনস্তাত্ত্বিক সমস্যা হিসেবে প্রায় প্রতিটি ঘরকে কমবেশি জতুগৃহে পরিণত করা সমস্যাটি নিয়ে বিস্তারিত আলোচনার আগে দুটো ঐতিহাসিক ঘটনা বর্ণনা করে নিই।

প্রথম ঘটনাটি হজরত নুহ আ:-এর জমানার। আল্লাহ রাব্বুল আলামিন যখন সিদ্ধান্ত নিলেন যে, তিনি প্রবল বন্যা দিয়ে পাপী-তাপী, কাফের-মুনাফেকসহ জমিন ধ্বংস সাধন করবেন তখন হজরত নুহ আ:-এর পরিবার, অনুসারীসহ বিভিন্ন প্রজাতির প্রাণীদের জোড়ায় জোড়ায় তার ঐতিহাসিক নৌকায় তোলার হুকুম দিলেন। সবাই যথানিয়মে এবং যথাসময়ে নৌকায় আরোহণ করলেও নবীর এক পুত্র কিছুতেই রাজি হলো না। সে খোদার গজব বন্যাকে ভয় পেলো না- এমনকি বিশ্বাসও করল না। নবীর পীড়াপীড়ি-আকুতি-নিবেদনের জবাবে কাফের পুত্র বলল, যদি আসলেই কোনো বন্যা হয় তবে ওই যে সুউচ্চ পাহাড় রয়েছে এবং সেই পাহাড়ের চূড়ায় যে বিশাল বৃক্ষ রয়েছে সেই বৃক্ষের মগডালে উঠে সে বন্যার মোকাবেলা করবে।

হজরত নুহ আ: তাঁর পুত্রের অবাধ্যতা-নির্বুদ্ধিতা-নাফরমানি ও বেঈমানির কারণে যারপরনাই ব্যথিত হলেন। তিনি পুত্রের জন্য অঝোরে কাঁদতে লাগলেন। মহান আল্লাহ তখন তাঁর প্রিয় নবীকে জানালেন যে, তিনি যার জন্য কাঁদছেন সে তাঁর ঔরসজাত সন্তান নয়। নবী প্রকৃত ঘটনা বুঝতে পারলেন এবং তওবা করে আল্লাহর কাছে আশ্রয় চাইলেন। দ্বিতীয় ঘটনাটি হজরত ওমর রা:-এর জমানার এবং তাঁর নিজ পুত্রের। খলিফার কাছে অভিযোগ এলো যে, তাঁর এক পুত্র মদ্যপান করেছে। খলিফা নির্দেশ দিলেন মাতাল পুত্রকে ১০০টি দোররা মারার জন্য। দায়িত্বপ্রাপ্ত ব্যক্তি খলিফাকে জানালেন যে, ৯০টি ঘা মারার পর মাতালের মৃত্যু হয়েছে। নির্বিকার খলিফা বললেন, বাকি ১০ দোররা মাতালের কবরের ওপর মারতে থাকো।

উল্লিখিত উদাহরণ সম্পর্কে আমার বক্তব্য আজকের নিবন্ধের শেষ অংশে বর্ণনা করব। এবার শিরোনাম প্রসঙ্গে হালআমলের হালহকিকত সম্পর্কে কিছু বলে নিই। আমাদের সমাজে আপনি প্রায়ই দেখতে পাবেন যে, মন্দ পিতা-মাতার ঘরে বহু সুসন্তান পয়দা হয়েছে যারা জনক-জননীর পাপাচারকে পায়ে মাড়িয়ে দুনিয়া-আখিরাতের স্বার্থে কল্যাণকর কর্মের জন্য রীতিমতো জিহাদ করে যাচ্ছেন। বিপরীতে সৎ-সজ্জন ও আলেমের ঘরে এমন কুসন্তান জন্ম নিয়েছে যাদের কুকর্ম দেখে শয়তান পর্যন্ত রীতিমতো আঁতকে ওঠে। এসব বৈসাদৃশ্য দেখার পর সমাজে নানা গুঞ্জন শুরু হয়ে যায়। লোকজন বলতে থাকেন, আলেমের ঘরে এতবড় জালেম হলো কী করে অথবা এতবড় কাফের মুনাফেক দুর্নীতিবাজের ঘরে কিভাবে চক্ষু শীতলকারী সুসন্তান পয়দা হলো।

উপরোক্ত বৈসাদৃশ্য ছাড়া আরো বহু বিপরীত দৃশ্য আমাদের সমাজ-সংসারকে অশান্তির আগুনে দাহ করতে থাকে। শিক্ষিত পিতা-মাতার সন্তান লেখাপড়া না করে মদ-গাঁজায় আসক্তি। ধনীর পুত্র-কন্যারা পিতা-মাতার মতো কষ্ট করে অর্থ উপার্জনের পরিবর্তে হেলে-দুলে, শুয়ে-বসে নির্বিকারচিত্তে পিতা-মাতার সহায় সম্বল অপচয় করে ভিক্ষুকে পরিণত হওয়ার জন্য যত মন্দ অভ্যাস রয়েছে তা রপ্ত করতে রীতিমতো সাধনা করতে থাকে। বিদ্বান পিতা-মাতার সন্তানদের মূর্খতা জ্ঞানী পিতা-মাতার সন্তানদের নির্বুদ্ধিতা, চরিত্রবান পিতা-মাতার চরিত্রহীন সন্তান এবং সর্বজন শ্রদ্ধেয় পিতা-মাতার সন্তানদের নিন্দনীয় কর্মের কারণে বাংলাদেশের লাখ লাখ পরিবারে দিবানিশি জাহান্নামের আগুন দাউ দাউ করে জ্বলতে থাকে।

পিতা-মাতা সন্তান-সন্ততির মধ্যে হালআমলে যেসব বিষক্রিয়া দেখা যায় তার বিপরীত দৃশ্যও কিন্তু কম নয়। রিকশাওয়ালা মুটে মজুর প্রভৃতি প্রান্তিক জনগোষ্ঠীর পুত্র-কন্যারা দেশ-বিদেশের নামকরা কলেজ-বিশ্ববিদ্যালয়ে ভর্তি হয়ে অসাধারণ ফলাফল করছে এবং কর্মজীবনে বিশাল সফলতার স্বাক্ষর রেখে চলেছেন। দেবব্রত সিংহের অমর কবিতা- তেজের নায়িকা সাজলির মতোন করে বহু ছাত্রছাত্রী প্রতি বছর বাংলার আনাচে-কানাচে এমন সব সফলতার কীর্তিগাথা রচনা করে চলেছেন যা শুনলে পাষাণের হৃদয়ও বিগলিত হয়। মন্দ পিতা-মাতার সুসন্তান পিতা-মাতার প্রতি ভক্তি-শ্রদ্ধা প্রদর্শন ও দায়িত্ব পালনের ক্ষেত্রে এমন সব নজির স্থাপন করে চলেছেন; তা নিজে চোখে না দেখলে বিশ্বাস করা সম্ভব নয়।

এখন প্রশ্ন হলো, কেন এমনটি হয়। আমাদের সমাজের বেশির ভাগ মানুষ সন্তান-সন্ততির অমানুষ হওয়ার জন্য পিতা-মাতাকে দায়ী করে থাকেন। অন্য দিকে, অমানুষ পিতা-মাতার কীর্তিমান সুসন্তান সম্পর্কে বলতে গিয়ে সবাই একবাক্যে বলবেন, আল্লাহ বানিয়েছেন। অথচ বিষয়গুলো নিয়ে খোলামেলা আলোচনা ও বৈজ্ঞানিক কার্যকারণ নির্ণয়ের অভাবে বেশির ভাগ পরিবারে অশান্তির দাবানল অনবরত জ্বলতে থাকে। প্রতিটি পিতা-মাতা সর্বোচ্চ চেষ্টার সাথে তাপ-চাপ অর্থাৎ লাথি-গুঁতো-কিলঘুষি থেকে শুরু করে ঝাড়–পেটা-জুতোপেটা দিয়ে হলেও সন্তানকে ক্লাসে ভালো ফলাফল করোনো ও পরবর্তীতে কর্মজীবনে জজ-ব্যারিস্টার, ডাক্তার, ইঞ্জিনিয়ার বানানোর অপচেষ্টায় সারাক্ষণ ত্রিমাত্রিক চেষ্টায় মারাত্মক ব্যস্ত থাকেন। নিজে না খেয়ে সন্তানকে মাছের মুড়ো, মুরগির রান, গরু-খাসির ঘিলুসহ ঘি, মাখন, পনির, দুধ, কলা, ফলফলাদি খাওয়াতে থাকেন। সন্তানের লেখাপড়ার জন্য সর্বস্ব ব্যয় করেন এবং নিজের শরীর স্বাস্থ্যকে রোগাক্রান্ত বানিয়ে সন্তানকে হৃষ্টপুষ্ট নধর বানিয়ে দিন শেষে যখন উল্টো ফলাফল পান তখন প্রথমেই সন্তানের ওপর অত্যাচার শুরু করে দেন। তারপর নিজেকে দফায় দফায় গালাগাল দেন এবং পরিশেষে আল্লাহকেও ছাড় দেন না। অন্য দিকে, প্রান্তিক জনগোষ্ঠীর কোনো সন্তান যদি শিক্ষা-দীক্ষা ও কর্মজীবনে ভালো ফলাফল করেন সে ক্ষেত্রে সন্তান ও জনক-জননীর অহঙ্কার প্রায়ই দৃষ্টিকটু পরিস্থিতির সৃষ্টি করে এবং বেশির ভাগ ক্ষেত্রে সমাজে বিশৃঙ্খলা তৈরি করে। এদের অহঙ্কার বাস্তব জীবনে তাদের জন্য নানা অপমান ও বিপত্তি তৈরি করে যা সামাল দিতে না পারার কারণে তারা এক ধরনের হীনম্মন্যতায় ভোগেন এবং সেই হীনম্মন্যতা দূর করার জন্য বেশির ভাগ ক্ষেত্রেই মন্দ কর্ম ও মন্দ চিন্তায় আক্রান্ত হয়ে পড়েন।

আজকের শিরোনাম প্রসঙ্গে আমার ব্যক্তিগত অভিজ্ঞতা ও বই পুস্তকের জ্ঞান এবং অভিজ্ঞান ভিন্নতর। আমরা সাত ভাই অভিন্ন পরিবেশে বেড়ে উঠেছি কিন্তু বাস্তব জীবনে এসে শিক্ষা-দীক্ষা-সফলতার ক্ষেত্রে ভিন্নতর অবস্থানে রয়েছি। আমার তিন ছেলেমেয়েকে লালন পালন করতে গিয়ে জ্ঞান-বিজ্ঞানের যত সূত্র রয়েছে তা প্রয়োগ করেছি। ধর্ম-কর্ম, নীতি-নৈতিকতা থেকে শুরু করে সামাজিক মেলামেশার ক্ষেত্রে সর্বোচ্চ সতর্কতা অবলম্বন করে যথাসাধ্য পরিশ্রম-যত্ন আত্তি, স্নেহ-ভালোবাসা, আর্থিক বিনিয়োগসহ দেশের সেরা স্কুল-কলেজ-বিশ্ববিদ্যালয়ে পড়িয়েছি। কিন্তু নির্মম বাস্তবতা হলো- আমার তিন সন্তানের আকার-আকৃতি, গায়ের রঙ ও বয়সের মধ্যে যেমন অমিল তদ্রুপ তাদের চিন্তা-চেতনা-কর্মের অমিল বিস্তর। আমার বা আমার স্ত্রীর মধ্যে যেসব ভালো বিষয়াদি রয়েছে সেগুলোর প্রতি তাদের ন্যূনতম আকর্ষণ রয়েছে বলে আমার মনে হয় না। ফলে তারা কেউই আমার মতো হয়নি- তারা কেবল তাদের মতোই হয়েছে।

আমার ভাই ও সন্তানদের পেছনে আমার জীবনের বহু মূল্যবান সময়, অর্থ এবং শ্রম ব্যয় করেছি। আমার সফলতা-ভালোলাগা, সার্থকতা-আনন্দ, রুচি-অভিরুচি, খাদ্যাভ্যাস, ধর্মকর্ম, সামাজিকতা, জনসংযোগ, বিদ্যার্জনের কায়দা-কানুন এবং বিদ্যাকে বাস্তব জীবনে প্রয়োগের কলাকৌশল তাদের যতবার শেখানোর চেষ্টা করেছি ততবারই হিতে বিপরীত হয়েছে। ফলে একটা সময় আমি পিছু হটতে বাধ্য হই এবং কেন এমন হয় তার কার্যকারণ খোঁজার চেষ্টা করি। রবীন্দ্রনাথ-নজরুল কিংবা বঙ্কিমের সন্তানরা কেন পিতৃগুণে গুণান্বিত হয়নি তার খোঁজ করতে গিয়ে জানলাম, সাহাবি আমির মাবিয়া রা: সর্বোচ্চ চেষ্টা-সর্বোচ্চ শিক্ষা ও সর্বোত্তম পরিবেশ শতভাগ নিশ্চিত করেও তার পুত্র ইয়াজিদকে মানুষ বানাতে পারেননি। অন্য দিকে দুনিয়ার শ্রেষ্ঠতম শাসক রোমান সম্রাট ক্লডিয়াস সর্বকালের সেরা পণ্ডিত বন্ধুবর সেনেকাকে নিজ পুত্র নিরোকে মানুষ বানানোর সর্বোচ্চ চেষ্টা করেছিলেন। কিন্তু বাস্তবে নিরো হয়েছিল মহাকালের সবচেয়ে কুখ্যাত-নির্মম-নিষ্ঠুর অমানুষ।

সম্রাট ক্লডিয়াসের চেয়েও বিখ্যাত ছিলেন সম্রাট মার্কাস অরলিয়াস। তিনি শুধু সম্রাটই ছিলেন না ছিলেন সর্বকালের সেরা দার্শনিক, যুদ্ধবিশারদ, সফলতম শাসক, ন্যায়বিচারক ও ধার্মিক। তার পরও তিনি কামাডাসের মতো নিকৃষ্টতম সন্তানের পিতা ছিলেন যিনি আপন সন্তানের হাতে নিহত হয়েছিলেন।

আমরা আজকের আলোচনার শেষ পর্যায়ে চলে এসেছি। আলোচনার শুরুতে যে দু’টি ঐতিহাসিক উদাহরণ দিয়েছিলাম তার মর্মকথা হলো, পিতৃগুণে যদি সব কিছু হতো তবে হজরত নুহ আ: ও হজরত ওমর রা:-এর পুত্রদের কলঙ্কময় ইতিহাস লিখিত হতো না। দ্বিতীয়ত, পৃথিবীর কোনো কুসন্তান যেমন পিতা-মাতার সুকর্মকে কলঙ্কিত করতে পারেনি তদ্রুপ কোনো সুসন্তান মন্দ পিতা-মাতার বদনামি ঘোচাতে পারেনি। ব্যক্তির কর্মই কেবল ব্যক্তিকে মহিমাম্বিত অথবা কলঙ্কিত করতে পারে। আমাদের সমাজের বেশির ভাগ মানুষ পৃথিবীর প্রাকৃতিক অতি প্রাকৃতিক-অলৌকিক বিষয়াদি যেমন জানে না বা বোঝে না তদ্রুপ মানবের দেহ ঘিরে যে অভিনব ও বিস্ময়কর প্রকৌশল (Unique Engineering) রয়েছে, মানব মন-আত্মা ও মস্তিষ্কের যে রসায়ন রয়েছে তা মূল্যায়ন করতে পারে না। মানুষের দেহের বাইরের প্রকৃতি-পরিবেশ, সময় ও সুযোগ কিভাবে মানুষের শরীর-মন-মস্তিষ্কের সাথে ক্রিয়া-বিক্রিয়া করে তা নিয়ে চিন্তা করার মতো মানুষ সবসময়ই বিরল-আর এ বিষয়ে অভিজ্ঞতাসম্পন্ন মানুষ কোটিতে একজন পাওয়াও দুষ্কর। ফলে বেশির ভাগ মানুষ দু’টি সরল সূত্রে পরিচালিত হয়।

প্রথমটি হলো- চেষ্টা করলে সব হয়, পরিশ্রম সব সৌভাগ্যের চাবিকাঠি। অন্য দিকে, দ্বিতীয় গ্রুপ মনে করে, তসবিহ টিপলে, দোয়া দরুদ পড়লে, ধর্মকর্ম করলে আল্লাহ আকাশ থেকে সব নিয়ামত পাঠিয়ে থাকেন এবং আল্লাহর দয়া হলে মানুষ অসম্ভবকে সম্ভব করতে পারে। মানুষের এই বিপরীতমুখী চিন্তাকে যারা একত্র করতে পারে এবং নিজের যোগ্যতা পরিমাপ করে নির্দিষ্ট সীমার মধ্যে থেকে সংযত হয়ে চেষ্টা চালাতে পারে কেবল তারাই বেশির ভাগ ক্ষেত্রে সফলতার সন্ধান পায়। দ্বিতীয়ত, মানুষের মধ্যে যে শ্রেণীটি সন্তান-সন্ততিসহ আপনজন ও অধীনস্থদের নিজের মতো করে মানুষ বানানোর চেষ্টার লাগাম টানতে পারে তাদের ব্যক্তিগত সুখানুভতি বিনষ্ট হয় না। সর্বোপরি অন্যের সফলতা-ব্যর্থতার জন্য নিজেকে দায়ী করা অথবা ঈর্ষান্বিত হওয়া কিংবা অনুশোচনা করা থেকে বিরত থাকার মধ্যেই জীবনের গতিকে স্বাভাবিক রাখা সম্ভব।

লেখক : সাবেক সংসদ সদস্য


আরো সংবাদ



premium cement