২৯ এপ্রিল ২০২৪, ১৬ বৈশাখ ১৪৩১, ১৯ শাওয়াল ১৪৪৫
`


অকুতোভয় এক মুফতির সংগ্রামী আলেখ্য

লেখক ড. আ ফ ম খালিদ হোসেন। - ফাইল ছবি

হিজরি সপ্তম শতাব্দীর মুহাদ্দিস, ইসলামী ফিক্হ বিশারদ শায়খুল ইসলাম আল্লামা ইয্যুদ-দীন ইব্ন আবদুস সালামের নাম মুসলমানরা ভুলতে বসেছে। ৫৭৮ হিজরি সনে সিরিয়ার রাজধানী দামেস্কে তিনি জন্মগ্রহণ করেন। কুরআন, হাদিস ও ফিক্হে সুগভীর পাণ্ডিত্য, অনুপম তাক্ওয়া, স্বৈরাচারের সামনে সত্যকথনে দৃঢ়চিত্ততার কারণে সমসাময়িক উলামায়ে কেরাম ‘সুলতানুল উলামা’ নামে তাকে অভিহিত করেন। শায়খ জামালুদ-দীন ইব্ন হাজিবের মতে ইসলামী ফিক্হে আল্লামা ইয্যুদ-দীন এর সুগভীর মনীষা ও বিশ্লেষণধর্মী পাণ্ডিত্য ইমাম গাযালিকে ছাড়িয়ে গেছে। তার সৌভাগ্য যে তিনি শায়খ ফখরুদ্দিন ইব্ন আসাকির, সাইফুদ-দীন আমদী, হাফিয আবু মুহাম্মদ ইব্ন আসাকির ও শায়খ আবুল হাসান শামলীর মতো বিশ্ববরেণ্য আলিমদের নিকট শিক্ষা লাভ করেন। দীর্ঘদিন তিনি গাযালিয়া ইসলামী শিক্ষা নিকেতনে শিক্ষকতার গুরু দায়িত্ব অত্যন্ত নিষ্ঠার সাথে পালন করেন এবং একই সময়ে দামেস্কের ঐতিহাসিক উমাইয়া মসজিদের খতিব ছিলেন। তার ওয়ায ও নসিহতের ফলে দামেস্কে প্রচলিত বহু বিদ্’আত ও ধর্মীয় কুসংস্কারের অবসান ঘটে। সিরিয়ার সুলতান আল-মালিকুল কামিলের আমলে তিনি দামেস্কের আদালতে বিচারক নিযুক্ত হন এবং একবার রাষ্ট্রদূত হিসেবে বাগদাদে খলিফার দরবারে প্রেরিত হন। তরিকতের অন্যতম ইমাম শায়খ শাহাবুদ্দীন সোহরাওয়ার্দীর নিকট তিনি আধ্যাত্মসাধনার দীক্ষা ও খিলাফত লাভ করেন।
শিক্ষক, মুফ্তি ও বিচারপতি হওয়ার পাশাপাশি গ্রন্থকার হিসেবেও তার সবিশেষ খ্যাতি রয়েছে। মুসলিম বিশ্বে তার লিখিত গ্রন্থাবলির মধ্যে ‘মাজমুয়া ফাতাওয়া’ ‘আল কাওয়াইদুল কুবরা’ ‘মাজাযুল কুর‘আন’ ‘শাজারাতুল মা‘য়ারিফ’ ও ‘আদ-দালায়িলুল মুতা‘য়াল্লাকা’ বিদগ্ধ পণ্ডিতদের নিকট অতি মূল্যবান গবেষণাকর্ম হিসেবে স্বীকৃত। ইব্ন সুবকি শেষোক্ত গ্রন্থ দু’টি সম্পর্কে মন্তব্য করেন যে, উক্ত কিতাবদ্বয় ইমামত ও উলুমে শরীয়তে লেখকের উচ্চতর মর্যাদার সাক্ষ্য বহন করে। শাহ ওয়ালি উল্লাহ দেহলভী তার গ্রন্থ ‘হুজ্জাতুল্লাহ্ আল-বালেগাহ্’ এর ভূমিকায় বিশেষ যে তিনজন বড় আলিমের নাম উল্লেখ করেন, তাদের মধ্যে শায়খুল ইসলাম ইয্যুদ-দীন ইব্ন আবদুস সালাম অন্যতম। অপর দু’জন হচ্ছেন, ইমাম গাযালী ও আবু সুলাইমান খাতাবী (হুজ্জাতুল্লাহ্ আল-বালেগাহ্,পৃ.৮৪)।

ইলম, অভিজ্ঞতা ও প্রজ্ঞার পাশাপাশি আল্লামা ইয্যুদ-দীন এর চরিত্রে পরোপকার, বদান্যতা ও সহৃদয়তার মতো মহৎ গুণাবলী ছিল অনেকের নিকট শ্লাঘার বিষয়। দামেস্কে একবার ভীষণ মুদ্রাস্ফীতি দেখা দিলে বিভিন্ন ফলের বাগান সস্তা দামে বিক্রি হতে থাকে। শায়খের সহধর্মিণী নিজের একটি দামি গহনা তাকে দিয়ে বললেন, এটা দিয়ে একটি বাগান কিনে নাও। খরা ও গ্রীষ্মের মৌসুমে আমাদের কাজে আসবে। শায়খ স্বর্ণালঙ্কারটি বিক্রি করে পুরো অর্থ গরিব মিসকিনদের মধ্যে বিলিয়ে দেন। স্ত্রী জিজ্ঞাসা করেন, বাগান কেনা হয়েছে কী? শায়খ জবাব দিলেন : হ্যাঁ, কিনেছি তবে জান্নাতে। আমি দেখলাম দ্রব্যমূল্য বৃদ্ধির ফলে সাধারণ মানুষের নাভিশ্বাস উঠেছে। দুর্দশাগ্রস্ত মানুষের কল্যাণে আমি সব টাকা দান করে দিয়েছি। পুণ্যবতী স্ত্রী জবাব শুনে বলেন, ‘অল্লাহ পাক আপনাকে উত্তম প্রতিদানে ভূষিত করুন’ ন্যায় কাজের আদেশ ও অন্যায় কাজের প্রতিরোধ (‘আমর বিল মা’রুফ ওয়া নাহি আনিল মুনকার’) গোমরাহী ও বিদ’আতের প্রকাশ্য বিরোধিতা আলিমদের জন্য ফরজ বলে তিনি বিশ্বাস করতেন। তার মতে ‘এই দায়িত্ব পালন করতে গিয়ে সমূহ বিপদ ও দুঃখকে হাসি মুখে বরণ করে নিতে হবে। ইলম ও ভাষাজ্ঞান হচ্ছে উলামাদের হাতিয়ার। দীনের মর্যাদা বৃদ্ধি ও দীনকে বিজয়ী করার জন্য প্রয়োজনে জীবনকে বাজি রেখে মুশরিকদের প্রতিরক্ষা ব্যুহ ভেঙে ফেলতে হবে। যে ব্যক্তি নিজের প্রাণের চাইতে আল্লাহকে প্রাধান্য দেবে, আল্লাহ তায়ালা তাকে অন্যদের তুলনায় অধিকতর প্রাধান্য দেবেন, আল্লাহর সন্তুষ্টি থাকবে তার পক্ষে, জনগণকে সন্তুষ্ট করার জন্য যে ব্যক্তি ব্যস্ত হয়ে পড়ে, আল্লাহর রোষ পতিত হবে তার ওপর এবং আল্লাহ তা’য়ালা জনগণকে তার প্রতি বিদ্রোহী করে দেবেন।’ তৎকালীন সিরিয়ার বাদশাহ সালিহ ইসমাঈল আশঙ্কা করেন যে, যেকোনো মুহূর্তে মিসরের বাদশাহ নাজমুদ-দীন আয়ুব তার দেশে হামলা চালাতে পারেন। মিসরীয় হামলা প্রতিরোধে তিনি খ্রিষ্টান সৈন্যদের সাহায্য কামনা করে এক চুক্তি সম্পাদন করেন। চুক্তিবলে খ্রিষ্টান সৈন্যরা দলে দলে সিরিয়ার বাজার হতে অস্ত্র কিনতে লাগল। সে সময় সিরিয়া ছিল আধুনিক অস্ত্র ও গোলা বারুদ উৎপাদন ও বিপণনের আন্তর্জাতিক বাজার। অস্ত্র ব্যবসায়ীগণ শায়খ ইয্যুদ-দীন এর নিকট ফতোয়া তলব করেন। তিনি ফতোয়া জারি করে বলেন, ‘খ্রিষ্টানগণ এসব অস্ত্রশস্ত্র কিনে মুসলমানদের বুকে চালাবে তাই মুসলমানদের জন্য খ্রিষ্টানদের নিকট অস্ত্র ও গোলাবারুদ বিক্রি করা হারাম।’ দামেস্কের উমাইয়া মসজিদের মিম্বরে দাঁড়িয়ে তিনি অত্যন্ত জোরালো ভাষায় তার প্রদত্ত ফতোয়ার বিভিন্ন দিক বিশ্লেষণ করেন।
খোতবায় বাদশাহর জন্য দোয়া করা বন্ধ করে দেন। তিনি অত্যন্ত জোশের সাথে মুসলিমদের নিয়ে দোয়া করেন, ‘হে আল্লাহ! ইসলাম ও ইসলামের অনুগামীদের তুমি সাহায্য করো, ইসলামের দুশমনদের তুমি ধ্বংস করে দাও।’
এটা ছিল সিরিয়ার বাদশাহর প্রতি প্রচণ্ড ধরনের আঘাত। আল্লামা ইয্যুদ-দীন ইব্ন আবদুস সালাম এর ঈমানদীপ্ত ঘোষণার কারণে রুষ্ট হয়ে বাদশাহ তাকে গ্রেফতারের করে কারাগারের অন্ধ প্রকোষ্ঠে নিক্ষেপ করেন। এ দিকে অস্ত্র উৎপাদনকারী ও ব্যবসায়ীরা শায়খের ফতোয়ার কারণে খ্রিষ্টানদের নিকট অস্ত্র বিক্রি বন্ধ করে দেন। বহু দিন তিনি কারাগরে বন্দী ছিলেন, সিরিয়ার সাধারণ জনগণের ভক্তি দিন দিন শায়খের প্রতি বৃদ্ধি পেতে থাকে এবং বাদশাহর জনপ্রিয়তা দ্রুত নিম্নগামী হয়ে পড়ে। অবনতিশীল পরিস্থিতি অনুধাবন করে বাদশাহ্ শায়খের সাথে আপস রফার এক ফর্মুলা বের করেন। ইতোমধ্যে বাদশাহ সালেহ ইসমাঈল হিম্স প্রদেশের গভর্নর আল-মানসুর সমভিব্যাহারে জেরুসালেম নগরী আসেন। এক দিন বাদশাহ জনৈক মন্ত্রীকে নিজের একটি রুমাল দিয়ে নির্দেশ দেন যে, তিনি রাতের বেলা কারাগারে গিয়ে উক্ত রুমালটি শায়খকে হাদিয়া হিসেবে পেশ করবেন এবং তোষামোদ করে তাকে বলবেন তিনি যেন বাদশাহর সাথে একটি সম্মানজনক আপস রফায় উপনীত হন। তিনি যদি প্রস্তাবে সম্মত হন তা হলে তার হারানো চাকরি ও পদ ফিরিয়ে দেয়া হবে আর তিনি যদি প্রস্তাব প্রত্যাখ্যান করেন তা হলে কারাগারে হতে এনে প্রাসাদসংলগ্ন অপর একটি কক্ষে তাকে যেন বন্দী করে রাখা হয়। সিদ্ধান্ত অনুযায়ী গভীর রাতে মন্ত্রী জেরুশালেম কারাগারে অন্তরীণ শায়খের প্রকোষ্টে হাজির হন এবং অত্যন্ত বিনয় ও তোষামোদের সাথে তার সাথে আলাপ করেন। মন্ত্রী তাকে বললেন কারাগারের নিকটবর্তী রাজকীয় প্রাসাদে বাদশাহ অবস্থান করছেন, আপনি যদি বাদশাহর দরবারে গিয়ে তার হাতে চুমো দেন তা হলে সব ভুল বুঝাবুঝির অবসান ঘটবে আর আপনি পুরনো চাকরি, পদ, বেতন ও অপরাপর সুযোগ সুবিধা বর্ধিত আকারে পাবেন। আপসের এই হীন প্রস্তাব শুনে শায়খ ইয্যুদ-দীন জেলখানার ভিতরে চিৎকার দিয়ে যে বক্তব্য রাখেন তা ইতিহাসে সোনালী অক্ষরে উৎকীর্ণ করে রাখার মতো। শায়খ বলেন, ‘আল্লাহর কসম! আরে বেকুব, বাদশাহর হাতে চুমো দিয়ে ক্ষমা চাইব এটা তো দূরের কথা, বাদশাহ যদি স্বয়ং আমার কক্ষে এসে আমার হাতে চুমো দিতে চান আমি তাতে রাজি হবো না। তোমরা এক জগতের বাসিন্দা, আমি আরেক জগতের। আল্লাহর শোকরিয়া, তোমরা যেভাবে মানব বন্দনায় ব্যস্ত আমি তা হতে মুক্ত’ (সায়্যিদ আবুল হাসান আলী নদভী, তারিখে দাওয়াত ওয়া আযিমাত, মাজলিসে নাশরিয়াতে ইসলাম, লক্ষ্মৌ, ১৯৮২, ১ খণ্ড., পৃ.৩৭৬-৩৯৪)।

বাদশাহর নির্দেশ মতো মন্ত্রী শায়খকে বন্দী করে রাজপ্রাসাদে নিয়ে আসেন। শায়খের কক্ষ আর বাদশাহর কক্ষ পাশাপাশি। প্রায় সময় তিনি পবিত্র কুরআন মজিদ তেলাওয়াতে মশগুল থাকতেন। একদা খ্রিষ্টান প্রতিনিধি ও সৈন্যদের সম্বোধন করে বাদশাহ বলেন, তোমরা কী কুরআন তিলাওয়াতের আওয়াজ শুনতে পাচ্ছো? তারা জবাব দিলেন হ্যাঁ। বাদশাহ বলেন, তেলাওয়াতকারী কে তা কি তোমরা জান? তিনি সে ব্যক্তি যিনি ফতোয়া দিয়ে তোমাদের কাছে অস্ত্র বিক্রি বন্ধ করে দিয়েছেন। তিনি মুসলমানদের বড় ইমাম। আমি তাকে বিচারক ও মসজিদের খতিবের পদ হতে বহিষ্কার করে কারাগারে বন্দী করে রেখেছি। তোমাদের স্বার্থে তাকে দামেস্ক নগরী হতে বের করে দিয়েছি। খ্রিষ্টানগণ এ জবাব শুনে বলেন যে, ‘এ রকম দৃঢ়চেতা মানুষ যদি আমাদের পাদ্রীদের মধ্যে থাকত তা হলে তার পা ধুয়ে আমরা পানি পান করতাম।’

ইত্যবসরে মিসরীয় সৈন্যরা দামেস্কে অভিযান চালিয়ে সালিহ ইসমাঈলকে পরাজিত করে। খ্রিষ্টান সৈন্যদের আগ্রাসী থাবা স্তব্ধ হয়ে যায়। শায়খ কারাগার হতে মুক্তি পেয়ে সহিহ সালামতে মিসরের উদ্দেশ্যে যাত্রা করেন। মিসরের বাদশাহ নাজমুদ-দীন শায়খের হাতে বাইয়াত গ্রহণ করে তাকে আমর ইব্নুল আস মসজিদের খতিব, মিসরের আদালতের বিচারক এবং জরাজীর্ণ মসজিদগুলোর রক্ষণাবেক্ষণ ও সংস্কার বিভাগের প্রধান হিসেবে নিয়োগ দান করেন। পরবর্তীতে বাদশাহ যখন সালিহিয়্যা মাদরাসা প্রতিষ্ঠা করেন, তখন শাফেয়ী মাযহাবের শিক্ষা দেয়ার দায়িত্ব শায়খের ওপর অর্পণ করেন। ফখরুদ-দীন ওসমান নামক জনৈক ব্যক্তি যিনি রাজপ্রাসাদের তত্ত্বাবধায়ক ছিলেন একবার বাদ্যযন্ত্র অনুশীলনের জন্য মিসরের একটি মসজিদের ছাদের উপর তবলাখানা নির্মাণ করেন। শায়খের কানে যখন এই সংবাদ পৌঁছল তখন তদন্তের মাধ্যমে মসজিদের উপরে নির্মিত তবলাখানা ভেঙে ফেলার নির্দেশ দেন। মসজিদে তবলাখানা নির্মাণের অভিযোগে ফখরুদ্দীন উসমানের সাক্ষ্য অগ্রহণযোগ্য ঘোষণা করে এক নির্দেশ জারি করেন এবং তিনি বিচারকের পদ হতে ইস্তেফা দেন। না হক ও অসত্যের বিরুদ্ধে পরিচালিত শায়খের এই জিহাদী ভূমিকায় রাজদরবারে ও দেশের সাধারণ মানুষের মধ্যে শায়খের ইজ্জত ও মর্যাদা আরো বৃদ্ধি পায়। একদা ঈদের দিন রাজকীয় দুর্গের অভ্যন্তরে সৈন্যদের কুচকাওয়াজ চলছিল বাদশাহ স্বয়ং রেশমের চাদরে আবৃত আসনে সমাসীন। আমির, উমরাহ, সেনা অফিসার, কর্মকর্তারা বাদশাহকে সালাম জানাচ্ছেন। কেউ কেউ সিজদা করতেও কুণ্ঠিত হননি। এ দৃশ্য দেখে শায়খ ইয্যুদ-দীন স্থির থাকতে পারেননি। তিনি এই পূর্ণ দরবারে ডাক দিয়ে বলেন :
‘আয়ুব! আল্লাহকে কী জবাব দেবেন? কিয়ামতের দিন আল্লাহ যদি জিজ্ঞাসা করেন আমি তোমাদেরকে মিসরের রাজত্ব দিয়েছিলাম যে, স্বাধীনভাবে সবাই মদ পান করতে পারবে? বাদশাহ জানতে চাইলেন ঘটনা কী? শায়খ বলেন, অমুক শরাবখানায় বেপরোয়া ভাবে মদপানের আসর বসে এবং আরো কত অসামাজিক কার্যকলাপ চলে তার খবরাখবর তো আপনার থাকার কথা নয়? আপনি তো আরাম আয়েশের সাগরে হাবুডুবু খাচ্ছেন। বাদশাহ জবাবে বলেন :
জনাব! এতে আমার কিছু করার নেই। আমার পিতার শাসনকাল হতে এসব চলে আসছে। শায়খ বলেন আপনিও তাদের মতো বলছেন? যাদের সম্পর্কে কুরআনে বর্ণিত হয়েছে, ইন্না ওয়াজাদনা আ’বাআনা আলা উম্মাতিন (এসব আমাদের বাপ-দাদাদের যুগ ধরে অব্যাহত রয়েছে)। বাদশাহ তাৎক্ষণিকভাবে শরাবখানা বন্ধের নির্দেশ জারি করেন।

শাহী দরবার হতে গৃহপ্রত্যাবর্তনের পথে এক শিষ্য শায়খের নিকট জানতে চাইলেন ঘটনা কী? তিনি বলেন, বাদশাহ যে ভাবে শান-শওকতের সাথে দরবারে আসীন ছিলেন। মানুষ যেভাবে কুর্ণিশ করছিল। তাতে আমার আশঙ্কা হয় হয়তো এতে তার মধ্যে অহংবোধের সৃষ্টি হতে পারে এবং প্রবৃত্তির তাড়না জাগ্রত হতে পারে। আমি তাকে সংশোধন করার জন্য এ সব কথা বলেছি। শিষ্য জানতে চাইলেন এসব কথা বলার সময় আপনার মনে কোন রূপ ভীতির উদ্রেক হয়নি? শায়খ বলেন, মহান আল্লাহর শান-শওকত ও মর্যাদা আমার অন্তরে এমন ভাবে জাগ্রত ছিল যে, এর সামনে বাদশাহকে মনে হয়েছে অসহায় বিড়াল।

হিজরি সপ্তম শতাব্দীতে মোঙ্গলদের জুলুম, আক্রমণ ও ধ্বংসাত্মক তৎপরতা মুসলমানদের মনে ত্রাসের সৃষ্টি করে। মোঙ্গলদের হাতে বাগদাদ ধ্বংসের স্মৃতি মুসলমাদের হৃদয়ে দগদগে ঘায়ের মতো ছিল বেদনাদায়ক। ইতোমধ্যে খবর পাওয়া গেল যে, মোঙ্গলশক্তি মিশর অভিমুখে অভিযান চালাবার পরিকল্পনা করছে। মিসরের বাদশাহ ও জনগণ মোঙ্গল আগ্রাসনের মোকাবেলা করার সাহস হারিয়ে ফেলেন। আল্লামা শায়খ ইয্যুদ-দীন ইব্ন আবদুস সালাম মুসলমানদের অভয় দিয়ে ঘোষণা করেন, ‘আল্লাহর নাম নিয়ে বের হও!’ বাদশাহ বলেন, যুদ্ধ পরিচালনার মতো অর্থ আমার কোষাগারে নেই, আমি ব্যবসায়ীদের নিকট হতে ঋণ নিতে চাই। শায়খ বলেন, রাজকীয় মহলের অভ্যন্তরে শাহী কর্মকর্তা ও কর্মচারীদের ঘরে যেসব বৈধ-অবৈধ অর্থ ও স্বর্ণালঙ্কার রয়েছে সেগুলো প্রথমে হাজির করা হোক। এর পর যদি অর্থসঙ্কট থাকে তা হলে কর্জ নেয়ার কথা চিন্তা করা যেতে পারে। শায়খের অপ্রতিহত প্রভাবে আমির-ওমরাহগণ বিনাবাক্য ব্যয়ে নিজ নিজ স্ত্রীদের স্বর্ণালঙ্কার শায়খের সামনে হাজির করেন। এগুলো দিয়ে যুদ্ধের ব্যয়ভার মিটে যায়। আল্লাহর মেহেরবাণীতে মুসলমানরা বিজয়ী হয়।

৫৬০ হিজরি সালে ৮৩ বছর বয়সে এই বীর মুজাহিদ মিসরে ইন্তেকাল করেন। শায়খের লাশ যখন দুর্গের নিচ দিয়ে কবরস্থানে নিয়ে যাওয়া হচ্ছিল তখন বিপুল জনসমাগম দেখে মিসরের সম্রাট রুকন উদ্দিন বাইবার্স (১২২৩-১২৭৭) মন্তব্য করেন যে, ‘আজ আমার রাজত্ব সুদৃঢ় হলো। জনগণের উপর শায়খের যে অপ্রতিহত প্রভাব তিনি ইশারা করলে জনগণ আমাকে ক্ষমতা থেকে টেনে নামিয়ে ফেলত।’ বাইবার্স শায়খকে অত্যন্ত সম্মানও মর্যাদার চোখে দেখতেন।

লেখক : অধ্যাপক ও গবেষক
drkhalid09@gmail.com


আরো সংবাদ



premium cement