২৯ এপ্রিল ২০২৪, ১৬ বৈশাখ ১৪৩১, ১৯ শাওয়াল ১৪৪৫
`


২০২২ সালে সাংবাদিক ও সংবাদপত্র

-

সাংবাদিকদের জান ও জীবনের নিরাপত্তাহীনতা বেড়েই চলেছে। কর্মক্ষেত্র এতটাই অনিরাপদ হয়ে পড়েছে যে, হয় আপস করে, নত সাংবাদিকতা করে টিকে থাকতে হচ্ছে, না হলে জীবন কিংবা অঙ্গ দিয়ে সাহসী সাংবাদিকতার মূল্য শোধ করতে হচ্ছে। প্রত্যক্ষ-পরোক্ষ চাপ, চোখরাঙানি আর জেল-জুলুমের ভয়ে স্বাধীন সাংবাদিকতার পথ যখন রুদ্ধ প্রায়, তখন গুটিকতক সংবাদকর্মী পেশাদারিত্ব চর্চার চেষ্টা করে নিরাপদ কর্মপরিবেশ ও স্বাভাবিক মৃত্যুর নিশ্চয়তা পাচ্ছেন না। নিহত ও নির্যাতিত সাংবাদিকের মিছিল দিন দিন দীর্ঘ হচ্ছে। নতুন করে যুক্ত হয়েছে অপমৃত্যুর বহর।

বিগত বছরগুলোর মতো বিদায়ী ২০২২ সালটিও সাংবাদিকদের জন্য ছিল খুন, হামলা, মামলা, গ্রেফতার আর হুমকিতে বিভীষিকাময়। চারজন সাংবাদিক খুন হয়েছেন এক বছরে। আরো অন্তত পাঁচজন সংবাদকর্মীর লাশ উদ্ধার হয়েছে, যাদের মৃত্যু রহস্যের চাদরে ঢেকে আছে। পুলিশ আত্মহত্যা ধরে নিয়ে তদন্ত করলেও সহকর্মীদের কাছে সন্দেহ-সংশয়ের ঘন কুয়াশায় আচ্ছন্ন হয়ে আছে উদ্ধার হওয়া সংবাদকর্মীর পচাগলা লাশ। অতীতে কখনোই এত সংবাদকর্মীর লাশ উদ্ধার বা আত্মহত্যার ঘটনা ঘটেনি।

খুন ও অপমৃত্যু ছাড়াও গত এক বছরে দেশে কমপক্ষে ২১৪ জন সাংবাদিক হামলা, মামলা, গ্রেফতার, হুমকিসহ নানাভাবে নিপীড়নের শিকার হয়েছেন। এ হিসাবে প্রতি মাসে গড়ে ১৮ জন করে সাংবাদিককে নিগ্রহের শিকার হতে হয়েছে। গত বছর সেপ্টেম্বর মাসে সর্বাধিক ৩৫ জন সাংবাদিক শারীরিক হামলা, ডিজিটাল নিরাপত্তা আইনসহ বিভিন্ন আইনে মামলা ও হুমকি মোকাবেলা করেছেন। জুলাই মাসটি ছিল সাংবাদিকদের জন্য অপেক্ষাকৃত স্বস্তির। এ মাসে সবচেয়ে কম চারজন সাংবাদিক নিপীড়নের মুখে পড়েন।

বাংলাদেশ ফেডারেল সাংবাদিক ইউনিয়নের (বিএফইউজে) মিডিয়া মনিটরিং সেলে প্রাপ্ত তথ্য-পরিসংখ্যানে এ চিত্র উঠে এসেছে। দেশের শীর্ষস্থানীয় সংবাদপত্র ও অনলাইন সংবাদমাধ্যমের ওপর নজর রেখে বিএফইউজে সাংবাদিক নির্যাতনের বার্ষিক প্রতিবেদন তৈরি করেছে। সংবাদমাধ্যমে খবরের মর্যাদা পায়নি বা প্রকাশিত হয়নি এমন সাংবাদিক নিগ্রহের ঘটনা থাকলে তা এ পরিসংখ্যানের বাইরে রয়েছে।

বিদায়ী বছরে দৈহিকভাবে আক্রান্ত ও নির্যাতিত সাংবাদিকের সংখ্যা ১৬০ জন। গ্রেফতার হয়ে বিভিন্ন মেয়াদে জেল খেটেছেন সাত সাংবাদিক। এর বাইরে মামলা হয়েছে আরো ৩৯ জনের বিরুদ্ধে। তাদের মধ্যে প্রথম সারির সংবাদপত্রের দু’জন সম্পাদকও রয়েছেন। গেল বছর অন্তত তিনটি সংবাদমাধ্যম কার্যালয়ে হামলার ঘটনা ঘটেছে। প্রকাশনা বাতিল হয়েছে দু’টি জাতীয় দৈনিকসহ বেশ কয়েকটি আঞ্চলিক পত্রিকার।

সংবাদমাধ্যমে প্রকাশিত খবর অনুযায়ী গত বছরের জানুয়ারিতে ১৬ জন, ফেব্রুয়ারিতে ২৩ জন, মার্চে সাতজন, এপ্রিলে ১৭ জন, মে‘তে ১৫ জন, জুনে ১১ জন, জুলাইতে চারজন, আগস্টে ২৮ জন, সেপ্টেম্বরে ৩৫ জন, অক্টোবরে ৯ জন, নভেম্বরে ২৯ জন এবং সর্বশেষ ডিসেম্বরে ২১ জন সাংবাদিক নানাভাবে নিপীড়নের শিকার হয়েছেন।

খুন ও অপমৃত্যুর ৯টি ঘটনার মধ্যে চারটি ঘটেছে ঢাকায় এবং অপর পাঁচটি ঢাকার বাইরে। খুনের শিকার সাংবাদিকরা হচ্ছেন- কুমিল্লার বুড়িচংয়ের আনন্দ টিভির মহিউদ্দিন সরকার নাঈম, কুষ্টিয়ার আমাদের নতুন সময়ের হাসিবুর রহমান রুবেল, পটুয়াখালীর কলাপাড়ায় দৈনিক গণকণ্ঠের আবু জাফর প্রদীপ ও নারায়ণগঞ্জের সোনারগাঁওয়ে দৈনিক মাতৃজগতের গোলাম রব্বানী। এ ছাড়া লাশ উদ্ধারের পর যে পাঁচজন সাংবাদিক আত্মহত্যা করেছেন বলে পুলিশ দাবি করছে তারা হচ্ছেন- ঢাকার বাড্ডায় নিউজ টুয়েন্টিফোর বিডিডটনেটের সৌরভ মাহমুদ, হাতিরঝিলে ডিবিসি নিউজের প্রযোজক আবদুল বারী, হাজারীবাগে বাংলা ট্রিবিউনের সাবেক সিনিয়র সাব এডিটর সোহান আক্তার পারভিন তুলি, মগবাজারে দ্য রিপোর্ট টুয়েন্টিফোর লাইভ-এর শবনম শারমিন মুক্তি ও গাজীপুরের কালিয়াকৈরে শানু হোসেন।

বছরজুড়ে সাংবাদিক নির্যাতনের আলোচিত ঘটনাগুলোর মধ্যে রয়েছে জানুয়ারিতে সিলেটের কানাইঘাটে সাংবাদিক আবদুর রবের হাত-পা কেটে দেয়া, নারায়ণগঞ্জে যমুনা টিভির সাংবাদিক আল আমীন হক ও তার সঙ্গীর ওপর হামলা, ফেব্রুয়ারিতে বরিশালের আদালত প্রাঙ্গণে ১৮ সাংবাদিককে পেটানো, বাংলা ট্রিবিউনের শাহেদ শফিক, বাংলাভিশনের এসটি হোসেন ও জাগো নিউজের মূসা আহমেদের ওপর হামলা, মার্চে আশুলিয়ায় মামুন মোল্লা নামে এক সাংবাদিক গ্রেফতার, এপ্রিলে ঢাকার নিউমার্কেট এলাকায় ব্যবসায়ী ও ঢাকা কলেজ শিক্ষার্থীদের মধ্যে সংঘর্ষকালে পেশাগত দায়িত্ব পালনরত অন্তত ১৪ সাংবাদিকের ওপর হামলার ঘটনা।

এ ছাড়াও আলোচিত হয় কক্সবাজারের পেকুয়ায় নয়া দিগন্তের সাংবাদিক ছাফওয়ানুল করীমকে নির্যাতন, নওগাঁর মাহদেবপুরে দুই সাংবাদিককে গ্রেফতার, জুনে রাঙ্গামাটিতে কালের কণ্ঠ ও এনটিভির সাংবাদিক ফজলে এলাহীকে ডিজিটাল আইনে গ্রেফতার, জুলাইতে নারায়ণগঞ্জে মানবজমিন প্রতিনিধি নুরুজ্জমানকে কুপিয়ে হত্যাচেষ্টা, আগস্টে ঢাকার কামরাঙ্গীরচরে ইন্ডিপেন্ডেন্ট টিভির হাসান মিসবাহ ও সাজু মিয়াকে বেদম মারধর, মৌলভীবাজারের কমলগঞ্জে সাংবাদিক আবদুল বাসিত খানকে কুপিয়ে হাতের কব্জি কেটে ফেলা, ঢাকার আগারগাঁওয়ে ডিবিসি নিউজের সাইফুল ইসলাম জুয়েল ও আজাদ আহমদের ওপর হামলা।

বছরের শেষ দিকে আলোচিত সাংবাদিক নির্যাতনের ঘটনাগুলোর মধ্যে উল্লেখযোগ্য হচ্ছে- সেপ্টেম্বরে রাজশাহীতে বরেন্দ্র বহুমুখী প্রকল্পের কার্যালয়ের সামনে এটিএন নিউজের বুলবুল ও রুবেলের ওপর হামলা, হবিগঞ্জের বানিয়াচংয়ে ঢাকার সিনিয়র সাংবাদিক রাজীব নূরসহ চার সাংবাদিককে মারধর, নভেম্বরে ফেনীতে সাংবাদিক ইউসুফ আলীকে বাসা থেকে রাত গভীরে তুলে নিয়ে কোমরে রশি বেঁধে আদালতে তোলা, ডিসেম্বরে প্রেস ক্লাবের সামনে ইত্তেফাকের হাসিব প্রান্ত ও মানবজমিনের আবদুল্লাহ আল মারুফের ওপর ছাত্র লীগের হামলা এবং সংসদ ভবনের সামনে নাগরিক টিভিতে লাইভ সংবাদ পরিবেশনকালে সাঈদ আরমানের কাছ থেকে পুলিশ কনস্টেবল কর্তৃক মাইক্রোফোন কেড়ে নেয়া।

সাংবাদিক হত্যা-নির্যাতনের অধিকাংশ ঘটনায় প্রকাশিত সংবাদে সরকারদলীয় নেতাকর্মীদের নাম উঠে এসেছে। ঢাকার হাজারীবাগে সাংবাদিক নির্যাতনের একটি ঘটনায় বিএনপি কর্মীদের নাম এসেছে। এ ছাড়া প্রশাসন ও অজ্ঞাত দুর্বৃত্তদের হাতেও সাংবাদিক নিগ্রহের ঘটনা ঘটেছে। দু-একটি ব্যতিক্রম ছাড়া কোনো সাংবাদিক নিপীড়নের ঘটনায়ই প্রতিকার মেলেনি। হামলাকারীরা গ্রেফতার হয়েছে হাতেগোনা কয়েকটি মাত্র ঘটনায়।

সাংবাদিকতা বরাবরই ঝুঁকিপূর্ণ পেশা। এটা মেনেই সাংবাদিকরা পেশায় আসেন। তাই বলে বেঘোরে প্রাণ দিতে কেউ প্রস্তুত থাকেন না। যখন তখন মার খেতে হবে, পঙ্গুত্ববরণ করতে হবে- এ কেমন নিয়তি? কোনো সভ্য দেশে কি সচরাচর এমনটি ঘটে? প্রভাবশালীদের রোষানলে পড়ে অতীতে বিভিন্ন সময়ে সাংবাদিককে জীবন দিতে হয়েছে। স্বাধীনতার পর থেকে এ পর্যন্ত বাংলাদেশে কতজন সাংবাদিক নিহত হয়েছেন বা নির্যাতনের শিকার হয়েছেন তার সঠিক ও নির্ভরযোগ্য কোনো হিসাব নেই। বিভিন্ন সরকারের মেয়াদের বিচ্ছিন্ন কিছু হিসাব পাওয়া যায়। অনেক ঘটনাই রয়ে গেছে আড়ালে। বর্তমান সরকার ক্ষমতাসীন হওয়ার পর ২০০৯ সাল থেকে এ পর্যন্ত খুন হওয়া সাংবাদিকের সংখ্যা ৫৫। বিএফইউজের প্রকাশনা ও ওয়েবসাইটে তাদের খুনের দিন, তারিখ ও স্থান তুলে ধরা হয়েছে। সবচেয়ে আলোচিত সাংবাদিক দম্পতি সাগর-রুনী হত্যা মামলার প্রতিবেদন দিতে আদালতের সময় মঞ্জুর সেঞ্চুরি করতে চলেছে। সর্বশেষ পঁচানব্বইতম দফায় সময় দেয়া হয়েছে। বিচারহীনতার কারণেই সাংবাদিক হত্যা নির্যাতন যে বাড়ছে তা জোর দিয়েই বলা যায়। স্বাধীন ও মুক্ত সাংবাদিকতার পরিবেশ সৃষ্টির জন্য সাংবাদিক সংগঠন ও সুশীল সমাজের দাবি অরণ্যে রোদন হয়ে উঠেছে। সরকার মুখে সাংবাদিকতার অবাধ স্বাধীনতা বিরাজমান বলে দাবি করলেও নিজেদের সমালোচনা ও অপশাসন নিয়ে লেখার অধিকার দিতে একেবারেই অনীহা দেখিয়ে আসছে। সরকারের পছন্দ শুধুই ‘উন্নয়ন সাংবাদিকতা’। ফলে আন্তর্জাতিক সূচকে বাংলাদেশের সাংবাদিকতার মান ও সূচক ক্রমাগতভাবে নিম্নমুখী। বিশ্ব মুক্ত গণমাধ্যম সূচক-২০২২ অনুযায়ী দশ ধাপ পিছিয়ে ১৮০টি দেশের মধ্যে বাংলাদেশের অবস্থান নেমেছে ১৬২-তে।

লেখক : সভাপতি, বাংলাদেশ ফেডারেল সাংবাদিক ইউনিয়ন (বিএফইউজে)


আরো সংবাদ



premium cement