২৭ এপ্রিল ২০২৪, ১৪ বৈশাখ ১৪৩১, ১৭ শাওয়াল ১৪৪৫
`

হোওয়াইট সুপ্রিম্যাসি : বুদ্ধিজীবীর তত্ত্ব, খুনির বন্দুক

- ছবি : সংগৃহীত

শ্বেতাঙ্গ শ্রেষ্ঠত্ববাদের জন্ম বর্ণবাদ থেকে। তার দাবি অন্য বর্ণের মানুষের চেয়ে সেরা সাদা বর্ণের মানুষ। তারা যেহেতু সেরা, তাই তাদের আধিপত্য ও সরদারি চলবে অন্য সবার ওপর। সোজা বক্তব্য। কোনো রাখঢাক নেই। বক্তব্যটি সোজা হলেও এর ভেতরে আছে প্যাঁচ। কারণ এর আড়ালে আছে বৈজ্ঞানিক বর্ণবাদ। বৈজ্ঞানিক বা ছদ্মবৈজ্ঞানিক যুক্তির ওপর সে খাড়া হয়। মানবতাকে জৈবিকভাবে পৃথক গোষ্ঠীতে বিভক্ত করাকে বলা হয়েছে জাতিবাস্তবতা। কিন্তু তা প্রকৃতপক্ষে জৈবিক বর্ণবাদ। সেই যে ফ্রাসোঁয়া বার্নিয়ার (১৬২০-১৬৮৮) ত্বকের বর্ণ এবং কিছু শারীরিক বৈশিষ্ট্য দ্বারা মানুষকে পৃথক করেছিলেন এবং চারটি বিভিন্ন বর্ণে বিভক্ত করেন মানুষকে, সেখানে শ্রেষ্ঠত্ব ছিল সাদাদের!

দার্শনিক রবার্ট বয়েল (১৬২৭-১৬৯১) তো দাবি করে বসলেন সমস্ত জাতির সূচনা যেহেতু ঈভ ও আদম থেকে আর ঈভ ও আদমের গায়ের রং ছিল সাদা, তাই সাদাই মৌলিক, শ্বেতাঙ্গরাই শ্রেষ্ঠ। রিচার্ড ব্র্যাডলি (১৬৮৮-১৭৩২) তাঁর ‘ফিলোসফিক্যাল অ্যাকাউন্ট অব ওয়ার্কস’ (১৭২১) বইয়ে দাবি করেন, মানুষের বিভাজন মূলত ত্বকের ভিন্নতা থেকে। অন্যান্য শারীরিক চরিত্রও এর সাথে যুক্ত আছে। রেনেসাঁর উত্তরাধিকার পশ্চিমা চিন্তা ও মনকে যে আকার দিয়েছে, সেখানে সাম্য ও মানববাদের প্রবল মুখরতা সত্ত্বেও বর্ণবাদ তার তাত্ত্বিক বয়ান উচ্চারণ করে গেছে আপন স্বভাবে। সেই উচ্চারণ আমরা শুনি প্রতিটি কালখণ্ডে। দার্শনিক, বৈজ্ঞানিক, নৃতাত্ত্বিক ও বিশ্লেষকদের বয়ানে। এ ধারায় লর্ড কামেস (১৬৯৬-১৭৮২) কার্ল লিনিয়াস (১৭০৭-১৭৭৮), জন হান্টার (১৭২৮-১৭৯৩), বেঞ্জামিন রাশ (১৭৪৫-১৮১৩), ক্রিস্টোফ মাইনার্স (১৭৪৭-১৮১০), থমাস জেফারসন (১৭৪৩-১৮২৬), স্যামুয়েল স্ট্যানহোপ স্মিথ (১৭৫১-১৮১৯) জর্জেস কুভিয়ার (১৭৬৯-১৮৩২), আর্থার শোপেনহাওয়ার (১৭৮৮-১৮৬০) স্যামুয়েল জর্জ মর্টন (১৭৯৯-১৮৫১) ফ্রাঞ্জ আগনাজ প্রুনার (১৮০৮-১৮৮২) আর্থার ডি গোবিনেও (১৮১৬-১৮৮১), কার্ল ভোগ (১৮১৭-১৮৯৬) হারবার্ট হোপ রিসলে (১৮৫১-১৯১১), আর্নস্ট হেকেল (১৮৩৪-১৯১৯), প্যালাসিওস নাভরো (১৮৫৪-১৯৩১), জর্জেস ভ্যাচার দে লাপুজ (১৮৫৪-১৯৩৬), চার্লস ডেভেনপোর্ট (১৮৬৬-১৯৪৪) ... কী ধারাবাহিকতা! এর মানে হলো রেনেসাঁর কালপর্ব থেকে নিয়ে ঔপনিবেশিক আমলের অন্তিম মুহূর্ত অবধি সাদা শ্রেষ্ঠত্ববাদের পক্ষে তাত্ত্বিকতা-দার্শনিকতার স্রোত জারি থেকেছে। এর পক্ষে দাঁড় করানো হয়েছে ‘বৈজ্ঞানিক’ বয়ান। ফলে আজ যখন হোওয়াইট সুপ্রিম্যাসি নতুন তীব্রতায় মাথা তুলছে, তখন তার তাত্তি¡ক খাবার-দাবারের অভাব হবার কথা নয়। প্রেরণা লাভের উপাদানেরও কমতি থাকার নয়।

বৈজ্ঞানিক বর্ণবাদের সুসময় ছিল ১৮ ও উনিশ শতকে। ২০ শতকের শুরুর দিকে প্রবলভাবে জনপ্রিয় হয় অমানবিক ইউজেনিক্স, যার মাধ্যমে বিশেষ বৈশিষ্ট্যসম্পন্ন সঙ্গী তালাশ করে তথাকথিত মানব উন্নয়ন ও সুস্থ-সবল ভবিষ্যৎ প্রজন্ম তৈরির নামে হাজার হাজার মানুষকে বন্ধ্যা করা হয়েছিল, এমনকি কেড়ে নেয়া হয় বহু লোকের প্রাণ। এ ছিল বর্ণবাদেরই অনুশীলন। এর প্রস্তাবনা নিহিত ছিল ১৯১৬ সালে প্রকাশিত ম্যাডিসন গ্র্যান্ট (১৮৬৫-১৯৩৭) এর ‘দ্য পাসিং অব দ্য গ্রেট রেস’ গ্রন্থে। বইটি শিখিয়ে দেয় শ্রেষ্ঠ বর্ণকে কিভাবে সুরক্ষিত ও বর্ধমান করা যায়! জন্ম হয় শ্রেষ্ঠতম প্রজন্ম-তত্ত¡ ও ‘রেস সুইসাইড’ তত্ত¡। এ বই পড়ে হিটলার (১৮৮৯-১৯৪৫) এক চিঠি লেখেন গ্র্যান্টকে। জানান, ‘দ্য পাসিং অব দ্য গ্রেট রেস’ বইটি তার কাছে বাইবেলের সমান।

এ বাইবেলকে অবলম্বন করে নাজিবাদ পৃথিবীর জন্য নরকের বাজনা বাজাতে থাকে। ১৯২০ এর দশকের আগে, সমাজবিজ্ঞানীরা একমত হয়েছিলেন যে, সাদা বর্ণের মানুষ কৃষ্ণাঙ্গদের চেয়ে শ্রেষ্ঠ। তবে একে প্রমাণ করার একটি উপায় প্রয়োজন। সেরা উপায় হিসেবে বিবেচিত হলো বুদ্ধি পরীক্ষা। এরপরে সাদা নয়, এমন জনগোষ্ঠীর বুদ্ধির বয়সকে নাবালক অবস্থায় দেখানো হতো। তাদের বুদ্ধির গড়পড়তা বয়স ১২-১৪ বছর। এর চেয়ে অধিক বয়স্ক হয় না তারা। মানে গোটা জীবন বুদ্ধির বিচারে তারা অপ্রাপ্তবয়স্ক রয়ে যায়। বর্ণ ও বুদ্ধির দুনিয়ায় উড়তে থাকে সাদা শ্রেষ্ঠত্ববাদের পতাকা। এর সাথে ধর্ম ছিল কমবেশি যুক্ত, বরাবরই। শ্রেষ্ঠ হবার জন্য সাদা তো বটেই, খ্রিষ্টানও হতে হবে। তখনই কেউ শ্রেষ্ঠ এবং সাথে সাথে সভ্যও। শ্বেতাঙ্গ শ্রেষ্ঠত্ববাদী বহু গোষ্ঠীর উদ্ভব হয়েছে জিনগত বিশুদ্ধতার বিশ্বাসের ওপর ভিত্তি করে। ফলে তাদের শ্রেষ্ঠত্বের দাবির মাত্রা অনেক বেশি।

আরো নতুন তাত্ত্বিকতা সামনে আসে দ্রুতই। ১৯৮৮ সালে প্রকাশিত হয় ডেভিড লেইনের ‘দ্য হোয়াইট জেনোসাইড ম্যানিফেস্টো’। গ্র্যান্টের ‘রেইস সুইসাইডে’র তত্ত্বকে নতুন অবয়ব দেন লেইন। তার ম্যানিফেস্টো ব্যক্ত করে শ্বেতাঙ্গ জাতীয়তাবাদীদের মূল বক্তব্য। স্লোগানের ভাষায় লেইন লেখেন, ‘আমাদেরকে অবশ্যই আমাদের জনগণের অস্তিত্ব ও শ্বেতাঙ্গ শিশুদের ভবিষ্যৎ নিশ্চিত করতে হবে।’ মূল ইংরেজি বাক্যটি ছিল ১৪টি শব্দের। শ্বেতাঙ্গ জাতীয়তাবাদীদের কাছে এই বাক্য ছিল প্রেরণার প্রাণভোমরা, যাকে তারা বলত, ‘দ্য ফোর্টিন ওয়ার্ডস’। লেইন উজ্জীবিত হন আমেরিকান লেখক উইলিয়াম লুথার পিয়ের্স (১৯৩৩-২০০২) এর দ্বারা।

১৯৭৮ সালে পিয়ের্স ‘দ্য টার্নার ডাইরিজ’ নামে একটি শ্বেতাঙ্গ জাতীয়তাবাদী ফ্যান্টাসি উপন্যাস রচনা করেন। এ উপন্যাস এগিয়ে যায় শ্বেতাঙ্গদের রক্ষায় নিবেদিত যোদ্ধাদের কাল্পনিক সশস্ত্র লড়াইকে ঘিরে। যারা কেন্দ্রীয় সরকারের বিরুদ্ধে বিদ্রোহ করেছে। এ বই ছিল টিমোথি ম্যকভেই নামে এক সাবেক সেনাসদস্যের বাইবেল। যার ভিত্তিতে তিনি ১৯৯৫ সালে কুখ্যাত ওকলাহোমা সিটি বোমা হামলা চালান। ওই হামলায় নিহত হন ১৬৮ মানুষ। এই যে তত্ত্ব ও কর্মের হাত ধরাধরি, পরবর্তী কালপর্বে তাতে নতুন মাত্রা যোগ হয়। আমেরিকান মনোবিজ্ঞানী রিচার্ড জুলিয়াস হার্নস্টেইন (১৯৩০-১৯৯৪), আমেরিকান রাষ্ট্রবিজ্ঞানী চার্লস অ্যালান মারে (জন্ম : ১৯৪৩- ), আমেরিকান মনোবিজ্ঞানী ডোনাল্ড আই টেম্পলার (১৯৩৮-২০১৬) ব্রিটিশ লেখক-সাংবাদিক নিকোলাস ওয়েড (জন্ম : ১৯৪২- ), কানাডীয় মনোবিজ্ঞানী জন ফিলিপ রুশনসহ (১৯৪৩-২০১২) অনেকেই সাদা শ্রেষ্ঠত্বের ওকালতি করেন, তাত্ত্বিক উপাদান সরবরাহ করেন। হোওয়াইট সুপ্রিম্যাসিকে রাজনৈতিক মতাদর্শ ও পরিভাষা হিসেবেও ব্যবহার করেন কেউ কেউ। যার স্পষ্ট দাবি, শ্বেতাঙ্গদের সামাজিক, রাজনৈতিক, ঐতিহাসিক ও প্রাতিষ্ঠানিক আধিপত্যের নিশ্চয়তা। এ দাবিতে পশ্চিমা দুনিয়ায় দেশে দেশে তৈরি হয়েছে বর্ণবাদী বহু সংগঠন। যাদের অনেকেই নির্দিষ্ট জাতি ও ভিন্ন বর্ণের মানুষকে জাতিগতভাবে নির্মূলের ঘোষণা দিচ্ছে। মতাদর্শ হিসেবে সে শিল্প -সাহিত্য, সংস্কৃতিতে সক্রিয়। প্রথাগত প্রক্রিয়ায় তো বটেই, বিভিন্ন মিউজিক ভিডিও, ফিচার ফিল্ম ও প্রামাণ্যচিত্রেও শ্বেতাঙ্গ শ্রেষ্ঠবাদের অভিপ্রায়কে ফুটিয়ে তোলা হচ্ছে। তবে সবচেয়ে প্রবলভাবে সে এখন রাজনৈতিক। এটি এখন শক্তিমান এক আন্দোলন। অনেকটা নাজিজমের মতো। নাজিজম প্রধানত ইহুদি বিদ্বেষকে অবলম্বন করেছিল। হোয়াইট সুপ্রিম্যাসির প্রধান অবলম্বন মুসলিম ভয়, মুসলিম বিদ্বেষ। এ ধারার রাজনীতি নিজেদের লক্ষ্য নিশ্চিত করার জন্য প্রচার করছে হোয়াইট জেনোসাইডের ভীতি।

কী মানে এই জেনোসাইডের? তাদের মতে, আগামী ২০-৫০ বছরের মধ্যে শ্বেতাঙ্গ নিয়ন্ত্রিত দেশ যেমন আমেরিকা, কানাডা অস্ট্রেলিয়া এবং ইউরোপে মুসলিম জনসংখ্যা ১০ গুণ বেড়ে যাবে। তাদের সংখ্যা ও শক্তিবৃদ্ধি মানেই তো জেনোসাইড; মৃত্যু ও বিনাশ! হাজার বছর ধরে এদের সাথে চলে আসছে হোলি ওয়ার। সে যুদ্ধ এখনো চলমান। কিন্তু মুসলিমরা তো পশ্চিমের প্রাণকেন্দ্রে ঢুকে হোয়াইট রেস বা শ্বেতাঙ্গ জাতির মানুষকে সংখ্যালঘু বানাতে চলছে। বিপজ্জনক সেই জাতি নিজেদের সংস্কৃতিকে দিচ্ছে প্রতিষ্ঠা। এটি এক স্পষ্ট ষড়যন্ত্র, যুদ্ধ। কিন্তু পশ্চিমা দুনিয়ার শাসকরা পুঁজিবাদী প্রয়োজনে অভিবাসীদের আসতে দিচ্ছে। যাদের অনেকেই মুসলমান। এর মধ্য দিয়ে তারা সম্ভাব্য হোওয়াইট জেনোসাইডকে নিশ্চিত করতে সহায়তা করছে। এর বিরুদ্ধে লড়াই জরুরি। বার্নার্ড লুইস (১৯১৬-২০১৮) এর ইউরোবা তথা ইউরোপকে আরব্য ধর্ম ও সংস্কৃতি দিয়ে ঢেকে ফেলার ভীতি তৈরি এই তত্ত্বকে শক্তি জোগায়।

পশ্চিমা দেশগুলোতে অব্যাহতভাবে বাড়তে থাকা ‘মুসলিম জনশক্তিকে’ রুখে দাঁড়ানোটাই হোওয়াইট সুপ্রিম্যাসির অগ্রাধিকার। এই রুখে দাঁড়ানোটা শান্তিপূর্ণ হতে হবে, তা নয়। অস্ত্র ব্যবহার করতে হবে। এখানে মানবতার কোনো স্থান নেই। বাদামি চামড়ার বহিরাগতদের তাড়াতেই হবে। ওদের অস্তিত্বটাই এক আগ্রাসন! এই লড়াইয়ের যোদ্ধারা তাই হত্যার পদ্ধতি অবলম্বন করছে। বসনীয় সার্ব নেতা রাদোভান কারাদজিচ গত শতকের নব্বই দশকে বসনীয় যুদ্ধে আট হাজার মুসলমান পুরুষ ও বালককে হত্যার দায়ে অভিযুক্ত হন। তিনি অভিনন্দিত হয়েছিলেন সাদা শ্রেষ্ঠত্ববাদীদের দ্বারা। যদিও ২০১৬ সালে আন্তর্জাতিক অপরাধ আদালতে গণহত্যা ও মানবতার বিরুদ্ধে অপরাধের দায়ে কারাদজিচ ৪০ বছরের কারাদণ্ড পান।

২০১৯ সালের ১৫ মার্চ শুক্রবার জুমার নামাজ চলাকালে নিউজিল্যান্ডের আল নূর মসজিদ এবং ক্রাইস্টচার্চে লিনউড ইসলামিক সেন্টারে সংঘটিত সন্ত্রাসীরা গুলিবর্ষণের ঘটনা আমরা জানি। এতে প্রায় ৫০ জন নিহত হন ও কমপক্ষে ৫০ জন গুরুতরভাবে আহত হন। অপরাধী অস্ট্রেলিয়ান ব্রেন্টন ট্যারেন্টকে গ্রেফতার করা হয়, সে ছিল সাদা শ্রেষ্ঠত্ববাদের সৈনিক।

আমরা হিটলার ও টিমোথির মতো হত্যাকারীর বাইবেলের কথা জেনেছি। ব্রেন্টনের বাইবেল কী ছিল? সেটা ছিল ফরাসি দার্শনিক রেনৌদ কামুস (জন্ম : ১৯৪৬- ) এর ‘দ্য গ্রেট রিপ্লেসমেন্ট’ গ্রন্থ। বর্ণবাদ ও বিদ্বেষবিষাক্ত গ্রেট রিপ্লেসমেন্ট তত্ত¡ প্রচারে রনৌদ বলেছিলেন, ‘মুসলিমরা সবাই দুর্বৃত্ত ও সশস্ত্র, এরা সহসাই ফ্রান্স দখল করে নেবে।’ আদালত তাকে চার হাজার ইউরো জরিমানা করলেও তিনি হাসি দিয়ে উড়িয়ে দিয়েছিলেন জরিমানার দণ্ড। ব্রেন্টনের ছিল ৭৩ পৃষ্ঠার এক ম্যানিফেস্টো, কামুসের গ্রন্থনামই যার শিরোনাম : দ্য গ্রেট রিপ্লেসমেন্ট। সেখানে নিজেকে সে একজন রেসিস্ট আর ফ্যাসিস্ট বলে দাবি করে। সেখানে তার স্পষ্ট ঘোষণা, এই হামলা করেছি অভিবাসীদের এটা বোঝাতে যে, আমার মাতৃভূমি আমারই থাকবে। যত দিন পর্যন্ত শ্বেতাঙ্গরা বেঁচে থাকবে এই মাটি তাদের দখল করতে দেয়া হবে না। আমি চাই, আমাদের মানুষের অস্তিত্ব টিকিয়ে রাখা এবং আমাদের সন্তানদের ভবিষ্যৎ নিশ্চিত করা।
আমি সাধারণভাবে মনে করি এটি সন্ত্রাসী হামলা। কিন্তু এ হামলা দেশাত্মবোধক কাজ। যারাই আমাদের দেশে এসেছে, তারা দখলকারী। তাদের সবাই আক্রান্ত হবে। তাদের মধ্যে কোনো নিরীহ লোক নেই। ব্রেন্টনের ইশতেহারে যা উচ্চারিত, তা মূলত কামুসের চিন্তার অপরিশোধিত বয়ান।

এরকম হামলার ঘটনা পশ্চিমা দুনিয়ায় ঘটছে বারবার। হামলাকারীরা একই মানসিকতার সন্তান। নরওয়ের অসলো ও পার্শ্ববর্তী দ্বীপে ২০১১ সালে শ্বেতাঙ্গ সন্ত্রাসী আন্দ্রে ব্রেইভিক ৭৭ জন মানুষকে হত্যা করেছিল। ২০১৫ সালে চার্লস্টনে একটি গির্জায় হামলা চালিয়ে ৯ জনকে মেরে ফেলার ঘটনার বন্দুকধারী ডিলান রুফ ছিল শ্বেতাঙ্গবাদী। ২০১৭ সালে কানাডায় এক মসজিদে হামলা চালিয়ে ছয়জনকে হত্যা করে শ্বেতাঙ্গ শ্রেষ্ঠত্ববাদী আলেসান্দ্রো। ২০১৮ সালে আফ্রিকা থেকে আসা ছয় অভিবাসীকে মাসেরাতা শহরে প্রকাশ্যে হত্যা করে লুকা ত্রাইনি নামের সাদা শ্রেষ্ঠত্ববাদী। সে ছিল হিটলারের অনুরাগী। ২০১৮ সালে আমেরিকায় শ্বেতাঙ্গ চরমপন্থীরা কমপক্ষে ৫০টি হত্যাকাণ্ডের সাথে জড়িত ছিল। ২০১৯ সালের আগস্টে যুক্তরাষ্ট্রের এলপাসোতে অতর্কিত হামলায় নিহত হন ২২ জন। শ্বেতাঙ্গ হামলাকারী প্যাট্রিক ক্রুসিয়াস একটি অশ্বেতাঙ্গ সংখ্যাগরিষ্ঠ শহরে এই হামলা চালানোর আগে টেক্সাসে কয়েক শ’ মাইল গাড়ি চালিয়ে এসেছিল। সে ছিল হিটলার দ্বারা উজ্জীবিত। অ্যান্তন লুন্ডিন পিটারসনও হিটলারের অনুরাগী ছিল, সুইডেনে সে হত্যা করে দুই অভিবাসী শিশুকে। ভেনিসীয় আইনজীবী ও সামরিক কর্মকর্তা মার্কো অ্যান্তনিও ব্রেগাডিন ১৫২১ সালে ভেনিসে বন্দী তুর্কিদের হত্যা না করে শান্ত হতে পারছিলেন না। একটি চুক্তি ভঙ্গ করে তিনি হত্যা করেন মুসলিম বন্দীদের। এখন পর্যন্ত তাকে বীরের মর্যাদায় স্মরণ করে খ্রিষ্টানরা।

আমেরিকায় শ্বেতাঙ্গ শ্রেষ্ঠত্ববাদীদের মধ্যে ক্রিস্টোফার রুফোকে মনে করা হয় সবচেয়ে একগুঁয়ে তাত্ত্বিক। রাজনৈতিক শুদ্ধাচার বা পলিটিক্যাল কারেক্টনেসে তিনি আপত্তি তুলছেন শ্বেতাঙ্গবাদের আওতায়। অল্টারনেটিভ রাইট বা অল্ট রাইট আন্দোলন আমেরিকায় একই কথা বলছে। পলিটিক্যাল কারেক্টনেসকে এরা সহ্যই করতে পারে না। প্রেসিডেন্ট ট্রাম্পকে এরা খুবই পছন্দ করে। আমরা আমেরিকায় ট্রাম্পের অবয়বে দেখলাম এমন প্রেসিডেন্ট, যিনি সরাসরি পলিটিক্যাল কারেক্টনেসকে উপেক্ষা করে এগিয়েছেন।

২০১৬ সালে প্রেসিডেন্ট নির্বাচনের সময় যখন ডোনাল্ড ট্রাম্পের বিরুদ্ধে বর্ণবাদ, ইসলামবিদ্বেষ, সেমিটিক বিদ্বেষের মতো অভিযোগ ওঠে, তখন তার পক্ষে এগিয়ে এসেছিল অল্ট রাইট গোষ্ঠী। তারা মনে করিয়ে দেয় কু ক্লাক্স ক্ল্যানের কথা, যার সদস্যরা সাদা কস্টিউম পরে দক্ষিণাঞ্চলীয় রাজ্যগুলোতে অশ্বেতাঙ্গদের হত্যা করত। কিন্তু আমেরিকায় সাদা শ্রেষ্ঠত্ববাদী গোষ্ঠী তারাই একা নয়। কেননা সেখানে আছে পামেলা গেলারের স্টপ ইসলামাইজেশন ইন আমেরিকার মতো ভয়ঙ্কর ঘৃণাবাদী সংগঠন। এসব গোষ্ঠীর সদস্যরা যুক্তরাষ্ট্রে যে অভ্যন্তরীণ সন্ত্রাসের দরোজা খুলে দিয়েছে, তা এখন আমেরিকার জন্য সবচেয়ে বড় হুমকি। যুক্তরাষ্ট্রের নিউ ইয়র্ক অঙ্গরাজ্যের বাফেলো শহরের একটি সুপারমার্কেটে পেটন গেন্ড্রন নামের এক শ্বেতাঙ্গ তরুণের নির্বিচার গুলিবর্ষণে ১০ জন নিহত ও তিনজন আহত হয়েছে। ঘটনাটি ঘটে ১৪ মে, ২০২২ এ। ঘটনাকে ‘বর্ণবাদী সহিংস হামলা’ বলে বর্ণনা করে নিউ ইয়র্ক পুলিশ। পুলিশের মতে, বর্ণবাদে উৎসাহী হয়ে হামলার ঘটনাটি ঘটিয়েছে ঘাতক। সুপার মার্কেটটি অবস্থিত কৃষ্ণাঙ্গ অধ্যুষিত এলাকায়। হতাহতদের ১১ জনই কৃষ্ণাঙ্গ। হামলাকারী ৩২০ কিলোমিটারেরও বেশি গাড়ি চালিয়ে ইচ্ছাকৃতভাবে কৃষ্ণাঙ্গ প্রধান এলাকা খুঁজে বের করেছিল। তার হামলার লক্ষ্য কী ছিল, সেটা তার অনলাইনে প্রকাশিত ইশতেহার পাঠে বোঝা যায়। হামলার আগে ইশতেহারটি অনলাইনে পোস্ট করে সে। সংখ্যালঘু গোষ্ঠীর প্রতি তার বিরক্তির কারণ ব্যাখ্যা করতে গিয়ে ‘শ্বেতাঙ্গ গণহত্যা’ এবং ‘শ্বেতাঙ্গ প্রতিস্থাপন’ ষড়যন্ত্রের তত্ত্ব উল্লেখ করেছে সে। সাম্প্রতিক শ্বেতাঙ্গবাদী হামলাগুলোতে ‘প্রতিস্থাপন তত্ত্ব’ বা রিপ্লেসমেন্ট থিওরি’ হয়ে উঠছে অনুঘটক। দেশে দেশে তারা করছে ম্যাস শুটিং। এর পেছনের প্ররোচক এই তত্ত্ব।

শুধু আমেরিকা নয়, গোটা ইউরোপে নিজেদের শ্রেষ্ঠত্বের যে অহম বর্ণবাদের আকারে এতদিন চর্চিত হয়েছে, তা হিংসা ও সন্ত্রাস হয়ে পশ্চিমা সমাজ ও রাজনীতিকে গভীরভাবে প্রকম্পিত করছে। তৈরি করছে অশ্বেতাঙ্গ, বিশেষত মুসলিমদের ইচ্ছেমতো হত্যার যুক্তি ও মানসিকতা। এর ফলাফল পশ্চিমা দুনিয়াকে বিপন্ন করবে কেবল। যদিও সেখানে সাদা ত্বকের এমন মানুষ কম নন, যারা গায়ের রঙের ভিত্তিতে নিজেদের শ্রেষ্ঠ ও অন্যদের তুচ্ছ মনে করতে রাজি নন। তাদের কাছে ‘সাদা’ একটি রং, ‘সাদা’ মানে নয় শ্রেষ্ঠত্বের কোনো মানদণ্ড কিংবা প্রাধান্যবিস্তারের কোনো আদর্শ!

বস্তুত পশ্চিমারা নিজেদের ঔপনিবেশিকতাকে দৃঢ় ও যথার্থ করার জন্য মানুষকে বিভিন্ন শ্রেণীতে বিভক্ত করার খেলায় গায়ের রংকে সামনে আনে প্রকটভাবে। সাদা চামড়ার মানুষ মানেই প্রথম শ্রেণীর মানুষ, তারা হবে শাসক ও শিক্ষক, তাদের সমাজ-সংস্কৃতি আলোকমণ্ডিত, এমন এক ভাবধারা তৈরির কোশেশ চালায় তীব্রভাবে। এর মধ্য দিয়ে নিজেদের প্রভুত্বকে অন্যদের ওপর চাপিয়ে দেয়ার প্রয়াস জারি রাখে। পশ্চিমা শিল্পে, সাহিত্যে, বিজ্ঞানে, দর্শনে, মনস্তত্ত্বে, রাজনীতিতে নিজেদের শ্রেষ্ঠত্বের সেই অহম নানাভাবে চিৎকৃত। পশ্চিমা সেই শ্রেষ্ঠত্বের অহম দুনিয়ার জন্য বিপদ তৈরি করেছে শুধু। উগ্র জাতীয়তাবাদ ও বর্ণবাদী শ্রেষ্ঠত্বের দম্ভ দুনিয়াকে ঠেলে দিয়েছিল দু’টি বিশ্বযুদ্ধের প্রলয়ে। এখন তা যে নতুন চরিত্রে দাঁত-নখ বের করছে, এর ফলাফল ভালো কিছু হবার নয়; কারো জন্যই। যে ব্রেন্টনরা ঘৃণার বন্দুক দিয়ে গুলি করে মানুষ মারছে, তারা হয়তো পরিণতি খেয়াল করতে পারছে না। কিন্তু যে তাত্ত্বিকরা এর পথনির্দেশ করছেন, তাদের অপরিণামদর্শিতা বিস্ময়কর!

লেখক : কবি, গবেষক
71.alhafij@gmail.com

 


আরো সংবাদ



premium cement