২৭ এপ্রিল ২০২৪, ১৪ বৈশাখ ১৪৩১, ১৭ শাওয়াল ১৪৪৫
`

তেঁতুলতলা মাঠ

- ছবি : সংগৃহীত

অবশেষে প্রধানমন্ত্রীর হস্তক্ষেপে তেঁতুলতলা মাঠটি বাঁচল। পুলিশ আর কোনো স্থাপনা নির্মাণ করবে না, বলেছেন স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী। তিনিও ধন্যবাদার্হ, কেননা, তিনি কথাটি জানানোয় প্রধানমন্ত্রী বিষয়টি জানতে পেরে বদান্ততা দেখাতে পারলেন। সরকার যে কলাবাগানের ওই মাঠ ব্যবহারকারী শিশুদের ভালোবাসে, ঢাকার শিশুদের ভালোবাসে তা আমরা জানি। শুধু শিশু নয়, ঢাকার সব মানুষকেই ভালোবাসে, তাই তো বেশির ভাগ উন্নয়ন প্রকল্প ঢাকাকেন্দ্রিক। কেবল ঢাকাই নয়, দেশের বিভিন্ন এলাকায়ও চলছে সরকারের মেগা প্রকল্প। সেগুলো সরকারের রোডম্যাপের অংশ। আর রোডম্যাপের নির্মাতা ও নির্দেশক আমাদের প্রধানমন্ত্রী। তিনি না বললে যে কিছু হয় না; তা বোঝা গেল ছোট, বলতে গেলে এক ছটাক খোলা জায়গা, যেখানে তেঁতুলগাছ আছে কি নেই, বা অন্য কোনো গাছের পাতা ঝরে কি না, তাও সন্দেহ, তবু মাঠটি তেঁতুলতলা মাঠ, সেই মাঠটি তার নির্দেশেই রক্ষা পেল।

মাঠ শব্দটি আমাদের খুব প্রিয়। আমরা গ্রামের বাসিন্দা ছিলাম। ফলে স্কুলের মাঠ ছাড়া আর কোনো মাঠ ছিল না। তবে ছিল চারদিকে অবারিত খোলা জমির প্রান্তর আর বাতাস। তীব্র তাপদাহে কাতর ও ক্লান্ত মানুষ গাছের ছায়ায় বসে জিরাতেন। এতে শান্তি পেতেন। গ্রামে আজো গাছপালা বেশ আছে। কিন্তু দেশের শহরগুলোতে নেই নিঃশ্বাস নেওয়ার মতো খোলা জায়গা ও খেলার বা সবুজ গাছপালাময় অক্সিজেন ফ্যাক্টরি, যেখান থেকে আমরা পাই টন টন অক্সিজেন, বিনা পয়সায়। না, কোনো গ্যাস বা পাওয়ার বা ওই রকম কোনো কোম্পানির বিল পরিশোধ করতে হয় না সেই অক্সিজেন ফ্যাক্টরির মালিককে। অক্সিজেন ফ্যাক্টরির মালিক অদৃশ্য। নিরাকার তিনি। দেখা যায় না। ধরাও যায় না। কেবল তাঁর কাছে আর্জি জানানো যায়। তিনি খুলে রেখেছেন তাঁর দুনিয়ার সব দরোজা-জানালা, যাতে আমরা ভোগী মানুষেরা নিতে পারি বিনা কষ্টে, বিনা পরিশ্রমে, বিনা নির্দেশে।

এ ব্যবস্থা আমরা অনুভব করি না বলেই তেঁতুলতলা মাঠ নিয়ে রাস্তায় নামতে হয়। প্রতিবাদ জানাতে হয়, এই মাঠ, মাঠই থাকবে, এখানে পুলিশের ভবন উঠবে না। জায়গাটা কার, সেটা জানা গেল, পুলিশের। তার আগে কার ছিল? জেলার প্রশাসক যেহেতু পুলিশের আবেদনের বিপরীতে বরাদ্দ দিয়েছেন, তাতেই বোঝা গেল ওই জেলা প্রশাসনই এর মালিক। আবার জেলার মালিক সরকার। আর সরকারের সব সম্পদই জনগণের। জনগণ যেহেতু সংবিধান অনুযায়ী দেশেরই মালিক, তাই কলাবাগান তেঁতুলতলা মাঠের মালিক জনগণ, যাদের কিছু অংশ কলাবাগান এলাকায় বাস করেন। তারা চান, তেঁতুলতলা মাঠে তাদের নিঃশ্বাস নেয়ার জায়গায় কোনো স্থাপনা না উঠুক। সেটা পুলিশেরই হোক বা কোনো ভূমিদস্যুরই হোক, তা তারা চান না। ভূমিদস্যুর কথা যখন উঠল, যারা সরকারি জমি দখল করে নিয়ে নানান জটিল ভূমি ব্যবস্থাপনার কারিগরদের সহযোগিতায় গ্রাস করে নেন, সঠিক বা বেঠিক নকশার অনুমোদনকারীদের সাহায্যে সেখানে বসবাসের সিটি নির্মাণ করেন, তখন আমরা বাহবা দিই। কেননা, এমন পরিকল্পনাই তো চাই। কিন্তু একবারও এ-প্রশ্ন মনে জাগে না যে, ওই জায়গাটি কি সরকারি ছিল, পড়ুন, জনগণের ছিল, নাকি ব্যক্তিগত সম্পত্তি কিনে নিয়ে আবাসন প্রকল্প গড়ে তোলা হয়েছে।

আমরা খেয়াল করি না যে, সেই আবাসন প্রকল্পের নকশায় খেলার মাঠ, সবুজ বনানী, পুকুর, মসজিদ, বাজার-ঘাট করার মার্কেটের জায়গা দেখানো থাকলেও, বাস্তবে নেই। মানে নকশায় আছে, বাস্তবে নেই। আমি যে পরিকল্পিত এলাকার বাসিন্দা, সেখানেও ওই সব সামাজিক সুযোগ-সুবিধার ব্যবস্থা রাখা হয়েছিল, কিন্তু ক্রেতাদের কেনার উৎসাহে সেসব জায়গা তাদের কাছে বিক্রি করে দেয়া হয়েছে। নিঃশ্বাস নেয়ার জায়গা আজ আর নেই। ঢাকা মহানগরের উন্নয়ন একটি সামাজিক ও আবাসিক প্রয়োজনের দিক থেকে করা হয়ে থাকলে (অতীতে ছিল, লোভ গ্রাস করে নিয়েছে) আজ আমরা বলতে পারতাম না যে এই মহানগর একটি রাজনৈতিক সমাজের রাজধানী হলেও আজ এটি একটি অচল বা কংক্রিটে মোড়া মৃত মহানগর। নানাভাবে আমরা এ মহানগরকে মৃত বা ডেড সিটি বলতে পারি। নগর-মহানগরের যে ধারণা সারাবিশ্বে আছে, তার সাথে তুলনা করলেও আমরা বুঝতে পারব। এর জন্য বিশেষজ্ঞ হতে হবে না। উদাহরণ হিসেবে বিশ্বের কোনো বড় মহানগরের নাম বলতে পারি, যেখানে সড়ক পরিকল্পনা করা হয়েছে নেচার সাথে নিয়ে। সেই মহানগরের মধ্যিখানে বিশাল হাজার/দেড় হাজার একরের পার্ক ও পন্ড/পুকুর আছে। না, আমি সেসব মহানগরের নামও বলব না, সেসবের রোড ডিজাইনের বিষয়েও কথা বলব না। কারণ সেগুলোতে অনেক জায়গা আছে। দেশটিও বাংলাদেশের চেয়ে কয়েক শ গুণ বড়। আমাদের মহানগর আকারে যেমন ছোট তেমনি মাস্টারপ্ল্যানও ছোট। কিন্তু বলতে গেলে এ মহানগর বেড়ে চলছে দ্রুত লয়ে। মাত্র ৫০ বছরে এই ঢাকা পাল্টে গেছে। শান্তশিষ্ট মহানগরের রূপটি ১৯৭০ সালে আমরা যেমন দেখেছি, তাতে এটা বিশ্বাস করতে কষ্ট হয়, এটাই কি আমাদের যৌবনের সেই সুন্দর শহরের বর্তমান রূপ? অবিশ্বাসের চোখে দেখা ঠিক না। ঢাকার প্রধান রূপ ছিল এর সবুজ এলাকা আর নান্দনিকতায় পূর্ণ স্থাপনা। রমনায় যে সবুজ পার্কটি ছিল, তা তেমনভাবে অটুট আছে বলতে পারি। কিন্তু কেন, কি প্রয়োজনে সেখানেও একটি স্থাপনা তোলার অধিকার দেয়া হয়েছে; তার জবাব কে দেবেন? পাশের রাজনৈতিক ইতিহাসের সবচেয়ে নান্দনিক গাছপালার রাজ গড়ে উঠেছিল, সেখানে প্রায় সব গাছপালা বিরান করা হয়েছে। যদিও এগুলো সরকারের চিন্তার মধ্যে থাকা উচিত। সরকার প্রশাসন একটি মেকানিজমের নির্দেশক সংগঠন, কিন্তু যারা চালান, তারা তো চিন্তাশীল মানুষ, সৃজনী ভাবনায় তারা উজ্জ্বল, তারা কেন সোহরাওয়ার্দী উদ্যানের গাছ কাটার অনুমতি দিলেন। গাছ রেখেও পুকুর বা লেক তৈরি হতে পারত, হতে পারত টাওয়ারও, রূপসীর সৌন্দর্যও অটুট রাখা যেত। মাত্র দুটি উদ্যান আমাদের হৃদয়ের মধ্যে ছিল বা আছে আর আছে পচে যাওয়া একটি লেককে নতুন বিন্যাসে সাজিয়ে নান্দনিক করে তোলার উদাহরণ, তার নাম হাতিরঝিল। একটিমাত্র, নতুন প্রকল্প, যাতে চিন্তার স্ফুরণ দেখতে পাচ্ছি। কিন্তু এই কংক্রিটের ভেতরে কেবল তো কংক্রিটই আছে, প্রাণের জন্য নেই অক্সিজেন ফ্যাক্টরি।

২.
ঢাকা মহানগরের আকার ৩০৪ দশমিক শূন্য ৪ বর্গকিলোমিটার বা ১১৮.২৯ বর্গমাইল। এ আকারটি কি খুব ছোট? পাশের দেশের প্রাদেশিক শহর কলকাতার চেয়ে ছোট? কলকাতায় গড়ের মাঠের মতো বিশাল পার্ক আছে, নিউ ইয়কের ম্যানহাটানের হৃৎপিণ্ডের মধ্যে আছে সেন্ট্রাল পার্ক। আর আছে অনেক সবুজে মোড়ানো পার্ক, মানুষের খেলাধুলা ও বিনোদনের, নিঃশ্বাস নেয়ার সবুজ প্রকৃতি, অক্সিজেন ফ্যাক্টরি।

আমাদের এই উন্নয়নমুখী রাজধানীতে কি আর কোনো পার্ক আছে, যার নাম বলতে পারি? মোহাম্মদপুর এলাকায় একটি, দুটি পার্ক আছে বটে, কিন্তু এতটা ছোট যে, কী বলব। মিরপুরে বোটানিক্যাল গার্ডেন, চিড়িয়াখানার সবুজ এলাকা ছাড়া আর কি খোলা প্রান্তর আছে মহানগরের বাসিন্দাদের জন্য?

৩.
তেঁতুলতলা মাঠ নিয়ে কথা বলতে গিয়ে কোথায় এসেছি, বুঝতেই পারছেন; কেন এসেছি। তেঁতুলতলা মাঠ উপলক্ষমাত্র। মাননীয় প্রধানমন্ত্রী এটি রক্ষা না করলে পুলিশের দাপটে ভেসে যেত প্রতিবাদীদের অধিকার, দাবি ইত্যাদি। আমরা সৌভাগ্যবান যে আমাদের এমন একজন প্রধানমন্ত্রী আছেন, যিনি গোচরে গেলেই পজিটিভ কাজটি করে দেন। কিন্তু তার পক্ষে কি তেঁতুলতলার মতো ক্ষুদ্র একটি মাঠ নিয়ে ভাবার সময় আছে বা তিনি কেন এ-নিয়ে ভাববেন? তার প্রশাসন আছে। মন্ত্রী আছেন, রাজনৈতিক সহকর্মী আছেন, তারা কী করেন সারাদিন? প্রশাসনের দায়িত্ব কি কেবল চেয়ারের পেছনে তোয়ালে ঝুলিয়ে অফিস করা নাকি কখনোবা সরেজমিন দেখা উচিত, বিষয়টি কী? পুলিশ চেয়েছে, আর আগপাছতলা না ভেবে, না বুঝেই বরাদ্দ দিয়ে দিলেন। এটা যে পাবলিক ইন্টারেস্টের জায়গা, একটা মাঠ, শিশু-কিশোরদের প্রাণ উচ্ছ্বাসের এক টুকরো আকাশ, সেটা কেন পুলিশের থানাবাড়ি বানানোর জন্য দেবেন। জনগণের চেয়ে কি পুলিশি সেবা বড়? পুলিশের যে ইমেজ, তাতে বাসিন্দরা তাদের পাশে থানা-পুলিশ চান না। তারা নিরাপত্তার চেয়ে ভীতি সঞ্চারী অধিকমাত্রায়। পুলিশকে বুঝতে হবে, তাদের জনগণ কেন ভয় পায়? তারা জননিরাপত্তার কাজে ব্যস্ত, তাহলে ভয় কেন? ভয় পায় কারণ, কোনো ঘটনা ঘটলেও পুলিশ তাদের মনমত নিরীহদের ধরে নিবে, অর্থের বিনিময়ে ছেড়ে দেবে, রাজনৈতিক বিরোধী হলে আসামি করবে। যেমন নিউ মার্কেটের সংঘর্ষের ঘটনায় বিএনপির মকবুল হোসেনকে আটক করেছে। রিমান্ড শেষে কারাগারে পাঠিয়েছে।

পুলিশকে এই ইমেজ থেকে, এ ধরনের কর্ম থেকে বিরত থাকতে হবে। ডিবি পুলিশই প্রমাণ করেছে যে, চাইলে পুলিশ সব অপরাধীকেই চিনতে পারে, ধরতে পারে, সেই চোখ তাদের আছে। তাদের সুকাজের জন্য অবশ্যই প্রশংসা করব আমরা। কিন্তু অন্যায়, অপকর্ম ও অপরাধে তাদের সমালোচনা করব। এর চেয়ে বেশি কিছু কি করতে পারি আমরা?

৪.
ক্রমবর্ধমান মহানগর ঢাকায় মিনিমাম ১৫টি সবুজ-ঘেরা উদ্যান করতে হবে। প্রত্যেক উদ্যানের আকার হতে হবে নিদেনপক্ষে ৫০০ থেকে ১০০০ একরের। তার ভেতরে লেক বা পুকুর থাকতে হবে। খেলার মাঠ থাকতে হবে। বসার বেঞ্চ ও শৌচাগার থাকতে হবে, যা প্রতিদিনই পরিষ্কার পরিচ্ছন্ন ও দুর্গন্ধমুক্ত রাখতে হবে। পারিবারিক পিকনিকের বা আউটিং বা হ্যাঙওভারের আয়োজনসমৃদ্ধ হতে হবে। এ-সবই আমাদের দাবি। আমাদের সাংস্কৃতিক জীবনের জন্য, আমাদের নিঃশ্বাস নেয়ার জায়গা হিসেবে এটা অতি জরুরি। রাজউকের নগর পরিকল্পনায় যেমন তা থাকতে হবে, তেমনি বাস্তবায়নও করতে হবে। ঢাকার জন্য একটি মহাপরিকল্পনা অতি জরুরি যেখানে যাতে কোনো রকম অপরিকল্পনা না থাকে।

৫.
আমাদের দাবি তখনই পূরিত হতে পারে, যদি কেন্দ্রীভূত রাজনৈতিক ক্ষমতার উৎস বলেন, হ্যাঁ, করুন। এটা প্রয়োজন।


আরো সংবাদ



premium cement