২৭ এপ্রিল ২০২৪, ১৪ বৈশাখ ১৪৩১, ১৭ শাওয়াল ১৪৪৫
`

চীনের সম্ভাবনা ও সীমাবদ্ধতা

চীনা প্রেসিডেন্ট - ছবি : সংগৃহীত

চীন একটি গুরুত্বপূর্ণ সময় অতিক্রম করছে। দেশটির কমিউনিস্ট পার্টির (সিপিসি) ২০তম জাতীয় কংগ্রেসের প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, পার্টির নেতৃত্বে ঐতিহাসিক সাফল্য অর্জনে চীনা জনগণের ঐক্য প্রচেষ্টাই একমাত্র পথ। চীনের উন্নয়ন যখন এমন একটি সময়ে প্রবেশ করেছে যেখানে কৌশলগত সুযোগ, ঝুঁকি এবং চ্যালেঞ্জগুলো সহাবস্থান করছে এবং অনিশ্চিত ও অপ্রত্যাশিত কারণগুলো বৃদ্ধি পাচ্ছে, তখন আমাদের জন্য বিশেষভাবে প্রয়োজন ‘একতার মধ্যে প্রচেষ্টা’কে শক্তির উৎস হিসাবে গ্রহণ করা।

ঐক্যই শক্তি : কেন এত জোর

চীনা কমিউনিস্ট পার্টির মূল্যায়ন অনুসারে এখন একতার সাথে সংগ্রাম করা সময়ের একটি নতুন তাৎপর্য দ্বারা সমৃদ্ধ হয়েছে। এক শতাব্দীতে অদেখা বড় বৈশ্বিক পরিবর্তনের ত্বরণ বিশ্বকে একটি নতুন অশান্ত সময়ের মধ্যে নিয়ে এসেছে। চীনকে শত্রু হিসেবে বিবেচনাকারী বাইরের সুবিধা নেয়ার চেষ্টা করছে। যতক্ষণ পর্যন্ত চীন ঐক্যবদ্ধ থাকবে, ততক্ষণ বাইরের কোনো শক্তিই তাকে নাড়া দিতে পারবে না। বাহ্যিক দমন কেবল চীনা জনগণকে আরো গর্বিত, আত্মবিশ্বাসী এবং আশ্বস্ত করে তুলতে পারে, সেই সাথে চাইনিজ সমাজ সেসব শক্তিকে পরাস্ত করতে আরো ঐক্যবদ্ধ করতে পারে যারা আমাদের উত্তেজিত করার এবং আমাদের নাশকতার চেষ্টা করে।

এবারের কংগ্রেস শুরু হবার কয়েক দিন আগে একটি গুজব ছড়িয়ে পড়ে যে শি জিনপিং তার দল ও দেশের মধ্যে বিদ্রোহ বা চ্যালেঞ্জের মুখে পড়েছেন। তিনি নেতৃত্ব ছেড়ে দেবার চাপেও পড়েছেন। কিন্তু এর কয়েক দিন পর শি’র প্রকাশ্যে আসা এবং পার্টির ২০তম কংগ্রেসে তৃতীয়বারের মতো প্রেসিডেন্ট হওয়ার মধ্যে স্পষ্ট হয় যে কমিউনিস্ট পার্টি এবং চীনের প্রশাসনের ওপর শি’র চমকপ্রদ কর্তৃত্ব রয়েছে। তবে ঐক্যের ওপর জোর দেয়া থেকে এটিও বোঝা যায় যে, অনৈক্যের কিছু ঘটনা ঘটেছে।

৫ বছর আগে চীনা কমিউনিস্ট পার্টির ১৯তম কংগ্রেসের সময় জিওপলিটিক্যাল ফিউচারের প্রধান ও আন্তর্জাতিক রাজনীতি বিশ্লেষক জর্জ ফ্রিডম্যান একটি কলাম লিখেছিলেন। তাতে তিনি উল্লেখ করেন, চীনের এই সম্মেলন বেশির ভাগ দেশের রাজনৈতিক সমাবেশের মতো কার্যত ফলপ্রসূ হয় খুব সামান্য। তবে চীনের এবারের কংগ্রেস ভিন্ন। কারণ এটি চীনের জন্য সামনে এগোনোর নতুন পথ তৈরি করেছে। তবে সামাজিক ও রাজনৈতিক চ্যালেঞ্জ মোকাবেলা ছাড়া সামাজিক ও রাজনৈতিক রূপান্তর ঘটতে পারে না এবং সেই প্রক্রিয়াটি কখনোই সহজ হয় না।

বাস্তবতা ও চ্যালেঞ্জ

২০তম কংগ্রেস যখন অনুষ্ঠিত হলো তখন বৈশ্বিক পরিবেশ পাঁচ বছর আগের তুলনায় বেশ ভিন্ন। তবে মূল বাস্তবতাটি এখনো বহাল। চীনে কমিউনিজম দু’টি পর্যায়ের মধ্য দিয়ে চলে এসেছে। প্রথমটি ছিল মাওবাদী পর্যায়, যার তিনটি লক্ষ্য ছিল। একটি প্রাক কমিউনিস্ট যুগে চীনে অবিচ্ছিন্নভাবে যে অভ্যন্তরীণ যুদ্ধ-সঙ্ঘাত চলে আসছিল তার অবসান। দ্বিতীয়টি ছিল চীনা মাটিতে বৈদেশিক হামলা বা অনুপ্রবেশের অবসান। তৃতীয়টি ছিল মৌলিকভাবে নতুন ও সমতামূলক সমাজ তৈরি করা। এই সময়টির সেরা নাম ছিল ‘স্থায়ী বিপ্লব’। এ তিনটি লক্ষ্য অর্জনে চীন সফল হয়েছিল, তবে এর জন্য মূল্য ছিল বেশ উচ্চ। আঞ্চলিক দ্ব›দ্ব-সঙ্ঘাত এক নৃশংস একনায়কত্ব দিয়ে দমন করা হয়। চীন নানাভাবে বিশ্বের বড় অংশের সাথে মিথষ্ক্রিয়া থেকে নিজেকে প্রত্যাহার করে নেয়। আর গ্রেট লিপ ফরওয়ার্ড থেকে গ্রেট সর্বহারার সাংস্কৃতিক বিপ্লব পর্যন্ত চীনা সমাজের ওপর আক্রমণের ধ্রুবক তরঙ্গ চলতে থাকে। ক্ষুধা আর রাজনৈতিক নিপীড়নে লাখ লাখ লোকের মৃত্যু হয়। কিন্তু মাও এমন একটি দেশ তৈরি করেন যেটি আগে ছিল না। অন্য রাষ্ট্রের স্পন্সর করা ছাড়া নতুন চীন অন্য যেকোনো ধরনের অভ্যন্তরীণ সঙ্ঘাত থেকে মুক্ত ছিল। আর মুক্ত ছিল ঔপনিবেশিক প্রভাব থেকে। তবে দেশটি একই সাথে ছিল অত্যন্ত দরিদ্র এবং দুর্ভোগে পূর্ণ।

১৯৭৬ সালে মাও সেতুং যখন মারা গেলেন তখন ক্ষমতার দ্ব›দ্ব শুরু হয়। তাঁর নিজস্ব গ্রুপ দেং জিয়াও পিংয়ের হাতে পরাজিত হয়। দেং স্বীকার করেছিলেন যে মাও তার যা ইচ্ছা তা করতে পেরেছিলেন কিন্তু তিনি দেশকে দুর্যোগের প্রান্তে নিয়ে গিয়েছিলেন। দেং বুঝতে পেরেছিলেন যে মাওয়ের র‌্যাডিক্যাল কমিউনিজম চলতে পারছে না এবং প্রয়োজনের পরিপ্রেক্ষিতে তিনি চীনের জন্য একটি নতুন মডেল তৈরি করেন।

‘নিজেকে সমৃদ্ধ করো’ ছিল দেং মডেল এর মূল স্লোগান। দেং বুঝতে পেরেছিলেন, চীনের সমস্যা হলো দারিদ্র্য এবং শুধু উৎপাদনই এর সমাধান করতে পারে। তবে চীনের উৎপাদিত দ্রব্যগুলো ভোগ করার মতো সমৃদ্ধি ছিল না দেশটিতে। ফলে চীনকে অন্যান্য দেশে তার পণ্য বিক্রি করতে হয়েছিল। এ জন্য তিনি বৈশ্বিক অর্থনীতির সাথে চীনা ব্যবস্থার সমন্বয়ের উদ্যোগ নেন। এই একই কৌশল জার্মানি, জাপান এবং অন্যরা যুদ্ধ থেকে নিজেদের পুনরুদ্ধার করতে ব্যবহার করেছিল।

চীনের সুবিধা ছিল যে, দেশটির যথেষ্ট সক্ষম শ্রমশক্তি রয়েছে আর তাদের মজুরি খুব কম। বাণিজ্যের সীমানা উন্মুক্ত করার পর এ কারণে চীন একটি প্রজন্মের চেয়েও দীর্ঘ সময় দ্রুত প্রবৃদ্ধি পেয়েছিল। এই প্রবৃদ্ধি কোনো মহা দক্ষতা থেকে আসেনি; মাও চীনকে এতটা দরিদ্র করেন যে চীনের নীতির ক্ষুদ্রতম যৌক্তিকীকরণের ফলে ব্যাপক উন্নতি সাধিত হয়। চীনকে এখন নতুন এক বাস্তবতার মুখোমুখি হতে হচ্ছে। এর প্রথমটি হলো, অনির্ভরযোগ্য অর্থনৈতিক প্রবৃদ্ধির সময় শেষ হয়ে গেছে। দেং এমন এক চীন তৈরি করেছেন যেটি কমিউনিস্ট পার্টিকে দুর্বল রেখেই তার উপক‚লীয় অঞ্চলগুলোতে বাণিজ্যিক দক্ষতা ছড়িয়ে দিয়েছে এবং যুক্তরাষ্ট্র ও ইউরোপের গ্রাহকদের সাথে তাদের যুক্ত করেছে। দেং এর আগ্রাসী রফতানির কৌশল বিশ্ব অর্থনীতিতে চীনকে পুনর্বিন্যস্ত করেছে, তবে এটি অন্যান্য দেশের আকাক্সক্ষার ওপর তার সাফল্যকে ব্যাপকভাবে নির্ভরশীল করেছে। যদি তারা চীনকে রুদ্ধ করে দেয়ার কোনো পদক্ষেপ নেয় তাতে চীনের ওপর বড় আঘাত আসতে পারে।

দ্বিতীয়ত, দেং এর সংস্কারগুলো বিশাল আঞ্চলিক সম্পদ তৈরি করে, যদিও অধিকাংশ দেশই এক সময় এর পেছনে ছিল। এটি উপক‚ল বরাবর একটি ধনী চীন এবং অভ্যন্তরে একটি উন্নয়নমুখী চীন তৈরি করে যেখানে একটি অপর্যাপ্ত মধ্যবিত্ত শ্রেণী ছিল যা চীনের অতিরিক্ত শিল্প পণ্য ভোগ করতে অক্ষম ছিল। এ ছাড়া দ্রুত প্রবৃদ্ধির মধ্য দিয়ে সৃষ্ট দুর্নীতি বৈষম্য বাড়িয়ে তোলে।

তৃতীয়ত, চীন আন্তর্জাতিক পরিমণ্ডলে প্রবেশ করে কেবল একটি অর্থনৈতিক শক্তি হিসেবে। এর সামরিক বাহিনী উন্নত ছিল কিন্তু এখনো তার স্বার্থ রক্ষায় যথেষ্ট সমর্থন ও সক্রিয়তাবাদী হবার ক্ষেত্রে অক্ষম। চীনের বেশির ভাগ ক্ষমতা পরিবর্তিত হয় বিভ্রান্তির সৃষ্টি করে এবং পশ্চিমের স্বার্থে বিভিন্ন কারণে তাদের বিশ্বাস করা হয়।

চতুর্থত, চীন পশ্চিমাশৈলীর গণতন্ত্র গ্রহণ করতে পারেনি। এর জন্য একটি এক-দলীয় ব্যবস্থা বজায় রাখার প্রয়োজন হয় এবং সেটি কমিউনিস্ট পার্টি। পশ্চিমাকরণের মাধ্যমে অর্থনৈতিক উন্নয়ন হবে বিভ্রান্তিকর যা চীনকে দুর্বল করে দিতে পারে। প্রকৃতপক্ষে, চীনা উন্নয়ন মডেল চীনের বৈশ্বিক শক্তির জন্য একটি প্রধান চালিকা হয়ে উঠবে, কারণ দরিদ্র দেশগুলো চীনের রাজনৈতিক ব্যবস্থাকে একদলীয় শাসনব্যবস্থার সাথে এক গতিশীল অর্থনীতির সমন্বয় করার জন্য গ্রহণ করে নেয়।

চীনের এই প্রতিচ্ছবিটি বিশ্বের নেতৃস্থানীয় শক্তিতে পরিবর্তিত করার জন্য প্রস্তুত নয় এবং এটি এমন এক দেশ যা কেবল একনায়কতান্ত্রিকতাকে স্থায়ী সত্য হিসাবে গ্রহণ করে বেঁচে থাকতে পারে, অর্থনৈতিক স্থিতিশীলতার লক্ষ্যে একটি স্থিতিশীল প্ল্যাটফর্ম নির্মাণের জন্য রাজনৈতিক বিপর্যয়কে দমিয়ে রাখে উদ্দীপনা এবং সামাজিক স্থায়িত্ব। শি তার বক্তৃতায়, সমাধানের ওপরই জোর দিয়েছেন। কিন্তু নতুন সমাধান নিয়ে তিনি শুধু বিতর্কই করেননি যে, দেং যুগ মাওবাদ হিসেবে মৃত ছিল, তবে এটি প্রতিটি কঠিন সমস্যার চিত্তাকর্ষক সমাধানের পেছনে সক্রিয় ছিল।

শি তার বক্তৃতায় চীনের অর্থনৈতিক কৌশল হিসাবে এখন পরিমাণের চেয়ে মানের ওপর বেশি জোর দিয়েছেন। তিনি চীনের প্রযুক্তিগত আধুনিকায়ন ও সক্ষমতার গুরুত্ব তুলে ধরে বলেছেন, তাদের অগ্রগতির জন্য এটি অপরিহার্য। তিনি উন্নয়নের প্রতিশ্রুতি দিয়েছেন। সমগ্র চীনের অভ্যন্তরীণ বাজারের বিকাশের কথা বলেছেন। উচ্চ হারের প্রবৃদ্ধি ছাড়া, এটি করার একমাত্র উপায় হলো সমৃদ্ধ অঞ্চল থেকে সম্পদ স্থানান্তর করা। কিন্তু তিনি এটি কতটা করতে পারবেন সে সংশয় রয়ে গেছে।

শি ২০৫০ সালের মধ্যে একটি বিশ্বমানের সামরিক বাহিনীর প্রতিশ্রæতি দেন। তিনি স্বীকার করেন যে, চীনের এখনো একটি বিশ্বমানের সামরিক বাহিনী নেই। বিশ্বমানের সামরিক বাহিনী গঠনের জন্য বিপুল বিনিয়োগের প্রয়োজন হবে এবং এই বিনিয়োগের জন্য যে সম্পদ স্থানান্তর করতে হবে তার জন্য একটি সুবিশাল প্রযুক্তিভিত্তিক অর্থনীতি গড়ে তোলার চেষ্টা করতে হবে- এ ক্ষেত্রে সব সহায়তা আছে কিন্তু এতে বিপদের শঙ্কাও রয়েছে।

চীনা নেতৃত্ব ও কর্তৃত্ববাদিতা

মাও সেতুং-এর নেতৃত্বে চীনের সমাজতান্ত্রিক বিপ্লবের পর যে ধারা দেশটিতে শুরু হয়েছিল সেটি ছিল কমিউনিজমের আদর্শ বাস্তবায়নের যুগ। এ সময় মার্কসবাদের তাত্তি¡ক ধারণা অনুসারে উৎপাদন উপকরণের ওপর রাষ্ট্রের মালিকানা প্রতিষ্ঠা, রাষ্ট্রের সর্বক্ষেত্রে কমিউনিস্ট পার্টির সার্বভৌম নিয়ন্ত্রণ প্রতিষ্ঠা হয়। বৈশ্বিক অর্থনীতির সাথে এবং আন্তর্জাতিক ব্যবস্থার সাথে একটি বড় সময় ধরে সীমিত সংযোগ ও সমন্বয় ছিল। মাও সেতুং পর্ব শেষ হবার পর চীনের শীর্ষ পর্যায়ে নতুন চিন্তার সূত্রপাত ঘটে। পরবর্তী নেতা দেং অনেক মৌলিক সংস্কার করেন। ব্যক্তি মালিকানা ও উদ্যোগের স্বীকৃতি ও অবকাশ তৈরি করা হয়। অর্থনীতির বিকাশের কৌশল হিসেবে বাজার অর্থনৈতিক নীতিমালা নেয়া হয়। আন্তর্জাতিক অর্থনীতি ও বাণিজ্য ব্যবস্থার সাথে সমন্বয়ের নীতি গ্রহণ করা হয়। চীনকে বৈশ্বিক বিনিয়োগের জন্য উন্মুক্ত করা হয়।

দেং এর এই সংস্কারের ধারা শি জিন পিং পূর্ণ কর্তৃত্বে আসার আগ পর্যন্ত চলতে থাকে। রাষ্ট্রকে যৌথ নেতৃত্বে চালানোর কৌশল হিসেবে প্রেসিডেন্ট থাকা দুই মেয়াদের জন্য সীমিত করা হয়। পশ্চিমা নেতৃত্বের সাথে সংঘাতের পরিবর্তে সমন্বয় ও সহযোগিতার নীতি গ্রহণ করা হয়। শি জিনপিং প্রেসিডেন্ট হবার পর তিনি অর্থনৈতিকভাবে দেং-এর সংস্কার ধারা বজায় রাখলেও রাজনৈতিকভাবে মাও সেতুং এর ধারা ফিরিয়ে আনার উদ্যোগ নেন। আগে যেখানে রাষ্ট্রের শীর্ষ নিয়ন্ত্রক পদগুলোতে বিভিন্ন ব্যক্তির মধ্যে দায়িত্ব বিভাজিত ছিল সেখানে শি আসার পর সব গুরুত্বপূর্ণ শীর্ষ পদ প্রত্যক্ষভাবে নিজ নিয়ন্ত্রণে নিয়ে আসেন। দুই মেয়াদে প্রেসিডেন্ট থাকার বিধান তিনি পার্টির পূর্ববর্তী কংগ্রেসে উঠিয়ে দিয়ে নিজের জন্য আজীবন প্রেসিডেন্ট থাকার পথ উন্মোচন করেন। এর ধারাবাহিকতায় এবার তিনি তৃতীয়বারের মতো প্রেসিডেন্টের দায়িত্ব নিতে যাচ্ছেন। মূলত মাও সেতুং-এর সময় সাংস্কৃতিক বিপ্লব বা শুদ্ধি অভিযানের নামে ভিন্নমত পোষণকারীকেও নেতৃত্ব থেকে বিদায়ের কৌশল ফিরিয়ে এনেছেন শি। তিনি এটি করছেন দুর্নীতিবিরোধী অভিযানের নামে। প্রতিবারই কংগ্রেসের আগে কমিউনিস্ট পার্টির বিভিন্ন পর্যায়ে নীরব শুদ্ধি অভিযান চলে। এর মাধ্যমে শি পার্টির মধ্যে বহুমতের লালনের পরিবর্তে একক কর্তৃত্ববাদিতার ধারা নিয়ে এসেছেন। এর প্রভাব পড়ছে দেশটি সার্বিক সিদ্ধান্ত গ্রহণ প্রক্রিয়ায়।

বৈশ্বিক অর্থনীতি থেকে বিচ্ছিন্নতা

চীন যে বিশ্বের দ্বিতীয় বৃহত্তম অর্থনীতির দেশে পরিণত হয়েছে তার পেছনে মূল অবদান হলো দেং জিয়াও পিং-এর সংস্কার ও যুগান্তকারী পদক্ষেপসমূহ। তার ব্যক্তি মালিকানা, মুক্তবাজার অর্থনীতি আর বৈশ্বিক বাণিজ্য ও অর্থনীতির সাথে চীনকে সমন্বয় করার ফলে আন্তর্জাতিক পুঁজির ব্যাপক প্রবেশ ঘটে চীনে। সে সাথে বিশ্ব বাজার উন্মুক্ত হয় চীনা পণ্যের জন্য। ব্যক্তি মালিকানার সুযোগ দেয়ায় চীনের মধ্যে ছোট বড় মাঝারি শিল্পের ব্যাপক বিকাশ ঘটে। চীনা নাগরিকরা বিশ্বের নামকরা বিশ্ববিদ্যালয় ও প্রযুক্তি প্রতিষ্ঠানগুলোতে প্রবেশাধিকার পায়। চীনা অর্থনীতি দশককালব্যাপী দুই অঙ্কের প্রবৃদ্ধির পর্বে প্রবেশ করে।

কিন্তু দেং পরবর্তী চীনা নেতৃত্ব বিশেষ করে শি জিনপিং নেতৃত্বে আসার পর বৈশ্বিক অর্থনৈতিক প্রতিষ্ঠান-বিশ্বব্যাংক আইএমএফসহ অন্যান্য প্রতিষ্ঠানে সংস্কারের দাবি উত্থাপন করে। আর এ ব্যাপারে সাড়া না পেয়ে উদীয়মান দেশগুলোকে নিয়ে ব্রিকস গঠন করে। এরপর বিশ্বব্যাংক আইএমএফ এশীয় উন্নয়ন ব্যাংকের বিকল্প প্রতিষ্ঠান হিসেবে নিউ ডেভেলপমেন্ট ব্যাংক এশীয় অবকাঠামো উন্নয়ন ব্যাংক গঠন করে। আন্তর্জাতিক মুদ্রা হিসেবে ডলার ইউরো পাউন্ডের বিকল্প ডিজিটাল মুদ্রা গঠনের উদ্যোগ এগিয়ে নেয়।
এ ছাড়া আন্তর্জাতিক বাণিজ্যের তথ্য পরিষেবার ব্যাপারে পশ্চিমা নিয়ন্ত্রিত সুইফট এর বিকল্পও তৈরি করে চীন। চীনের এসব উদ্যোগ যুক্তরাষ্ট্রের নেতৃত্বাধীন পশ্চিমা দেশগুলোর আন্তর্জাতিক ব্যবস্থায় কর্তৃত্বের স্বল্প মধ্য ও দীর্ঘ তথা সর্ব মেয়াদে চ্যালেঞ্জ হিসেবে চিহ্নিত হয়েছে। সঙ্গত কারণেই এসব উন্নয়নের ব্যাপারে পশ্চিমা দেশগুলো নজর রেখেছে এবং আতঙ্কিত হয়েছে। এর ফলে ডোনাল্ড ট্রাম্প প্রথম চীনের বিরুদ্ধে বাণিজ্য যুদ্ধ শুরু করেন। যুক্তরাষ্ট্রের প্রযুক্তি চুরির অভিযোগে বিভিন্ন চীনা নেটওয়ার্কে অভিযান চালান। বাণিজ্যে ট্যারিফ বৃদ্ধিসহ নানা কর্মসূচির সাথে সাথে বিনিয়োগ প্রত্যাহারেরও উদ্যোগ নেয়া হয়। জো বাইডেন ক্ষমতায় আসার পর এই মার্কিন নীতিতে বড় কোনো পরিবর্তন আসেনি। অধিকন্তু রাশিয়ার ইউক্রেন হামলা এবং এর জের ধরে তাইওয়ান ইস্যু নিয়ে উত্তেজনা সৃষ্টিতে দুই পক্ষের মধ্যকার উত্তেজনা বৃদ্ধি পেয়েছে।

সর্বশেষ কংগ্রেসে শি জিনপিং তাইওয়ানে শক্তি প্রয়োগের ব্যাপারে সুস্পষ্ট ইঙ্গিত দিয়েছেন। এ ক্ষেত্রে আগামীতে চীন তাইওয়ান ইস্যুতে যুদ্ধে জড়ালে দুই পক্ষের অর্থনৈতিক উত্তেজনা আরো বাড়বে। চীনের বিআরআই প্রকল্পের ব্যাপারে যুক্তরাষ্ট্র পরিষ্কার কোনো পদক্ষেপ না নিলেও কোয়াড, এশিয়ান ইকোনমিক কো-অপারেশনসহ বিভিন্ন জোট করার পেছনে চীনকে বেঁধে ফেলার উদ্দেশ্য সক্রিয় বলে মনে করা হয়। এসবকে কেন্দ্র করে পশ্চিমের সাথে চীনের লড়াই জোরদার হলে তা শুধু দুই পক্ষের বাণিজ্য ও বিনিয়োগ বাধাগ্রস্ত করবে না, সে সাথে তৃতীয় দেশসমূহে বিনিয়োগ ও বাণিজ্য বাধাগ্রস্ত হতে পারে। এতে চীন অর্থনৈতিক সঙ্ঘাতে জড়িয়ে পড়বে পশ্চিমা দেশগুলোর সাথে।

কৌশলগত সমীকরণে সঙ্ঘাত

ঐক্য ও সংহতির কথা বলে শি এটি স্পষ্ট করেছেন যে, তার দেশে একটি একক একনায়কতন্ত্র অবশ্যই থাকা আবশ্যক এবং সম্ভবত এটা শক্তিশালী করা প্রয়োজন। তিনি একই সাথে বৈশ্বিক নেতৃত্ব গ্রহণেও চীনকে এগিয়ে নিতে চাইছেন। চীন পশ্চিমের মোকাবেলা করতে দীর্ঘ সময় নিয়েছে। দেশটির বিশ্বের কর্তৃত্ব নেবার উচ্চাকাক্সক্ষা পশ্চিমা বিশ্বের সঙ্ঘাতের বিষয়টিও সামনে নিয়ে এসেছে। রাশিয়া-ইউক্রেন যুদ্ধে চীনের অবস্থান পাশ্চাত্যের মধ্যে যে অবিশ্বাস তৈরি করেছে তাইওয়ান প্রশ্নে সামরিক হস্তক্ষেপ সেটিকে আরো প্রত্যক্ষ সঙ্ঘাতে রূপান্তরিত করতে পারে।

চীন একসময় অন্য দেশ বা অঞ্চলে প্রভাব বিস্তারের ব্যাপারে প্রকাশ্য ভূমিকা পালন করত না। শি জিনপিং নেতৃত্বে আসার পর চীন প্রভাব বিস্তারের ব্যাপারে সক্রিয় উদ্যোগ নেয়। এর পর দক্ষিণ এশিয়ার দেশগুলোতে প্রভাব বিস্তার নিয়ে ভারতের সাথে, আর ভারত ও প্রশান্ত মহাসাগরে প্রভাব বিস্তারে যুক্তরাষ্ট্রের নেতৃত্বাধীন অকাস ও কোয়াড জোটের সাথে সঙ্ঘাত দেখা দেয়। চীন এর পাল্টা গ্লোবাল সিকিউরিটি ইনিশিয়েটিভ তৈরি করেছে। এর বিপরীতে গ্লোবাল ন্যাটো জোট তৈরির কথাও পশ্চিমের বিভিন্ন দেশ বলা শুরু করেছে। পশ্চিমের সাথে দক্ষিণ চীন সাগর, বঙ্গোপসাগর আশিয়ান সার্ক অঞ্চলে প্রভাব বিস্তারের প্রতিযোগিতা ক্রমেই তীব্র হয়ে উঠছে। মধ্যপ্রাচ্য ও আফ্রিকায়ও রাজনৈতিক অর্থনৈতিক ও কৌশলগত প্রভাব বিস্তারের প্রতিযোগিতা তৈরি হচ্ছে। চীনের সাথে পাশ্চাত্যের এই দ্বন্দ্বের মাত্রাগত বিষয়টি ইউক্রেন যুদ্ধের ব্যাপারে রাশিয়াকে চীন কতটা সহযোগিতা করবে তার ওপর নির্ভর করতে পারে। তবে কমিউনিস্ট পার্টির কংগ্রেসে শি জিনপিংয়ের বক্তব্যে এ বিষয়ে সক্রিয়তাবাদী নীতি বেইজিং নিতে পারে বলে আভাস পাওয়া গেছে। বাস্তবে এটি ঘটে থাকলে ইউরোপ-আমেরিকা বনাম চীন-রাশিয়া বলয়ের একটি কৌশলগত লড়াই আগামীতে দেখা যেতে পারে। এটি যে চীনের স্বাভাবিক বিকাশ ও উচ্চাকাক্সক্ষাকে বাধাগ্রস্ত করবে তাতে সন্দেহ নেই।

mrkmmb@gmail.com


আরো সংবাদ



premium cement