২৭ এপ্রিল ২০২৪, ১৪ বৈশাখ ১৪৩১, ১৭ শাওয়াল ১৪৪৫
`

তারি দু’চারিটি অশ্রুজল

-

গতকালের পর
দুই কথার মামলা
মামলাজট, এডিআর ও বিলম্ব নিয়ে লেখাটি শেষ হওয়ার পর ইমেইল করার উদ্দেশ্যে কপি করাকালে মোবাইল বেজে ওঠে। মেঘনার মাসুদা। আমার হাইস্কুল জীবনে রয়েল বেঙ্গল টাইগার খ্যাত নূরুল হক স্যার। সামান্য অপরাধ করার কারণে যে টাইগারের ভয়ে পালিয়ে বেড়িয়েছি পাঁচ দশক। ‘রাধাও নেই, নেই বৃন্দাবনও’ লিখে গুগলে ক্লিক করলেই আমার পালিয়ে বেড়ানোর হাস্যকর কাহিনীটি বের হয়ে আসবে। স্যারের বাড়ি মেঘনা উপজেলার শেখেরগাঁও। মাসুদার বাড়িও শেখেরগাঁও। আমার বাড়িও মেঘনা উপজেলায়। সেই পরিচয়সূত্রে আমার কাছে মামলা করতে আসা। মামলার ১২ নং বাদি মাসুদা। গত ৪ অক্টোবর ২০২২ মামলার তারিখ ছিল। পরবর্তী তারিখ কবে এবং কী জন্য? ফোন করে জানতে চায়। পরবর্তী তারিখ ২০২৩ সালের ২ মার্চ। ২০২৩ সালের ২ মার্চ শুনেই আঁতকে ওঠেন মাসুদা। আঁতকে উঠে বলেন,

-স্যার, কেইসটা না করলেই ভালো ছিল। দলিলে দাগ ভুলের বিষয়টি কেউ জানত না। এখন জানাজানি হয়ে গেছে। তখন বলছিলেন, সহজ মামলা। নোটিশ ঠিকমতো জারি হয়ে এলে জবাবের জন্য কয়েক তারিখ যাবে। জবাব না দিলে একতরফা। সাক্ষ্যের পরেই রায়। দলিল সংশোধনের মামলার রায় সবচেয়ে সহজ। এখন বছর পার হচ্ছে এক যুগ, হাকিম পার হলো প্রায় এক ডজন, কিছুই হচ্ছে না। এসব বলে বলেই আপনারা মক্কেলকে মামলায় নামান। তার পরেই শুরু হয় ঘোরাঘুরি।

মাসুদার কথা সত্য। মামলা নেওয়ার সময় এমনই বলেছিলাম। উপজেলা মেঘনার বাড়িঘর হারা পাঁচ-ছয়টি পরিবার সব খুইয়ে বাড়ি করেছে সোনারগাঁও। সীমানা নির্ধারণসহ নামজারি করতে গিয়ে দেখে, দলিলে দাগ ভুল। ভুলের কারণটা সহজে চোখে পড়ার মতো নয়। সাবেক দাগে সম্পত্তির পরিমাণ ১০১ শতাংশ। ১০১ শতাংশ আর এস রেকর্ডকালে ৩২৭ থেকে ৩৩০ এই চারটি দাগে রূপান্তর হয়। আর এস পর্চায় চারটি দাগ পাশাপাশি অবস্থিত। দলিল লেখার সময় লেখকের অসাবধানতার কারণে ৩২৭ লেখার স্থলে ৩৩০ লেখা হয়ে গেছে। মূল এবং ভায়া মিলে এই ভুল ১৭টি দলিলে। কেউ কেউ ১৭টি মামলা করার পরামর্শ দিয়েছিল। আমি মামলার সংখ্যা না বাড়িয়ে সর্বোচ্চ ৪৬ হাজার টাকার এডভোলেরাম কোর্ট ফি দিয়ে বিজ্ঞ যুগ্ম জেলাজজ আদালতে ২০১১ সালে একটি মামলা করি। মামলার নাম্বার ৫৮৫/০১১। মূল মামলার সাথে করা হয়েছিল অস্থায়ী নিষেধাজ্ঞার আবেদনও। যথাযথভাবে নোটিশ জারি হওয়ার পর ২৫ নভেম্বর ২০১৩ তারিখে একতরফা শুনানির জন্য নির্ধারণ করা হয়। যেহেতু একতরফা মামলা এবং যেহেতু সরকার পক্ষের কোনো স্বার্থ নেই সেহেতু দাখিলকৃত ১৭টি মূল ও সইমোহরার মূল সরাসরি প্রদর্শন করার অনুরোধ করেছিলাম, কাজ হয়নি। ৬০ দশকের কয়েকটি দলিলের বালাম ছিল ঢাকা ও মুন্সীগঞ্জ। পুরনো ভায়া দলিলের বুনিয়াদে আর এস পর্চা লিপি হয়েছে। আর এস পর্চাটি যেহেতু প্রদর্শন মার্ক হয়েছে সেহেতু দলিলটি প্রদর্শন করতে বাধা নেই। তাই আদালতের কাছে অনুরোধ করে বলি, ‘স্যার, ঢাকা সদর রেকর্ডরুম থেকে ১৯৬৬ সালের বালাম খুঁজে বের করা আর সাগর থেকে সুঁই খুঁজে বের করা সমান কথা। মুন্সীগঞ্জও প্রায় একই অবস্থা। নদী পার হয়ে এক জেলা থেকে আরেক জেলায় বালাম বহন কঠিন ও ঝুঁকিপূর্ণ। স্যার, অত্র আদালতেরই এক কন্টেসটিং মামলা নং ২৯২। ২০০৬ পরবর্তী দলিলের প্রদর্শন সূত্রে অপ্রদর্শিত দলিলটিও বিজ্ঞ আদালত প্রদর্শন করেছেন। বিস্তারিত উল্লেখ করে গত ৭ আগস্ট ২০১৭ লিখিত দরখাস্তও দিলাম। আমার দরখাস্ত নামঞ্জুর করায় ঢাকা ও মুন্সীগঞ্জ থেকে বালাম আনয়ন অনিবার্য হয়ে পড়ে। বালাম এনে মিলাতেই পার হয় (২৫/১১/২০১৩ থেকে ১৪/৫/২০১৯) প্রায় ৬ বছর। এবার আদেশের পালা। নানা কারণে বিচারক জনার শেখ হাফিজুর রহমান থেকে শুরু করে ১০ জন বিচারকের হাত বদল হয়ে গত ১৬ মার্চ ২০২১ তারিখে সোনারগাঁও সহকারী জজ আদলতে এসে নতুন নাম্বার ৬৩/২০২১ হয়। সাক্ষীর পর যতবার বিচারক বদল হয়েছে ততবারই করতে হয়েছে যুক্তিতর্ক। যতবার যুক্তিতর্ক ততবারই বলি ‘স্যার, ‘ক’ তফসিল বর্ণিত ভূমি সম্পর্কে ‘খ’ তফসিল বর্ণিত দলিলসমূহে আর এস ৩৩০ দাগের পরিবর্তে ৩২৭ দাগ লিপি হবে, লিপির মর্মমতে ‘খ’ তফসিল বর্ণিত দলিলের বালাম সংশোধন করার জন্য সংশ্লিষ্ট সাবরেজিস্ট্রারকে নির্দেশ দিতে।’

এই দুই কথার মামলা। দুই কথার আদেশের জন্য বছরের পর বছর পার হওয়ার কারণে ভিন্ন জেলার লোক পেয়ে বাদিদের ঘর-বাড়ি গাছপালা গ্রাস করতে শুরু করেছে। এই মামলা শেষ না হওয়ায় কিছুই করতে পারছি না। দেড় মিনিটে দুই কথার রায়ের জন্য আমার পক্ষ পথে বসতে শুরু করবে। এই মামলায় ১৭ জন বাদির মধ্যে অনেকেই হাল ছেড়ে দিয়েছে। কোর্টে আসে না, খরচপাতিও পাঠায় না। ৮ নং বাদি যোগাযোগ করত, সে এখন কুমিল্লা হাসপাতালে চিকিৎসাধীন। মাসুদাই মাঝে মাঝে টেলিফোন করে খোঁজখবর নেয়। কয়েক মাস আগে আর্জি ও আমমোক্তার নামা দলিলে স্বাক্ষরের সমস্যা থাকায় ইটালি থেকে স্বাক্ষর আনাসহ এ বিষয়ে ব্যাখ্যাও দেয়া হয়েছে। মাসুদা মাঝে মাঝে মামলা রায়ের খবর নিতে চেম্বারে আসে। হতাশ হয়ে বলে, ‘এখন আর মামলা পাইলেই লাভ কী? ৩২৭ দাগের জায়গা বেচাকেনাসহ বেদখল হয়ে গেছে। পাওয়ার চেয়ে মামলা না পাওয়াই যেন তাদের বেশি ভালো ছিল। কারণ, মামলা পাওয়ার পর নারায়ণগঞ্জ, মুন্সীগঞ্জ ও ঢাকা সাদর সাবরেজিস্ট্রি অফিসে গিয়ে ১৭টি দলিলের বালাম সংশোধনসহ করতে হবে ১৫ বাদির নামে নামজারি। নামজারি করতে গিয়েই দেখবে, অনেক ভূমি নামজারি হয়ে রয়েছে অন্যের নামে। নামজারির বিরুদ্ধে মিস মামলাসহ করতে হবে নতুন ক্রেতাদের নামে বণ্টনের মামলা যে মামলায় তিন রায় তিন যুগ পার হয়। বেদখল হয়ে যাওয়া বাড়ি উদ্ধার করতে কমসে-কম ৫০ বছর। এই ক্ষতির দায় কার? বাদি, আইনজীবী, বিচারব্যবস্থা, না বিচারকের?

ফুরাচ্ছে আইনজীবীর দিনও
কয়েক মাস আগের কথা। বিজ্ঞ জেলা জজ কোর্টে আপিল মামলা। প্রিয়েমশন মামলায় আমি খরিদ্দার তরফছানি পক্ষের আইনজীবী। গত ৩০ অক্টোবর ২০১৯ সালে নিম্ন আদালতে খারিজ করার পর আপিল করেন জেলা জজ কোর্টে। আপিলকারী পক্ষের আইনজীবী আমার চেয়েও সিনিয়র। বিজ্ঞ জেলা জজ কোর্টে গত ৬ ডিসেম্বর ২০২০ ছিল শুনানি। আপিলকারী সময়ের আবেদন করেন। আমি হাজিরা দিলেও যেহেতু একজন সিনিয়র সময় চেয়েছেন সেহেতু জোর আপত্তি করিনি। সন্ধ্যার দিকে আমার ক্লায়েন্ট ফোন করে জানায়, ‘আর শুনানির দরকার নেই। আপনাদের শুনানি ছাড়াই মামলা পেয়ে গেছি।’ ক্লায়েন্টের কথা শুনে হতভম্ব। হতভম্ব হওয়ার কারণ, মজহর আপিলকারী পক্ষের আইনজীবী সময় চাইলেন, আমি তরফছানি রেসপনডেন্ট পক্ষের আইনজীবী চলে এলাম, বিচারক স্বতঃস্ফূর্ত আদেশ দিলে। বিচারকগণ রেকর্ডপত্র দেখে এরকম স্বতঃস্ফূর্ত আদেশ দিলে আইনজীবীর প্রয়োজন কী?

লেখক : আইনজীবী ও কথাসাহিত্যিক
E-mail : adv.zainulabedin@gmail.com


আরো সংবাদ



premium cement