২৭ এপ্রিল ২০২৪, ১৪ বৈশাখ ১৪৩১, ১৭ শাওয়াল ১৪৪৫
`

পোশাক খাতের চ্যালেঞ্জে বিপন্ন হওয়ার ঝুঁকি?

পোশাক খাতের চ্যালেঞ্জে বিপন্ন হওয়ার ঝুঁকি? - ছবি : নয়া দিগন্ত

করোনা সংক্রমণের প্রভাবে বাংলাদেশের রফতানি আয় ক্রমেই কমতে শুরু করেছে। এই আয় কমার ক্ষেত্রে মূল প্রভাব যে তৈরী পোশাক খাতের ওপর, তাতে সংশয় নেই। আর তৈরী পোশাক খাত দেশের রফতানি আয়ের ৮৫ শতাংশের বেশি জোগান দেয়। তাই নয়, জাতীয় আয়ে এর উল্লেখযোগ্য অবদানও রয়েছে। এর পাশাপাশি কর্মসংস্থান ও সামাজিক ভারসাম্য রক্ষায়ও রয়েছে এর অনন্য অবদান। নানা সম্ভাবনা ও সীমাবদ্ধতার মধ্য দিয়ে তৈরী পোশাক খাত বিশ্ববাজারে নিজের স্থান করে নিচ্ছিল। কিন্তু এবারের বিশ্বব্যাপী কোভিড-১৯ এর ভয়াবহ হানায় বড় ধরনের চ্যালেঞ্জে পড়েছে বাংলাদেশের এই খাত। তৈরী পোশাক খাতের এই বিপন্নতার মুখে সরকার চোখ বন্ধ করে রেখেছে এ কথা বলা সঠিক হবে না। তবে সরকারের নীতিগত সহায়তার কিছু সীমাবদ্ধতার কারণে এই খাত বড় রকমের চ্যালেঞ্জে পড়েছে।

সর্বশেষ খবর অনুসারে, চলতি ২০২১-২২ অর্থবছরের প্রথম মাসে তৈরী পোশাক খাতের রফতানি আয় ১১ শতাংশের বেশি কমে গেছে। দুই বছর আগের একই সময়ের সাথে তুলনা করলে ‘নেতিবাচক রফতানি প্রবৃদ্ধি’ আরো বেশি হবে। রফতানির তথ্য বিশ্লেষণে দেখা যায়, ২০২১-২২ অর্থবছরে প্রথম মাসে ২৮৮ কোটি ৭২ লাখ ডলারের তৈরী পোশাক পণ্য রফতানি করেছে বাংলাদেশ যা মোট রফতানি আয়ের ৮১ দশমিক ১৬ শতাংশ।

তবে টানা ১২ দিন কারখানা বন্ধ থাকায় আগের বছরের একই সময়ের চেয়ে পোশাক রফতানি কমেছে ১১ দশমিক ২ শতাংশ। লক্ষ্যের চেয়ে আয় কমেছে ৪ দশমিক ১৭ শতাংশ। একই সময়ে নিট পোশাক রফতানি প্রবৃদ্ধি কমেছে ৫ দশমিক ২৫ শতাংশ। লক্ষ্যমাত্রা কমেছে শূন্য দশমিক ৮৬ শতাংশ। ওভেন পোশাক রফতানি খাতে এই সময়ে ১৭ দশমিক ৭৯ শতাংশ প্রবৃদ্ধি কমেছে। ৮ দশমিক ২৯ শতাংশ লক্ষ্যমাত্রা কমেছে।

এ প্রসঙ্গে বিজিএমইএর ব্যাখ্যা হলো, জুলাইয়ে ১৮ তারিখ পর্যন্ত আমাদের রফতানি আয় খুবই ভালো ছিল। তারপরে কোরবানি ঈদ ও কঠোর বিধিনিষেধে গার্মেন্টস বন্ধ রাখতে হয়েছে। অন্য সময় নানা কারণে রফতানি কমে; এবার কমেছে শুধু গার্মেন্টস বন্ধ থাকার কারণে। বরং কারখানাগুলোর হাতে এখন প্রচুর অর্ডার আছে। কিন্তু কাজ করা সম্ভব হয়নি। ২০২০ সালের জুলাইয়েও করোনার প্রভাব ছিল। কিন্তু ২০১৯ সালে ততটা ছিল না।

ভিয়েতনামের হাতে এ খাতে দ্বিতীয় স্থান হারানো, কিন্তু কেন?
এদিকে, পোশাক রফতানিতে বাংলাদেশকে পেছনে ফেলে দ্বিতীয় স্থানে উঠে এসেছে ভিয়েতনাম। কয়েক বছর ধরেই বাংলাদেশের কাছাকাছি অবস্থান করছিল এশীয় দেশটির রফতানি আয়। শেষ পর্যন্ত দ্বিতীয় শীর্ষ অবস্থানেই উঠে গেছে ভিয়েতনাম। বাংলাদেশ এখন পোশাক রফতানিতে তৃতীয় স্থানে অবস্থান করছে। আর চীনের অবস্থান সবার উপরে। বিশ্ব বাণিজ্য সংস্থার (ডব্লিউটিও) প্রতিবেদনের তথ্যমতে, ২০২০ সালে ভিয়েতনাম দুই হাজার ৯০০ কোটি ডলারের পোশাক রফতানি করেছে। আর বাংলাদেশ রফতানি করেছে দুই হাজার ৮০০ কোটি ডলারের পোশাক। অথচ তার আগের বছর বাংলাদেশের রফতানি ছিল তিন হাজার ৪০০ কোটি ডলার। তখন ভিয়েতনামের রফতানি ছিল তিন হাজার ১০০ কোটি ডলার।

ভিয়েতনামের বাংলাদেশকে ছাড়িয়ে যাওয়া হয়তো শেষ চিত্র নয়। কারণ বিশ্ববাজারে বাংলাদেশের তৈরী পোশাকের প্রতিযোগী দেশগুলোর তুলনায় বাংলাদেশের কোভিড পরিস্থিতি বেশি নাজুক। করোনা সংক্রমণের দ্বিতীয় ঢেউয়ে ঢাকায় ৯৮ শতাংশ ভাইরাস পাওয়া গেছে অতিসংক্রমণ ঘটানোর জন্য খ্যাত ‘ডেল্টা ভাইরাস’। সারা দেশের অবস্থাও এর চেয়ে ভিন্ন হওয়ার কথা নয়। অন্য দিকে ভিয়েতনামের মতো দেশে সংক্রমণের হার কম হওয়ার পাশাপাশি রেজিমেন্টেড শাসনের ফলে স্বার্থের টানাপড়েন এবং শ্রমিকদের মধ্যে অসন্তোষের প্রকাশ কম।

ভিয়েতনামের দ্বিতীয় স্থানে উঠে আসা প্রসঙ্গে একজন শীর্ষস্থানীয় পোশাক মালিকের বক্তব্য হলো, ভিয়েতনাম বাংলাদেশকে ছাড়িয়ে যেতেই পারে। কারণ ওদের বিনিয়োগকারী চীন ও জাপান। আমাদের দেশের মতো ওদের নিয়ে বিশ্বে কোথাও নেতিবাচক কথাবার্তা নেই। ফ্যাক্টরি খুলে দেয়া হয়েছে এজন্য সরকার ও আমাদের সমালোচনার শেষ নেই। আর ভিয়েতনামের ব্যবসায়ীরা আমাদের তুলনায় নানা সুবিধায় রয়েছে। সেখানে বছরে দু’বার বিদ্যুৎ গ্যাস ও পানির দাম বাড়ে না। এসব কারণেই তারা আমাদের চেয়ে এগিয়ে গেছে।

কেন গুরুত্বপূর্ণ পোশাক খাত?
বাংলাদেশের অর্থনীতিতে তৈরী পোশাক (আরএমজি) শিল্পের রয়েছে বিশেষ গুরুত্ব। কর্মসংস্থান, বৈদেশিক রিজার্ভ এবং নারীর ক্ষমতায়নের জন্য বাংলাদেশের অর্থনীতি তৈরী পোশাক শিল্পের ওপর অত্যন্ত নির্ভরশীল। দেশের মোট দেশজ উৎপাদনে ১১.২ শতাংশ অবদান এ খাত থেকে আসে। চার হাজার ৬০০টিরও বেশি কারখানা নিয়ে এটি দেশের শিল্প খাতের বৃহত্তম উপখাত। আর উৎপাদন কর্মসংস্থানের ৩৬ শতাংশ তথা ৪১ লাখ শ্রমিক কর্মরত এই খাতে। সাশ্রয়ী মজুরির সুশৃঙ্খল নারীশ্রমিক এই শিল্পের মেরুদণ্ড। দেশের ৬১ শতাংশ নারীর কর্মসংস্থানের মধ্য দিয়ে আরএমজি শিল্প নারীর ক্ষমতায়ন এবং জেন্ডার সমতার ক্ষেত্রে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করেছে।

বিশ্বব্যাপী আরএমজি ট্রেডিংয়ে বাংলাদেশের বাজারের অংশ প্রায় ৬.৫ শতাংশ আর কোভিডের অস্বাভাবিক পরিস্থিতি বাদ দেয়া হলে বাংলাদেশ চীনের পর ধারাবাহিকভাবে ‘দ্বিতীয় বৃহত্তম রফতানিকারক দেশ’ হিসেবে রয়েছে। বাংলাদেশ প্রাথমিকভাবে ইউরোপীয় ইউনিয়নে ৬২ শতাংশ এবং মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র ও কানাডায় ২১ শতাংশ করে পোশাক রফতানি করে। গত তিন দশক ধরে, আরএমজি রফতানিগুলো বছরে ১৪.৮ শতাংশ হারে বৃদ্ধি পেয়েছে যা সর্বশেষ ২০২০-২১ অর্থবছরে ৩৮.৮ বিলিয়ন ডলারে এসে দাঁড়ায়। তা ২০১৮-১৯ প্রাক-কোভিড অর্থবছরে ৪০.৫৩ বিলিয়ন ডলার ছিল। ১৯৯০ সাল থেকে আরএমজি শিল্পের প্রবৃদ্ধি সব আঞ্চলিক এবং আন্তর্জাতিক সঙ্কট এড়িয়ে ইতিবাচক ধারায় ছিল যদিও কোভিড-১৯ এর কারণে এই শিল্প এখন ‘ক্রসরোডে’ রয়েছে।

কোভিডের প্রভাবে বিপর্যয়
আরএমজি বা তৈরী পোশাক শিল্প অন্য যে কোনো খাতের তুলনায় বেশি সংবেদনশীল। এই খাতের ইনপুট তথা কাঁচামালের জোগান যেমন নিরবচ্ছিন্ন থাকতে হয় তেমনিভাবে বাজারে উৎপাদিত রফতানি পণ্য পৌঁছানোও সঙ্কটমুক্ত থাকতে হয়। এর বাইরে উৎপাদনখরচ এবং পণ্যের রফতানি মূল্যের মধ্যকার মূল্য সংযোজন যৌক্তিক একটি পর্যায়ে থাকতে হয়। কোভিড-১৯ এর প্রভাব পড়েছে এর সব স্থানে। আরএমজি সেক্টর এখন এক ধরনের অভূতপূর্ব মানবিক ও ব্যবসায়িক বিপর্যয়ের দ্বারপ্রান্তে। করোনাভাইরাস ছড়িয়ে পড়া মোকাবেলা করার জন্য, সরকার বিভিন্ন সময় দেশব্যাপী ছুটি ঘোষণা করেছে এবং জরুরি পরিষেবা ছাড়া ব্যবসা ও শিল্পকার্যক্রম বন্ধ হয়ে গেছে। এতে অনেক আন্তর্জাতিক ক্রেতা নিশ্চিত করা ক্রয় আদেশ বাতিল বা স্থগিত করেছেন।

বাংলাদেশ গার্মেন্টস ম্যানুফ্যাকচারার্স অ্যান্ড এক্সপোর্টার্স অ্যাসোসিয়েশনের (বিজিএমইএ) তথ্য মতে, আন্তর্জাতিক ক্রেতারা ১৮ এপ্রিল ২০২০ পর্যন্ত ১১৪২টি কারখানার ৩.১৬ বিলিয়ন ডলারের পোশাক চালান বাতিল বা স্থগিত করেছে যার প্রভাব পড়েছে সাড়ে ২২ লাখ শ্রমিকের ওপর। বিশ্বব্যাপী পোশাকের চাহিদাও কোভিড মন্দার কারণে কমে যাচ্ছে। বিজিএমইএ এর প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, ইতোমধ্যে ১০ লাখ শ্রমিক কর্মহীন হয়েছে। সরকারি লকডাউন অমান্য করে, হাজার হাজার আরএমজি কর্মীকে বকেয়া মজুরির দাবিতে সারা দেশে রাস্তায় বিক্ষোভ করতেও দেখা গেছে।

বাংলাদেশের পোশাক খাতের কিছু প্রকৃতিগত সীমাবদ্ধতাও রয়েছে। নিউ ইয়র্ক ইউনিভার্সিটি স্টার্ন সেন্টার ফর বিজনেস অ্যান্ড হিউম্যান রাইটসের একটি প্রতিবেদনের পর্যবেক্ষণ হলো, যদিও বাংলাদেশে তার পোশাক রফতানি চিত্তাকর্ষকভাবে বৃদ্ধি পেয়েছে, তবে শিল্পটি সাধারণত মৌলিক আইটেমগুলো কাটা ও সেলাইয়ের বাইরে অগ্রসর হয়নি, যার সাথে তুলনামূলকভাবে কম মূল্য যোগ হয়েছে এবং যা থেকে নিট লাভ বেশি হয়নি। বাংলাদেশের গার্মেন্টস শিল্প চাকরি সৃষ্টি করেছে, গ্রামীণ তরুণীদের স্বাধীনতার সুযোগ প্রদান করেছে এবং দেশের নড়বড়ে অর্থনীতিকে এগিয়ে নিতে সাহায্য করেছে। কিন্তু সেসব কাজের গুণগত মান, রফতানিতে যোগ করা মান বা শ্রমিকদের প্রকৃত মজুরির অগ্রগতি কাক্সিক্ষত পর্যায়ে হয়েছে এ কথা বলা যাবে না।

এখন পোশাক খাতে মাসিক ন্যূনতম মজুরি আট হাজার টাকা (৯৫ ডলার)। এটি ডলার হিসাবে আন্তর্জাতিকভাবে তুলনা করলে একবারে নি¤œস্তরে মনে হবে। তবে পারচেজ পাওয়ার প্যারিটি (পিপিপি) হিসাব করা হলে এই আয় দ্বিগুণের মতো হবে। আর নি¤œবিত্ত পরিবারের স্বামী স্ত্রী চাকরি করলে মোটামুটিভাবে জীবন চালানোর একটি উপায় হয়ে যায়। পোশাক খাতে যেকোনো বিপর্যয় ঘটলে এর বিকল্প কর্মসংস্থানের ব্যবস্থা হওয়ার সুযোগ দেশে আছে বলে মনে হয় না। তবে পোশাকশ্রমিকদের প্রাপ্য বেতন ও বাড়তি কাজের মজুরি নিশ্চিতভাবে পাওয়ার একটি প্রক্রিয়া বিজেএমইএ ও সরকারের মিলিতভাবে বের করা উচিত।

প্রভাব পড়বে অন্য খাতেও
কোভিড-১৯ এর প্রভাব আরএমজি শিল্পের মধ্যে সীমাবদ্ধ থাকবে না এবং অন্যান্য শিল্প, ভোক্তা এবং পরিষেবা খাতে এর মারাত্মক প্রভাব পড়তে পারে। এক সময় আরএমজি শিল্পে মূল্য সংযোজন ক্রমান্বয়ে বৃদ্ধি পেয়েছে এবং পশ্চাৎ-সংযোগ শিল্প গড়ে ওঠায় মূল্য সংযোজন এখন ১৫ শতাংশ থেকে বেড়ে ৬৩.২ শতাংশ দাঁড়িয়েছে। বর্তমানে, টেক্সটাইল-ভ্যালু চেইনে এক হাজার ৪৬১টি ম্যানুফ্যাকচারিং ইউনিট রয়েছে, যার মধ্যে ৪২৫টি সুতা উৎপাদনে, ৭৯৬টি কাপড় উৎপাদনে এবং ২৪০টি ডাইং-প্রিন্টিং-ফিনিশিং অপারেশনে রয়েছে। এ ছাড়াও রয়েছে প্রচুর আনুষঙ্গিক সরবরাহকারী, বেশির ভাগ ক্ষুদ্র ও মাঝারি উদ্যোগ (এসএমই), যারা বোতাম, জিপার, হ্যাঙ্গার, থ্রেড এবং অন্যান্য আনুষঙ্গিক পণ্য সরবরাহ করছেন।

আরএমজি শিল্প অন্যান্য অর্থনৈতিক খাত যেমন ব্যাংকিং, বীমা, রিয়েল এস্টেট, প্যাকেজিং, হোটেল, রিসাইক্লিং, ভোক্তাসামগ্রী, ইউটিলিটি সার্ভিস এবং লজিস্টিক্সের একটি প্রধান অবদানকারী। বিশ্বব্যাংকের একটি জরিপে দেখা গেছে যে, আরএমজি কারখানার ৯৮ শতাংশ বাণিজ্যিক ব্যাংকের ক্লায়েন্ট। সব মেশিন ও প্ল্যান্ট বীমা কোম্পানিগুলোর সাথে বীমা করা এবং এ ছাড়া, ৮৭ শতাংশ আমদানিকারক এবং ১৫ শতাংশ রফতানিকারকের আমদানি/ রফতানি থেকে বীমা কোম্পানিগুলো বীমার অর্থ পায়। এটা অনুমান করা হয় যে আরএমজি সেক্টর থেকে অর্জিত ফি বন্দর কর্তৃপক্ষের আয়ের ৪০ শতাংশেরও বেশি। এই শিল্পের ৪১ লাখ শ্রমিক স্বল্পমূল্যের ভোগ্যপণের একটি বাজার তৈরি করেছে যার ওপর ভিত্তি করে দেশে অনেক শিল্প গড়ে উঠেছে। ফলে আরএমজি শিল্পে ক্রমবর্ধমান সঙ্কট সমগ্র অর্থনীতির ওপর বহুবিধ চেইন প্রতিক্রিয়া সৃষ্টি করবে এবং এই শিল্পকে উদ্ধার করা অন্যান্য খাতের জন্যও উপকারী।

দারিদ্র্যবিমোচনে ভূমিকা
২০১০-২০১৬ সময়কালে, বাংলাদেশে দারিদ্র্য ৩১.৫ শতাংশ থেকে হ্রাস পেয়ে ২৪.৩ শতাংশ হয়েছে, প্রধানত গ্রামীণ দারিদ্র্য ৮.৫ শতাংশ পয়েন্ট কমে গিয়ে ২৬.৪ শতাংশে নেমেছে। এই সময়ের মধ্যে, শহুরে দারিদ্র্য ২.৪ শতাংশ পয়েন্ট কমে ১৮.৯ শতাংশ হয়েছে, যা সামগ্রিকভাবে দেশব্যাপী দারিদ্র্য হ্রাসের গতি কমিয়ে দিয়েছে। এক প্রতিবেদন অনুসারে, শহুরে এলাকা ২০৩০ সালের মধ্যে অর্ধেক গরিব মানুষের বসবাস হবে। শহুরে দারিদ্র্যের অব্যাহত হ্রাস মূলত শিল্প খাত, সাধারণভাবে এবং বিশেষ করে আরএমজি খাত দ্বারা পরিচালিত হয়। আরএমজি শিল্প শহুরে দারিদ্র্য হ্রাস এবং অন্যান্য খাতের ধীর অগ্রগতির ক্ষতিপূরণে প্রধান ভূমিকা পালন করছে। ২০১০-২০১৬ সাল পর্যন্ত সময়কালে, আরএমজি সেক্টরের শহুরে দারিদ্র্যের মাত্রা ২৫ শতাংশ থেকে কমে ১৬ শতাংশ হয়েছে, যখন অন্যান্য প্রধান সেক্টরে দারিদ্র্য বিমোচন অনেকাংশে স্থিতিশীল রয়েছে।

নানা সীমাবদ্ধতার পরও আরএমজি শিল্প বাংলাদেশে নারীর ক্ষমতায়নে গভীর প্রভাব ফেলেছে। মহিলাদের আনুষ্ঠানিক উপার্জনমূলক ক্রিয়াকলাপে নিযুক্ত করে, শিল্পটি পরিবারে মহিলাদের উন্নত মর্যাদা, দুর্বলতা হ্রাস এবং পারিবারিক বিষয়ে সিদ্ধান্ত গ্রহণের ক্ষমতা প্রদান করেছে। নারীর কর্মসংস্থানের প্রসার সঞ্চয়ের আচরণের উন্নতিতে ইতিবাচক অবদান রেখেছে। একটি সমীক্ষায় দেখা গেছে যে, প্রায় ৯০ শতাংশ নারীকর্মী আয় এবং সঞ্চয় বৃদ্ধির কথা বলেছেন, ৭৭ শতাংশ জীবিকার মান বাড়িয়েছেন, ৭৩ শতাংশ উন্নত চিকিৎসাসুবিধা নিশ্চিত করতে পেরেছেন। তা ছাড়া, মহিলা কর্মীরা আগের চেয়ে উন্নত জীবনধারা, উন্নত স্যানিটেশন এবং আবাসনসুবিধার কথা জানিয়েছেন। আরএমজি শিল্পে নারীশ্রমিকরা বেশির ভাগই অল্পবয়সী যাদের খুব কম বা কোনো আনুষ্ঠানিক শিক্ষা বা বৃত্তিমূলক প্রশিক্ষণ নেই। এই মেয়েকর্মীরা তাদের কর্মজীবন সাহায্যকারী হিসাবে শুরু করে এবং প্রয়োজনীয় দক্ষতা অর্জনের পর সাধারণত তিন থেকে ছয় মাস পরে মেশিন অপারেটরদের স্তরে উন্নীত হয়। সামগ্রিকভাবে, আরএমজি শিল্প ক্ষমতায়ন করে নারীদের সামাজিক ও অর্থনৈতিকভাবে আর্থসামাজিক অবস্থার উল্লেখযোগ্য পরিবর্তন এবং জীবনযাত্রার ধরনে পরিবর্তন এনেছে।

আরএমজি শিল্পে কর্মক্ষেত্রের নিরাপত্তা সাম্প্রতিক বছরগুলোতে উল্লেখযোগ্যভাবে উন্নত হয়েছে। ২০১২ সালে তাজরীন ফ্যাশনসে অগ্নিকাণ্ডের ঘটনা এবং ২০১৩ সালে রানা প্লাজা ভবনধসের পর সরকার ইউরোপীয় ও উত্তর আমেরিকার খুচরা বিক্রেতাদের চাপে (অ্যাকর্ড এবং অ্যালায়েন্স নামে পরিচিত) ব্যাপক প্রতিকার কার্যক্রম বাস্তবায়ন করেছে। সামগ্রিকভাবে, প্রতিকারের প্রচেষ্টা আরএমজি কারখানায় কর্মক্ষেত্রের নিরাপত্তা উল্লেখযোগ্যভাবে বৃদ্ধি করেছে।

সরকারের প্রণোদনা কতটা কাজে লাগছে?
কোভিড-১৯ এর নেতিবাচক প্রভাব থেকে উত্তরণের জন্য সরকার সামাজিক নিরাপত্তা বেষ্টনী, রফতানি খাত, এসএমই এবং অন্যান্য অগ্রাধিকার খাতকে শক্তিশালী করে অর্থনীতি পুনরুজ্জীবিত করার জন্য ৯৫ হাজার ৬০০ কোটি টাকা (১১.২ বিলিয়ন ডলার) বা জিডিপির ৩.৩ শতাংশের সমান একটি উদ্দীপক প্যাকেজ ঘোষণা করেছে। প্যাকেজটি আরএমজি এবং অন্যান্য রফতানিমুখী শিল্পের জন্য পাঁচ হাজার কোটি টাকা বরাদ্দ করে শুধুমাত্র শ্রমিক এবং কর্মচারীদের বেতন ও ভাতা প্রদানে ব্যবহারের জন্য।

রফতানি উন্নয়ন তহবিলের আকার ৩.৫ বিলিয়ন ডলার থেকে বাড়িয়ে ৫.০ বিলিয়ন ডলার করা হয়েছে যা রফতানিমুখী শিল্পের কাঁচামাল আমদানির জন্য স্বল্পমেয়াদি সুবিধা প্রদান করে। এই প্যাকেজ থেকে, কেন্দ্রীয় ব্যাংক আরএমজি এবং অন্যান্য রফতানিমুখী শিল্পের জন্য ৬০০ মিলিয়ন ডলারের প্রাক-চালান ক্রেডিট পুনঃঅর্থায়ন স্কিম প্রতিষ্ঠা করেছে। এসব প্যাকেজ তাৎপর্যপূর্ণ হলেও, সেক্টরের ব্যাপক চাহিদার মাত্র একটি অংশ পূরণ করছে। কারণ এই সেক্টরে প্রতি মাসে মজুরি দিতে কমপক্ষে ৭০০ মিলিয়ন ডলার প্রয়োজন। শ্রমিকদের মৌলিক জীবিকার জন্য এবং এ শিল্পকে বাঁচিয়ে রাখতে দেশটির আরো বেশি সমর্থন এবং প্রদত্ত প্রণোদনার আরো কার্যকর ব্যবহার প্রয়োজন রয়েছে।

পোশাক খাতের বিপর্যয়ে সরাসরি মানবিক এবং ব্যবসায়িক প্রভাব ছাড়াও, বৈদেশিক মুদ্রার প্রবাহ তাতে উল্লেখযোগ্যভাবে হ্রাস পাবে যা বৈদেশিক খাতের দুর্বলতা তৈরি করবে। এখন জীবিকা নির্বাহ করার জন্য শ্রমিকদের জরুরি নগদসহায়তা এবং পরবর্তী পুনরুজ্জীবনের জন্য শিল্পের মাঝারি মেয়াদি তারল্যসহায়তা প্রয়োজন। সরকার এ ব্যাপারে সুদ ভর্তুকি আকারে নগদসহায়তা প্রদান করছে। কিন্তু এই সহায়তা সব ক্ষেত্রে যথাযথভাবে হচ্ছে না বলে অভিযোগ রয়েছে। ব্যাংকের মালিকানা ও নিয়ন্ত্রণের সাথে যুক্ত অনেক ব্যক্তি প্রণোদনার অর্থ নামে বেনামে নিয়ে যাওয়ার অভিযোগ রয়েছে যার কারণে বাংলাদেশ ব্যাংক সম্প্রতি প্রণোদনার অর্থ বিতরণের যথার্থতার বিষয়টি তদন্ত করার উদ্যোগ নেয়ার কথা জানিয়েছে। কিন্তু কেন্দ্রীয় ব্যাংকের এই ধরনের অনেক উদ্যোগ প্রভাবশালীদের হস্তক্ষেপের কারণে শেষ পর্যন্ত থেমে যায়।

সব আশা শেষ হয়ে যায়নি
কোভিড-১৯ এর প্রভাব এখনো চলমান রয়েছে। দ্বিতীয় ঢেউ শেষ হওয়ার আগে করোনার তৃতীয় ঢেউ আসতে পারে বলে জানাচ্ছেন বিশেষজ্ঞরা। এ অবস্থায় রাষ্ট্রের অর্থনৈতিক সীমাবদ্ধতার মধ্যেই যতটা সম্ভব এই শিল্পে সরকারের সহায়তা প্রয়োজন। উদ্যোক্তাদের পাশে দাঁড়ানোর সাথে সাথে এই শিল্পের স্বল্প আয়ের শ্রমিকদের পাশেও সরকারকে কার্যকরভাবে দাঁড়াতে হবে। বাংলাদেশের পোশাক খাতের বিকাশের পেছনের নগদসহায়তা এবং বন্ডেড ওয়্যার হাউজ সুবিধা দানের পাশাপাশি শ্রমিকদের দক্ষতার একটি গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রয়েছে। পোশাক খাতের বিকাশের জন্য অনেক দেশ বাংলাদেশ থেকে দক্ষ শ্রমিকও নিয়ে গেছে। সরকারকে পোশাক খাতের উন্নয়নের বিষয়ে এবং বৈরী সময়ে এ খাতের পাশে দাঁড়ানোর ব্যাপারে যৌক্তিক এবং সমন্বিতভাবে থাকতে হবে।

বাংলাদেশের পোশাক শিল্পের সম্ভাবনা কোনোভাবেই শেষ হয়ে যায়নি। পোশাক খাতের উদ্যোক্তারা এই কোভিডের মধ্যেও বর্ধিত হারে অর্ডার পাওয়ার কথা জানাচ্ছেন। এ অবস্থায় নীতিগত সহায়তা ও কার্যকর প্রণোদনা দেয়া গেলে পোশাক খাত এক সময় দ্বিতীয় কেন, শীর্ষ স্থানও দখল করতে পারবে। তবে এ ক্ষেত্রে অর্থনৈতিক নীতি উদ্যোগের পাশাপাশি রাষ্ট্রের পররাষ্ট্র সম্পর্ক ও কৌশলগত নীতিও গুরুত্বপূর্ণ হয়ে দাঁড়াতে পারে। বাংলাদেশের পোশাকের বাজার মূলত ইউরোপ আমেরিকা আর এর কাঁচামালের বড় অংশ চীনের মতো দেশ থেকে আসে। বাংলাদেশ যদি এ ক্ষেত্রে ভারসাম্যপূর্ণ নীতি নিতে না পারে তাহলেও বিপর্যয় অনিবার্য হয়ে উঠতে পারে। তেমন এক ধরনের আশঙ্কা এখন অনেকের মধ্যে রয়েছে।

mrkmmb@gmail.com


আরো সংবাদ



premium cement