২৭ এপ্রিল ২০২৪, ১৪ বৈশাখ ১৪৩১, ১৭ শাওয়াল ১৪৪৫
`

বঙ্গবন্ধুর ব্যক্তিত্ব ও ভারতীয় বাহিনী প্রত্যাহার

-

পাকিস্তানের কারাগার থেকে ৯ মাস ১৫ দিন পর মুক্ত হয়ে ১৯৭২ সালের ১০ জানুয়ারি সদ্য স্বাধীন বাংলাদেশে ফিরে আসেন অবিসংবাদিত নেতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান। বিমান থেকে নামার পর মুক্তিযুদ্ধের সর্বাধিনায়ক জেনারেল ওসমানী বঙ্গবন্ধুকে একটি চৌকস গার্ড-অব-অনার দিয়ে অভ্যর্থনা জানান। এরপর তিনি মিশে যান লাখ লাখ জনতার মধ্যে। ঐতিহাসিক আরেকটি ভাষণ দেন সোহরাওয়ার্দী উদ্যানে।

মহান আল্লাহ বঙ্গবন্ধুকে এ দেশে ফিরিয়ে না আনলে বাংলাদেশ হয়তো কখনো একটি স্বাধীন-সার্বভৌম দেশ হিসেবে আত্মপ্রকাশ করতে পারত না। কেননা, যুদ্ধে বিজয়ের ২৫ দিনের ব্যবধানে তখন দেশের অবস্থা যা ছিল, তার দুই-একটি ছিল এমন :
১. ১৬ ডিসেম্বর দেশ শত্রুমুক্ত হলে মাত্র ১৩ দিন যুদ্ধ করে এ দেশের সর্বত্র ভারতীয় বাহিনী সর্বেসর্বা হিসেবে আত্মপ্রকাশ করে। এক লাখ পাকিস্তানি বাহিনীর অস্ত্র, গোলাবারুদ, সব মূল্যবান সরঞ্জামাদি ও দেশের অন্যান্য সম্পদের মালিক বনে যায় তারা।

২. সেনাসদর ও ঢাকা সেনানিবাসসহ দেশের সব সেনানিবাস ভারতীয় বাহিনীর দখলে ছিল। আমাদের সেনাসদরকে তারা তাদের দফতর হিসেবে ব্যবহার করছিল।

৩. আমাদের মুক্তিবাহিনীর সর্বাধিনায়ক জেনারেল ওসমানীসহ সেনাবাহিনীর সব ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তারা সেনানিবাসে প্রবেশ করতে না পেরে ঢাকার মিন্টু রোড (বর্তমানে মেট্রোপলিটান পুলিশ সদর দফতর) এলাকায় আশ্রয় নেন। এবং দেশের অন্যান্য এলাকায় সেনানিবাসের ভেতরে প্রবেশ করতে না পেরে আমাদের সেনাবাহিনীর বিভিন্ন ইউনিট বিভিন্ন স্কুল-কলেজে আশ্রয় নেয়।

৪. আওয়ামী লীগ, ছাত্রলীগ, ছাত্র ইউনিয়ন ও অন্যান্য বামপন্থী সংগঠনের সবাই নিজেদের মহারাজা ভাবতে শুরু করে দিয়েছেন। কেউ কারো কথা বা নির্দেশ শোনার জন্য প্রস্তুত নন।

৫. মুজিব বাহিনী, কাদেরিয়া বাহিনীসহ বিভিন্ন মিলিশিয়া বাহিনী ও দেশের অসংখ্য মানুষের হাতে অস্ত্র ও তাজা গোলাবারুদ, যা দেশের সাধারণ জনগণের জন্য ছিল ভয়াবহ আতঙ্কের ব্যাপার।

৬. আইনশৃঙ্খলা পরিস্থিতির দিন দিন অবনতি ঘটতে থাকে। বাংলাদেশ থেকে খাদ্যশস্য ও অন্যান্য প্রয়োজনীয় দ্রব্যসামগ্রী বিনা বাধায় ভারতে পাচার হচ্ছিল।

এ সব কথার সত্যতা প্রমাণিত হয় Gen, Jacob এর লিখা “Surrender at Dacca- Birth of a NationÓ eB‡qi P¨vÞvi ÔAftermath of WarÕ-G ÒIn anticipation of the Liberation of Bangladesh Civil Affairs Cell had been created at Fort William, consisting of Indian Administrative Service (IAS), Police and other miscellaneous services.... The Indian Government was of the view that civil affairs should be run by the Army and Indian civilians.” এমনি এক অবস্থায় আমাদের অস্থায়ী সরকার ডিসেম্বরের শেষের দিকে মুজিব নগর থেকে ঢাকায় এসে তাদের কার্যক্রম শুরু করে বিভিন্ন নির্দেশনা জারি করতে থাকেন। কিন্তু বঙ্গবন্ধুর মতো বিশাল মাপের নেতা ছাড়া এ পরিস্থিতি হতে দেশকে রক্ষা করার মতো কেউ ছিল না। মহান আল্লাহ এ দেশের মানুষের অবিসংবাদিত নেতাকে ফিরিয়ে আনার মাধ্যমে আমাদের মাতৃভূমিকে রক্ষা করেন বড় ধরনের এক বিপদ হতে।

বঙ্গবন্ধুর সবচেয়ে বড় অবদান হলো, ভারতীয় সামরিক বাহিনীকে আমাদের দেশ থেকে প্রত্যাহার করার ব্যবস্থা করা। তাকে ব্যতীত এ কাজ করার মতো কেউ ছিল না। বিশ্বের ইতিহাসে এভাবে এত দ্রুত একটি দেশ থেকে বিদেশী সৈন্য প্রত্যাহারের ঘটনা বিরল। ভারতীয় সৈন্যবাহিনী প্রত্যাহারে বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের একক কৃতিত্ব ও অসামান্য অবদান এবং আমরা চির কৃতজ্ঞ। ১৯৭১ সালের ৩ ডিসেম্বর ভারত তার সৈন্যবাহিনীর সাথে বেসামরিক প্রশাসন পরিচালনার জন্য সকল প্রস্তুতি নিয়েই বাংলাদেশে প্রবেশ করেছিল।

স্বাধীনবাংলা বেতার কেন্দ্রের চরমপত্র খ্যাত এম আর আকতার মুকুলের বই ‘চল্লিশ থেকে একাত্তর’-এর ১১৭ পৃষ্ঠায় (প্রথম প্রকাশ ১৯৮৫): “উনি (শেখ মুজিবুর রহমান) পাইপে কয়েকটা টান দিয়ে হালকা মেজাজে কথা আরম্ভ করলেন। ‘কানের মাঝ থাইক্যা চুল বাইরাইয়া আইছে ভারতে এমন সব ঝানু পুরনো আইসিএস (ইন্ডিয়ান সিভিল সার্ভিস) অফিসার দেখছোস? এরা সব ইন্দিরা গান্ধীরে বুদ্ধি দেওনের আগেই আজ আলোচনার সময় মাদামের হাত ধইরা যা কথা লমু। জানোস্ কি কথা? কথাটা হইতেছে, মাদাম, তুমি বাংলাদেশ থাইক্যা কবে ইন্ডিয়ান সোলজার ফেরত আনবা?”

বঙ্গবন্ধু তার দেয়া প্রতিশ্রুতি রেখেছিলেন। কলকাতার রাজভবনে ফার্স্ট রাউন্ড আলোচনার শুরুতে দু’জনে পরস্পরের কুশলাদি বিনিময় করলেন। এরপর বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধে সক্রিয়ভাবে সাহায্য করার জন্য ভারতের জনগণ, ভারত সরকার এবং প্রধানমন্ত্রী ইন্দিরা গান্ধীকে ধন্যবাদ জানিয়ে বঙ্গবন্ধু হঠাৎ করে আসল কথাটি উত্থাপন করলেন।

শেখ মুজিব: মাদাম, আপনে কবে নাগাদ বাংলাদেশ থেকে ভারতীয় সৈন্য প্রত্যাহার করবেন?
ইন্দিরা গান্ধী: বাংলাদেশে আইনশৃঙ্খলার পরিস্থিতি তো এখনো পর্যন্ত নাজুক পর্যায়ে রয়েছে। পুরো “সিচুয়েশন” বাংলাদেশ সরকারের কন্ট্রোলে আসা পর্যন্ত অপেক্ষা করাটা কি বাঞ্ছনীয় নয়? অবশ্য আপনি যেভাবে বলবেন সেটাই করা হবে।

শেখ মুজিব: মুক্তিযুদ্ধে আমাদের প্রায় ৩০ লাখ লোক আত্মাহুতি দিয়েছে। স্বাধীন বাংলাদেশে আইনশৃঙ্খলাজনিত পরিস্থিতির জন্য আরো যদি লাখ দশেক লোকের মৃত্যু হয়, আমি সেই অবস্থাটা বরদাশত করতে রাজি আছি। কিন্তু আপনারা অকৃত্রিম বন্ধু বলেই বলছি, বৃহত্তর স্বার্থে বাংলাদেশ থেকে ভারতীয় সৈন্য প্রত্যাহার করলে আমরা কৃতজ্ঞ থাকব।

ইন্দিরা গান্ধী : এক্সেলেনসি, কারণটা আর একটু ব্যাখ্যা করলে খুশি হবো।

শেখ মুজিব : এখন হচ্ছে বাংলাদেশে পুনর্গঠনের সময়। তাই এই মুহূর্তে দেশে শক্তিশালী রাজনৈতিক বিরোধিতা আমাদের কাম্য নয়। কিন্তু ভারতীয় সৈন্যের উপস্থিতিকে অছিলা করে আমাদের বিরোধী পক্ষ দ্রুত সংগঠিত হতে সক্ষম হবে বলে মনে হয়। মাদাম, আপনেও বোধ হয় এই অবস্থা চাইতে পারেন না। তাহলে কবে নাগাদ ভারতীয় সৈন্য প্রত্যাহার করছেন?

ইন্দিরা গান্ধী: (ঘরের সিলিংয়ের দিকে তাকিয়ে একটু চিন্তা করলেন) এক্সেলেনসি, আমার সিদ্ধান্ত হচ্ছে, আগামী ১৭ মার্চ বাংলাদেশের মাটি থেকে ভারতীয় সৈন্য প্রত্যাহার করা হবে।

শেখ মুজিব: মাদাম কেন এই বিশেষ দিন ১৭ মার্চের কথা বললেন?

ইন্দিরা গান্ধী: এক্সেলেনসি প্রাইম মিনিস্টার, ১৭ মার্চ হচ্ছে আপনার জন্মদিন। এই বিশেষ দিনের মধ্যে আমাদের সৈন্যরা বাংলাদেশ থেকে ভারতে ফেরত আসবে।’

উল্লেখ্য, ভারতীয় সৈন্যদের শেষ দলটি বাংলার মাটি ত্যাগ করল ১৯৭২ সালের ১৭ মার্চ, বঙ্গবন্ধুর জন্মদিনে।

সাবেক স্পিকার ও পেশাদার কূটনীতিক হুমায়ূন রশিদ চৌধুরীর ভাষায়: “১৯৭২ সালের ফেব্রুয়ারি মাসে কলকাতা সফরে গিয়ে বঙ্গবন্ধু সাধারণ কথাবার্তার মাঝে প্রধানমন্ত্রী মিসেস ইব্দিরা গান্ধীকে অপ্রস্তুত করে দিয়ে বলেন, আমার দেশ থেকে আপনার সেনাবাহিনী ফিরিয়ে আনতে হবে।” শেখ মুজিব এমন একটি গুরুত্বপূর্ণ বিষয় এর সহজভাবে তুলতে পারেন, ভাবতেও পারেননি ভারতীয় প্রধানমন্ত্রী। তার এই অপ্রস্তুত অবস্থার সুযোগ নিয়ে শেখ মুজিব নিজের কথার পুনরাবৃত্তি করে বললেন, “এ ব্যাপারে প্রধানমন্ত্রীর আদেশই যথেষ্ট। ‘অস্বস্তিকর অবস্থা কাটাতে মিসেস ইন্দিরা গান্ধীকে রাজি হতে হয় এবং (তিনি) জেনারেল মানেকশকে বাংলাদেশ থেকে সৈন্য প্রত্যাহারের দিনক্ষণ নির্ধারণের নির্দেশ দেন।”

প্রখ্যাত রাজনীতিবিদ ও লেখক আবুল মনসুর আহমদের বিখ্যাত বই ‘আমার দেখা রাজনীতির পঞ্চাশ বছর’ থেকে, “পরদিন উভয় প্রধানমন্ত্রীর আলোচনা সম্পর্কে একটি সুন্দর যুক্ত বিবৃতি প্রকাশিত হইল। তাতে উভয় স্বাধীন সার্বভৌম রাষ্ট্রের কল্যাণের জন্য পারস্পরিক সহযোগিতার কথা ছাড়াও বলা হইল যে, আগামী ২৫ শে মার্চের মধ্যে ভারতীয় সৈন্য অপসারণের কাজ সমাপ্ত হইবে। আমি এই ঘোষণায় আহলাদিত হইলাম এবং শেখ মুজিবের কূটনৈতিক সাফল্যে গর্বিত হইলাম। কার্যত বাংলাদেশ হইতে সৈন্য অপসারণের কাজটা নির্ধারিত তারিখের অনেক আগেই সমাপ্ত হইল। ১২ই মার্চ তারিখে ভারতীয় সৈন্য ঢাকা ত্যাগ করিল। প্রধানমন্ত্রী শেখ মুজিবুর রহমান একটি প্রাণস্পর্শী সংক্ষিপ্ত ভাষণে তাদের বিদায় সম্ভাষণ জানাইলেন।”

বঙ্গবন্ধু বলেন, “আমি সশ্রদ্ধচিত্তে ভারতের জনগণ ও প্রধানমন্ত্রী ইন্দিরা গান্ধীকে সালাম জানাই। বিশ্বের এমন কোনো দেশ নাই যেখানে শ্রীমতি ইন্দিরা গান্ধী ব্যক্তিগতভাবে আমার মুক্তির জন্য যান নাই।

অনেকে বলেছেন, ভারতীয় সেনাবাহিনী কবে যাবে। মতিলাল নেহরুর নাতনী, পণ্ডিত জওহরলাল নেহরুর কন্যা ভারতের প্রধানমন্ত্রী শ্রীমতি ইন্দিরা গান্ধীকে আমি ভালো করে চিনি। আমি যেইদিন বলবো, সেই দিনই ভারতীয় সৈন্য বাংলা থেকে চলে যাবে। ভারতীয় সৈন্য হানাদার বাহিনী নয়।”

সাবেক পররাষ্ট্রসচিব ফারুক চৌধুরী বলেছেন, “১৯৭২ সালের ১০ই জানুয়ারি দিল্লি থেকে তাঁর সঙ্গে ঢাকা আসার সৌভাগ্য আমার হয়েছিল। আমি তখনই দেখেছি তাঁর মনে কাজ করছে কবে বাংলাদেশ থেকে ভারতীয় সেনাবাহিনী চলে যাবে। একটি স্বাধীন দেশে অন্য দেশের সৈন্য অবস্থান করলে সে দেশ আন্তর্জাতিক স্বীকৃতি পাবে না, এটা তিনি বুঝতেন। ১৯৭২ সালের ফেব্রুয়ারি মাসে তাঁর কলকাতা সফরের সময় ২৫ শে মার্চের মধ্যে ভারতীয় সেনাবাহিনী প্রত্যাহারের ঘোষণা আসে। তিনি কিছুটা ঝুঁকি নিয়েই, আইনশৃঙ্খলা পরিস্থিতি যথেষ্ট ভালো না হওয়া সত্তে¡ও এ কাজটি করেছিলেন। এটা না হলে আন্তর্জাতিক স্বীকৃতি পাওয়া দুরূহ হতো।”

প্রখ্যাত ইতিহাসবিদ এ এফ সালাহউদ্দিন আহমেদের বই “বাংলাদেশ-পাস্ট অ্যান্ড প্রেজেন্ট” (নয়াদিল্লির এপিএইচ পাবলিশিং হাউজ থেকে প্রকাশিত) বইয়ের ২১৫ নং পৃষ্ঠায় : Ä high watermark of Sheikh MujibÕs statesmanship was reflected when during his visit to Kolkata on 6-8 February,1972, a joint declaration was signed by the prime minister of India and Bangladesh, announcing that the Indian troops would be withdrawn from Bangladesh by 25 March, 1972. It is a matter of interest to note that secret British official papers released after thirty years on January 1, 2003, mention that Mrs. Gandhi, on a visit to Britain in December 1971 told British Prime Minister Edward Heath regarding the pressure in her cabinet for her to take Pakistani territory and not return it.

আমরা বঙ্গবন্ধুর রূহের মাগফিরাত কামনা করে মহান আল্লাহ্ তায়ালার দরবারে কায়মনোবাক্যে দোয়া করি।

লেখক: সামরিক ইতিহাস ও নিরাপত্তা বিশ্লেষক
Email : hoque2515@gmail.com


আরো সংবাদ



premium cement