২৭ এপ্রিল ২০২৪, ১৪ বৈশাখ ১৪৩১, ১৭ শাওয়াল ১৪৪৫
`

সড়ক নিয়ে নিয়ন্ত্রকদের রাজনীতি

- ছবি : নয়া দিগন্ত

আসন্ন ঈদুল ফিতরে ঢাকা মহানগরে বাস করেন এমন এক কোটি ২০ লাখ মানুষ তাদের গ্রামের বাড়ি বা উপজেলা, জেলা শহরের বাড়িতে যাবেন সপরিবারে। এটা আমি দেখে আসছি গত ৫০ বছর ধরে। ঢাকায় বসবাসরত মানুষেরা নাড়ির টানে গ্রামে যায়--- এই ধারণা নিয়েই আমরা আছি। নাড়ি পোঁতা আছে গ্রামে, যেখানে তাদের বাবা-মা বাস করেন। এটাই স্বাভাবিক যে সন্তানেরা ঈদে বাবা-মায়ের কাছেই যাবে। এই যাওয়াটা নাড়ির টান বলা হলেও আসলে চাকরিজীবীদের এর বাইরে ভাবার উপায় নেই। তাদের সাংবাৎসরিক কাজের ধারার মধ্যে দুটি পবিত্র ঈদই একটু নিঃশ্বাস নেবার জায়গা। কিন্তু সেই নিঃশ্বাস নেবার জায়গাটি আজ শঙ্কা আর আশঙ্কায় ভর্তিÑ ঠিকমতো গন্তব্যে, মা-বাবার কাছে যেতে পারবে তো? এই শঙ্কা দু’-ধরনের। এক. ঠিক সময়ে (বেঠিক সময়ে হলেও ক্ষতি নেই) বাড়িতে পৌঁছানো যাবে তো? দুই. নাকি যানবাহনের চাপে, ঘণ্টার পর ঘণ্টা অপেক্ষার সিংহাসনে বসে বিরক্তিকর যাত্রা উপভোগ না দুর্ভোগ করতে করতে যাবে মায়ের কোলে। নাকি পথি মধ্যে, যাত্রাপথের প্রতিযোগিতায় নাস্তানাবুদ হয়ে দুর্ঘটনার শিকার হবে? ফি বছর এই দৃশ্য সড়কে ও নৌপথে আমরা দেখছি। দুর্ঘটনা আর মৃত্যুর মধ্যে ওই মিছিল থেকে যারা বেঁচে যান, তারা অবশ্যই আল্লাহর রহমতে সিক্ত মানুষ, না হলে তারা বেঁচে বাবা-মায়ের কোলে গেলেন কেমন করে?

একে আমরা বলছি ঈদ আনন্দের ভোগান্তি। ওই ভোগান্তির মধ্যেও লুকিয়ে থাকে ঈদের আনন্দ, যা মা-বাবার সঙ্গে একত্রে ঈদ উদযাপন করার আনন্দ।

২.
যাবেন তো মা-বাবার কাছে ঈদের ছুটিতে, কিন্তু যাবেন কেমন করে? ঢাকা থেকে বেরুবার চারটি পথ/সড়ক আছে। সব থেকে ব্যস্ত ও বহু জেলার সঙ্গে সংযুক্ত হলো ঢাকা-টাঙ্গাইল হয়ে যমুনা সেতু পার হয়ে গোটা উত্তরাঞ্চলে যাওয়ার মহাসড়ক। নামে মহাসড়ক হলেও ওই পথগুলো মহাসড়কের সুযোগ সুবিধা, যানবাহন ধারণ, যান চলাচলের গতি ও সড়কের ডিজাইন ও সব ক্ষেত্রের ব্যবস্থাপনা দেখলে তাকে মহাসড়কের মর্যাদায় বসানো যায় না।

তার পরও আমরা বলিÑ নাই মামার চেয়ে কানা মামা ভালো। এই লোকসত্তায়ই আমাদের কানা সড়কগুলোকে মহাসড়কের মর্যাদায় সিক্ত করা যায়। না হয় তাই করা হলো; তা প্রতি বছর যে ওই মহাসড়কে এবং রাজধানীর সড়কে অ্যাক্সিডেন্টে মারা যায় মানুষ, সেই ছবিটা কি আমরা হারিয়ে ফেলব? মানে এ বছর আর কোনো অ্যাক্সিডেন্ট হবে না এবং যাত্রীরা যথাসময়ে বা নির্ধারিত সময়ে গন্তব্যে পৌঁছাতে পারবে। আনন্দ বরবাদ করে দিতে আর কোনো দুর্ঘটনার শিকার হবে না ঘরে ফেরা কোনো যাত্রী!
এই আশা নিয়েই আমাদের যাত্রীরা যাত্রা করুক বাড়ির উদ্দেশে, নাড়ির টানে, মায়ের কাছে।

৩.
কিন্তু প্রশ্ন হচ্ছে, যারা বাড়িতে যাচ্ছে তারা সশরীরে, নির্বিঘেœ, আনন্দময়চিত্তে যেতে পারবে তো?

এ প্রশ্নের জবাব কি আমরা দিতে পারব? কী করে দেব। যখন দেখি বাসগুলো উন্মত্তপ্রায় ছুটে আসছে, তখন শঙ্কা গলায় উঠে আসে। আমার এক ঘনিষ্ঠ আত্মীয়া ঢাকা থেকে বাড়িতে যাচ্ছিলেন। তিনি ঢাকা-টাঙ্গাইল মহাসড়কের করটিয়া বাইপাসে নেমে রাস্তা পার হতে যাচ্ছিলেন, তাকে একটি বাস/ট্রাক পিষে দিয়ে চলে যায়। তিনি হত্যার শিকার হন। এখন এই হত্যার দায়টি কার কাঁধে চাপবে? যানবাহনের চালকের কাঁধে, নাকি পথচারীর?

এ প্রশ্ন আপনাদের কাছে রাখা হলো। কেননা, আপনারাই তো আগামী দিনগুলোতে যেকোনোভাবে, যেকোনো সড়কে বা মহাসড়কে এ-রকম সড়ক দুর্ঘটনার শিকার হয়ে প্রাণ হারাবেন। কিংবা হারাতে পারেন। আপনারাই বিবেচনা করুন এই সব হত্যার দায় কার।

দাবি করা হয়, ঢাকা থেকে বেরুবার সড়কগুলো বেশ ভালো করা হয়েছে। সত্য মিথ্যা যাচাই করতে পারবেন যাত্রীরা। আমরা সংবাদপত্রের মাধ্যমে, টিভির পর্দায় যতটা দেখি, রিপোর্টিংয়ে যতটা শুনি, সেইটুকু নিয়েই আমাদের জানা, বোঝা ও মন্তব্য করা। কিন্তু যানবাহনের গতি দেখা বা তাদের উন্মত্ত-কায়দায় চালনা, উন্মাদের মতো প্রতিযোগিতা তো আমাদের নিত্যদিনের অভিজ্ঞতায় আছে। সড়কের নির্মাণ যতই মসৃণ হোক, গাড়ির চালক যদি ট্রাফিক আইন না মানে, তাহলে সেখানে অ্যাক্সিডেন্ট হবেই।

সড়কে, মহাসড়কে যানজটের প্রধান কারণ ট্রাফিক আইন মেনে না চলা। এই ট্রাফিক আইন মেনে চলার শিক্ষা আমাদের বাস, ট্রাক, লরি, কার, মাইক্রোবাস, মিনিবাসসহ যতরকম যানবাহন আছে, তাদের কারো মন-মানসিকতাই নেই। তারা উন্মাদের মতো কেবল গন্তব্যে পৌঁছার চিন্তায় থাকে। ফলে জ্যামের মধ্যেই সে পাঁচ ইঞ্চি এগোবার সুযোগ পেলে, সেখানেই তার নাক ঢুকিয়ে দিতে দ্বিধা করে না। এই মানসিকতা গাড়ির চালকদের রক্তের মধ্যে নিহিত।

সেই সঙ্গে রাজধানীর সড়কে, মহাসড়কে অযান্ত্রিক-কমগতির ভটভটি মার্কা ঠেলা, বেবিট্যাক্সি, ছোট পরিবহন, যানবাহন-ননস্টপ সড়কে জট তৈরিতে ভূমিকা রাখে। কেন মহাসড়কে উঠে আসবে ওই কমগতির যান বা মানবচালিত অযান্ত্রিক বাহন? যারা ডিজাইন করেছেন সড়কের, কেন বিভিন্ন পয়েন্টে সার্ভিস সড়ক রাখেননি। যেগুলো আছে, তা আদিকালের হালটমার্কা। সেগুলো দিয়ে কমগতির যানবাহন উঠে আসে কোনো রকম সিগন্যালের অপেক্ষা না করেই। মহাসড়কে উঠে এসেই সে ৬০-৭০ মাইল বেগে আসা কোনো দূরপাল্লার গাড়িকে থামিয়ে দেয় বা দুর্ঘটনার শিকার হয়। এসব দুর্ঘটনার দায় কার?

৪.
জনপথের বিষয়ে যারা বিশেষজ্ঞ, তারা এবার বেশ সজাগ। যারা ট্রাফিক নিয়ন্ত্রণের দায়িত্বে আছেন তারাও এ বছর সহযোগী প্রতিষ্ঠানের সঙ্গে আলাপ আলোচনার ভেতর দিয়ে প্রস্তুতি নিয়েছেন। ট্রাফিক পুলিশ সব মহাসড়কেই প্রয়োজনীয় জায়গায় যথেষ্ট লোকবল নিয়েই তৈরি থাকছেন। বিশেষ করে মহাসড়কের ইন্টারসেকশনগুলোতে। সেখানে যদি যানবাহন সঠিকভাবে ম্যানেজ করতে পারেন তাহলে আশা করা যায়, নির্ধারিত সময়েই যাত্রীরা বাড়িতে পৌঁছাতে পারবেন।
কিন্তু তার জন্য ট্রাফিককে সহযোগিতা দিতে হবে বাসট্রাকের, লরির চালকদের। সেই সঙ্গে ক্ষুদ্র যানবাহন ও অযান্ত্রিক যানগুলোকে ভিন্ন পথে, সার্ভিস সড়কের মাধ্যমে সেবা দিতে পারলেই একমাত্র কামিয়াব হতে পারে।

কিন্তু ট্রাফিক আইন কি মেনে গাড়ি চালাবে ড্রাইভাররা? তাদের স্বভাব কে পাল্টাতে পারেন? গাড়ির মালিকরা হুঁশিয়ারি দিতে পারেন, কিন্তু তারা সেটা শুনবেন, তার কি নিশ্চয়তা আছে? যদি বলা হয়, তোমার চাকরি যাবে। তখন তিনি/তারা ভিন্ন কোনো গাড়িতে চালক হিসেবে নিয়োগ পাবেন। এই ভিন্ন কোনো গাড়িতে নিয়োগ পাওয়ার যদি কার্টেল করা যায়, ড্রাইভারের অন্যায়, অসততা ও বেপরোয়াভাবে গাড়ি চালনা, অ্যাক্সিডেন্ট করার পরও, তাহলে তারা তাদের চালক-স্বভাব পরিবর্তন করবে না। এদের লাইসেন্সে যদি পয়েন্ট কেটে যাওয়ার ব্যবস্থা নেয়া যায়, যদি কয়েক পয়েন্ট শেষ হলে আর কোনো দিন লাইসেন্স পাওয়ার অধিকার হারায়, তাহলেই কেবল তাদের বেপরোয়াভাবে গাড়ি চালানো, অতিরিক্ত যাত্রী পরিবহন, যাত্রীদের সঙ্গে চালক, কনডাকটর, হেলপার দুর্ব্যবহার করেন, তাহলে তাদের চাকরি যাবে এবং তার রেকর্ড দেখে আর কোনো মালিক তাদের নিয়োগ দিতে পারবেন না। এভাবেই তাদের থামানো যেতে পারে।

সড়কে কত মাইল/কিমি. বেগে গাড়ি চলবে, সেটা মানতে হবে চালকদের। ধরা যাক, ট্রাফিক আইনে বলা হলো মহাসড়কে ৬৫ মাইল বেগে চাড়ি চালাতে হবে। কম বেগে চালালে জ্যামের কারণ হতে পারে, তাই সে ক্ষেত্রে ৬০ মাইল বেগের কম গতিতে গাড়ি চালানো যাবে না। আবার উপরে ৬৫ থেকে ৭৫ মাইল বেগে গাড়ি চালানো যাবে না। এই গতি নিয়ন্ত্রণের জন্য হাইওয়েতে ক্যামেরা ও গতিমাপক টেকনোলজির সাহায্য নিতে হবে। যেসব গাড়ি নির্ধারিত গতির লিমিট ক্রস করবে, তাদের সতর্ক নোটিশ পাঠাতে হবে। তারপর ফাইন, তারপর লাইসেন্সের পয়েন্ট কর্তন ইত্যাদি পদক্ষেপ নেয়া যেতে পারে। ফিটনেসবিহীন গাড়ি, কালো ধোঁয়া ছাড়ছে এমন গাড়ি যাতে সড়কে চলাচল করতে না পারে, সেটা নিশ্চিত করতে হবে ট্রাফিক পুলিশকে। হাত দিয়ে গাড়ি থামানোর যুগ শেষ হয়েছে অনেক আগেই। এখন ডিজিটাল যুগ। ব্যবস্থাপনাও হতে হবে যুগের সঙ্গে তাল মিলিয়ে। না হলে যুগ আটকে থাকবে পুরনোকালের সুড়ঙ্গের মধ্যে। আমরা প্রগতির চাকা লাগালেও তাতে গতি দিতে পারব না।

কেবল গাড়ির চালকদের মনমানসিকতার পরিবর্তন করলেই হবে না, লাইসেন্সদাতা, ট্রাফিক নিয়ন্ত্রকের ঊর্ধ্বতন কর্তাদের শিক্ষা ও মান সংশোধন জরুরি। কারণ, মূলত তারাই ট্রাফিক জ্যাম লালন করেন। তারাই সব কিছু হযবরল করতে ভালোবাসেন। সেই ভালোবাসার মধ্যে আছে অবৈধপথে মাল কামানোর ফন্দি।


আরো সংবাদ



premium cement