২৯ এপ্রিল ২০২৪, ১৬ বৈশাখ ১৪৩১, ১৯ শাওয়াল ১৪৪৫
`


নতুন বছরে চাই সঙ্ঘাতমুক্ত নব সূচনা

লেখক : মইনুল হোসেন - ফাইল ছবি

রাজনৈতিক নেতাদের গণতান্ত্রিক প্রক্রিয়ায় সরকার পরিচালনার বাস্তব অভিজ্ঞতা না থাকায় আমরা সরল বিশ্বাসে একটা ফাঁদে আটকা পড়ে গেছি। গণতান্ত্রিক রাজনীতি চর্চার জন্য সদিচ্ছাই যথেষ্ট নয়, এজন্য জ্ঞান ও শিক্ষা থাকা জরুরি। কারণ, গণতন্ত্র সরকার পরিচালনার একটি ব্যবস্থা। ব্যবস্থাটি সম্পর্কে যারা জানেন না, তাদের মুখে গণতন্ত্রের কথা শুনে আসতে হচ্ছে। রাজনীতি যে চাকরি নয় তা অনেকেরই অজানা।

যাদের গণতান্ত্রিক শাসনব্যবস্থা সম্পর্কে কোনো ধারণা নেই, তাদের কাছে আইনের শাসন, মানুষের মৌলিক অধিকার বা বিচার বিভাগের স্বাধীনতার কথা বলাই অবান্তর। আমলারা যা বোঝান সেটাই নেতাদের কাছে গণতন্ত্র এবং নির্বাচন।

দলীয় নেতাদের দোষ দেবো না। কারণ, গলদ দলীয় রাজনীতিতে। রাজনৈতিক দলে রাজনীতি নেই। দলে যোগ দিলে বা নিজে দল করতে পারলে যে কেউ রাজনীতিবিদ হতে পারবেন। নেতাদের অভিজ্ঞতার অভাবে রাজনৈতিক দলগুলো বর্তমানে পারিবারিক বাণিজ্যিক প্রতিষ্ঠানে রূপ নিয়েছে। কিভাবে স্বল্প সময়ের মধ্যে বড় মাপের বিত্তশালী হওয়া যায়, এর নাম রাজনীতি নয়। রাজনীতির অর্থ যে নিঃস্বার্থভাবে জনগণের সেবা করা, সেই আদর্শেরই বিলুপ্তি ঘটেছে।

কমিউনিস্ট পার্টি শাসিত রাষ্ট্রে শাসনতান্ত্রিকভাবে স্বীকৃত কোনো মানবাধিকার থাকে না। অথচ গণতন্ত্র মানবাধিকার রক্ষার শাসন। সে কারণে গণতান্ত্রিক শাসনতন্ত্র ছুড়ে ফেলে দিয়ে একদলীয় বাকশাল কায়েম করতে হলো। এ ব্যবস্থায় গণমানুষের কোনো অধিকারই রাখা হলো না। গণতান্ত্রিক সংগ্রাম পরিচালনার জন্য হোসেন শহীদ সোহরাওয়ার্দী প্রতিষ্ঠিত আওয়ামী লীগের ব্যানারে বর্তমান শাসকরা বাকশালের রাজনীতি চালু করার চেষ্টা করছে। অথচ জনাব সোহরাওয়ার্দীর নেতৃত্বে গণতান্ত্রিক পন্থায় মুসলিম লীগের অগণতান্ত্রিক শাসনের নাম ও নিশানা মুছে গিয়েছিল ১৯৫৪ সালের অবাধ নির্বাচনে। তিনি বলেছেন, জনগণের অধিকার প্রতিষ্ঠায় গণতন্ত্রের বিকল্প নেই।

কিন্তু বর্তমান ১৯৭২-এর পরিবর্তিত গণতান্ত্রিক শাসনতন্ত্র মেনে নিলেও স্বাধীন ও শক্তিশালী বিচারব্যবস্থার প্রতি অসহিষ্ণু হওয়ায় জনগণের অধিকার সংরক্ষণ, অবাধ ও স্বচ্ছ নির্বাচন অনুষ্ঠান অসম্ভব হয়ে পড়েছে। সহজে পুলিশ দিয়ে মামলা দেয়া এবং মানুষকে জেলে ঢোকানো সরকারের কাছে পছন্দের বিচারব্যবস্থা হয়ে দাঁড়িয়েছে। গণতন্ত্র হচ্ছে আইনের শাসন, কোনো ব্যক্তির খেয়াল-খুশির শাসন নয়।

গেল শুক্রবার আগাম অনুমতি নিয়ে রাজধানী ঢাকায় বিরোধীদলসমূহ ঐক্যবদ্ধভাবে বিশাল গণমিছিলের কর্মসূচি পালন করে। তাদের দাবি ছিল দেশের নাজুক পরিস্থিতিতে অনির্বাচিত, চরম দুর্নীতিপরায়ণ বর্তমান ব্যর্থ সরকারকে পদত্যাগ করতে হবে। পুলিশের অনুমতি না থাকায় পুলিশের সাথে জামায়াত ও শিবিরের সংঘর্ষ বাধে। সুবিধাজনক জায়গাগুলোতে পুলিশের সাথে আওয়ামী লীগ কর্মীরাও অবস্থান নেয়। ১৯৭২ সালের শাসনতন্ত্রের যেটুকু বর্তমান সরকারের কাছে গ্রহণযোগ্য তাতেও জনসভা বা জনসমাবেশ করার এখনো জনগণের মৌলিক অধিকার হিসেবে সংরক্ষিত আছে। কিন্তু এখন পুলিশের অনুমতি নিতে হবে। তাদের ইচ্ছা মতো বিভিন্ন শর্তসমূহ জুড়ে দেয়ার ক্ষমতা রয়েছে।

দলীয় রাজনীতি ব্যবসায়িক প্রতিষ্ঠানে পরিণত হওয়ার কারণে যখন লুটতরাজ চলতে থাকে তখন সাধারণ মানুষের দুঃখ-দুর্ভোগ দেখার সময় সরকারের থাকে না। মাত্রাতিরিক্ত ব্যয়বহুল মেগা-প্রজেক্টগুলো নিয়ে সরকারের বিপুল জনপ্রিয়তা দাবি করতে সরকারের অসুবিধা হয় না। কিন্তু অবাধ নির্বাচন দিয়ে জনগণকে মোকাবেলা করার সাহসও তাদের নেই।

সরকারের পররাষ্ট্রমন্ত্রী বর্তমান সরকারকে আর একটি টার্মের জন্য ক্ষমতায় বহাল রাখার জন্য যখন ভারত সরকারের কাছে কাকুতি-মিনতি করতে শোনা যায়, তখন ভারতের ভূমিকা নিয়ে জনগণের মধ্যে ভুল বুঝাবুঝি হওয়া স্বাভাবিক। অথচ অন্য দেশের সাথে বন্ধুত্বের মতোই আমরা ভারতের সাথে বন্ধুত্বকে গুরুত্ব দিয়ে আসছি এবং বন্ধুত্ব হতে হবে জনগণের সাথে জনগণের। কিন্তু এ ক্ষেত্রে সরকারের অবস্থান হলো নির্বাচনের মাধ্যমে জনমত নেয়া যাবে না। অবাধ নির্বাচনব্যবস্থায় রাজি না হওয়ায় বর্তমান সরকার যে জনগণের নিকট গ্রহণীয় নয়, সরকার নিজেই তার স্বাক্ষর রাখছেন।

সরকার দাবি করে, দেশে একটি গণতান্ত্রিক শাসনতন্ত্র আছে কিন্তু স্বচ্ছ নির্বাচন কিংবা জনগণের অধিকার রক্ষার ব্যাপারে সরকার শাসনতন্ত্রকে গুরুত্ব দিচ্ছে না। শাসনতন্ত্রের পরিবর্তন করে অবাধ নির্বাচনের অস্তিত্বই বিলোপ করা হয়েছে। গণতন্ত্র সম্পর্কে ধারণা না থাকায় পুলিশকে তাদের ক্ষমতার উৎস হিসেবে দেখতেও কোনো অসুবিধা হচ্ছে না।

এ দেশের জনগণ সর্বদা গণতান্ত্রিক অধিকার নিয়ে বাঁচার জন্য সংগ্রাম করেছে, জীবন দিয়েছে, যাতে তাদের গণতান্ত্রিক অধিকারসমূহ সংরক্ষিত থাকে এবং স্বাধীনভাবে ভোট দিয়ে তারা তাদের পছন্দ মতো সরকার নির্বাচন করতে পারে। তাই বাকশাল মার্কা একদলীয় সমাজতন্ত্র কায়েম করার পরীক্ষা শোচনীয়ভাবে ব্যর্থ হয়ে যায়।

পাকিস্তানি সামরিক বাহিনীর নির্যাতনে লাখ লাখ নিরীহ লোক রক্ত দিয়েছে। কিন্তু তারা মুক্তিযোদ্ধা নন। যারা জনগণকে অসহায় রেখে ভারতে গিয়েছিলেন তারাই মুক্তিযোদ্ধা। তারাই মাসিক ভাতা পাচ্ছেন। রেশনের চাল, ডাল, তেল ইত্যাদি পাচ্ছেন। সাধারণ মানুষ অবহেলিত ও নির্যাতিত থেকেই যাচ্ছে। যারা রক্ত দিয়ে দেশটিকে রক্ষা করল তাদের মূল্যায়ন হচ্ছে না।

আওয়ামী লীগ আবার তার গণতান্ত্রিক নামে প্রত্যাবর্তন করে। কিন্তু তার পক্ষে একদলীয় জবাবদিহিতাবিহীন বিশ্বাসী শাসনের স্বপ্ন পরিত্যাগ করা সহজে সম্ভব হয়নি। সন্দেহ করা হচ্ছে, এ ব্যাপারে এখনো বাইরের প্রণোদনা থামেনি। অনেক মিথ্যা, অনেক চক্রান্ত অন্তরালে রয়ে গেছে। ‘ব্লাড টেলিগ্রাম’ শীর্ষক বইয়ে সাবেক ঢাকাস্থ মার্কিন কনসাল জেনারেল গেরি জে. বাস পাকিস্তান সেনাবাহিনী নিরীহ মানুষের ওপর যে হত্যাযজ্ঞ চালিয়েছিল তার বিশদ আলোচনা করতে গিয়ে পূর্ব পাকিস্তানে ভারতের গোপন যুদ্ধের কথাও বলেছেন। বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধে ভারতের সহযোগিতার কথা সবারই জানা। কিন্তু মানুষের মুক্তির কথা তো গুরুত্ব পাচ্ছে না।

গণতন্ত্র হচ্ছে এমন ব্যবস্থা, যা জানার জন্য দরকার জ্ঞান এবং প্রয়োগ করার জন্য প্রয়োজন অভিজ্ঞতা। উত্তরাধিকার সূত্রে নেতৃত্ব গ্রহণের কারণে আমাদের রাজনীতিতে চরম অবক্ষয় ঘটেছে, রাজনীতি অর্থ উপার্জনের ব্যবসায় রূপ নিয়েছে এবং ক্ষমতার দেদার অপব্যবহার করা হচ্ছে। দেখতে হচ্ছে শান্তিপ্রিয় বাংলাদেশে হত্যা ও গুমের ভয়াবহ সরকারি ব্যবস্থা।

দেশের মালিক হচ্ছে জনগণ কিন্তু সেই জনগণের স্বার্থ দেখার জন্য নিজেদের পছন্দের সরকার নির্বাচনের অধিকার থেকে তারা বঞ্চিত। এটা সত্য যে, ক্ষমতায় আসার জন্য বিএনপি ও আওয়ামী লীগ উভয় দলই নির্বাচনে কম-বেশি কারচুপির আশ্রয় নিয়েছে। আওয়ামী লীগেরই দাবি অনুযায়ী জাতীয় নির্বাচনের সময় দলনিরপেক্ষ তত্ত্বাবধায়ক সরকার প্রতিষ্ঠা করা হয়েছিল। কিন্তু আওয়ামী লীগ এখন তার বিরোধী। আওয়ামী লীগ সরকারকে ক্ষমতায় রেখেই নির্বাচন হতে হবে। সংসদও বহাল থাকবে। নির্বাচন কমিশনের কোনো কার্যকারিতা নেই। সরকারি কর্মচারীরাই নির্বাচনের সবকিছু নির্ধারণ করেন।


গণআন্দোলনের মুখে আওয়ামী লীগের সামনে এখন দুটি বিকল্প, হয় শান্তিপূর্ণ প্রক্রিয়ায় ক্ষমতা থেকে বিদায় গ্রহণ, নতুবা ক্ষমতায় আঁকড়ে থাকার নেশায় জনগণের আক্রোশ, হিংসাবিদ্বেষ ও ক্ষোভের মোকাবেলা করা। নতুন বছরে রাজনৈতিক সংঘাত-সংঘর্ষ আমাদের কাম্য নয়।

গণতন্ত্র টেকসই করতে চাইলে সরকার পরিবর্তনের চেয়ে কে রাজনীতিবিদ, সেটা নির্ধারণ করাও কম জরুরি ও গুরুত্বপূর্ণ নয়। রাজনীতির অর্থ স্বার্থহীন জনসেবায় উদ্বুদ্ধ হওয়া-ক্ষমতার ফুটানি দেখানো নয়। রাষ্ট্রীয় ক্ষমতার অপব্যবহার করে বিত্তশালী হওয়াও নয়। রাজনীতি এখন সরকার সমর্থক দুর্নীতিপরায়ণ ব্যবসায়ীদের একটি বিশেষ গোষ্ঠীর হাতে। তাদের কাছ থেকে শুনতে হচ্ছে দেশের উন্নয়নের সাফল্যের কথা। তারা তো খুশিতেই আছেন। আয়-উপার্জনের সুযোগ না থাকায় এ দেশের লাখ লাখ মানুষ পরিবার-পরিজন রেখে কর্মসংস্থানের উদ্দেশে যেতে হচ্ছে বিদেশে এবং কঠোর পরিশ্রম করার পাশাপাশি মানবেতর জীবন-যাপন করতে হচ্ছে, সেটাও সরকারের জন্য বড় সাফল্য। কারণ, তাদের প্রেরিত ডলার বাংলাদেশের জন্য অপরিহার্য। কিন্তু তাদের যে পরিবার-পরিজন রেখে বিদেশে কর্মসংস্থানের জন্য মর্মান্তিক জীবন কাটাতে হচ্ছে, তা নিয়ে কোনো চিন্তা নেই। দেশের মধ্যেই তাদের জন্য কেন আয়-রোজগারের ব্যবস্থা থাকতে পারে না? জীবন দিয়ে দেশটিকে স্বাধীন করা হয়েছিল সবাই মিলে ভালো থাকার জন্য, নিরাপদে থাকার জন্য।

দলীয় রাজনীতি পারিবারিক বাণিজ্য প্রতিষ্ঠান হতে পারে না। নিঃস্বার্থ জনসেবার জন্য রাজনীতি। নির্বাচনবিরোধী রাজনীতি যে শাসনতন্ত্রবিরোধী এবং রাষ্ট্রদ্রোহের অপরাধ, তাও ব্যবসায়ী রাজনীতিবিদরা জানেন না।

লেখক : সিনিয়র আইনজীবী, বাংলাদেশ সুপ্রীম কোর্ট


আরো সংবাদ



premium cement