২৭ এপ্রিল ২০২৪, ১৪ বৈশাখ ১৪৩১, ১৭ শাওয়াল ১৪৪৫
`

গার্মেন্ট পণ্য নকলের অভিযোগ নতুন চাপ আসছে কি

গার্মেন্ট পণ্য নকলের অভিযোগ নতুন চাপ আসছে কি! - ছবি : সংগৃহীত

সরকারের ওপর নতুন চাপ আসছে কি না তাই নিয়ে জল্পনা চলছে রাজনৈতিক পর্যবেক্ষকদের মধ্যে। নতুন এই জল্পনার উৎস বাংলাদেশে তৈরী পোশাক পণ্যের বিরুদ্ধে নকলের অভিযোগ। অভিযোগ এসেছে যুক্তরাষ্ট্রের পক্ষ থেকে। মার্কিন ব্র্যান্ডগুলোর সংগঠন আমেরিকান অ্যাপারেল অ্যান্ড ফুটওয়্যার অ্যাসোসিয়েশন (এএএফএ) ও প্যারিসের শ্রমিক ইউনিয়ন ডেস ফেব্রিক্সের (ইউনিফ্যাব) অভিযোগের ভিত্তিতে যুক্তরাষ্ট্র এ অভিযোগ দিয়েছে বাংলাদেশ সরকারের কাছে। যুক্তরাষ্ট্রের বাণিজ্য কর্তৃপক্ষ ইউনাইটেড স্টেটস ট্রেড রিপ্রেজেন্টেটিভ (ইউএসটিআর) গত ১০ ফেব্রæয়ারি বাণিজ্য মন্ত্রণালয়কে চিঠি দিয়ে জানিয়েছে, কথিত অভিযোগ তারা খতিয়ে দেখবে।

অভিযোগটি মূলত মেধাস্বত্ব সম্পর্কিত আন্তর্জাতিক আইন লঙ্ঘনের। বাংলাদেশ যদি সত্যি বিশ্বের বড় বড় কোম্পানির ব্র্যান্ডের পণ্য নকল করে থাকে তা হলে তাতে মেধাস্বত্ব আইন লঙ্ঘন হয়েছে। আর নকলবিরোধী আইন তো লঙ্ঘন হয়েছেই।

এএএফএ’র অভিযোগে বলা হয়েছে, ২০২২ সালে বাংলাদেশে প্রস্তুত করা ৫৬টি নকল পণ্যের চালান জব্দ করা হয়েছে, ২০২১ সালের চেয়ে যা ৫০ শতাংশ বেশি। এর অর্থ হলো- ১০-১১ বছর ধরেই এই নকলবাজি চলছে। নকলের অভিযোগ একা বাংলাদেশের বিরুদ্ধেই নয়। আরো অনেক দেশের বিরুদ্ধে এমন অভিযোগ আছে। শোনা যায় চীন, ভিয়েতনাম, কম্বোডিয়া, ইন্দোনেশিয়া, থাইল্যান্ড, তুরস্কসহ বেশ কয়েকটি দেশের বিরুদ্ধে একই ধরনের অভিযোগ। আর নকল পণ্য যেসব দেশে সরবরাহ করা হয়েছে বলে বলা হচ্ছে, তার মধ্যে আছে অস্ট্রেলিয়া, ইতালি, মালয়েশিয়া, ত্রিনিদাদ ও টোবাগো, জাপান, সংযুক্ত আরব আমিরাত, যুক্তরাজ্য, যুক্তরাষ্ট্র, রোমানিয়া, সৌদি আরব, জার্মানি ও ফিলিপাইনসহ ১২টি দেশ। এই দেশগুলোতে বিভিন্ন সময়ে বাংলাদেশের তৈরী নকল পোশাক জব্দ করা হয়েছে। মালয়েশিয়ায় ২০২২ সালে ১৭টি অভিযানে প্রায় পৌনে দুই লাখ পোশাক জব্দ করা হয়, যার পুরোটাই বাংলাদেশে তৈরি করা নকল পণ্য।

এ নিয়েই গার্মেন্ট খাতে চলছে তোলপাড়। রাজনৈতিক মহলে জল্পনা। ইউরোপ, আমেরিকার দু’টি প্রতিষ্ঠান নকলের অভিযোগ তোলায় আমেরিকার বাজারের পাশাপাশি ইউরোপে পোশাক রফতানিতেও বিরূপ প্রভাব পড়ার আশঙ্কা করা হচ্ছে। কারণ, অভিযোগে প্রমাণ পেলে যুক্তরাষ্ট্র শাস্তিমূলক ব্যবস্থা নিতে পারে। সম্ভাব্য শাস্তিমূলক ব্যবস্থার মধ্যে রয়েছে- যুক্তরাষ্ট্রে বাজারে বাংলাদেশের তৈরী পোশাক রফতানির ওপর কোটা আরোপ, বাড়তি শুল্কারোপ এমনকি পুরোপুরি নিষেধাজ্ঞা আরোপ।

সবাই জানেন, যুক্তরাষ্ট্র বাংলাদেশে তৈরী পোশাকের একক বৃহত্তম ক্রেতা। দেশটি যে পরিমাণ তৈরী পোশাক আমদানি করে তার ১০ শতাংশ যায় বাংলাদেশ থেকে। যুক্তরাষ্ট্র আমদানি করে বছরে ১০০ বিলিয়ন ডলারের পোশাক। বাংলাদেশ থেকে যায় ১০ বিলিয়ন ডলারের। টাকার অঙ্কে বললে ব্যাপারটি বোঝা অনেকের জন্য সহজ হবে। বাংলাদেশ ব্যাংকের তথ্য অনুযায়ী, ২০২১-২২ অর্থবছরে তৈরী পোশাক রফতানি হয়েছে দুই লাখ ৮২ হাজার ৬৩৯ কোটি টাকার। এর মধ্যে যুক্তরাষ্ট্রে গেছে ৫৯ হাজার ৬২৪ কোটি ১০ লাখ টাকার পোশাক, যা মোট পোশাক রফতানির প্রায় ২১ শতাংশ। যুক্তরাষ্ট্রের অফিস অব টেক্সটাইলস অ্যান্ড অ্যাপারেলের (ওটেক্সা) তথ্য অনুযায়ী, ২০২২ সালে দেশটিতে বাংলাদেশের পোশাক রফতানি ২০২১ সালের আগের বছরের চেয়ে ৩৬.৪ শতাংশ বেড়ে প্রায় ১০ বিলিয়ন ডলারে পৌঁছেছে।

এটিও সত্য যে, আমাদের মোট রফতানি আয়ের ৮২ শতাংশেরও বেশি আসে তৈরী পোশাক থেকে। সুতরাং গার্মেন্ট পণ্য রফতানির ওপরই বাংলাদেশের অর্থনীতি টিকে আছে, এ কথা বললে অত্যুক্তি হবে না।
ডলার সঙ্কটে দেশের অর্থনীতি যখন সঙ্কুচিত হয়ে আসছে; জরুরি পণ্য আমদানির জন্য এলসি খোলার সামর্থ্যও লোপ পাওয়ার উপক্রম হয়েছে ব্যাংকগুলোর। সেই মুহূর্তে তৈরী পোশাক নকলের অভিযোগ বিনা মেঘে বজ্রপাতের মতোই মনে করেন অনেকে।

ইউএসটিআর অভিযোগের বিষয়ে ১৩ ফেব্রুয়ারির মধ্যে বাংলাদেশের জবাব পেতে চেয়েছিল। সরকার একটি জবাব দিয়েছে। তবে এটি প্রাথমিক জবাব। বাংলাদেশের বাণিজ্য মন্ত্রণালয়ে বিশ্ব বাণিজ্য সংস্থা (ডব্লিউটিও) সম্পর্কিত যে শাখা আছে সেই শাখা থেকে প্রাথমিক মতামত দেয়া হয়েছে এবং বিস্তারিত জানানোর জন্য ১৫ দিনের সময় চাওয়া হয়েছে। সেই মোতাবেক আগামী ২৮ তারিখের মধ্যে চূড়ান্ত বক্তব্য জানাবে বাংলাদেশ।

পত্রপত্রিকার রিপোর্ট থেকে জানা যাচ্ছে, প্রাথমিক জবাবে সরকার বাংলাদেশে নকল প্রতিরোধে বিদ্যমান বিভিন্ন আইন কানুনের উল্লেখ করেছে এবং এ ক্ষেত্রে আইনে কী কী শাস্তির বিধান আছে সেগুলো তুলে ধরেছে। শুধু এটুকুই নয়, যুক্তরাষ্ট্র নকলের অভিযোগ খতিয়ে দেখার বা পর্যালোচনার যে উদ্যোগ নিয়েছে সে বিষয়ে আপত্তি জানিয়েছে বাণিজ্য মন্ত্রণালয়। প্রমাণ ছাড়া এ ধরনের অভিযোগ তোলা ‘অযৌক্তিক, অন্যায্য ও ক্ষতিকর’ বলেও চিঠিতে উল্লেখ করা হয়েছে।

বাংলাদেশের গার্মেন্ট মালিকরা উদ্বিগ্ন। তবে যেসব গার্মেন্ট কারখানা বিজিইএমএ ও বিকেএমইএ’র সদস্য তারা নকলের দায় নিতে চান না। তারা বলছেন, কারো বিরুদ্ধে যদি সুনির্দিষ্ট অভিযোগ পাওয়া যায়, তাহলে অবশ্যই সরকার এবং বিকেএমইএ-বিজেএমই তাদের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নেবে। বাংলাদেশ নিটওয়্যার ম্যানুফ্যাকচারার্স অ্যান্ড এক্সপোর্টার্স অ্যাসোসিয়েশনের (বিকেএমইএ) নির্বাহী সভাপতি মোহাম্মদ হাতেম গত সপ্তাহে নয়া দিগন্তের প্রতিবেদককে বলেন, ‘বিএকেএমইএ-বিজেএমইএ কোনোভাবেই এটিকে ওউন করে না। আমরা সরকারকে বলেছি, যদি বাংলাদেশে এ ধরনের কিছু হয় তাহলে তা বন্ধ করার জন্য সরকারের যা করা প্রয়োজন তা করতে হবে।’

বাণিজ্যমন্ত্রী ও বিজিএমইএ সভাপতি প্যারিসে গেছেন। ধারণা করা হচ্ছে, অভিযোগের বিষয়ে আলোচনা করতেই তাদের এ সফর। এ দিকে আজ ২২ ফেব্রুয়ারি ওয়াশিংটনে ইউএসটিআরের উন্মুক্ত শুনানি হওয়ার কথা রয়েছে।
মালিক সমিতির নেতারা যাই বলুন না কেন, বাংলাদেশে যে নকল পণ্য তৈরি হয় তাতে সন্দেহ সামান্যই। অনেক আগে থেকেই নানাভাবে এটি হচ্ছে। যেমন- মান নিয়ন্ত্রণ করতে গিয়ে অনেক সময় কিছু পণ্যে ত্রুটি দেখা দেয়। সেই ঘাটতি পূরণে সর্বোচ্চ ৩ শতাংশ পর্যন্ত অতিরিক্ত পণ্য তৈরি করা হয়। এই অতিরিক্ত পণ্য কোনো ক্রেতাই নেন না। ফলে স্টক লট তৈরি হয়। এগুলো লট আকারে দেশের ভেতরেই বিক্রি করা হয়। সেই পণ্যে কেউ কোনো কোম্পানির নকল লোগো লাগিয়ে বিদেশে রফতানি করতে পারে।

এমনও ঘটে যে, কিছু অসাধু গার্মেন্ট ব্যবসায়ী ঠিক সময়ে পণ্য ডেলিভারি করেন না। এতে ক্রেতা ক্ষতি স্বীকার করেও অর্ডার বাতিল করে। এটি হলো, ইচ্ছাকৃতভাবে অর্ডার বাতিল করানোর কৌশল। পরে গার্মেন্ট ব্যবসায়ী বাতিল হওয়া পণ্য স্টক লট হিসেবে বিক্রি করেন। স্টক লটের সব পণ্য কেবল স্থানীয় বাজারেই ছাড়া হয়, এমন নয়। বাতিল হওয়া বিপুল পণ্য তারা উচ্চমূল্যে বিদেশে বিক্রি করেন না, এমন নিশ্চয়তা কেউ দিতে পারবেন না। বেশি মুনাফার লোভেই অসাধু মালিকরা ইচ্ছা করে অর্ডার বাতিল করান। এসব অনিয়ম হয়ে আসছে আগে থেকেই। সবাই জানেন। আর নকল পোশাক রফতানির একটি আন্তর্জাতিক চক্রও যে আছে তা তো কারো অজানা নয়।

পলিসি রিসার্চ ইনস্টিটিউটের (পিআরআই) গবেষণা পরিচালক ড. এম এ রাজ্জাক মিডিয়াকে বলেন, ‘যুক্তরাষ্ট্র-চীন টেকনোলজি ওয়ার ইতোমধ্যে শুরু হয়ে গেছে, যার নেতিবাচক প্রভাব পড়বে আমাদের মতো ভালনারেবল দেশগুলোতে। আইপিআর (মেধাস্বত্ব) ইস্যুতে যুক্তরাষ্ট্র এখন অনেক বেশি আগ্রাসী। তাই এএএফএ এবং ইউনিফ্যাবের অভিযোগগুলো বাংলাদেশকে ভালোভাবে খতিয়ে দেখতে হবে।’ বাংলাদেশে বিশ্বব্যাংকের সাবেক মুখ্য অর্থনীতিবিদ ড. জাহিদ হোসেন বলেন, নকল পণ্য সরবরাহের অভিযোগ বাংলাদেশকে গুরুত্বের সাথে খতিয়ে দেখে দোষীদের বিরুদ্ধে দৃষ্টান্তমূলক ব্যবস্থা নিতে হবে। না হলে বাংলাদেশের তৈরী পোশাক রফতানি হুমকির মুখে পড়বে।

কিন্তু সমস্যা হলো, অভিযোগের এই সময়টা বাংলাদেশের জন্য তাৎপর্যপূর্ণ। অর্থনীতির অবস্থা অনেকটাই নাজুক। রিজার্ভ নিম্নগামী। রফতানি আয়, রেমিট্যান্স কমেছে। অনিয়ম, অব্যবস্থাপনা ও ঋণখেলাপির চাপে ব্যাংক খাত ধরাশায়ী। আইএমএফের কাছ থেকে যা পাওয়া যাচ্ছে তা মরুভূমিতে এক পশলা বৃষ্টিমাত্র। নতুন বিনিয়োগ নেই বললেই চলে। এ অবস্থায় সামনে নির্বাচন। নির্বাচন অবাধ, সুষ্ঠু ও নিরপেক্ষ করা, মানবাধিকার ও গণতান্ত্রিক প্রক্রিয়া সমুন্নত রাখার বিষয়ে যুক্তরাষ্ট্র এক বছরের বেশি সময় ধরে সরকারের ওপর চাপ দিয়ে আসছে। র‌্যাব ও এর শীর্ষ কর্মকর্তাদের ওপর নিষেধাজ্ঞা থেকে শুরু করে ঢাকায় মার্কিন রাষ্ট্রদূত পিটার হাসের ঘেরাও হওয়া পর্যন্ত একের পর এক নানা ঘটনা কোনো লুকোছাপার বিষয় হয়ে থাকেনি। সরকারও নানা সময়ে এসব নিয়ে উষ্মা প্রকাশ করেছে।

এমন একটি সময়ে তৈরী পোশাক নকলের অভিযোগ খতিয়ে দেখার বিষয়টিকে অনেকেই যুক্তরাষ্ট্রের চলমান চাপের সাথে বাড়তি সংযোজন বলে মেলাতে চাইছেন। ব্যাপারটি সরকারের জন্য উভয় সঙ্কটের মতো। অর্থনৈতিক টানাপড়েনের কারণে উত্তরের দেশ চীনের সাথে সম্পর্ক চুকিয়ে দেয়া যেমন সম্ভব নয়, তেমনি ইন্দো-প্যাসিফিক কৌশলে বাংলাদেশকে পাশে পাওয়ার পরোক্ষ পশ্চিমা চাপ এড়ানোও অসম্ভবের কাছাকাছি। অর্থনৈতিক দুরবস্থা কাটাতে চীন ত্রাতার ভূমিকা নিতে পারে বলে সরকারের মতো অনেক বিশ্লেষকেরও ধারণা। সরকার কি পারবে সেই একই ভূমিকা নিতে যুক্তরাষ্ট্র ও পাশ্চাত্যকে রাজি করাতে? সেটিই এখন দেখার।

শেষকথা : সরকার পশ্চিম বা উত্তর যে দিকেই নজর ফেরাক, দেশবাসীর জন্য কোনোটিই স্বস্তিকর দখিন হাওয়া বয়ে আনবে না। পশ্চিমে তাকালে গণতন্ত্র, মানবাধিকার, সুষ্ঠু নির্বাচন ও পরিবর্তনের আশা ধূলিসাৎ হবে। কারণ আমেরিকাকে বিশ্বাস করার কোনো কারণ নেই। তার চাওয়া পূরণ হলে সে বাংলাদেশে গণতন্ত্র, মানবাধিকার কোনো চুলায় গেল দেখতে আসবে না। উত্তরে তাকালে পরিণতি কী হতে পারে তা সহজে অনুমেয়।

mujta42@gmail.com


আরো সংবাদ



premium cement