২৭ এপ্রিল ২০২৪, ১৪ বৈশাখ ১৪৩১, ১৭ শাওয়াল ১৪৪৫
`

ভয়কে জয় করার রাজনীতি কী

লেখক : ড. মাহবুব হাসান - ফাইল ছবি

‘হলে উঠতে ছাত্রদের ভয়’ এই শিরোনামের একটি রিপোর্ট বেরিয়েছে প্রথম আলোয়। রিপোর্ট পড়ার পর আমার মনে হলো ভয় জিনিসটা তো ডিজিটালি তরঙ্গ তুলল। কেবল ছাত্রদের মধ্যেই কি ওই ভয় সীমাবদ্ধ? জনমনে কী এরকম ভয় নেই? আছে। বিশেষ করে সরকারের বিরুদ্ধে বা উন্নয়ন পরিকল্পনার বিষয়-আশয় নিয়ে দুর্নীতির প্রশ্ন তুললে বা বেফাঁস কথা বললে সেই ভয় এসে জাপটে ধরে। অনেকে তো বলছেন রাষ্ট্রটিকে পুলিশি রাষ্ট্রে পরিণত করা হয়েছে। এর সত্য-মিথ্যা বিচার কে করবে? আমরা তো আমজনতা। খাদ্যশস্যের দাম বাড়লেই সরকারের চৌদ্দগোষ্ঠী উদ্ধারে নেমে পড়ি। একবারও ভাবি না, সরকারেরও সীমাবদ্ধতা আছে। ইউক্রেন যুদ্ধের পরিণামে আমরা যে বৈশ্বিক পরিস্থিতির শিকার সেটা তো মানতে হবে। কিন্তু সেটাই কি একমাত্র কারণ? নাকি দেশীয় ম্যানেজমেন্টাল অদক্ষতাও এর সাথে জড়িত? আর প্রকল্পভিত্তিক দুর্নীতি, ঠিকাদারদের ব্যর্থতা, তাদের অদক্ষতা, তাদের অলস কর্মপ্রবাহ, ঠিকাদারের টাকা না থাকার পরও তাকে বাতিল না করে, ঝুলিয়ে রাখার পেছনে সরকারের দায় কেন প্রশ্নের মুখে পড়বে না - এসব প্রশ্ন তুললেই ভয় জাপটে ধরত আগে। মাস কয়েক হলো সরকার ও পুলিশ একটু ঢিলেমি করছে। সেটা কি র‌্যাবের কয়েকজনের ওপর মার্কিনি স্যাঙ্কশনের ফলে?

মানবাধিকার হরণ ও অ্যাবডাকশন মানে গুমের কারণে তারা অনেকটাই ভয় পেয়েছেন? জাতিসঙ্ঘের মানবাধিকার কমিশন বা পরিষদ গুম ও হত্যার বিষয়ে প্রশ্ন তুলেছে। সংস্থাটি বাংলাদেশে এসে সরেজমিন বিষয়টি পরখ করতে চেয়ে চিঠি দিয়েছিল সরকারকে। সরকার সে সবের কোনো উত্তর দেয়নি। তাদের পরিদর্শনের ব্যবস্থাও করেনি। সেটাও তো এক ভয়। যদি জাতিসঙ্ঘের টিম এসে গুম, হত্যা ও দমনপীড়নের সুস্পষ্ট নমুনা পায়, তাহলে বাংলাদেশের রাজনৈতিক ও মানবাধিকার পরিস্থিতির যে গালগল্প চালু আছে, তাতে কালিমা লাগবে। আর সেই কালিমা গিয়ে লাগতে পারে পিস বা শান্তিরক্ষী হিসেবে বাংলাদেশের সেনা ও পুলিশদের ওপর কালো দাগ পড়বে- এটা কি ভয় নয়? এই রকম ভয় থেকেই তো আমরা কত কিছু লুকিয়ে রাখি। যেমন আমরা সরকারের সাংবিধানিক অধিকার লঙ্ঘনের বিষয়গুলো কি কখনো সামনে নিয়ে আসি? আসি না। বলবেন, সরকার আবার কোথায় সংবিধান লঙ্ঘন করল? আমার জানা মতে, দেশের প্রতিটি নাগরিকের মতপ্রকাশের স্বাধীনতা আছে। রাজনৈতিক, অর্থনৈতিক, সামাজিক ও সাংস্কৃতিকসহ সব বিষেয়ে মানুষ তার মতপ্রকাশের অধিকারী। সেই অধিকারের চর্চা করতে গেলেই আমাদের মনে ভয় জন্ম নেয়।

রাজনৈতিক দলগুলোও সাংবিধানিক অধিকার আছে গণতান্ত্রিক রাজনীতির কর্মকাণ্ড পরিচালনার। কিন্তু বিএনপিকে কি সেই অধিকার পালন করতে দিচ্ছে? না, দিচ্ছে না। এটাই লঙ্ঘন। অতীতে যখন ক্ষমতায় ছিল বিএনপি, তারাও একই কাজ করেছে। এসব লঙ্ঘন নিয়ে আমরা প্রশ্ন তুলি না কখনো। কারণ জানি, রাজনীতিতে এগুলোই এখন ট্রাডিশন বা ঐতিহ্যে পরিণত হয়েছে। এটা যে ট্রাডিশন নয়, অপচিন্তা আর অপসংস্কৃতির কুফল, সেটা বুঝেও না বোঝার ভান করেন আমাদের রাজনৈতিক সরকার।

যখন যে রাজনৈতিক দল ক্ষমতায় থাকে, তখন সেই সরকারই এই আচরণ করে এবং দুর্ভাগ্যের বিষয় হলো, আজকে বিএনপি যে নির্দলীয় নিরপেক্ষ তত্ত্বাবধায়ক সরকার চাইছে, নির্বাচন সুষ্ঠু ও সাধারণ মানুষের ভোটাধিকার কায়েমের জন্য, সেটি কিন্তু আন্দোলন করে আওয়ামী লীগই প্রতিষ্ঠা করতে বাধ্য করেছিল বিএনপিকে। আজ সেই বিএনপি একই দাবিতে লড়ছে। এখন আওয়ামী সরকার ওই নির্দলীয় নিরপেক্ষ অনির্বাচিত সরকারের কাছে ক্ষমতা ছেড়ে দেবে না বলে খুঁট্টি ধরেছে। তারা বলছে সংবিধান অনুযায়ী নির্বাচন এই সরকারের অধীনেই হবে। যে গোঁ-ধরাটি আমরা দেখেছিলাম বিএনপি সরকারের আমলে, সেই গো কেন আজ আওয়ামী লীগ সরকারের? তাহলে কি ভয় এখানে কাজ করছে? এই ভয় কি হেরে গিয়ে ক্ষমতা হারাবার? সেটা তো হতেই পারে। আজীবন তো আর রাষ্ট্রক্ষমতায় থাকতে পারবে না কোনো দল। গণতান্ত্রিক রাজনীতিতে সেটা গ্রহণযোগ্য নয়। এ কারণে গণতান্ত্রিক রাজনীতিতে ভয় শব্দটি নেই।

ভয় তখনই জুজুর মতো জেঁকে বসে, যখন ন্যায় শাসন, যাকে লোকেরা বলে সুশাসন, গুড গভর্ন্যান্স যদি সরকারের মৌল মটো হয়, তাহলে জনগণ বোঝে সরকার ঠিক কাজটি করেছে। তারাই সরকারে যেতে পারে আবারো। আওয়ামী লীগ সরকার মনে করে তারা সুশাসক। তারা উন্নয়নের জোয়ার এনেছে এবং তাদেরই পুনরায় ক্ষমতায় যাওয়া উচিত ও জরুরি।

এতে কোনো ভুল নেই যে তারা চোখে দেখা যায় এমন উন্নয়নের রশিটি ধরে আছে। কিন্তু সাধারণের মনে এই প্রশ্নটি আছে যে, সেসব উন্নয়ন প্রকল্পের ব্যয় হয়েছে লাগাম ছাড়া। এশিয়ার তো বটেই, বিশ্বেরও শীর্ষে উঠেছে সেই প্রকল্প ব্যয়। যদি তাই সত্য হয়, তুলনামূলক তথ্য-উপাত্ত বিবেচনা করে যদি সত্যই দেখা যায় যে, এ দেশের উন্নয়ন ব্যয় পৃথিবীর মধ্যে শীর্ষে, তাহলে সেটা জনগণেরই দুর্ভাগ্য। তারা কি বিশ্বাস করে আওয়ামী লীগকে ভোট দিয়ে ক্ষমতায় পাঠিয়েছিল? নাকি বিরোধী দলের অভিযোগ অনুযায়ী রিগিং করে, মানে ভোট চুরি করে ক্ষমতার মসনদে বসেছে। ২০১৪ ও ২০১৮ সালের নির্বাচনে যে প্রকাশ্যে ভোট রিগিং হতে দেখেছে ভোটার জনগণ, ভোট দিতে না পারা ভোটাররা তো ওই সত্য মন থেকে, দিল থেকে মুছে ফেলতে পারবে না। সেই ভোট দিতে না পারা লোকটি যদি আওয়ামী লীগও করেন বা সমর্থন করেন, তিনিও কিন্তু এটিকে তার অধিকার হরণ হিসেবেই দেখবেন। এটা বুঝেই আওয়ামী ছাত্রলীগ, যুবলীগ ও পুলিশ মিলে ১০০ আসনে ভোটের আগের রাতেই নিজেরা সিল মেরে ব্যালট পেপার বাক্সে ঢুকিয়ে দিয়ে ইতিহাস রচনা করেছে। আর সেই সাগরচুরির মতো ঘটনাকে সিইসি নূরুল হুদা বৈধ বলে মেনে নিয়ে আওয়ামী লীগকে বিজয়ী বলে ঘোষণা দিলেন।

রিগিং সংস্কৃতি রাজনৈতিক দলের উচ্ছৃঙ্খলতার সব ইতিহাস ম্লান করে দিয়েছে। এটি এখন গিয়ে পৌঁছেছে সাংবিধানিক প্রতিষ্ঠান নির্বাচন কমিশনের মনে ও মজ্জায়। অর্থাৎ সিইসি ও কমিশন নিজেই যদি রিগিং করেন, তাহলে ওই সাংবিধানিক প্রতিষ্ঠানের কি কোনো মূল্য থাকে? দ্বাদশ সংসদ নির্বাচনে কেন বিএনপি ও অন্যান্য সমমনা দলনিরপেক্ষ নির্দলীয় সরকারের অধীনে নির্বাচন চাইছেন, তা বুঝতে হবে। এ ধারণার জন্মদাতারাও আজ ভীত ওই ব্যবস্থায়। কারণ ওই ব্যবস্থায় রিগিং করা কিছুটা হলেও ঝুঁকিপূর্ণ। দলনিরপেক্ষ বিধায় তারা কারো কাছে দায়বদ্ধ নয়। সে কারণে নির্বাচনে ডিসি, এসপিরা রাজনৈতিক সরকারের অন্যায়কে সার্ভিস হিসেবে নেবে না। তাতে তার ও তাদের প্রাতিষ্ঠানিক ক্ষতি হওয়ার আশঙ্কা নেই। ভয়টা সেখানে।

‘দেয়ালেরও কান আছে’ বলে পাকিস্তানি আমলে হোটেল-রেস্তোরাঁর দেয়ালে নোট লেখা থাকত। তার মানে এমন সমালোচনা করবেন না যা সরকারকে উত্তেজিত করে। সরকার উত্তেজিত হলে, পুলিশ পাঠিয়ে সায়েস্তা করতে অতীতে বহু ইতিহাস আছে, সেগুলোর বর্ণনায় গেলে মহাভারত রচিত হবে। তার কী দরকার। কোনো দরকার নেই সরকারকে উত্তেজিত করে খারাপ পরিস্থিতি সৃষ্টি করতে আমরা চাই না। কিন্তু এটা কি মেনে নেয়ার মতো যে বিশ্ববিদ্যালয়ের আবাসিক হলগুলো ক্ষমতাসীন সরকারের ছাত্রশাখা ছাত্রলীগের রাম-রাজত্বে পরিণত হবে? হলগুলোতে ছাত্রলীগের রাজত্ব সিট নিয়ে। তারা থাকতে দিলে বরাদ্দপ্রাপ্ত ছাত্র হলে উঠতে পারবেন। তবে, তার আগে সে যে ছাত্রলীগ করে তার প্রমাণ দিতে হবে মিটিংয়ে-মিছিলে উপস্থিত হয়ে, বিপক্ষের কিংবা সাধারণ ছাত্রদের কোনো দাবির মিটিং ছত্রভঙ্গ করে বা পিটিয়ে হত্যা করে। যেসব অভিভাবক তাদের ছেলেকে বা মেয়েকে বিশ্ববিদ্যালয়ে পাঠিয়েছেন, তারা জানতেও পারবেন না যে তাদের সন্তান পড়াশোনো রেখে ছাত্র রাজনীতির ক্যাডারে পরিণত হয়েছে।

এই যে হল দখল করার রাজনীতি তা তো ভয়কে জয় করার জন্যই। প্রতিপক্ষ যদি এসে তাদের তাড়িয়ে দেয়? এই ভয়ই কি কাজ করছে না?

হলের ছাত্র রাজনীতিকদের ভয়, ক্ষমতাসীন সরকারের ভয় জয় করে বিএনপি ও তাদের ছাত্রদল রাজপথে দাপিয়ে বেড়াচ্ছে। তারা ক্ষমতার মসনদকে নিজেদের দখলে নিতে চায়। সেটা তাদের ভাষায় রাজনৈতিক কর্মসূচির মাধ্যমে, জনগণকে সাথে নিয়ে। এতকাল তো আওয়ামী নেতারা সমস্বরে টিটকিরি দিত বিএনপির সাংগঠনিক শক্তি নেই। তাই তারা রাজনৈতিক মাঠ গরম করতে ব্যর্থ হচ্ছে। এখন সেই টিটকারির ভয়কে জয় করে যখন বিএনপি রাজনৈতিক মাঠই কেবল গরম করেনি, সরকারের ভেতরে যে ভয়টি লুকানো ছিল, তাকেও জাগিয়ে দিয়েছে। সরকার এখন ভয় পাচ্ছে তাদের গদি বুঝি হেলে গেল। দ্রব্যমূল্য নিয়ন্ত্রণ করতে না পেরে, একে কি তাদের ব্যর্থতা বলব নাকি ব্যবসায়িক সম্প্রদায়ের লোভ বলব, বুঝতে পারছি না- বাণিজ্যমন্ত্রী তো বলেছেন ব্যবসায়িকরা সরকারের নির্দেশ মানছে না। মানছে না, মানে সরকার তাদের সামলাতে পারছে না। সামলাতে না পারাকে কি ব্যর্থতা বলব? ভয় লাগছে। ওই শব্দটি ব্যবহারের দায়ে যদি...

গোলমাল থেকে ভয় তুলে নিতে হলে বিএনপি জনসভা ভণ্ডুল করতে বাস/ ট্রাক/ জলযান ধর্মঘট কাজে দেয়নি, সামনেও দেবে না। রেল আছে না? রেলে চড়ে কিংবা কয়েক দিন আগেই লোকজন পৌঁছে গেছে সভাস্থলের কাছে। সেখানেই অবস্থান করেছে। তার মানে কি ওই লোকগুলো কেবল বিএনপির কর্মী? যদি কর্মীই হয়, তাহলে বলতে হবে তারা মাত্র ১০ হাজার নয়, কেবল এক লাখ নয়, তাদের সংখ্যা লাখ লাখ এবং অচেনা মানুষ, যারা খাদ্যের শঙ্কায়, অর্থের শঙ্কায়, দ্রব্যমূল্যের ঘোড়ার পিঠে উঠে তো তারা উঠতে পারবেন না। গাঁটে যা ছিল তা তো ভেঙে খাচ্ছেন। এখন ভয় ধেয়ে আসা খাদ্যসঙ্কট, ধেয়ে আসা অর্থনৈতিক মন্দা কি করে সামাল দেবে তাই নিয়ে। তারা কিন্তু ভয়কে জয় করতেই বিনপির সভাগুলোতে জড়ো হচ্ছে। কারণ সেখানেই তাদের মুক্তির গন্ধ লেগে আছে। সেই গন্ধের স্বপ্ন গণমানুষের কাছে বড় স্বপ্ন। কারণ, শেষতক বাঁচার আকাক্সক্ষাই প্রধান। সেখানে কোনো রকম ভয় কাজ করে না।


আরো সংবাদ



premium cement